#লীলাবালি🌺
#পর্ব_১২
আফনান লারা
.
পরেরদিন প্রথম ক্লাসেই জুথি হাজির হয়েছে।একটু দেরি করে ফেললো তবে।অর্ণব তখন পড়াচ্ছিল।জুথিকে ওপারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাতের ঘড়িতে চোখ রাখলো সে। পাক্কা বিশ মিনিট দেরি করেছে জুথি।অর্ণব দাঁত কেলিয়ে বইয়ের পাতা উল্টে পড়ানো শুরু করে দিলো আবার।ওদিকে জুথি বিরক্ত হচ্ছে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে।শেষে আর থাকতে না পেরে বললো,’ভাইয়া আসতে পারি?’
অর্ণব বইতে চোখ রেখে বললো,’না’
জুথি রাগ করে চলে গেলো ক্লাস থেকে।অর্ণব ওকে ডাকার জন্য পাশে তাকিয়ে দেখলো সে নেই।সবাইকে একটা কবিতা পড়তে দিয়ে ক্লাস থেকে বের হলো অর্ণব।দূরের কোণায় ফ্লোরের উপর কাগজ বিছিয়ে গোল হয়ে বসে আছে জুথি।আর হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছতেছে।অর্ণব প্রথমে ভাবলো তার এমন ব্যবহারে হয়ত কাঁদছে।সে ছুটে আসলো সেখানে।কাছে এসে দেখলো হাতে ভাঙা পুতুলের টুকরো নিয়ে কাঁদছে জুথি।
মানে এই ঘটনার জন্য কাঁদছে, তার ব্যবহারে না।তাই হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে সে বললো,’ক্লাসে আসুন’
-‘যান আপনি।আমি আজ ক্লাস করবোনা।দেখছেননা আমার পুতুল ভেঙ্গে গেছে?
-‘এটা কি আমার দোষ?’
-‘তা নয়ত কি?আমাকে কতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন।শেষে উল্টো পথে যাওয়া ধরতে গিয়েই তো আমি পড়ে গেলাম নিচে।আর আমার পুতুলটাও ভেঙ্গে গেলো।ব্যাগে ঝোলানো ছিল।কত প্রিয় ছিল এটা’
অর্ণব চলে এসেছে ক্লাসে।
জুথির কথাতে সে কখনওই পাত্তা দেয়না।সবসময় এড়িয়ে চলে।জুথি বিশ /একুশ বয়সী একটা মেয়ে হবার পরেও তার ব্যবহারে সবসময় একটা ছোট মেয়ে মনে হয়েছে।যার কারণে সে সবসময় ওকে ঐ চোখেই দেখে।জুথি পুতুলের ভাঙ্গা টুকরো গুলো কুড়িয়ে পিছু পিছু আসলো ওর।মেয়েরা একজন আরেকজনের সাথে বলাবলি করছে অর্ণব জুথির রাগ ভাঙ্গিয়ে নিয়ে এসেছে।কথাটা অর্ণবের কানে না গেলেও জুথির কানে এসেছে।সে বলতে চাইলো আসল সত্যিটা পরে কি ভেবে আর বললোনা কাউকে।সবাই কেমন হিংসার চোখে তাকাচ্ছে।তা দেখে কেমন একটা প্রাউড ফিল হতে লাগলো।
অর্ণব তার ক্লাস শেষ করে চলে গেছে।জুথি ভাবছিল কুমিল্লা যাবার ট্রিপ কি করলে ক্যানসেল হবে সেসময়ে বাকিরা এসে জোট বেঁধে জিজ্ঞেস করলো অর্ণব তখন করিডোরে গিয়ে ওকে কি বলেছিল যাতে করে সে ক্লাসে আসতে মেনে গেলো।জুথি উত্তর দেওয়ার আগেই তপন এসে বললো জুথিকে অর্ণব ডেকেছে।সবাই তো হা করে তাকালো ওর দিকে।কি এমন জাদু করেছে সে অর্ণব ভাইয়ার উপর।কারোর বিশ্বাস হচ্ছেনা।জুথি ব্যাগ রেখে সেদিকে চললো।অর্ণব স্যারের কেবিনে আছে।সেখানে স্যার কিসব বলছিলেন আর ও খাতায় লিখছিল।জুথি আসার পর স্যার ওকে বললেন বসতে।জুথি তাই অর্ণবের পাশে বসলো।স্যার বললেন সামনে যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে তার জন্য কিছু দল বানাতে হবে।এক দল আবৃত্তি করবে,আরেকদল ছোটগল্প দিবে,কেউবা রচনা দিবে।জুথি যেন সেসব লিস্ট করে রাখে।জুথি জিজ্ঞেস করলো তাকে কেন এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।সে সময় পাবেনা এগুলো করার জন্য।
স্যার যেতে যেতে বললেন,’অর্ণবই তো বললো তুমি অনেক ফ্রি থাকো’
তখন মন চাইলো অর্ণবের মাথার সব চুল ছিঁড়তে।কিন্তু পারলোনা।ওর সাথের বাকি মেয়েগুলো বাহিরে দিয়ে উঁকি বুকি মারছিল।জুথি দাঁত কেলিয়ে ওদের নিজের মুখের হাসি দেখিয়ে অর্ণবের দিকে চেয়ে বললো,’আমাকে আজাইরা দেখলে আপনার গা জ্বলে তাইনা?’
