#তবু_সুর_ফিরে_আসে
২৭ তম পর্ব
নওশাদ অবাক হয়ে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে আছে ! নিশাল বাবা আমার তুমি এত মন খারাপ করলে তোমার মা মনি আরো কষ্ট পাবে ! দেখো কাঁদছে তোমার সঙ্গে ! এটা জাস্ট একটা ঘটনা ছিল ! আমারই ভুল হয়েছে তোমার মামনিকে একটা মোবাইল কিনে দেয়ার দরকার ছিল । আমার মোবাইল নাম্বার টা নোট করে দেয়ার দরকার ছিল । বাসার ঠিকানা টা জানানোর দরকার ছিল ! আমি কিছুই করিনি ! এত বড় একটা ঘটনা ঘটবে বুঝতেই পারিনি !
আজ যদি মা মনির কিছু হয়ে যেত পাপা ! খারাপ লোকের তো অভাব নেই !
কিছুই হতো না, আমি হতে দিলে তো ! আমি আছি তো আমার ফ্যামিলির জন্য তুমি মন খারাপ করো না !
তুমি তোমার মা মনিকে একটু গাইড করো কিভাবে চালাক চতুর হওয়া যায় কেমন ! তার আগে মা মনির জন্য একটা মোবাইল কিনে নিয়ে এসো তোমার পছন্দ অনুযায়ী !
মামনির চালক হতে হবে না যেমন আছে তেমনই থাকুক শুধু কেয়ারফুল থাকলেই হবে । আমি এক্ষুনি যাচ্ছি মোবাইল কিনে নিয়ে আসছি !
ঠিক আছে যাও !
নওশাদ নিশাল কে কার্ড বের করে দিল ! নিশাল চোখ মুছে ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে গেল !
দেখলে হেরা ছেলেটা তোমার জন্য অস্থির হয়ে ছিল ! নওশাদ হেরার কাছে এসে বসলো , থ্যাঙ্কস তুমি আমার লাইফে আসার পর আমি তোমার মত সঙ্গী পেয়েছি আর আমার ছেলেটাকে ফিরে পেয়েছি! ও তোমাকে মামনি ডাকছে শুনেছো ! আমার খুব ভালো লাগছে , তোমার কেমন লাগছে বলবে না আমাকে? হেরা চোখের পানি মুছলো!
নওশাদ হেরার কপালে চুমু খেলো ! আমি শাওয়ার নিয়ে আসি তারপর তুমি খাবার খাবে দুই দিন কিছুই খাওয়া হয়নি তোমার ! তারপর আমরা অনেক গল্প করব কেমন !
নওশাদ উঠে ওয়াস রুমে ঢুকে গেল !
হেরা চুপচাপ শুয়ে আছে ! ওর খালি কান্না পাচ্ছে , ভয় হচ্ছে !
আনারের মা দরজায় নক করছে !
ট্রলিতে করে খাওয়া নিয়ে ঢুকলো নওশাদ আর হেরার জন্য !
আম্মা শরীরডা কেমন আপনের ? ঐদিন বিশ্বাস করবেন না আম্মা আপনে যাওয়ার সময়ই আমার মনডা কু ডাকতে ছিল ! আপনার শরীর খারাপ আছিল তাও আপনে খালাম্মার সাথে গেলেন ! কি যে ডরাইছি আম্মা শুধু আল্লাহ আল্লাহ করছি ! আম্মা ভাইয়া আপনার জন্য খুব কানছে গো ! ফুফুআম্মা বলছে তোমার পাপা তোমার মা কে নিয়ে আসবেই তুমি কান্না বন্ধ করো তাও কানছে !
তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যান আম্মা আপনারে এমন দেখতে কষ্ট লাগতেছে !
আমি এখন যাই আপনারে দেখতে লোকজন আসা শুরু হইব একটু পর । প্রচুর কাম আছে আমার !
আনারের মা বের হয়ে গেল ঘর থেকে !
হেরা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে !
