#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৬৭
আফনান লারা
.
অর্ণবের মজা করাকে কুসুম সত্যি ধরে নিয়ে চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে এক পর্যায়ে।শেষে বাধ্য হয়ে ওর মুখটা চেপে ধরতে হলো অর্ণবকে।ওর কানে ঠোঁট লাগিয়ে ফিসফিস করে সে বললো,’আমি মজা করতেছি’
এরপর ওর মুখ থেকে হাত ছেড়ে সে চললো নিচের দিকে।কুসুম ও তার পিছু পিছু আসতেছে।
মৃদুলদের বাসায় মানুষের সমাগম আরও বেড়ে গেছে।মনে হলো ছেলের আরও কিছু আত্নীয় এসেছেন পর দিয়ে।
সম্ভবত তারা ছেলের খালার পরিবার।
এখন এমন অবস্থা হয়েছে জায়গার অভাবে সোফার কিণারায় ও বসা আছে কেউ কেউ।মম মাথা নিচু করে বসে ছিল।তারই পাশে জিসান বসা।
দুজনে আস্তে আস্তে কথা বলছিল।ঠোঁট নড়ছিল তাদের।
বাকিরা বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করার আলাপে ব্যস্ত।
অর্ণব বাসায় ঢোকার আগে বাহিরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিল মৃদুলের সাথে।কুসুম ঘোমটা টেনে ঢুকে গেছে ভেতরে।জিসানের মা ওকে দেখে মমর মাকে বললেন,’আপা মেয়েটা কে?’
তখনই সবার চোখ গেলো কুসুমের দিকে।মিষ্টি কালারের শাড়ী আর খোলা চুলে এক আলাদা রকমের সৌন্দর্য্য বেয়ে পড়ছিল ওর সারা শরীর জুড়ে।তার রুপে মোহিত হয়ে গেলো জিসানের ছোট ভাই জানিম।
জানিম তার মায়ের দিকে তাকালো সঙ্গে সঙ্গে।তার মা আবার বললেন,’তোমার বাসা কই মা?কি হও মমর?’
মিজুয়ানা হেসে বললেন,’ও হচ্ছে কুসুম।আমাদের দোতলার ভাঁড়াটিয়া।একদম আমার মেয়ের মতন।অর্ণব কোথায় কুসুম?? ‘
‘বাহিরে ফোনে কথা বলছেন’
জানিম জিজ্ঞেস করলো অর্ণব কে।মিজুয়ানা উত্তর দিলেন সে কুসুমের স্বামী।এটা শুনে জানিমের মনটা খারাপ হয়ে গেছে।জিসানের মা তার শাশুড়িকে ফিসফিসিয়ে বললেন,’আমরা এতদিন কেমন মেয়ে খুঁজছি!সুন্দর সুন্দর মেয়েগুলো মিস হয়ে গেলো।’
‘ঠিক কইছো মা!এ দেখি চাঁদের টুকরো!ইশ আমাদের কপাল!’
সেসময়ে অর্ণব ও ঢুকেছে বাসায়।সে কুসুমের পাশে এসে দাঁড়ালো।ওদের দুজনকে দেখে জিসানের দাদি আবারও ফিসফিস করে বললেন,’নাহহহ।মেয়েটা তার মতনই সুন্দর একজন পেয়েছে।একেবারে দুজনকে মানিয়েছে বেশ।’
জানিম গাল ফুলিয়ে রেখেছে।অর্ণব কুসুমের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,’যাবে নাকি?শেয়াল ভ্রমণে?’
