#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৪৩
আফনান লারা
.
মাওয়া ঘাটে মানুষ বেশিরভাগ সময় খুব ভোরে আসে।টাটকা ইলিশের খোঁজে।টাটকা ইলিশ পেয়ে কেউ বা ওখানের ছোটখাটো ঝুপড়ির রেস্টুরেন্ট গুলোতে খেতে বসে যায়।ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত সাথে ইলিশ ভাজা,সঙ্গে আবার ইলিশ ভাজার সুস্বাদু সেই তেল।এরই পাশে যদি থাকে ইলিশের ডিম তাহলে জমে ক্ষীর।
কিন্তু এসবের মায়া ত্যাগ করে মৃদুল এই রাত এগারোটার সময় এসেছে মাছ নিতে।আজ রাত বারোটায় তাদের মেসের ছাদে ইলিশ পার্টি হবে।আইডিয়াটা ওরই ছিল।সবাই রাজি হলো,চাঁদা তোলা হলো।কিন্তু যেহেতু এই সুন্দর বুদ্ধিখানা সয়ং মৃদুল দিয়েছে তাই মাছ আনার দায়িত্বটাও ওর ঘাঁড়ে এসে পড়েছে।
চাদর গায়ে দিয়ে মাওয়া ঘটে এসে উপস্থিত সে।সাজানো ইলিশ মাছের ঝুড়ি দেখলেও সেখান থেকে সে নিতে চায়নি।তার ইচ্ছা একেবারে ট্রলার থেকে লাফানো মাছ নেবে।
পনেরো দশ মিনিট অপেক্ষার পর একটা ট্রলার আসতে দেখলো সে।দূর থেকে লঞ্চ,ট্রলারের আওয়াজ কানে আসছে সাথে ঐ ট্রলারটাও।
হাত ভাঁজ করে মৃদুল একটু কাছে এসে দাঁড়ালো।ট্রলার থামার পর জেলেরা এক এক করে মাছের ঝুড়ি এনে এনে নিচে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
মৃদুল মুচকি হেসে দেখছে মাছগুলোকে।বাতির আলোয় চকচক করছে।
দাম কড়া হবার পরও তাজা মাছ কিনতে পেরে সে বেশ খুশি মনে ফিরছিল।মেইন রোডে এসে একা একা পথ দিয়ে চলছিল, একটা সিনএনজি পেলে উঠে যাবে।সামনে একজন ফেরিওয়ালা দাঁড়িয়ে শনপাপড়ি বিক্রি করছেন একটা মেয়ের কাছে।মৃদুল এই দৃশ্য দেখে চমকে ঘড়িতে চোখ রাখলো।রাত তখন পনে বারোটা বাজে।এসময়ে একটা মেয়ে এরকম নির্জন রাস্তায় দাঁড়িয়ে একা একা শনপাপড়ি কিনছে?
শনপাপড়ি বোঝাই ব্যাগ দেখে মৃদুলেরও মন চাইলো শনপাপড়ি খেতে।তাই সে একটু এগিয়ে গেলো।
কিন্তু কাছে আসার পর মেয়েটার মুখ দেখে সে আরও অবাক হয়ে পড়েছে।এটা তো জুথি।জুথি ব্যাগ থেকে টাকা বের করে লোকটার দিকে ধরতে গিয়ে মৃদুলকে দেখে সে নিজেও চমকে গেছে।
-“তুমি এখানে এত রাতে কি করতেছো?’
-“আপনি এখানে কি করেন?’
-“ইলিশ কিনতে এসেছি।তুমি কি করতে এসেছো?মনে ভয় নাই?’
-“আছে।তবে আমি যথেষ্ট আত্ননির্ভরশীল একটা মেয়ে।নিজের সেফটি নিজেই দিতে জানি।তাছাড়া এই রোডটা আমার কাছে নির্জন মনে হচ্ছেনা।এটা মেইন রোড।প্রতি দশ সেকেন্ডে একটা করে দূর পাল্লার বাস যাতায়াত করে।’
-“তা নাহয় বুঝলাম।কিন্তু এত রাতে এখানে কেন আসা হলো তোমার?’
