#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৫৩
আফনান লারা
.
গ্রামের বেশিরভাগ মেয়েরা সবসময় ভোরবেলায় উঠে পড়ে।কুসুম ও পারতো।কিন্তু রাতে মাথা যন্ত্রনার সঙ্গে যুদ্ধ করে তার ঘুম আসতে ভোর হয়ে যায়।তাই আটটা অবধি ঘুমিয়ে থাকে অনেক সময়।তো এই ভোরে অর্ণব ওঠার পর ওকে দুবার ডেকে সে নামাজ পড়তে চলে গেছিল।নামাজ পড়ে এসে দেখলো এখনও আগের মতন শুয়ে আছে।নড়ছেনা।
অর্ণব একটু কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললো,’তোমার কি পড়াতে মনযোগ নেই?তবে আমাকে দিয়ে বই আনালে কেন?’
কুসুম যেন অনেক কষ্টে তার চোখ খুলেছে।বিছানায় হাত রেখে আস্তে করে উঠে বসে বললো,”আমার শরীর খারাপ লাগে।আচ্ছা আমি বই নিচ্ছি ‘
এই কথা বলে ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে কুসুম মুখ ধুতে চলে গেছে।অর্ণব বইগুলো আগের জায়গায় রেখে দিয়ে ভাবছিল হয়ত ওকে ওঠানো ঠিক হয়নি।
কুসুম মুখ ধুয়ে এসে বললো,’নিন শুরু করুন’
‘নাহ।ঘুমাও।শরীর খারাপের ভেতর পড়ায় মন বসবেনা তোমার’
কুসুম ওর কথা যেন শুনেইনি।বই নিয়ে বসে পড়েছে বিছানার মাঝ বরাবর।অর্ণব সামনে বসে ওকে প্রথমে এক থেকে দশ পর্যন্ত শেখানো শুরু করেছে।
কয়েকটা পড়ে কুসুম বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছিলো।অর্ণবের সঙ্গে পড়াতে তাল মেলাতে পারছিলনা।অর্ণব সেটা বুঝতে পেরে বই বন্ধ করে ওকে শুয়ে পড়তে বলে।
সাথে সাথে কুসুম শুয়েও পড়ে।তার নিজেরই সহ্য হচ্ছিলনা এত অস্বস্তি।
কালকের সেই ডাক্তারের নাম্বারে অর্ণব কয়েকবার কল করলো।কিন্তু তিনি রিসিভ করলেন না।এদিকে কুসুম কেমন কেমন করছে।
অর্ণবের ভীষণ ভয় লাগছে।ওর পাশে বসে মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করেছে কি কষ্ট হয় তার।
কুসুম শুধু বললো মাথা ব্যাথা।
অর্ণব ওর চুলে হাত দিয়ে টানতে গিয়ে ওর মনে পড়ে গেলো চুল সব উঠে চলে আসবে।তাই আস্তে আস্তে ওর কপাল টিপছে সে।কুসুম এক হাতে ওর পাঞ্জাবিটা ধরে ছিল আর চোখ বন্ধ রেখে জিকির করছিল অনবরত।
হঠাৎ করে এতটা অসুস্থ হয়ে পড়বে তা অর্ণব ভাবতেও পারেনি।