-“একদম ঠিক বলেছো।একা আমি কেন কষ্ট করবো?’
-“আপনার জন্য মেয়ের অভাব পড়েছে তাইনা?’
-‘কি আর করবো বলো!আমার নজরে একমাত্র তোমাকেই অকর্মার ঢেঁকি মনে হয়।সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়াও, দেখি তো সব।যাও কাজে লেগে পড়ো।সময় নষ্ট করবেনা”
—–
ক্লাসে এসে জুথি খাতা কলম নিয়ে সবার নাম নেওয়া শুরু করেছে।নামের লিস্ট করে সেটা অর্ণবকে দিতে এসে জানতে পারলো ও আরেক ডিপার্টমেন্টে চলে গেছে।এবার সে ছুটলো সেদিকে।
হাঁপাতে হাঁপাতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ডিপার্টমেন্টে এসে অর্ণবকে পেলো অবশেষে।অর্ণব সেখানে কয়েকজনের নাম লিখছিল খাতায়।জুথি এসে ওর হাতে কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললো,’আমাদের বিভাগের বাইরের বিভাগরের দায়িত্ব ও কি আমাদেরই দেওয়া হয়েছে?’
-“যেহেতু বাংলা বিভাগের আমরা সেহেতু সবার দায়িত্ব ঘুরফিরে আমাদের ঘাঁড়ে এসেই পড়বে।এসেছেন ভাল করেছেন। এবার এই ক্লাসরুমে ঢুকে সবার নাম নিয়ে আসেন’
জুথি মুখ বাঁকিয়ে চললো লিস্ট করতে।
এসব কাজ শেষ করতে করতে বিকাল হয়ে গেছে ওর।শেষে ক্লান্ত হয়ে বটতলার নিচে বসে ফোনে দেখছিল কটা বাজে।অর্ণব ওর পাশে এসে বসলো হঠাৎ।আচমকা ওকে বসতে দেখে জুথি সরে বসলো।অর্ণবের হাতে ফুচকা দুই প্লেট। এক প্লেট ওর দিকে ধরে সে বললো,’স্যারের পক্ষ থেকে ট্রিট’
-‘কেন?’
-‘অনেক খাটনি গেছে আমাদের সে জন্যে।খান নাহলে আমি খেয়ে ফেলবো।
আমার অনেক প্রিয় ফুচকা’
জুথি প্লেটটা কেড়ে নিয়ে আড়চোখে তাকালো,তার নিজেরও অনেক প্রিয় এটা।অর্ণবের ফোন বাজছে।অফিসে নতুন ক্যান্ডিডেট এসেছে।সবসময় নতুন ক্যান্ডিডেটদের অর্ণব নিজেই ট্রেইন করে।তাই জলদি করে ফুচকা শেষ করছে সে।জুথি ওর দিকে ফিরে বললো,’আস্তে খান।আমিও যাব কম্পিউটারের দোকানে।আমার একটা কাজ আছে’
অর্ণব মুখে ফুচকা পুরে বললো,’আমার সঙ্গে যেতে চান?আমি কখনও রিকশা নিইনা।হেঁটে যাই,পারবেন দুই মাইল হাঁটতে?’
জুথি ব্যাগ থেকে টাকা বের করে বললো,’এই যে টাকা।আপনি চাইলে আমার সঙ্গে যেতে পারেন’
-‘আপনার সঙ্গে গেলে হয় আপনি আমায় জ্বালাবেন নাহয় অন্য কিছু করে মেজাজ গরম করবেন।তার চেয়ে বরং আমি যেভাবে যেতাম সেভাবে যাব,আপনি রিকশা করে আসেন’
প্লেট দোকানে রেখে অর্ণব হাঁটা ধরেছে।মিনিট দশেক পর দূর থেকে কারো তেড়ে আসার আওয়াজ পেয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখতে পেলো জুথি দৌড়ে আসছে এদিকে।
অর্ণবের কাছে এসে ওর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বললো,’আসলে আমি একা কোথাও যাইনা।আপনি থাকলে একটু সাহস পাবো’
অর্ণব হেসে বললো,’আপনার আবার সাহস কম?সেটাও বিশ্বাস করতে হবে আমায়? ‘
-‘সবসময় সাহস থাকেনা।কুমিল্লায় আমার চাচার বাড়ির পাশের একটা ছেলে অনেক ডিস্টার্ব করে তাই আমি ওখানে যেতে চাচ্ছি না।কিন্তু বাবা তো বোঝেনা।ভাবলাম আপনাকে জ্বালালে আপনি মেনে যাবেন।আপনি মেনেও গেছিলেন কিন্তু হঠাৎ বাবা আবার রিকুয়েস্ট করায় আগের মতে ফিরে গেলেন’
-“আপনার মধ্যে যে সাহস আছে সেটাকে কাজে লাগান।এমন ভীতুর মতন থাকলে হবেনা।আমাকে যে পরিমাণ জ্বালালেন তেমন করে যদি ঐ ছেলেটাকে জ্বালাতেন তাহলে কাজের কাহই হতো।মেয়েদের ডিস্টার্ব করার ভূত নামতো তার ঘাঁড় থেকে’