কুসুন আড় চোখে চেয়ে সরে দাঁড়িয়েছে।অর্ণব ও ওর পাশে ঘেঁষে দাঁড়ালো।এমন করতে করতে কুসুম একেবারে দেয়ালের সাথে লেগে গেছে।আর জায়গা নেই যাবার।এদিকে অর্ণব একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে হেসে হেসে সবার সাথে মাথা নাড়ছে।কুসুম ওকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে গিয়ে হঠাৎ করে থমকে গেছে।অর্ণবকে খুব সুন্দর লাগছিল তখন।এক দারুণ উজ্জ্বলতা তার মুখ জুড়ে ঝল ঝল করছিল।মুচকি হেসে কুসুম ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল।হঠাৎ মৃন্ময়ীর কথা মনে আসায় চোখ নামিয়ে নিয়েছে।
অর্ণব ওর দিকে চেয়ে আস্তে করে বললো,’জানো!মৃন্ময়ীকে মৃদুল অনেক পছন্দ করে।আই থিংক ওদের বোঝাপড়া হয়ে গেলে বিয়েটাও হয়ে যাবে’
কথাটা শুনে কুুসম প্রথমে অবাক হলো তারপর প্রশ্ন করলো মৃন্ময়ী মৃদুলকে পছন্দ করে কিনা
অর্ণব বললো হয়ত করে।কারণ এয়ারপোর্টে সে মৃদুলকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল।
কুসুম তার আঁচলে গিট্টু করতে করতে বললো,’আপনি যেমন আমায় মেনে নিতে পারেননি হয়ত তিনিও মৃদুল ভাইয়াকে মেনে নিতে পারবেননা’
অর্ণবের এবার খারাপ লাগলো।তাই সে ওর থেকে একটু দূরে সোফায় জানিমের পাশে গিয়ে বসলো খালি জায়গা পেয়ে।এতক্ষণ ঐ জায়গায় জানিমের খালা বসে ছিলেন।
কুসুমের হাতে জাহান নুডুলসের বাটি ধরিয়ে চলে গেছে।নুডুলসের দিকে তাকাতেই ওর বমি ভাব মনে হলো।সে বাটিটা রেখে বাসা থেকে বেরিয়ে বাগানের দিকে চলে এসেছে ছুটে।
বমি ভাব হলেও বমি আসেনা।মাথা ধরে নিচে ঘাসের উপর বসে থাকলো সে।
অর্ণব ওকে ছুটে চলে যেতে দেখে সেও এখানে এসেছিল।এসে ওকে নিচে বসে পড়তে দেখে সে ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছে কি হয়েছে।কুসুম মাথা তুলে জবাব দিলো তার বমি ভাব হচ্ছিলো।
‘চলো বাসায় ফিরবে’
কুসুম মাথা নাড়িয়ে না জানিয়েছে।সে যেতে চায়না এখন।
অর্ণব ওর পাশে ঘাসের উপর বসে বললো,’আমার খিধে পেয়েছে।রাতের জন্য যে খাবার কিনেছিলাম ওগুলো খাব, চলো।তুমি নাহয় পরে খেও।আমার পেটে কোকিল ডাকছে’
কুসুম ফিক করে হেসে ফেললো ওর কথা শুনে।ওর মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছে দেখে অর্ণব ওর চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে এবার।কুসুম অবাক হয়ে ওকে দেখছিল বলে সে বললো,’ভেবোনা।আমি অভিনয় জানিনা।এসব অভিনয় না।
স্কুলে যেমন খুশি তেমন সাজতে বলা হয়েছিল আর আমি সেজেছিলাম “একমাত্র আমি।”
আমার মতন চলাফেরা করেছি।বুকে কাগজ লাগিয়ে সেটাতে লিখে দিয়েছি “অর্ণব’
আমি আমার ব্যাক্তিত্বটাকে প্রচণ্ড গুরুত্ব দিই।আমাকে সবাই বুঝতে পারেনা।যারা বছরের পর বছর পাশে থাকে তারা বোঝে।যেমন ধরো মৃদুল তোমায় বলতে পারবে আমি কেমন মানুষ।অভিনয়ের কথা যদি সে শোনে তবে আচ্ছা করে তোমায় কড়া কথা শুনাবে।কারণ আমি অভিনয় জানিনা এটা সেও জানে।
আমি কেমন তা না তুমি জানলে, আর না মৃন্ময়ী জানলো।আফসোস!”