নওশাদ গোসল শেষ করে কাঁপতে কাঁপতে বের হয়ে এলো ! আজ খুব ঠান্ডা পড়েছে দেখেছো হেরা !
খাবার দিয়ে গেছে, খুব ক্ষিধে পেয়েছে আমারও ! হেরার মুখের সামনে স্যুপের চামচ ধরলো !
প্লিজ হেরা খাও , তুমি না খেলে আমিও খাব না ! আমিও দুই দিন না খেয়ে আছি !
হেরা স্যুপের চামচে চুমুক দিলো !
গুড গার্ল !
দুজনের খাওয়া শেষ হতেই নওশাদ কিছু একটা খোঁজার জন্য উঠে গেল !
এখানেই তো রেখেছিলাম জিনিস গুলো ! এই তো, বেড সাইড ড্রয়ার থেকে একটা খাম বের করলো নওশাদ! তোমার সব গয়না এটাতে ! হসপিটালে ভর্তির সঙ্গে সঙ্গে এসব খুলে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েছে নার্স ।
নওশাদ হাসি মুখে বলল,আমি পড়িয়ে দেই ? একটু অপেক্ষা করো !
আমি কি তোমার বেডে তোমার কমফোর্টারের নিচে আসতে পারি ?
তোমার অনুমতি নিয়ে আসতে চাইছি মিটমিট করে হাসছে নওশাদ !
হেরা একটা সাইড হয়ে বসলো !
নওশাদ ওর পাশে কমফোর্টারের ভেতরে ঢুকলো ! খুব ঠান্ডা লাগছে বুঝলে ! নওশাদ হেরার গলায় চেইন টা পড়িয়ে দিলো । হাতে চুড়ি, কানের দুল গুলো পড়িয়ে দিলো !
আর একটা জিনিস আছে আমার কাছে তোমার জন্য !
তাকাও আমার দিকে ! নওশাদের আঙ্গুলে একটা টিপ ! হেরার কপালে টিপটা পড়িয়ে দিল ! তারপর হেরার মুখটা দুই হাতে ধরে তাকিয়ে আছে অপলক চোখে !
আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম মনে হচ্ছিল এই মুখটা আর দেখতে পাবো না । এই সুন্দর চোখ গুলো কি আর দেখা হবে না ভেবে অনেক কষ্ট হচ্ছিল? সত্যি অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম হেরা ! হেরার দুই চোখ বেয়ে আবার পানি পড়ছে ! তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি পাগল হয়ে যেতাম ! একবার একজনকে হারিয়ে নিজেকে সামলে নিতে পেরেছিলাম কিন্তু এবার মরে যেতাম ! একা জীবনটা বয়ে নেয়ার আর শক্তি নেই আমার।
নওশাদের চোখও ভিজে যাচ্ছে ! হেরার ঠোঁটে ঠোঁট রাখতেই হেরা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নওশাদকে !
কিছুক্ষণ হেরাকে বুকে জড়িয়ে চুপচাপ হয়ে রইলো নওশাদ !
আমি তোমাকে প্রমিজ করছি তোমাকে এরকম নিরাপত্তা হীনতায় পড়তে আর দিব না ! হেরা নওশাদের বুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে ! বিশ্বাস করবে হেরা এক একটা মিনিট যাচ্ছিল আমার নিঃশ্বাস টা বন্ধ হয়ে আসছিল ! বারবার মনে হচ্ছিল তুমি না জানি কতটা অসহায় অবস্থায় আছো ! আমাকে খুজছো হয়তো ! আমি কি করব কোথায় গেলে তোমাকে পাব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না ! কখনো মনে হলো চিৎকার দিয়ে কাঁদি ! সময় যাচ্ছিল আমার ভয়টা বেড়ে যাচ্ছিল ! তুমি এই শহরের কিছুই চিনো না এই শহর একটা অসহায় মেয়ের জন্য যে কতটা ভয়ংকর চিন্তা করেই আমি আতঙ্কে জমে যাচ্ছিলাম ! এতটা অসহায় লাগছিল নিজেকে !
