#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৮৭,৮৮
আফনান লারা
৮৭
‘আপনি না বলেছিলেন বৃষ্টিতে ভিজবেন।তবে এখানে কেন আবার?’
‘কেউ দেখলে লজ্জায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে থাকতে হবে,বুঝলে।তোমার তো এখনও সেই জ্ঞান হয় নাই’
‘বৃষ্টিতে ভিজতে দেখা দারুণ ব্যাপার।আমাদের সেই দারুণ ব্যাপার অন্য কেউ দেখলে তাতে ক্ষতি কোথায়?’
‘ঐ যে বললাম সে জ্ঞান তোমার এখনও হয়নি,আমার পরিবার যে নিরামিষ টাইপের,আমার মনে হয়না বারান্দায় এসে দাঁড়াবে বৃষ্টি দেখবে বলে।চলো তবে বৃষ্টিতে ভেজা যাক’
কথাটা বলে সে কুসুমকে টান দিয়ে বাগানের মাঝে নিয়ে আসলো।ওর হাত ছেড়ে আকাশের দিকে চেয়ে বললো,’জীবন তো একটাই,কোনো কিছু বাদ রাখা যাবেনা।সবকিছু করে দেখে নিতে হবে’
বৃষ্টি পড়ার পরিমাণ বেড়ে গেছে অনেক।কুসুম মাথায় হাত দিয়ে হাসতে হাসতে সবুজ ঘাসের উপর বসে পড়ে।অর্ণব ওর দেখাদেখি নিজেও বসলো।আসলেই খুব মনকাড়া একটা মূহুর্ত।কখনও বৃষ্টির সময় ঘাসে বসে দেখা হয়নি।এখন মনে হয় এর চেয়ে সুখকর আর কি হতে পারে।এত ভাল কেন লাগে??
কুসুম হাসি আটকাতে পারছেনা।শুধু হেসেই চলেছে।অর্ণব ওর হাসি দেখে নিজের হাসিটাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি,সেও খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো আনন্দে।
কুসুম কাদা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ হাত বাড়িয়ে অর্ণবের সারামুখে ডলে দিয়ে এক ছুট লাগিয়েছে।কিন্তু আফসোস! পিছলে কাদা মাটিতে নিজেই ধপাস করে পড়ে গেছে কিছুদূর যেতেই।এদিকে অর্ণব কাদা মাটি এক মুঠোর মতন নিয়ে এগিয়ে এসে ওকে ঝাপটে ধরে লাগিয়ে দিলো তার সারা মুখে, সারা গায়ে।
বৃষ্টির আওয়াজে ওর চিৎকার চেঁচামেচি কেউ শুনতে পায়নি।
‘কেমন লাগে এখন?আমি একটু লাগিয়েছিলাম আর আপনি পুরা সারা শরীরে কাদা মাখিয়ে দিলেন?এটা ঠিক করেননি।’
‘সবাই দেখলে বলবে পড়ে গেছিলে’
‘পড়ে গেলে এমন লেপটে লেপটে কাদা লাগে?সবাই কি বাবু যে কথা বুঝবেনা?’
—-
বাসায় এসে মৃদুল জ্বালাবে বলে জুথি আজ তার এক বান্ধবীর বাসায় বেড়াতে এসেছে।মণিতার বাসায়।মণিতা ওকে রেখে টইটই করে ঘুরে বেড়াচ্ছে সারা বাসায়,কিসব রান্না করছে।তার বাসায় তার মা- বাবা আর বড় ভাইয়া থাকে।কিন্তু তারা সবাই যার যার অফিসে এখন।বাসায় মণিতা একা।সারাদিন একা থাকা হয় না,ছোটখাটো একটা জব করে সে।
আজ শুক্রবার বলে অফিস ও বন্ধ।এই সুযোগ জুথি হাত ছাড়া করেনি।শান্তিতে মণিতার বিছানায় বালিশ জড়িয়ে ঘুম দিয়েছে।
কলিংবেল বাজার আওয়াজ পেয়ে মণিতা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখলো মৃদুলকে।
মণিটা আর জুথি দুই বান্ধুবী হলেও পড়েছে আলাদা ভার্সিটিতে, যার কারণে সে মৃদুলকে চেনে নাই।
‘কাকে চাই?’
