#
আফনান লারা
.
অর্ণবের কাড়ি কাড়ি প্রশ্নের একটা জবাব ও কুসুম দিতে পারেনি।বাংলার পাঁচের মতন মুখ করে টেবিলের সাথে কোমড় ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মূর্তির ন্যায়।অর্ণব আশ্চর্য হলোনা।কুসুম প্রায়শই এমন উদ্ভট আচরণ করে।সে ভাবলো হয়তবা বই পেয়ে খুশিতে আত্নহারা হয়ে এখন কি বলবে না বলবে তা বুঝে উঠতে পারছেনা।সে নিচে তোষকের উপর গোল হয়ে বসে পড়ে বললো,’পাতিল এনেছি,চাপাতা,চিনি,মিল্ক পাউডার ও এনেছি। ফটাফট চা বানিয়ে ফেলো।’
কুসুম এবার মুখ খুললো।বললো সে দুধ চা বানাতে জানেনা।বাড়িতে রঙ চা খেতো সবসময়।অর্ণবদের বাড়িতে আসার পর মিশু ভাবী কিংবা মা চা বানিয়ে দিলে সে হাতে করে নিয়ে আসতো অর্ণবের জন্য।যেটা সে অর্ণবের জন্য বানিয়েছিল একবার, সেটা ছিল রঙ চা।
অর্ণব ঘাড় ঘুরিয়ে বললো,’কথা বললে তাহলে।আমি তো ভাবলাম আজ বুঝি কথাই বলবেনা’
—
পাঞ্জাবির হাতা কুনুই অবধি টেনে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকেছে অর্ণব।পাতিল হাতে নিয়ে বললো,’কি ঝামেলা!এটাকে তো মাজতে হবে।ধুর!!!চা ‘ই খাবোনা’
পাতিল রেখে অর্ণব চলে গেলো।
—
কলিংবেলের গুনে গুনে তিনবার আওয়াজ কানে আসায় কাজলের কৌটো ফ্লোরে গুছিয়ে রেখে জাহান ছুটে এসে দরজা খুলে দিলো।কুসুম এসেছে।হাতে একটা স্টিলের বাটি।বাটিটা এগিয়ে ধরে সে বললো,’কিছুটা পাউডার দেবে?হাঁড়ি পাতিল মাজবো’
জাহান কপাল কুঁচকে বললো,’মাজবেন কি দিয়ে?মাজুনি আছে তো?’
-‘থাকলে একটা দাও।না থাকলে হাত দিয়ে চালিয়ে নেবো।’
জাহান বাটি নিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে হুইল পাউডার ঢেলে একটা মাজুনি সহ এনে বললো,’হাত দিয়ে কেমনে করবেন?হাত কাটা না?জামাইরে দেখাইছেন?’
কুসুম জবাব দিলোনা।বাটি নিয়ে চলে আসলো।রান্নাঘরে এসে ভেসিনের কাছে দাঁড়িয়ে বাম হাত দিয়ে আর ডান হাতের হালকা সাহায্যে যতটুকু পারলো চায়ের পাতিলটা মেজে নিলো।ভাল করে পরিষ্কার করে চায়ের পানি বসিয়ে দিয়ে আঁচল দিয়ে আস্তে আস্তে কাটা আঙ্গুলটা মুছে ছুটে গেলো অর্ণবের কাছে।সে তখন কুসুমের বইগুলো উল্টে পাল্টে দেখছিল ভেতরের রুমে। আগের মতন দরজার কিণারা জড়িয়ে ধরে কুসুম দাঁড়িয়ে থেকে এক দৃষ্টিতে অর্ণবকে দেখছিল।অর্ণব খেয়াল করেনি।এক এক করে বইয়ে আঁকা আম,জাম,কাঁঠাল, কলা এসব দেখছে মনযোগ দিয়ে।
-‘বলছি,দুধ চায়ে কি রঙ চায়ের মতন মশলা দিতে হয়?’
অর্ণব বই থেকে চোখ হটিয়ে কুসুমের দিকে তাকিয়ে বললো,’পাতিল মাজা ছাড়া কিসের চা?’
-“মেজেছি’
-“কি করে?’
-“যেমন করে, করে।তেমন করে।’
অর্ণব চট করে বিছানা থেকে নেমে রান্নাঘরে এসে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললো,’ওহ।বুঝলাম।মশলা দিতে হবেনা।পানি গরম হলে চা পাতা দিবে।যত কাপ চা তত কাপ চাপাতা’
কুসুম মাথা নাড়ালো।অর্ণব একটা বাটি নিয়ে বললো,’এটাও মেজে নাও।কাপ কিনতে ভুলে গেছি।বাটিতে চা খাব।আর কত কি যে দেখতে হবে আমায়’
কুসুম বাটিটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।অর্ণব চা পাতার প্যাকেট খুলে ঘ্রাণ নিচ্ছিল।সে না সরলে বাম হাতে মাজবে কি করে?নড়ছেই না।অর্ণব প্যাকেট থেকে নাক উঠিয়ে বললো,’কি হলো?থাক,দাও আমি মাজবো।না জানি আজ তোমার কি হয়েছে।সন্ধ্যায় ছাদে গিয়েছিলে?মাথা পাগল পাগল করে?ঘুরতে ইচ্ছে করে চরকার মতন?লাফাতে ইচ্ছে হয়?’