হেরা গুটিসুটি হয়ে নওশাদের বুকের সঙ্গে মিশে আছে ! নওশাদ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তুমি এখনো ভয় পাচ্ছো ?
হেরা মাথা নেড়ে না করলো !
গুড কোন ভয় নেই আমি এভাবেই বুকে জড়িয়ে ধরে রাখব তোমাকে কোথাও যেতে দিব না আর ! কোথাও না !
দরজায় টোকা দিচ্ছে কেউ ! নওশাদ খুব বিরক্ত হয়ে উঠলো, কে আবার ? থাক নক করুক খুলব না এখন !
যে এসেছে সে আবার নক করছে ! হেরা দরজার দিকে তাকিয়ে আছে!
এদিকে ফিরো আমি তোমার ঠোঁটে আরেক বার চুমু খাব তারপর গিয়ে দরজা খুলব তার আগে না বলেই নওশাদ হেরার ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরলো ! এভাবে প্রতি ঘন্টায় অন্তত তিনবার চুমু খেতে দাও যদি আমাকে তাহলে তোমার সব কষ্ট ভেনিস হয়ে যাবে নওশাদ হাসতে হাসতে বলল ! আমি এই থেরাপিতেই তোমাকে সুস্থ করে তুলবো দেখো ! হেরা লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেলল কমফোর্টারের নিচে !
আমি ঘন্টায় ঘন্টায় এই থেরাপি সত্যি সত্যি দিব তোমাকে , দেখবে এক থেরাপিতে দুজন সুস্থ হয়ে যাব ! তোমার শরীর খারাপ ভালো হয়ে যাবে আমার মন খারাপ ভালো হয়ে যাবে। কি দারুন চিকিৎসা তাই না হেরা ! এটা ডাক্তার নওশাদ আজমীর চিকিৎসা বুঝলে ডাইরেক একশন হবেই হবে ! তুমি যতই লজ্জা পাও কিছুই করার নেই এই চিকিৎসা তুমি ভালো না হওয়া পর্যন্ত চলবে !
নওশাদ হাসতে হাসতে উঠে দরজা খুলে দিল !
পারুল দাঁড়িয়ে আছে দরজায় !
কিছু বলবে ?
আম্মারে দেখতে আসছে মেঝ আম্মা আর ছোট আম্মা !
নওশাদ তাকিয়ে দেখে ওর দুই ভাইয়ের বউ দাঁড়িয়ে আছে !
ও নাদিয়া, মিলা তোমরা এসো ভেতরে এসো !
সরি ভাইয়া আপনারা রেস্ট নিচ্ছিলেন ?
না না যাও ভেতরে যাও হেরা শুয়ে আছে !
নাদিয়া আর মিলা ঘরে ঢুকতেই নওশাদ বের হয়ে গেল !
মিলা ঘরের ডেকোরেশন দেখে হা হয়ে গেল মেঝ ভাবি দেখেছো কি সুন্দর করে সাজিয়েছে ঘরটা মনে হচ্ছে ভাইয়া ভাবির বাসর রাত আজকে ! কথাটা বলেই পিছনে তাকিয়ে দেখে নওশাদ দরজায় দাঁড়িয়ে আছে !
মিলা দাঁত দিয়ে জিব কাটলো লজ্জায় !
আমার চশমাটা নিয়ে যাই তোমরা বসো !
নওশাদ লজ্জা পেয়ে চশমা নিয়ে দ্রুত বের হয়ে গেল রুম থেকে ! হেরা বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে আছে ! নাদিয়া আর মিলা ওর পাশে গিয়ে বসলো !
কি অবস্থা তোমার ভাবি ? যা ভয় পেয়েছিলাম আমরা নাদিয়া হেরার মাথায় হাত রাখলো!
হেরা তাকিয়ে আছে ওদের দিকে !