‘জুথি আপনার বাসায়?’
‘হুম।আপনি কে?ওকে চিনেন কিভাবে?’
‘ওর উড বি হাসবেন্ড আমি।এইবার ভিতরে আসতে বলবেন নাকি বাহিরে থেকে বিয়ের কার্ড কোন কারখানায় ছাপা হয়েছে সেটারও ডিটেইলস জানতে চাইবেন?’
মণিতা লজ্জিত হয়ে ওকে ভেতরে আসতে বললো।মৃদুল সোফায় বসে সেন্টার টেবিলের উপর থেকে একটা ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে বললো,’মহারাণীকে ডাকুন,একটু মুখ দর্শন করি তার’
‘সে তো ঘুমাচ্ছে।আচ্ছা আপনার কথা তো জুথি আমায় বললোনা কখনও,আপনি কে আসলে?’
‘বলবে বলবে।কফি খাওয়াবেন না??নিজের বান্ধুবীর হবু বরকে মানুষ এত প্রশ্ন করে?আচ্ছা আপনি কফি নিয়ে আসুব,আমি আমার বউয়ের ঘুম তাড়াচ্ছি,সে নাহয় পরিচয়টা দেবে’
কথাটা বলে সে সোজা চলে গেলো সামনের রুম গুলোর দিকে।দরজা খোলা ছিল বলে জুথিকে দেখলো রুমে উঁকি মারতেই।সে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমে কাতর।
—-
মিশু ভাবী দরজা খুলে দেখলেন কাদা মাখামাখি করে দুই ভূত এসে দাঁড়িয়েছে দরজার ওপারে।অর্ণবকে দেখে চিনতে পারলেও কুসুমকে চিনতে কষ্ট হলো।সে বেশি মাখো মাখো হয়ে গেছে কাদায়।
হাসতে হাসতে ভাবী সাগর ভাইয়াকে ডাকতে চাইলেন সেসময়ে অর্ণব তাঁকে থামিয়ে বললো যেন না ডাকে।
এরপর দুজনে চুপিচুপি রুমে চলে আসলো।কুসুম মাথার চুল থেকে কাদা হাত দিয়ে ঘঁষতে ঘঁষতে বাথরুমে গেছে।ঢুকে দরজা লাগানোর আগ মূহুর্তে অর্ণবও এক দৌড়ে ওর সাথে বাথরুমে ঢুকে গেলো।
‘আপনি এখানে কেন?’
‘সাগর ভাইয়া আমাকে ডাকতে আসতেছে এদিকে।এই হালে দেখলে এক ঘন্টা ধরে হাসবে’
এদিকে সাগর ভাইয়া ওদের বিছানায় বসে অর্ণবের অপেক্ষা করছেন
কুসুম আর অর্ণব দুজনে চোরের মতন দাঁড়িয়ে আছে ভেতরে।
কুসুম মোড়া একটা টেনে সেটাতে বসে আঁচল বালতির পানিতে ভিজিয়ে মুখ থেকে কাদা তুলছিল।অর্ণব দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দেখছে সেসব।
সাগর ভাইয়া এইবার মিশু ভাবীকে নিয়ে বাদাম খাচ্ছে আর ওদের নিয়ে কথা বলছে ওখানে বসে বসেই।মানে তারা এখান থেকে যাবেই না বলে ঠিক করেছে।তারা জানেও না এই বাথরুমে সেই দুইজন একসাথে যাদের নিয়ে তারা আলাপ করছে এখন।
অর্ণব গাল ফুলিয়ে ঝর্না ছেড়ে দিলো।কুসুম একটু দূরে গিয়ে বসে হাত থেকে কাদা তুলছে এবার।কি কাদা এগুলো কে জানে।অল্প সময়েই শুকিয়ে গেছে।উঠছেও না।
অর্ণব দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে ঝর্ণার পানিতে ভিজছে।কুসুম গাল থেকে কাদা তুলে নিয়ে ওর দিকে ফিরে বললো,’এত যে ভিজছেন আজ আপনার কত জ্বর আসতে পারে সে বিষয়ে জানেন?’