কুুসুম মাথা নাড়িয়ে না জানালো।অর্ণব ওর থেকে বাটিটা কেড়ে নিয়ে বললো,’ভূতে তো ধরেনি।তাহলে কথা শুনছোনা কেন?এমন ব্যবহারের কারণ কি?’
কুসুম তাও কিছু বললোনা।অর্ণব বাটিটা মাজতে মাজতে বললো,’ভাগ্যিস চামচ কিনেছি।নাহলে আঙ্গুল দিয়ে নাড়তে হতো।
চা বানাতে এত হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।ভাত তরকারি রাঁধতে গিয়ে কি হবে খোদা জানে’
অনেক যুদ্ধ করে চা বানিয়ে বাটি হাতে সেই নিচে বিছানো বিছানায় বসে পড়েছে সে।কুসুম ওর থেকে একটু দূরে বসে দেখছিল ওকে।অর্ণব কপালের ঘাম মুছে চায়ে চুমুক দিয়ে চোখ বুজে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,’রেস্টুরেন্টের চায়ের স্বাদকেও হার মানিয়ে দেবে আমার হাতের এই চা।জাস্ট ওসাম হয়েছে।’
কুসুম মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে।অর্ণব বাটিটা রেখে বললো,’তোমার জন্য দিলে না কেন?’
-“ইচ্ছে নেই।আপনি খান’
অর্ণব আরও দুবার চুমুক দিয়ে বাটিটা ওর দিকে এগিয়ে ধরে বললো,’আমি জানি তুমি এই চা খেতে দ্বিধান্বিত হবেনা কারণ সেদিন ঢাকায় ফিরে আসার আগে আমি পেছনে তাকিয়ে তোমায়, আমার মুখের চা খেতে দেখেছি।
কুসুম লজ্জাবতী পাতার মতন লজ্জা পেয়ে মুখ লুকাতে অন্য দিকে ফিরে বসেছে।অর্ণব বাটিটা নিচে রেখে উঠে চলে গেলো।ও যাবার পরপরই কুুসম ব্যস্ত হয়ে চায়ের বাটিটা হাতে নিলো যেন সে এটারই অপেক্ষায় ছিল এতক্ষণ।
হাসিমুখে চায়ে চুমুক ও দিলো সে।অর্ণব দূর থেকে এই দৃশ্য দেখেছে।
—
বাটিটা আর পাতিল ভেসিনের কাছে এনে রেখে কুসুম শাড়ীর আঁচল কোমড়ে গুজছিল এগুলো ধুবে বলে। সেসময়ে অর্ণবের ডাক শুনতে পেয়ে ওসব রেখে ছুটে গেলো ওখানে।
-‘আমার সামনে এসে বোসো’
-‘কেন?পড়াবেন এখন?তার আগে আমি বাটি আর পাতিলটা ধুয়ে আসি?’
-“নাহ।বসতে বলেছি তোমায়।ত্যাড়ামো করো কেন?’
কুসুম এগিয়ে এসে বিছানায় বসলো।অর্ণব ওর দিকে শক্ত চোখে তাকিয়ে ছিল।ও বসার পর খপ করে ডান হাতটা টেনে ধরলো ওর।কুসুম ভয় পেয়ে বাম হাতে মুখ ধরেছে।
-‘তোমার আঙ্গুলে এমন হলো কি করে?আমাকে বললে কি তোমায় চিবিয়ে খেয়ে নিতাম?’
-“নাহ।ও কিছুনা’
-“এটা কিছুনা?বারবার শাড়ীর যে অংশে আঙ্গুল ঢাকছিলে সে অংশে রক্তের লাল রঙ দেখেছি আমি।হলুদ শাড়ী পরেছো কিনা!!”
কথাটা বলেই অর্ণব চলে গেলো।কুসুম শাড়ীর আঁচল টেনে দেখে নিজের কপালে নিজে চড় মারলো।অর্ণব বাসার পাশের একটা দোকান থেকে মলম কিনে এনেছে।কুসুম ভাবছিল হঠাৎ কই গেছে সে।মলম নিয়ে এসে ওর হাতে সুন্দরমতন লাগিয়ে দিতে দিতে অর্ণব বললো,’আমি আরও ভাবলাম ভূতে বুঝি মুখের বুলি কেড়ে নিলো তোমার।এখন দেখি কাহিনী অন্য।আর কখনও এমন করবেনা।ব্যাথা পেলে জানাবে,আমি ঠিক করে দেবো।তুমি জানো এটাতে মলম না দিলে পঁচে ইনফেকশান হয়ে যেতো?’