বীথি এতটা কেয়ারলেস আগে বুঝি নাই ! সব কিছুতেই অস্থির সে, আর মেজাজ সে জন্যই সংসার টা টিকেনি প্রথমবার , নাদিয়া বলল!
বড় ভাবি ঘটনা কি হয়েছে বলো তো আমি আর মেঝ ভাবি তো মানতেই পারছিলাম না তুমি হারিয়ে গিয়েছো !
তবে ভাবি আরমান বলেছে ভাইয়া তোমার জন্য অস্থির হয়ে গিয়েছিল এতটা অসহায় ভাইয়াকে সে জীবনে কখনো দেখিনি !
ফারহান ও বলল ভাইয়া হসপিটালে সারারাত তোমার হাত ধরে বসে ছিল ! ভাইয়া কান্নাকাটি ও করেছে ! ইস তোমার ভাগ্য ভাবি আমার কিছু হলে ফারহান জীবনেও এত অস্থির হবে না মনে মনে বলবে, জান ছুটলো বাবা ! নিজের কথায় মিলা নিজেই হেসে ভেঙ্গে পড়লো !
বড় ভাবি এত সুন্দর করে ঘর কে সাজিয়েছে ভাইয়া ?
হেরা মাথা নেড়ে না করলো ! এলিন, নাহিন !
খুব সুন্দর হয়েছে ! মনে হচ্ছে বাসর ঘর মিলা আর নাদিয়া হাসছে !
নওশাদ তার দুই ভাই আর বুবুর সঙ্গে বসে আছে লিভিং রুমে !
ভাইয়া তুমি ব্যাঙ্কক গেলে না যে সমস্যা হবে না ?
না ফারহান গার্মেন্টস মেশিনারিজের একটা ফেয়ার এটেনড করতে যাচ্ছিলাম !
বুবু বলল,আমি চিন্তা করছি বাবু যাওয়ার পর ঘটনা ঘটলে কি হতো ?
বুবু আল্লাহ অনেক বড় ফারা থেকে বাঁচিয়েছে ভাবিকে ! চিন্তা করো আজকালের দিনে অপরিচিত কোন মেয়েকে রাতে কেউ আশ্রয় দেয় আমরা হলে দিতাম ? ও ভদ্রমহিলা ভাবিকে কাঁদছে দেখে নিজের বাসায় নিয়ে গেছে ভাবির গায়ে জ্বর দেখে তিনি ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে । ভাবির অনেক জ্বর ছিল তিনি ভাবিকে মাথায় জল পট্টি দিয়েছে ! উনার ছেলে মেয়ে কেউ ছিল না বাসায় একা বাসায় তিনি এসব করেছেন ! ভাবি নাকি কথাই বলতে পারছিল না ! অবশ্য ভাবিকে দেখে ওরা নাকি বুঝেছে ভালো ফ্যামিলির মেয়ে!
তোকে এসব কে বলেছে আরমান ?
বুবু আমি তো থানায় ছেলে মেয়ে গুলোর স্ট্যাটমেন্ট নিচ্ছিল যখন পুলিশ তখন ছিলাম সেখানে !
ভালো করে থ্যাঙ্কস বলেছিস তো ওদের !
সেটা বলেছি !
বাবু তুই ও ওদের থ্যাঙ্কস বলে দিস ভাই !
হেরা একটু সুস্থ হয়ে উঠলে আমি আর হেরা পার্সোনালি গিয়ে ঐ ভদ্রমহিলা আর তার ফ্যামিলি মেম্বারদের থ্যাঙ্কস বলে আসব !
এটা সবচেয়ে ভালো হবে !
ওরা আমার জন্য যা করেছে সারাজীবন থ্যাঙ্কস বললেও কম বলা হবে বুবু নওশাদ বলল !
ভাইয়া ভাবির গায়ে জ্বর নেই তো ?
না বাসায় আসার পর ছিল না এখন কি অবস্থা দেখতে হবে !