কুসুমের কষ্ট দেখে তার নিজের মনের শান্তিই গায়েব হয়ে গেছে।
বেশ কিছুক্ষন মাথা টিপে দেবার পর অর্ণব যখন বুঝেছে কুসুম ঘুমে তখন সে আলতো করে নিজের পাঞ্জাবি থেকে ওর হাত সরিয়ে নামলো বিছানা থেকে।খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে।
কাল রাতের খাবার এতক্ষণে নষ্ট হয়ে গেছে মনে হয়।সেটা আর মুখে দেওয়া যাবেনা।এদিকে তরকারি সব কালকের আনা।
রান্না না করলে ওগুলোও নষ্ট হবে।ঘরে তো ফ্রিজ নেই।বাধ্য হয়ে সে নিজেই রান্নাঘরে প্রবেশ করেছে।উদ্দেশ্য পরোটা আর ডিম ভাজবে।কাল আটার বদলে ময়দা নিয়ে এসেছিল সে যার কারণে এখন পরোটা বানাবে।বুদ্ধি করে হাঁড়ি পাতিলের সাথে তাওয়াও এনেছিল তা নাহলে এখন রুটি পরোটা কিছুই খাওয়া হতোনা।ময়দা পানি সব একসাথ করে তুলকালাম বাঁধিয়ে কোনোরকমে তিনটা পরোটা বানাতে সে সফল।এখন বাকি রইলো ডিম ভাজি।হোটেলে খেতে গেলে রাঁধুনীকে ডিম ভাজতে সে অনেকবার দেখেছে।সেরকম করে কাঁচা মরিচ কুচি কুচি করে ডিমটাকে চামচ দিয়ে নড়াচড়া করে দিয়ে দিলো কড়াইয়ে।
হাত পুড়ে -টুড়ে সব সম্পন্ন করেছে সে।
দম ফেলে এবার সব এক এক করে টেবিলে এনে রাখছে।কিরকম বিশ্ব জয়ের মতন ফিল ফিল হচ্ছে মনের ভেতরে।এবার দেখতে হবে কুসুমের কাছে খাবারটা কেমন লাগে।
‘এ্যাই কুসুম উঠো।সকাল আটটা বাজে’
কুসুম আচমকা ভয় পেয়ে উঠে পড়েছে।অর্ণবের মনে ছিলনা ওর অসুস্থতার কথা।দেরিতে মনে আসায় জিভে কামড় দিয়ে চেয়ে আছে সে।
কুসুম প্রথমে ঝাপসা দেখছিল পরে চোখ ডলে বললো,’বেশি সকাল হয়ে গেলো বুঝি?’
অর্ণব মাথা নাড়িয়ে বললো,’হালকা কিছু খাবার রেডি করেছি।খেতে এসো।মাথা ব্যাথা কমছে?’
কুসুম মাথায় হাত দিয়ে মুখটা কালো করে বললো কিছুটা।এরপর ওর সাথে রুমের বাহিরে টেবিলের কাছে এসে পরোটা আর ডিম ভাজির হাল দেখে জিজ্ঞেস করলো এগুলো কি সে নিজে বানিয়েছে।অর্ণব পাঞ্জাবির কলার ঠিক করে উত্তরে বললো,’আর কে করবে?’
কুসুম হাসি মুখে চেয়ারে বসে পরোটা দিয়ে ডিমের টুকরো মুখে দিয়ে চিবাতে গিয়ে চোখ কপালে তুলে ফেলেছে।অর্ণব ওর পাশে বসে বললো,’কি হলো?স্বাদ কেমন?লবণ বেশি হলো বুঝি?’