-‘আচ্ছা,একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’
-‘না’
-“করি না!’
-“হুম শুনছি।বলো’
-‘আপনি আমাকে তালাক দিবেন কখনও?’
অর্ণব চোখ বড় করে তাকালো কুসুমের দিকে তারপর মলমের সাথে আনা সাদা কাপড় দিয়ে আঙ্গুল বাঁধতে বাঁধতে বললো,’তালাক শব্দটা কে ঢুকিয়েছে তোমার মাথায়?’
-“এটা তো দূর্বল সম্পর্কের পরিবারে চিরাচরিত ‘
-‘নাহ।এটা চিরাচরিত নয়।আমি যতদূর জানি তোমার মাথায় যে শব্দ নাই সে শব্দের ব্যাপারে তুমি জানো না,বুঝোনা।তাহলে তালাকের ব্যাপারে কে বলেছে তোমায়?’
-“কেউনা।উত্তর তো দিবেন’
-“তালাক দেওয়ার মতন কাজ করলে নিশ্চয় দেবো’
কুসুম উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে।ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থেকে বললো,’আমি তো নিজ থেকে পড়তে পারবোনা।তাহলে? ‘
-“পড়ার সঙ্গে তালাকের কি সম্পর্ক?এই তোমাকে সত্যি ভূতে ধরেছে?নাকি হাতের ব্যাথায় মরিয়া হয়ে উঠতেছো?কোনটা?’
-‘আপনি তো বললেন তালাক দেওয়ার মতন কাজ করলে তালাক দিবেন’
-“তুমি আারেক ছেলের সাথে ভেগে যাবে?’
কুসুম জিভে কামড় দিয়ে বললো,’না! তা কেন করবো?’
-“তাহলে আর কিছু বলবেনা এটা নিয়ে।চুপচাপ বসে থাকো।বই এনেছি বই দেখো।বই না পড়ে বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেও জ্ঞান বাড়ে’
-‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
-“যেগুলো ধুতে এত কান্ড।সেগুলো ধুবো।তোমাকে কি বললাম?’
কুসুম দ্রুত গতিতে বিছানায় বসে বই দেখা শুরু করে দিলো।অর্ণব রান্নাঘরের দিকে গেছে।নতুন বাতির আলোয় বইগুলো কি সুন্দর দেখায়।প্রতিটা পাতায় হাত বুলিয়ে দেখে কুসুম।
সেগুলোর ঘ্রাণ প্রাণভরে নিলো।অক্ষরগুলোতেও হাত বুলালো।এক দারুণ ভাল লাগা কাজ করছে।
-‘আমিও পড়তে জানবো।লিখতে পারবো।উনিও আমাকে পছন্দ করবেন।আচ্ছা তখন কেন বললেন আমি আরেক জনের সাথে ভেগে যাব?তিনি কি জানেননা আমি তার জন্য কত পাগল?এটা আবার প্রমাণ করতে হবে নাকি।এটা তো তার জানার কথা।শুধু শুধু কথাটা বলে কষ্ট দিলেন।
কিন্তু একটু ভাল লাগলো যে উনি অন্তত আমার লেখাপড়া নিয়ে অসন্তুষ্ট নন।আমার জীবন সুরমা আপুর মতন হবেনা।
ভিন্নতর হবে।’
হঠাৎ বেজে উঠলো কুসুমের ফোন।এত কিছুর মাঝে ফোনের কথা ভুলেই গিয়েছিল সে।বালিশের তলা থেকে বের করে কানে ধরলো।অর্ণবের মা ফোন করেছেন। সালাম দিয়ে কুসুম জিজ্ঞেস করলো তিনি কেমন আছেন।
তিনি সালাম নিয়ে অর্ণবের কথা জিজ্ঞেস করে শেষে বললেন,”তোমাকে আদর যত্ন করে?’
কুসুম আঙ্গুল উল্টে পাল্টে বললো,’হুম।উনি অনেক ভাল মানুষ।’
-“নিজের খেয়াল রেখো।অর্ণবের খেয়াল সে নিজেই রাখতে জানে।তোমার জন্য চিন্তা হয়।বাচ্চা মেয়ে একা একা সংসারে নেমেছো।রান্না তো ঠিকমত পারবেনা।না পারলে বলিও।অর্ণব দেখিয়ে দেবে।নিজে পাকামো করিওনা।
পাকামোর জিনিস মন্দ হয়।বুঝলে?’
কুসুম আচ্ছা বলে ফোন রাখলো। অর্ণব হাত ঝাড়তে ঝাড়তে আসছিল এদিকে।সে ছুটে গিয়ে গামছাটা খুঁজে এনে ওর সামনে এগিয়ে ধরেছে।
চলবে♥
জয়েন হোন আমাদের নতুন গ্রুপে
https://www.facebook.com/groups/676436250036874/