মিলা তো মনে হয় বকবক করে ভাবির মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে !
থাক ফারহান গল্প হাসির মাঝে থাকলে ওর ভালো লাগবে !
আরমান বলল,বুঝলে ভাইয়া তোমার পরিচিত লোকজন আমাকে ফোন দিয়ে ঘটনা জানতে চাইছে !
সবাই কে কি বলেছিস আরমান ?
বলেছি ভাবি শপিং মলে গিয়ে অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল একা ছিল আমরা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আর কি বলব, বীথি সহজ সরল একজন মানুষ কে হারিয়ে রেখে চলে আসছে এটা কাউকে বলা যায় ?
নওশাদ চোখ মুখ শক্ত করে চুপ করে আছে !
তখনই রেজোয়ান এসে ঢুকলো লিভিং রুমে !
কি অবস্থা বন্ধু ? বুবু কেমন আছেন ?
এই তো আছি ! বসো !
সোফায় বসতে বসতে রেজোয়ান বলল,এই ঘটনার পেছনে সবচেয়ে বড় কেয়ারলেস ছিল তোমাদের ভাই ! তিনি তো আছেন বিজনেস আর গলফ খেলা নিয়ে ! বউ , সংসার নিয়ে কোন ভাবনা আছে তার ! মেয়েটা যে তার নাম্বার টা জানে না তার খেয়াল ই নেই ! এই সুযোগে এত বড় ঘটনা ঘটলো ! জাস্ট একটা ফোন দিতে যদি পারতো হেরা ঘটনা এত দূর গড়াতো না !
নওশাদ রেজোয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, নিশাল গেছে ওর মা মনির জন্য মোবাইল কিনতে !
চোর পালানোর পর বুদ্ধি বেড়েছে নওশাদ আজমীর !
ব্যাপার টা কিভাবে মিস হয়ে গেল বুঝলাম না ! আসলে অনেক বছর বাসায় কাউকে ফোন করা হয় না সেই জন্যই হয়তো মাথাই আসে নাই আমার !
নওশাদ হাসছে !
হাসবি না শালা কি একটা রাত ছিল ভাবলেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায় !
সুমনা কোথায় ?
ওর মাইগ্রেন এর পেইন শুরু হয়েছে আমি একাই এলাম !
নিশাল হেরার জন্য মোবাইল কিনে গাড়ি থেকে যখন নামছে দেখে বীথির গাড়ি বাসায় ঢুকছে ! নিশাল ঘরে না ঢুকে দাঁড়িয়ে গেল ! বীথি,যুথী নিশালকে দেখে বলে উঠলো, কোথায় গিয়েছিলে নিশু ?
একটু কাজ ছিল বাহিরে ! তোমরা কি মামনি কে দেখতে এসেছো ?
মা মনি কে ? বীথি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো !
যুথী খালামনি তুমি ভেতরে যাও আমি একটু ছোট খালামনির সঙ্গে কথা বলব !
ঠিক আছে আমি ভেতরে যাচ্ছি আমার এত সময় নেই তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে ,তোরা আয় ! যুথী বাসার ভেতরে ঢুকে গেল !
তুমি আমার সঙ্গে এদিকে এসো খালামনি বলে নিশাল সুইমিং পুলের দিকে এগিয়ে গেল !
বীথি নিশালের পেছনে পেছনে সুইমিং পুলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো ! এখানে কেউ নেই। বাসার সবাই দোতলায়।
নিশাল বীথির দিকে তাকিয়ে বলল,তুমি বাসায় এসেছো কেন খালামনি ?
হেরা কে দেখতে এসেছি আর কিসের জন্য বীথি বলল !
নিশাল কঠিন গলায় বলল, এত কিছুর পর তুমি কিভাবে মামনি কে দেখতে আসো ? পাপা কে ফেইস করতে তোমার একটুও বুক কাঁপছে না খালামনি ?
আমি কি করেছি যে ভয় পাব? ঐ গর্দভ মেয়ে হারিয়ে গেছে আমার কিসের দায় !