-“আমি আর দশদিন পর সিঙ্গাপুর চলে যাচ্ছি।আম্মুর অনেক অনেক ইচ্ছা বাংলাদেশের শনপাপড়ি খাবে।সিঙ্গাপুরে অনেক খুঁজেও পাননি।আব্বুর সাথে নাকি একবার এই মাওয়া ঘাটে ইলিশ খেতে এসে এই মামার থেকে শনপাপড়ি খেয়েছিলেন।অবশ্য আমাকে বলেছিলেন যেকোনো শপে পেলেই হবে।কিন্তু আমি কাহিনী শুনে ভেবে নিলাম শনপাপড়ি নিলে এই মামার থেকেই নেবো।রাতে আসা কারণ মামা এই সময়টায় তার জিনিসপাতি নিয়ে বের হোন।দিনে তার অন্য চাকরি।শ্রমিক।’
-‘বুঝলাম।তা আমাকে আনলে কি দোষ হয়ে যেতো?বা ফরহাদ অথবা আপনার বাবা?’
-“ফরহাদ ঘুমায়,বাবা এখনও ফেরননি।আর একা চলার হেবিট আমার আছে’
কথায় কথায় মৃদুল ও কিছু শনপাপড়ি কিনে নিলো।জুথি নিয়েছিল গোটা এক ডিব্বা।
দুজনে এবার হাঁটা ধরেছে।মৃদুলের হাতে ইয়া বড় বড় কয়েকটা ইলিশ দেখে জুথি বললো,’পার্টি দিবেন যখন আমাকে দাওয়াত করবেননা?গার্লস এলাউ না বুঝি?’
-“আসতে পারেন তবে চাঁদা দুইশ পঞ্চাশ টাকা তমালের হাতে দিতে হবে।আমার পকেট ফাঁকা নাহলে আমি পে করে দিতাম’
-“সমস্যা নেই।আমি বিনাপয়সায় দাওয়াতে যাইনা’
মৃদুল একটা প্রশ্ন করবে করবে ভেবেও করতে পারছেনা।শেষে বুক ফুলিয়ে প্রশ্ন করেই ফেললো।
-‘আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?তুমি কি অর্ণবের উপর রাগ করে চলে যাচ্ছো?’
জুথি মৃদুলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,’রাগ?মানুষ কথা দিয়ে কথা রাখেনা, পরিস্থিতি তাকে দেওয়া কথা ভাঙ্গতে বাধ্য করে।এ কথাটা মা বলেছিল আমায়।আমি সে ভয়ে আজ পর্যন্ত প্রেম নামক জগৎয়ে প্রবেশ করিনি।অথচ অর্ণবের সাথে মেশার পর সব কিছু ভুলে গিয়েছিলাম।ভুলে গিয়েছিলাম মা আমাকে কি বলেছিল।এখানে দোষটা আমার।নিজের উপর নিজের বড্ড রাগ হয় এখন।এই রাগ কমাতে চলে যাচ্ছি।কারোর উপর আমার রাগ নেই।সবাই যার যার ভাগ্যের লিখন ফুলফিল করাতে ব্যস্ত ‘
কথাটা বলে জুথি একটা দীর্ঘশ্বাস নিলো।মৃদুল আবার বললো,’কবে ফিরবে?’
-‘জানিনা।যেদিন সব ভুলে যাবো সেদিন।’
-“আর যদি না ভুলো?’
-“তবে আর ফেরা হবেনা এদেশে’
মৃদুল মুখটা বাঁকিয়ে বললো,’আমায় মনে পড়বেনা তোমার?আমার জ্বালাতন মনে পড়বেনা?’
-‘মনে পড়লে একজনের বিরহে সেটা ধামাচাপা পড়ে যাবে’
—-
কুসুম খাটের এক কোণায় ঘুমাচ্ছে।তমাল ভিডিও কল দিয়ে পার্টির আয়োজন লাইভ দেখাচ্ছে অর্ণবকে।সে বসে বসে দেখছে আর ওদের সাথে উঞ্জয় করছে ভিউটা।
হঠাৎ সেখানে জুথিকে দেখে ওর মুখের হাসি চলে গেলো।সাথে মৃদুল ও আছে।তমাল ফোন সোজা করে রেখে গিয়ে মৃদুলের হাত থেকে ইলিশ নিয়ে দৌড় মেরেছে।জুথি একটা চেয়ার টেনে বসলো।মৃদুল ও ওর পাশে বসেছে।অর্ণব মুচকি হাসলো ওদের দুজনকে একসাথে দেখে তারপর ভিডিও কলটা কেটে ফোন রেখে দিয়ে পাশে তাকালো।কুসুম সকাল থেকে একবারও দু চোখের পাতা এক করেনি।
তাই এখন গভীর ঘুমের অতলে।এদিকে সারাদিন একটু একটু করে ঘুমানোর ফলে অর্ণবের চোখে ঘুম নেই।বন্ধুরা সবাই বলেছে কুসুমকে সঙ্গে করে নিয়ে হলেও পার্টিতে আসতে।কিন্তু সে যেতে চায়নি।মেস এখান থেকে দূরে।ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে।রিস্ক নেওয়ার প্রয়োজন নেই।একজন তো বললো কুুসুমকে হোটেলে রেখে চলে আসতে।এটা করা মোটেও সম্ভব না।
হঠাৎ মনে পড়লো কুসুমের রিপোর্টের কথা।
-‘ইশ রে!মেয়েটা মনে হয় রিপোর্ট না নিয়েই ঢাকায় চলে এসেছে।আজ তো রিপোর্ট আসার কথা ছিল।এমন বেখেয়ালি হলে চলে?