‘জ্বর হবেনা।রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি আমার।তুমি নিজেরটা ভাবো’
কুসুম উঠে বললো,’আমার তো এখন গোসল করতে হবে।আপনি না বের হলে কেমন করে গোসল করবো?কি দরকার ছিল এখানে ঢুকে পড়ার?বারান্দার দিকেও তো গিয়ে লুকাতে পারতেন’
‘বারান্দার দরজা আটকানো ছিল,ওটা খুলতে খুলতে ভাইয়া এসে পড়তো’
ওদিকে রুমে এবার বাবা মায়ের ও কথা শোনা যাচ্ছিল।অর্ণব মাথায় হাত দিয়ে কুসুমের থেকে মোড়াটা কেড়ে সেটাতে বসে পড়েছে।কুসুম দরজার কাছে গিয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করছে সবাই কি বলে।
অর্ণব বসে বসে মগ দিয়ে পানি নিয়ে মাথায় ঢেলে মাথা ঠাণ্ডা করার চেষ্টা চালায়।
কুসুম ঝর্নার কাছে এসে ঝর্ণাটাকে আবার ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।যেন এক বন্দি জীবন,অথচ কিসের এক ভাললাগা গায়ে এসে হেসে খেলে যায়।
যেন এক সুন্দর মূহুর্ত তাদের সামনে অথচ তারা সেটাকে উপভোগ করার উপায় জানেনা।সত্যি তাই!
অর্ণব ভেজা চুল চিপে চিপে পানি টেনে নিলো মাথা থেকে।তারপর হাঁচি একটা দিয়ে গায়ের পাঞ্জাবিটা খুলে ফ্লোরে রেখে বললো,’আমার হাঁচি কি জোরে শোনা গেলো?’
‘নাহ,আমি তো আওয়াজই শুনে ভাবলাম কি যেন বললেন,ওটা হাঁচি ছিল আসলে?’
অর্ণব এবার হাত দিয়ে গায়ের থেকে পানি ঝরানোর বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে।কিন্তু কুসুম তো আর ওর মতন করতে পারবেনা।ঝর্ণা অফ করেছে,তার গোসল ও শেষ কিন্তু ভেজা শরীরে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে।তাড়াহুড়োতে শুকনো শাড়ী নেওয়া হয়নি।
বাহিরে থেকে সবার হট্টগোল কমে গেলো মনে হয়।আওয়াজ নেই বললেই চলে।তাই সে লুকিয়ে দরজাটা একটু খুললো।কেউ নেই দেখে বেরিয়েও পড়েছে।অর্ণব ওকে বেরুতে দেখো সেও দরজার কাছে গেলো দেখতে,যদিও এখনও বের হয়নি।
বিছানা থেকে গামছাটা নিয়ে কুসুম পেছনে তাকাতেই দেখলো সবাই একসাথ হয়ে এদিকেই আসতেছে আবার।
আজ ওরা এই রুমটাকে আড্ডাঘর বানিয়ে তুলবে মনে হয়।কুসুম এক ছুটে আবার বাথরুমে ঢুকে পড়েছে,সঙ্গে সঙ্গে অর্ণবের সাথে খেলো জোরেশোরে এক ধাক্কা।
‘আরে কি হলো আবার!বুকে ব্যাথা পেলাম,হাঁড় মনে হয় নড়ে গেছে,এমন করতেসো কেন?’