কুসুম মাথা নাড়িয়ে জানালো সব ঠিক আছে।অর্ণবের ওর এমন ব্যবহারে সন্দেহ হওয়ায় সে নিজেও এক টুকরো মুখে দিলো।দিয়ে বুঝতে পারে ডিমের খোসা সমেত ভাজি করেছে সে।কিরকম একটা বিদঘুটে স্বাদ।লবণ কি বেশি দেবে!!লবণের ছিঁটেফোটাও দেয়নি।
থুথু করতে করতে সে ছুটলো রান্নাঘরের দিকে।কিন্তু কুসুম বসে বসে ডিমের ভেতর থেকে খোসার টুকরো গুলো বের করে এক পাশে রেখে তৃপ্তি সহকারে খাওয়া শুরু করেছে।
ওর খাওয়া দেখে অর্ণব অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল।তার নিজের কাছে খারাপ লাগলো অসুখের মাঝে এমন বিচ্ছিরি একটা খাবার কুসুমকে খেতে দিয়ে।তাই পকেটে হাত দিয়ে বাহিরে যাচ্ছিল কিছু খাবার কিনে আনতে।কুসুম ওকে থামতে বলে জানালো তার পেট ভরে গেছে।সে যেন শুধু নিজের জন্য খবার আনে।
অর্ণব চলে যাবার পর কুসুম বারান্দায় গিয়ে দেখছিল ও কি করে।বারান্দাটা দিয়ে সামনের বাজারটা সম্পূর্ণ দেখা যায়।অর্ণব অর্ডার দিকে যেইনা পেছনে তাকালো,কুসুমকে ওখানে দেখতে পেয়ে একটা চিপসের প্যাকেটে হাত রেখে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো খাবে কিনা।কুসুম আনতে মানা করেছে।
খাবার কিনে বাসায় এনে নাস্তা করে অর্ণব মৃদুলকে ফোন দিয়ে জানালো সে আজ ভার্সিটিতে আসবেনা।কুসুমের শরীর ভালোনা।ওকে একা রেখে যাওয়া ঠিক হবেনা।
মৃদুল রাজি হলো।সে রেসাল্ট ফোনে জানিয়ে দেবে বলেছে।আর নয়ত অর্ণব নিজেই নেট থেকে বের করতে পারবে।
এদিকে বাবা মা কুসুমের শরীর খারাপের কথা শুনে তারা নাকি ঢাকার জন্য রওনা হয়েছেন।এমনিতেও তারা আসবেন বলে ঠিক করেছিলেন আগেই।
উনারা আসতেছেন শুনে কুসুম ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কি রান্না করবে, কি করে সব সামলাবে সেটা ভেবে।অর্ণব আরামসে শুয়ে ছিল।কুসুম ওর কাছে এই নিয়ে পাঁচবার ছুটে এসে একই কথা বলেছে,’একটা মুরগী কিনে আনেন’
শেষে অর্ণব মাথা তুলে বললো,’তোমার অসুখ।আমার মুড নেই রান্না করার,পারিওনা।আমার হাতের ঐ অখাদ্য আমি বাবা মাকে খাওয়াতে পারবোনা।টাকা আছে পকেটে।বাহিরে থেকে কিনে আনবো’
কুসুমের খারাপ লাগলো।নিজের হাতে রাঁধতে পারলে হয়ত মনে মনে অনেক ভাল লাগতো।বাহিরের খাবার উনাদের খাওয়ানো ঠিক না।
এদিকে শরীর খারাপ হওয়ায় ঠিকমত দাঁড়াতেও পারছেনা সে।
এক রাশ মন খারাপের ঝুড়ি নিয়ে জবা ফুল গাছটার কাছে এসে বসে রইলো।অর্ণব ওকে নিরবে চলে যেতে দেখে পিছু নিয়েছিল।ওকে ওমন করে বসে থাকতে দেখে বললো,’আচ্ছা আমি বাজার করে আনবো,তারপর রাঁধবো।তুমি শুধু দেখিয়ে দেবে।হাত লাগাতে পারবেনা।রাজি?’