ঠিক বলেছো মা মনি গর্দভ আর তুমি খুব চালাক ! খালামনি পাপা একজন সেলফ মেইড পার্সন এই প্রোপার্টি এই বিজনেস পাপাকে কেউ গিফট করেনি এই পর্যন্ত পাপা এসেছে নিজের দক্ষতায়, নিজের মেধা আর বুদ্ধির জোরে । মা মনিকে বোকা বানানো যায় পাপা কে বোকা ভাবলে কিভাবে তুমি ?
কি বলতে চাইছো নিশাল ?
ঘটনা টা তুমি ইচ্ছে করে প্ল্যান করে ঘটিয়েছো ! তুমি কি ভেবেছো তুমি যা ইচ্ছে বলবে সবার মত পাপা ও তাই বিশ্বাস করবে ?
আমি ইচ্ছে করে হেরাকে হারিয়ে রেখে এসেছি বলতে চাইছো ?
হ্যাঁ অস্বীকার করো না খালামনি, সেদিন রাতে আমি তোমার আর যুথী খালামনির ফোনের কথা সব শুনেছি যা তুমি পোর্চের নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলছিলে ! তুমি বলোনি তুমি হেরাকে পাপার জীবন থেকে দূরে ফেলে রেখে এসেছো । সব তোমার প্ল্যান অনুযায়ী হয়েছে । শুধু পাপা যাওয়ার পর হলে পার্ফেক্ট হতো ব্যাপারটা ! বলোনি তুমি ? তুমি জুসের মধ্যে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাইয়ে দিয়েছো সব আমি জানি ! নিশাল চিৎকার দিয়ে উঠলো!
একদম চুপ , নিশাল এই সব আমি তোমার জন্য করেছি বেবি বীথি নিশালের মুখ চেপে ধরলো ! বীথি কথাটা বলে আশেপাশে তাকালো ।
ছাড়ো আমাকে একদম বাজে কথা বলবে না ! ছিঃ খালামনি তুমি আমার মাম্মার বোন ! তুমি পারলে এত বড় একটা কাজ করতে ? ইটস এ ক্রাইম ,মামনির যদি কিছু হয়ে যেত আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না ! তুমি ইচ্ছে করে ঘটনা টা ঘটিয়েছো শুনে আমি তখন থেকে কি অশান্তির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি বিশ্বাস করবে না ! তোমার দেয়া ঘুমের ওষুধের জন্য সারাক্ষণ ঘুমাচ্ছে মামনি । পাপা অস্থির হয়ে যাচ্ছে তাই দেখে আমি তবুও কিছু বলতে পারছিনা !
নিশাল কিসের মামনি মামনি করছো ?
ইয়েস সী ইজ মাই মামনি ! আমি ডাকব তোমার কি সমস্যা ?
ঐ মেয়ে তোমার পাপা কে দখল করেছে । দুই দিন পর বাচ্চা কাচ্চা জন্ম দিয়ে তোমার যা আছে সব দখল করবে বাবা !
তোমাকে এত চিন্তা না করলেও চলবে ! যাকে তুমি বিপদে ফেলেছো সেই মানুষটা আমার পাপার লাইফের একটা পার্ট আমি আমার পাপা কে ভালোবাসি তাই তার লাইফের সব কিছু কে ভালোবাসি ! তুমি তো মাম্মা যাওয়ার পর থেকে বলেছো পাপা শুধু তার বিজনেস কে ভালোবাসে আর কাউকে না কিন্তু কখনো আমাকে বোঝাও নি আমার পাপা কতটা একা ,কত কষ্ট তার জীবনে । সোহাম ভাইয়া আমার চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে আমার পাপা কতটা নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছিল ! উনি যা বুঝিয়ে বলতে পেরেছে তুমি বা যুথী খালামনি কোন দিন বলোনি আমাকে ! আমি পাপাকে কতটা ভুল বুঝতাম ! নিশাল চোখের পানি মুছলো !