‘আবার সবাই আসছে দেখেই তো দৌড় দিলাম,আচ্ছা আপনি ও বলিহারি! আমি বের হলাম সাথে সাথে বের হতে পারলেন না?তবে তো আর একসাথে বন্দি হয়ে এখন থাকতে হতো না আবার’
‘আমি তো বের হতেই যাচ্ছিলাম,তুমিই তো ঝড়ের গতিতে আবার ঢুকে পড়লে।সব দোষ এখন আনার?’
কুসুম গাল ফুলিয়ে গামছা গায়ে জড়িয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে কোনো কথা না বলে।অর্ণব নিজের গায়ে ফু দিয়ে পানি শুকানোর চেষ্টা করছে আগের মতন।ওর এই কাজে হাসি পেলো কুসুমের কিন্তু কিছু বললোনা।কিছু বললে দেখা গেলো ওর গায়ের থেকে গামছাটা কেড়ে নিয়ে যাবে সে।
—-
গালের নিচে কারোর নরম হাতের স্পর্শ পেয়ে জুথি মুচকি হেসে বললো,’মণিতা সুড়সুড়ি কেন দিচ্ছিস?হাত সরা!কাতুকুতু লাগে আমার,’
সুড়সুড়ির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় জুথি বাধ্য হয়ে চোখ খুললো।খুলে দেখলো মৃদুল ওর হাত গোল করে চেয়ে আছে।এতক্ষণ হাত দিয়ে ওর গালে সুড়সুড়ি দিচ্ছিল সে।মৃদুলের হাত নরম এটা জুথি জানতোনা,ছেলেদের হাত শক্ত হয় এটা সে জানে,কিন্তু কিছু কিছু ছেলের হাত যে এতটা নরম হয় এটা সে জানতোনা বলেই গুলিয়ে ফেলেছিল।হন্তদন্ত হয়ে পিছিয়ে যাওয়া ধরতেই খাটের স্ট্যান্ডের সঙ্গে ধুরুম করে বাড়ি খেয়ে তার ঘুমের রেশ একেবারে কেটে গেলো।বলতে গেলে বাপ বাপ করে পালালো।
‘আরে আরে এত ভয় পাও কেন,আমি মৃদুল,তোমার হাসবেন্ড!😂’
‘আপনি এখানে কি করে!’
‘তোমার ভাই ফরহাদকে ক্রিকেট ব্যাট কিনে দিয়েছি,বাজারে দেখা হয়েছিল।ওই তো আমাকে মণিতার চৌদ্দ গুষ্টির ঠিকানা দিয়ে দিলো।হেহে!যেখানেই লুকিয়ে থাকবেনা কেন,আমি তোমার আশেপাশে রয়ে যাবো সারাটাজীবন ‘
‘সরুন সামনে থেকে’
‘উহু!আজ আমি এখানেই থাকবো।যতক্ষণ না তুমি বেরুবে ততক্ষণ, এরপর বাসা থেকে বের হলে তুমি যেখানেই যাবে আমিও সেখানে যাব’
চলবে♥
#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৮৮
আফনান লারা
.
রুম খালি হতে প্রায় আরও দশ বারো মিনিটের মতন সময় লেগে গেলো।তাও তারা বের হতে পেরে বিরাট খুশি।
বাথরুমের ঠাণ্ডা পানি আর বৃষ্টির পানি এক হয়ে অর্ণবের জ্বর বেড়ে যাওয়ার বদলে একেবারে উধাও হয়ে গেছে।
তাতে সে খুশি বরং এমন ভাব করলো যেন আগে থেকেই জানতো।ওদিকে কুসুম হাঁচি দু একটা দেবার পর সেও ভারী সুস্থ।মাথা যন্ত্রনা আলাদা অসুখ।জ্বর হয়নি এই ভেবে সে খুশি।
সাগর ভাইয়া জানতে চাইলেন এতটা সময় অর্ণব কোথায় ছিল,কারণ কুসুম তো বাথরুমে গেছে এটা তারা আন্দাজ করেছে। অর্ণব কোথায় গেলো তবে?