জুথি হাসতে হাসতে বললো,’যদি সত্যি এমনটা করতাম তাহলে সে আরও বেশি করে প্রেমে পড়ে যেতো।শুধু সে নয়।যত ছেলে আছে সবাই প্রেমে পড়তো কিন্তু প্রেমে পড়ছেননা আপনি।আপনার মন শক্ত’
অর্ণব জুথির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো,’ঠিক বললেন।আসলেই আমার মন শক্ত। কথাটা শুধু আপনি নয় সবাই বলে।পুরুষদের মন শক্ত হতে হয়।নরম মন তো মেয়েদের হওয়া চাই’
জুথি এর বিরোধিতা করে বললো,’না তা নয়।মেয়েদের ও মন শক্ত হওয়া উচিত নাহলে আপনার মতন শক্ত মনের ছেলেরা তাদের কষ্ট দিবে বারবার আর তারা নরম মনের হয়েছে বলে শুধু কষ্টই পাবে’
অর্ণব থেমে গেলো।হুট করে এই প্রসঙ্গে কুসুমের কথা মনে আসলো।কুসুমের মন ও তো নরম।আর সে শক্ত মনের বলে ওকে কতবড় আঘাত দিয়েছে।সে তো কষ্ট পেয়েছে।জুথি মুখের সামনে হাত নড়াচড়া করে বললো,’আপনিও দিছেন নাকি এমন কষ্ট?’
অর্ণব আবার হাঁটা ধরে বললো,’জানিনা।আচ্ছা যদি কেউ বাধ্য হয়ে নরম মনের কাউকে কষ্ট দিয়ে ফেলে তখন তার কি উচিত?’
-“যদি বাধ্য হয়ে দেয় তবে তার উচিত পুরো ঘটনাটা তাকে খুলে বলা, যে কেন তাকে কষ্ট দিয়েছে।তাহলে নিশ্চয় সে কষ্ট পেলেও অন্তত বুঝবে আপনি ইচ্ছা করে করেননি’
অর্ণবের মনে যেন প্রশান্তি লাগলো জুথির কথায়।মনে হলো ঘাঁড় থেকে চাপ নেমে গেছে।হালকা লাগছে।
অর্ণবের সাথে একটা মেয়েকে অফিসে ঢুকতে দেখে বাকিরা ভূত দেখার মতন মুখ করে রেখেছে।অর্ণব ও বুঝতে পেরেছে সবাই এমন চমকে আছে কেন।তাই শুরুতেই বলে দিলো’ জুথি আমার ডিপার্টমেন্টের জুনিয়র স্টুডেন্ট। একটা ফটোকপি করতে এসেছে এখানে।রাকিব তুমি করে দাও কাজটা আমি নতুন ক্যান্ডিডেটের কাছে যাচ্ছি।’
জুথি কাগজ এগিয়ে ধরে বললো,’আপনারা প্রথমে এমন বাংলার ৫ এর মতন মুখ করে চেয়ে ছিলেন কেন?আমাকে চেনেন নাকি আপনারা?’
-‘আসলে অর্ণব ভাইয়ার সঙ্গে কখনও কোনো মেয়েকে আমরা দেখিনি।বড়জোর ম্যামদের দেখেছি।কিন্তু নরমালি এরকম সিচুয়েশনে কোনো মেয়েকে দেখিনি আগে।তাই সবাই একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।’
জুথি টেবিলে হাত রেখে ফিসফিস করে বললো,’সবাই বুঝি ভাবলো অর্ণব ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড এসে হাজির?হাহাহা’
-‘হুম তাই ভাবলাম।আহা আস্তে বলুন।ভাইয়া শুনলে বকবে আমাদের।ভাইয়ার নামে কেউ এমন কথা বললেও ভাইয়ার রাগ হয়।’
জুথি কাগজ গুছিয়ে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বললো,’ভাইয়া টাকা কত দেবো?’
অর্ণব চশমা পরতে পরতে বললো’ফ্রি’
জুথি দুষ্টুমি করে যেতে যেতে বললো,’দেখলে সবাই?আমি সিরিয়াসলি তোমাদের অর্ণব ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড তাই তো মুফতে কাজ করিয়ে নিতে পেরেছি’
জুথি কথাটা বলে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে।এদিকে অফিসের সবাই অর্ণবের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।অর্ণব হালকা কেশে বললো,’ও আসলে আমার খালার দেবরের মেয়ের মেয়ে।সম্পর্কে আমি ওর মামা হই।বুঝলে?আজব!!! এখনও মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কি বুঝাচ্ছো তোমরা?কাজে মন দাও’
চলবে♥
জয়েন হোন আমাদের গ্রুপে
https://www.facebook.com/groups/260300312617922/