আমি তোমার কথা কাউকে বলিনি আমি চাইনা তোমার জন্য আমার মাম্মা লজ্জা পাক কিন্তু দয়া করে তুমি পাপা কিংবা মামনির সামনে যাবে না ! মিথ্যে সহানুভূতির দরকার নেই ওদের !
আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি খালামনি তাই আরো বেশি কষ্ট পাচ্ছি ! আর একটা কথা আমি যাকে মামনি ডেকেছি তার ক্ষতি কখনো করতে চেয়ো না ! বারবার মা হারাতে চাই না আমি !
নিশাল কথাটা বলেই দৌড়ে চলে গেল দোতলায়! বীথি তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে !
হঠাৎ পারুল এসে পাশে দাড়াতেই চমকে উঠলো বীথি ! চোখের পানি টা মুছলো ! দেখলি পারুল যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর !
খালাম্মা আপনি এখন আর উপরে যাইয়েন না থাক , ভাইয়ার মাথা ঠান্ডা হোক দেখবেন আপনার কাছেই ছুইটা যাইব !
ওর জন্য কি করি নাই বল ?
সেটাই এতটুকু রাইখা মা মরলো আপনিই তো বড় করলেন বাপ তো অফিসেই পইড়া থাকতো ! এইডারে কয় রক্ত বুঝলেন খালাম্মা !
আমার কি স্বার্থ এখন হেরাকে নওশাদ আজমীর জীবন থেকে সরিয়ে দিয়ে, সব তো নিশালের জন্য ই করেছি ! যখন খুব চেয়েছিলাম মানুষটাকে, তখন আমার দিকে ফিরেও তাকায়নি তুই তো জানিস সব । কতটা পাগল হয়ে গিয়েছিলাম এই নওশাদ আজমী মানুষটার জন্য ! আপা যখন বেঁচে ছিল আপা আর উনাকে দেখতাম মুগ্ধ হয়ে । কি সুন্দর আন্ডারস্ট্যান্ডিং দুজনের ! আপার জন্য পাগল ! বিয়ের এত বছর পরেও আপা যা বলতো, যা বোঝাতো সেভাবেই মানুষটা বুঝতো ! আমার সংসার টা নষ্ট করেছি এই মানুষটা র জন্য । সারাক্ষণ উনার সঙ্গে ফয়সাল এর তুলনা করতাম ! আপার জন্য উনি এত পাগল , কেন ফয়সাল আমার জন্য পাগল হয় না ? কেন আমি ফয়সালের কাছ থেকে উনি যতটা ভালো আপাকে বাসে ততটা ভালোবাসা পাই না !
হঠাৎ আপা মরে গেল ! ততদিনে আমি আর ফয়সাল সেপারেশনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি ! বেঁচে থাকতে আপা কত বোঝাতো আমাকে একটু মানিয়ে নে আমি বলতাম তোমার জন্য বলা সহজ কারণ নওশাদ নামের মানুষটা তোমার জন্য পাগল কিন্তু ফয়সাল আমার জন্য পাগল না ! আমার পাগলের মত ভালোবাসা দরকার ! ফয়সাল ডিভোর্স লেটার সাইন করার আগে কত অনুরোধ করলো আমি সিদ্ধান্তে অনড় ছিলাম!
জানিস পারুল আমি যখন নিশালের জন্য এই বাসায় থাকি একদিন রাতের বেলা বৃষ্টি হচ্ছে ঝুম বৃষ্টি, আমি নিশালের বারান্দায় ওর স্কুল ড্রেস টা ভিজে যাচ্ছে আনতে গেছি দেখি দুলাভাই উনাদের রুমের ছাদ বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে । উনি বৃষ্টিতে ভিজতে পারতেন না কিন্তু আপার বৃষ্টি পছন্দ ছিল সারাজীবন ! আপার কথা মনে করে তিনি বৃষ্টিতে ভিজছেন ! আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম ! আমি সেই রাতে নওশাদ আজমীর প্রেমে পড়ে গেলাম ! একটা মানুষ কতটা বউ পাগল হলে মারা যাওয়ার পরেও এমন পাগলামী করে ! আপার জন্য উনি রাতের পর রাত কাঁদতেন আর আমি রাতের পর রাত উনার জন্য কাদতাম ! ছটফট করতাম ! লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম !
তুই তো দেখেছিস এই সংসারটাকে নিজের সংসার ভাবতে শুরু করেছিলাম ! কোনদিন ভুলেও আমার দিকে তাকিয়ে দেখেননি উনি ! দুলাভাই না বলে নওশাদ ভাই ডাকা শুরু করলাম একসময় , একদিন হঠাৎ বলে আমাকে দুলাভাই ডাকো সেটাই ভালো লাগে মনে হয় গীতি আছে আশেপাশে নওশাদ ভাই ডেকো না প্লিজ । লজ্জার মাথা খেয়ে একদিন নিজেই বলে ফেললাম আমাকে বিয়ে করেন আমি নিশালের মা হতে চাই আমি আপনার নিঃসঙ্গ জীবনের সঙ্গী হতে চাই। আমাকে ফিরিয়ে দিলো !
আমাকে কোন মূল্যই দিলো না !
উনার মত এত পশ, স্মার্ট মানুষ ভেবেছিলাম যাকে বিয়ে করবে উনার মতো হবে কিন্তু উনি কাকে বিয়ে করে আনলো একটা কমবয়সী সুন্দরী গাইয়া মেয়ে কে ! তুই যখন ওদের কক্সবাজারের ছবি গুলো দেখালি আমাকে, সেদিন আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল ! বউ কে কোলে নিয়ে এত আহ্লাদ ! আমি সহ্য করতে পারছিলাম না !
তার মধ্যে উনার বোন বিদেশ থেকে এসে হেরাকে রুমে পাঠিয়ে দিল ! আমি উনার চোখে হেরার জন্য যা দেখেছি আমার জন্য কোন দিন তা দেখি নাই ! আমি হেরাকে উনার পাশে সহ্য করতে পারছিলাম না ! জানি এখন আর আমার কোন কিছু পাওয়ার নেই তবুও ভালোবাসার আবেশ টা তো মুছে ফেলতে পারিনি ! এই বাসায় সময় অসময়ে কেন আসি, কেন এই বাসার কন্ট্রোল আমার কাছে রেখেছিলাম কারন ঐ মানুষ টা ।ওকে একটু দেখা, উনার জীবন টা সহজ করা । এতটা পার্ফেক্ট কিভাবে হয় মানুষ দেখে শান্তি পাই আজও ! এত বুদ্ধি,এত মেধা, এত বিচক্ষণ মানুষটা শুধু আমার মনটা আর ফিলিংস টা বুঝলো না ! কি জানি দেখ গিয়ে বুঝেও না বোঝার ভান করেছে ! বীথি কাঁদছে বসে !
খালাম্মা চুপ করেন এখন কেউ শুনলে আরেক কাহিনী হইব !
নিশালকে এতটা ভালবাসি ও আমাকে বুঝলো না । পাপার জন্য পাগল হয়ে গেল !
খালাম্মা আপনে যান কয়দিন পর সব ঠিক হইব আপনে আপনার মানুষটারে দেখতে আবার আসতে পারবেন !
কিন্তু আমি হেরার সঙ্গে মানুষটাকে সহ্য করতে তো পারছি না পারুল !
কি আর করবেন সহ্য তো করতেই হইব আপনার !
বীথি চোখের পানি মুছে গাড়িতে গিয়ে উঠলো ! তারপর যুথীকে রেখেই বাসায় চলে গেল ! যাওয়ার সময় উপরে তাকিয়ে দেখে নওশাদ আর রেজোয়ান সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে আর হাসছে কিছু নিয়ে !
( চলবে )