অর্ণব বললো সে বাগানে ছিল।এই ডাহা মিথ্যেটা ভাইয়া কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইলেন না।অর্ণব তার কথার নড়চড় করেনি তাই তিনি মেনে নিলেন শেষে।
আজকের দিনটা ভালমন্দ নিয়ে ভালোই কেটে যাচ্ছে।
সাগর ভাইয়া বললো এখানে পাশেই নাকি একটা রেস্টুরেন্টে শর্মা পওয়া যায়,একেবারে নামকরা।সবাইকে ট্রিট দিতে নিয়ে যাবেন এটাও বলেছে।বৃষ্টি থেমে হঠাৎ সূর্যর মুখ ও দেখা যাচ্ছিলো।ওর এই প্রস্তাবে সকলে রাজি হয়েছে সে জন্য।কুসুম তো তৈরিও হওয়া ধরেছে।
এরই মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়ালো অর্ণব।সে সবাইকে বুঝাতে চাইলো কুসুমের শরীর খারাপ,সে যেতে পারবেনা।আর সে তো একা।তাকে একা রেখে ও কি করে যাবে।তাই তারা দুজন বরং থেকে যাবে।বাকিরা যেতে চাইলে যাক।
কুসুম ওর কানে ফিসফিস করে বললো ‘এটা কখন বললাম?আমার তো যেতে ইচ্ছে করে’
‘চুপ থাকো।এত যেতে হবেনা।আমি তোমায় বাসায় ট্রিট দিব।’
কুসুমের অসুখের নতুন করে ব্যাখ্যা কাউকেই দিতে হবেনা।সবাই অর্ণবের কথা সুরসুরিয়ে মেনে নিয়েছেন।বাসা ফাঁকা করে বিকেল চার টার দিকে সকলে চলে গেছে ঐ রেস্টুরেন্টের দিকে।
এর কারণে কুসুম তখন থেকে গাল ফুলিয়ে বসে আছে বারান্দার শেষ সীমানায়।
অর্ণব বাহিরে গিয়ে অনেক খুঁজেও হাওয়াই মিঠাই পেলোনা।কোনো রকমে দশ টাকার বাদাম ভাজা হাতে ফিরেছে।দরজা লাগাতে না লাগাতেই মেঘে ডাক দিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো।
আজ সারাদিন বৃষ্টি হবে নাকি?
কুসুমের পাশে হাতের তালুতে বাদাম ধরে সে মুখে হাসি ফোটালো।কুসুম ভেংচি কেটে অন্য দিকে ফিরে গেছে।
‘খাবেনা তুমি?’
‘উহু’
অর্ণব গোল হয়ে বসে নিজেই খাচ্ছে এবার।ওর খাওয়ার শব্দ কানে আসতেই কুসুম মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে বললো ‘বললেন না, কেন আমাকে যেতে দিলেন না?আমি তো বেশ সুস্থ আছি,তবে কেন আমায় যেতে দিলেন না?আমার কি ইচ্ছা করেনা সবার সাথে ঘুরতে যেতে?শুধু যে খেতে যাব সেটা তো নয়।সাগর ভাইয়া আরও একটা জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যেতো।তাহলে কেন আমায় আটকে রাখলেন?’
‘কারণ সেসবের চেয়ে সুন্দর কিছু মূহুর্ত আমি তোমায় উপহার দেবো’
কুসুম কৌতুহল নিয়ে একটু এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে রইলো।অর্ণব ঠোঁট এগিয়ে ওর কপালে চুমু এঁকে বললো,’সুন্দর লাগে?’
‘ভীষণ’
‘বয়স কত তোমার?’
‘জানিনা’
‘জানতে হবেনা।চলো যাই’
‘কোথায়?’