কুসুম যেন বিরাট আশার আলো খুঁজে পেয়েছে।চট করে বসা থেকে উঠে গিয়ে বললো আমি রাজি।অর্ণব আর কি করবে উপায়ান্তর না পেয়ে বাজার করতে চলে গেছে।
—–
আজ ভার্সিটিতে মৃদুল আসার পর থেকে জুথিকে খোঁজার চিন্তা মাথায় আনেনি।অনেক অনেক ব্যস্ত সে।রেসাল্ট নিয়ে এক প্রকার দৌড়াদৌড়িতে আছে।
কিন্তু আজ ঘটলো উল্টো ঘটনা।জুথি নিজে মৃদুলকে খুঁজছে।তার কারণ হলো,কাল রাতে ওর হাত পুড়ে যাওয়ায় হাতের ঘড়িটা খুলে রেখে গিয়েছিল জুথির বিছানায়।জুথি সেটা ফেরত দিতে এখন ব্যস্ত হয়ে ওকে খুঁজে যাচ্ছে।
আজ অনেক ভীড়।সব স্টুডেন্ট একজোট হয়েছে রেসাল্ট নিয়ে গবেষণা করতে।মৃদুলকে পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।হঠাৎ এই ভীড়ের মাঝে আদিলের সাথে দেখা হয়ে গেলো তার।
স্বাভাবিক ভাবে আদিলের কাছে মৃদুল,অর্ণব আর তমালের সব খবর থাকে।জুথি তাই ওর কাছেই জিজ্ঞেস করলো।আদিল জুথিকে ভাল করে একবার দেখে নিয়ে বললো,’এতদিন না আপনি অর্ণব ভাইয়ার খবর নিতেন?এখন মৃদুল ভাইয়া কেন?’
জুথি বিরক্ত হয়ে বললো,’তোমার কি তাতে?’
‘বলছিনা।সুন্দর করে বললে তারপর বলবো মৃদুল ভাইয়া কই’
জুথি বিনয়ের সহিত বললো,’আদিল ভাই আমার।প্লিজ বলবে মৃদুল ভাইয়া কোথায়?’
‘কোথায় আবার!ডিপার্টমেন্টেই আছে’
‘আমি চার তলা উঠতে পারবোনা।পায়ে ব্যাথা।
একটু গিয়ে ডেকে আনো না প্লিজ।আচ্ছা এক কাজ করো, ধরো এই ঘড়ি।ওনাকে দিয়ে দিও’
‘আপনার যেমন চার তলা উঠতে গিয়ে পায়ে ব্যাথা হয় আমার ও ব্যাথা হয়।তবে সেটা বুকে।তাই আমিও উঠছিনা।আপনি গিয়ে দিয়ে আসুন।বাই’
আদিল চলে গেলো।জুথি কোমড়ে হাত দিয়ে ওর চলে যাওয়া দেখছিল সেসময়ে উপরে চার তলায় হঠাৎ করিডোরে মৃদুলকে দেখলো গ্রিলে হাত রেখে ফেনে কার সাথে যেন কথা বলছিল।জুথি হাত নাড়িয়ে কয়েকবার ইশারা করতেই মৃদুল ওকে দেখতে পেয়েছে।তাই সেও ইশারা করে বললো সে আসছে এদিকে।
—-
অর্ণব মুরগী কাটছে আর কুসুম পাশে থেকে দেখিয়ে দিচ্ছে।
কিছু সময় পর অর্ণব মুরগীর কলিজা হাতে নিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখে কুসুমের দিকে চেয়ে বললো,’আমরা কত নিষ্ঠুর।এত কিউট কলিজা কিনা ছিঁড়ে ফেললাম’
কুসুম হাসতে হাসতে শেষ।অর্ণব ওর হাসি দেখে বললো,’আমি সিরিয়াস।তোমার লজ্জা করেনা এমন দৃশ্য দেখে হাসতে?’
‘ভেবে দেখুন এই কলিজা রান্না করার পর আপনি সাগর ভাইয়ার সাথে প্রতিযোগিতা ধরে খেয়েছিলেন’
কথাটা শুনে অর্ণব ঢোক গিলে বললো,’ওহ আচ্ছা ওই কলিজা আর এই কলিজা একই।খাওয়ার জিনিস খেতেই পারি।আমিওনা!কেন যে কাঁদছি’
কুসুম মুখে হাত দিয়ে শুধু হাসছে।অর্ণব নাক টেনে আবারও মাংস কাটায় মন দিলো।
চলবে♥
জয়েন হোন আমাদের নতুন গ্রুপে
https://www.facebook.com/groups/676436250036874/