জানার দরকার ছিল ওর কি অসুখ।কেন খাওয়ায় অরুচি।
আচ্ছা এক কাজ করবো, সুযোগ পেলে একদিন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো ওকে।’
—–
খুব ভোরে।যখন ঢাকা শহরের পথে এক দুজনকে দেখা যায় ঠিক সেসময়ে কুসুম জানালার গ্রিল মুঠো করে ধরে পাঁচ তলার নিচে চেয়ে গান ধরেছিলো।একা থাকলে সে প্রায়শ নিজের প্রিয় গানগুলো গায়,মনে শান্তি আনে।ভেবে নেয় তার আশেপাশে আপন মানুষের অভাব নেই।
এসময়ে ক্ষীণ গলায় গাইছিল।অর্ণব জেগে যাবে সে ভয়ে।
চুকিয়ে দেব বেচা কেনা
মিটিয়ে দেব গো, মিটিয়ে দেব লেনা দেনা
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে
তারার পানে চেয়ে চেয়ে
নাইবা আমায় ডাকলে
তার এই গানের অন্তরা শুনে অর্ণব জেগে গিয়ে বিছানা ছেড়ে ছুটে এসে দাঁড়ালো কাছে।কুসুম পরের লাইন গাওয়া ধরতেই অর্ণব ওর হাত ধরে টান দিয়ে নিজের দিকে ফিরালো।কুসুম চমকে গিয়েছিল।অর্ণব ব্রু কুঁচকে বললো,’তোমাকে এমন বিরহের গানগুলো কে শিখিয়েছে?আমি আরও কদিন লক্ষ করেছি,যখন তখন একা একা বিরহের গান গুলো গাইতে থাকো।’
-‘কেন আপনার ভালো লাগেনা?’
-“ভাল লাগে তবে এগুলো সবসময় কেন গাইবে?’
-‘আমার গলা সুন্দর না?
-“সকাল সকাল ভূতে ধরেছে তোমায়?এমন আবেগী প্রশ্ন কেন করছো?’
-“আমি তো আজ নতুন বিরহের গান গাইনা।আমি তো রোজ এই গানগুলো একবার করে গাই।সময়ে- অসময়ে।হয়ত দু একদিন আপনি নিজের কানে শুনেছেন।তবে আজ কেন মানা করছেন?’
অর্ণব কুসুমের হাত ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে।কুসুম মুচকি হেসে গ্রিলটা ধরে আবারও নিচে তাকিয়ে রইলো।অর্ণব সোজা ওয়াশরুমে গিয়ে মুখে অনবরত পানির ঝাঁপটা দিয়ে চুল টান দিয়ে ধরে চুপ করে থাকলো।
কুসুমের মুখে অঢেল হাসি।এই হাসির পেছনে লুকিয়ে আছে হাজারটা রহস্য।অথচ সেই সব রহস্যের সূত্র আজ কুসুমের একটা প্রশ্নে খোলসা হয়ে গেলো।যার উত্তর কেবল অর্ণব জানে।কিঞ্চিত কুসুম ও জানে।তবে সে অর্ণবের মুখ থেকে না শোনা অবধি পেশ করবেনা।মুচকি হাসছে কারণ তার ধারণা সত্যি রুপ পেয়েছে আজ এই মূহুর্তে।অর্ণব ভেজা মুখ নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই কুসুম ছুটে এসে নিজের আঁচলটা এগিয়ে ধরলো।অর্ণবের হাতে কোনো উপায় নেই বলে আগের মতন এখনও কুসুমের আঁচলটা টেনে মুখ মুছে নিলো সে।
এরপর বিছানায় বসে ওকে বললো,’ব্যাগের যা যা বের করেছো ওগুলো গুছিয়ে নাও।নাস্তা করে আমরা মৃদুলের বাসায় যাবো’
চলবে♥