‘ছাদে’
‘শেয়াল?’
‘আসতে আধ ঘন্টা দেরি।ততক্ষণ ছাদে ভিজবো।আবারও ভিজবো।আজ আমরা শুধুই ভিজবো।একদিনে জীবনের সব প্রেম উজাড় করে বিলাবো আমি,সঙ্গী হবে তুমি।স্বাক্ষী হিসেবে থেকে যাবে ইতিহাসে।বলো যাবেনা?’
‘যাব।’
অর্ণবের হাতের কব্জি ধরে কুসুম ছাদে এসেছে।
ছাদ ফাঁকা।সেই শেয়ালগুলো নেই কারণ ওদের আসার সময় না এটা,তবে খুব বেশি দেরি নেই।খুব শীঘ্রই তাদের দেখতে পাওয়া যাবে।
কুসুম রেলিংয়ে হাত রেখে আবার হাতটা সরিয়ে নিলো,বৃষ্টির পানি পড়ে কেমন স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে।
‘দেখুন ছাদ থেকে জবা গাছটা কি সুন্দর দেখায়’
অর্ণবের সাড়া আসছেনা দেখে কুসুম পেছনে তাকালো।
ওমা সে সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে।কুসুম একটু পিছিয়ে গিয়ে বললো,’কি হলো?’
‘ডিস্টার্ব করো না তো।আমার অনেক আগ থেকে ইচ্ছে ছিল বিয়ের পর কোনো এক বৃষ্টির দিনে ছাদে বউকে এনে ওর পায়ে পায়েল পরিয়ে দেবো। পা বাড়াও সুন্দর করে।’
কুসুম পা বাড়িয়ে ওর দিকে অবাক চোখে চেয়ে আছে।সে যে সঠিক একটা মানুষকে প্রাণপণে ভালবেসেছে আজ সেটা মনে করে গর্ব বোধ হলো।অর্ণব পায়েল পরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দুষ্টু করে খানিক হেসে কুসুমের হাত টান দিয়ে ওকে একটু কাছে নিয়ে এসে বললো,’ভালবাসা উড়ন্ত মেঘের মতন বুঝলে?
কেউ জানেনানা ঐ মেঘটা কোন জায়গায় গিয়ে থামবে আর গায়ের সব ভালবাসা ঝরাবে সেই জায়গার মাটিতে।
আমি কবে জানতাম তোমার মতন একটা মেয়েকে এত ভালবেসে ফেলবো?একেবারে দম বন্ধ হবার মতন অবস্থা হয়ে দাঁড়াবে প্রতিবার?’
কুসুমকে আরেকটু টেনে এনে গায়ের সাথে লাগিয়ে ধরে হাসিটাকে ঘাড়ো করে সে আবার বললো,’ভাবো তোমার কিছু হলে আমার দমটা একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে।তারপর মৃত্যু’
কুসুম অর্ণবকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে পিছিয়ে বললো,’একজন মরলে আরেকজনকে মরতে হবে?আপনার জীবন সুন্দর,আমার মতো অসুস্থতার বালাই নেই।খুব সুন্দর হবে আপনার জীবন সামনের দিকে।দেখে নিয়েন,মিলিয়ে নিয়েন।কোনো একটা সময়ে হয়ত আমার কথা মনে পড়বে আপনার,তখন কষ্ট পাবেন।কিন্তু সবসময় কষ্ট পাবেন না।কিংবা মনে পড়বেনা, কারণ আপনি আপনার মতন একজন জীবনসঙ্গী পেয়ে যাবেন। আমার অনেক অনেক দোয়া আছে।আমি চাই আপনার মুখে সর্বদা এই সুন্দর হাসিটা লেগে থাকুক’
অর্ণব বৃষ্টির মধ্যেও হাত দিয়ে চোখ মুছলো।কাঁদো স্বরে বললো,’আমার এই হাসিটা আসার কারখানার নাম কুসুম।কুসুম না থাকলে এই কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে।সিল মেরে।
এটা মানুষের মনের কারখানা,যে কেউ কিনে নিয়ে মালিকানা দখল করতে পারবেনা।সেই জ্ঞান তোমার হয়নি কুসুম’
কুসুম তাচ্ছিল্য করে হেসে বললো,’শিক্ষার জ্ঞান হয়ত হয়নি,কিন্তু আমি ওতোটাও ছোট না যে ভালোবাসা কি সেটা জানিনা।আমি আপনাকে ভালবেসেছি তবে আমি জানবোনা এ ব্যাপারে?’
‘নিশ্চয় জানো তবে এটাও জেনে নেওয়া উচিত প্রথম ভালবাসা যারে বাসা হয় এই ভালবাসা ২য় জন কোনোদিন পায় না।আর আমার জীবনে আগে জুথি আসলেও ভালোবেসেছিলাম কেবল তোমায়,জুথিকে না।
হয়ত জুথি আমায় ভালবেসেছিল কিন্তু আমি বাসিনি।আমি বাসলে সেটা তোমায়,এখন!!শুরুতেও না।’
‘আপনি কাঁদছেন কেন?আমি কান্নার মতন কি বললাম?’
‘তুমি কেন বলবে আমি তোমার পরে অন্য কাউকে মেনে নিতাম?এটা বলার অধিকার তোমার নেই!আমার জীবন,আমার ইচ্ছে আমি কি করবো না করবো!তোমার সাথের বিয়েটাি কেউ জোর করে দেয়নি।আমি নিজের ইচ্ছেতে করেছিলাম এবং আমার নিজের ইচ্ছেতেই আমার এই জীবনটা চলবে।তোমার কোনো অধিকার নেই ভবিষ্যত বাণী দেওয়ার।সেই অধিকার আমি তোমায় দেইনি’
‘কোন অধিকার দিলেন তবে?’
অর্ণব কিছু বলতে পারলোনা।চলো গেলো চিলেকোঠার দিকে।কুসুম ওর পিছু পিছু এসে দেখলে নিচে সিঁড়িতে বসে আছে ও
তাই কুসুম ও ওর পাশে এসে বসলো।তারপর পরিস্থিতি ঘুরাতে বললো ‘আচ্ছা আমার নাম কি যেন?’
‘লীলাবালি’
‘আমি দেখতে কিরকম,মানে ধরুন বেশ?’
‘লাল শাড়ী,লাল চুড়ি,খোলা চুল আর একটা জবা কানে গুজা।কিন্তু কেন জিজ্ঞেস করতেছো?’
‘লীলাবালি আপনার কে হয়?’
‘আমার সব হয়’
‘তার দাপট কিরকম একটু বলবেন?’
‘তার দাপট সে আমার সবটা জুড়ে আছে।আমি পুরোটাই তার।এটাই তার একমাত্র দাপট’
কুসুম মুচকি হেসে নেমে গেলো সিঁড়ি বেয়ে।অর্ণব কিছুই বুঝলোনা।কিছু সময় সিঁড়িতেই বসে থাকলো।হঠাৎ ছাদ থেকে শেয়ালের ডাক শুনে তড়িগড়ি করে বাসার দিকে ছুটে গেছে।এখানে আর থাকা যাবেনা।
দরজা খোলাই ছিল।ভেতরে ঢুকে দরজাটা আটকে কুসুমের নাম ধরে ডেকে টেবিলের উপর থেকে পানি নিয়ে খেলো সে।কুসুম রুম থেকে বললো,’আসছি!!”
তাই অর্ণব ড্রয়িং রুমের বারান্দা থেকে একবার ঘুরে আসলো।এরপরেও ও আসছেনা দেখে সে নিজেই গেলো দেখতে।
চুল ছেড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল কুসুম।রুমের চলো জ্বালাতেই নজরে আসলে লাল থান কাপড় পরা সেই মেয়েটি যে অর্ণবের লীলাবালি হবার যোগ্যতা বহন করে।
ঠিক সেরকম সেজেছে যেমনটা অর্ণব তাকে জানিয়েছিল।
কুসুম ওর দিকে ফিরে আয়নার সাথে হেলান দিয়ে বললো,’আমার দাপট দেখাবো?’
‘দেখাও।দেখতে চাই’
অর্ণবের কথা শুনে কুসুম মিটমিট করে হাসছে।বলে তো দিলো।কিন্তু এটা পূরণ করবে কে?
ওর কদম ফেলার আগেই অর্ণব এগিয়ে এসে ওর কোঁকড়া চুলগুলোতে হাত লাগিয়ে বললো,’তোমায় কে বলে নিজে নিজে সাজতে?তোমার নিজের করা সাজ আমার সারা শরীরে নেশা জাগিয়ে দেয়।ভাবীর কাছে সাজতে পারলেনা?’
‘আমি সেই নেশা ধরাতেই নিজে সেজেছি জানেন?’
‘ঠিক করোনি’
কথাটা বলে অর্ণব ও ওর সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,’উমমমমমম্ বয়স কম তোমার’
‘তো?’
‘তো এত পাকনামো ঠিকনা তোমার’
‘তবে কি সাজ খুলে ফেলবো?’
‘এমন ভাবে বলছে যেন হীরা যহরত পরে দাঁড়িয়ে আছে।সামান্য বালাটাও পরোনি।’
‘তারপরেও তো আমার সাজ আপনার নেশা জাগিয়ে দিলো।ওরকম সাজলে এই নেশা তো কি ছাড়িয়ে যেতো সেটাই ভাবছি আমি’
‘শোনো সাজ খুলে ফেলো।ভাইয়া ভাবী দেখলে ভীষণ লজ্জা পাবো।আমি অনেক লাজুক জানোই তো’
কুসুম রেগে গিয়ে জবা ফুলটা কানের থেকে নিয়ে অর্ণবের মুখের দিকে ছুঁড়ে মেরে বললো,’ফোন এসেছিল সাগর ভাইয়ার,বাসার নাম্বারে।ওনারা নাকি বৃষ্টির কারণে আটকে আছেন।বৃষ্টি থামা পর্যন্ত আসতে পারবেন না’
‘সত্যি?’
‘হ্যাঁ’
অর্ণব ফুলটা আবারও ওর কানে লাগিয়ে দিয়ে বললো,’থাক সাজ নষ্ট করতে হবেনা,এমনই থাকো।আমি তোমায় দেখি আর নেশাখোর হয়ে যাই।’
কুসুম ওর কথায় হেসে ফেললো,মূহুর্তেই তার কাড়ি কাড়ি রাগ গায়েব।মুখে হাত দিয়ে হাসি থামিয়ে বিছানায় গিয়ে গোল হয়ে বসে পড়েছে সে।অর্ণব চাইছে ওকে নিজের সবটা দিয়ে ভালবাসতে কিন্তু নানারকম দ্বিধা এসে বাধা দিচ্ছে।হাজারটা প্রশ্ন মাথার ভেতর ঘুরপাক খেয়ে যায়।
এই মন বলে ওর হাতটা ধরে ওর ঠোঁটে প্রাণ ফিরিয়ে দিতে তো এই মন বলে এসবের সময় এখন না।
কুসুম কান থেকে ফুলটা খুলে নিয়ে দেখছে মনযোগ দিয়ে।অর্ণব হাত মুঠো করছে তো আবার খুলছে।
হঠাৎ গায়ে ফুঁ দিয়ে রুম থেকেই বেরিয়ে গেলো।প্রচুর সাহস প্রয়োজন।
‘বুকের ধুকবুক করাটা থামলে ওর কাছে যাব,তার আগেনা’
চলবে♥