‘আপনি উনাকে ভালবাসেন তাইনা?’
অর্ণব রেগে গিয়ে কুুসুমের মাথার চুলগুলো মুঠো করে ধরে এক টান দিয়ে বললো,’আমি না ওরে বাসি আর না তোমায় বাসি।আমি কাউরে বাসিনা।কথা ক্লিয়ার?আর জানতে চাও?’
কুসুম মাথায় হাত দিয়ে অর্ণবের হাত ছাড়িয়ে নিলো চুল থেকে।তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললো,’নিশ্চয় বাসেন।তা নাহলে আপু ওমন কাঁদে কেন সবসময়?
একজন ভাল না বাসলে আরেকজন এরকম সারাক্ষণ কান্না করবেনা। আপনি বেসেছেন,এখন অস্বীকার করার কারণ কি সেটাই বুঝতেছিনা।আমি কি আপনাকে মারধর করবো এই নিয়ে?আমি তো নিজেই অনুতপ্ত আপনাদের বিচ্ছেদ ঘটিয়েছি বলে!’
‘এক মিনিট!কিসের বিচ্ছেদ? প্রেম হলে তো বিচ্ছেদ হবে।মৃন্ময়ী আমার ভাল বান্ধুবী ছিল।হয়ত তুমি আমার জীবনে না আসলে একদিন আমি ওরে বিয়ে করতাম কারণ আমার সেরকম মেয়ে ফ্রেন্ড ছিলনা।জুথি যেহেতু সবসময় সামনা সামনি থাকতো সেহেতু একটা সময়ে লাইফ পার্টনার হওয়ার চান্স থাকা যেতো।ওসব কিছুই হয়নি তাহলে কেন তুমি ওগুলো বলে মেজাজ খারাপ করতেছো’
কুুসুম জবাব না দিয়ে চলে গেছে।অর্ণব মাথায় হাত রেখে ভাবছে চুপচাপ স্বভাবের মেয়েটা অতীত জেনে এখন রণচন্ডী হয়ে গেছে।সে ভাবছে তাকে আমি চিট করছি।
আদৌ সেটা করিনি আমি।আমি তো শুধু!ধ্যাত!!মেয়ে মানুষ এমন কেন!না বুঝে রাগ দেখায়।সবাই তার রাগ আমাকেই দেখাতে জানে।দুনিয়ায় রাগ দেখানোর মানুষের অভাব পড়ছে তাদের!”
—–
বাসায় ফিরে কুসুম খাবারগুলো প্লেটে নিচ্ছিলো।অর্ণব এখনও বাগানে ঘাসের উপর গালে হাত দিয়ে বসে আছে।ডাক্তার ফোন করে জানিয়েছে যে দুজন ডাক্তারের সাথে আলাপ করার কথা তারা এখনও হাসপাতালে পৌঁছায়নি বলে আলাপ হয়নি।তারা অতিব্যস্ত।
আপাতত কুসুমকে বাসায় ট্রিটমেন্টের উপর রাখতে হবে।ওকে চিন্তামুক্ত রাখতে হবে।মাথায় যেন কোনো প্রকার চাপ না পড়ে।
অর্ণব একটা বিষয় খেয়াল করেছে।সে যখনই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে।রাগ করে প্রচুর তখন তার ঐ লেভেলের রাগটা বেশি সময় আর থাকেনা।
পানি হয়ে যায়।ঠিক এখনও হয়েছে তাই।সে ইচ্ছে করেও কুসুমের সাথে বেশি সময়কাল রাগ করে থাকতে পারেনা।অটোমেটিক রাগ গায়েব হয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়, আবার সে বিষয়ে রাগ হয়।আবার পানি হয়।
এসব ভেবে উঠে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবি ঝাড়তে ঝাড়তে বাসায় চলে আসলো সে।
টেবিলে খাবার সাজানো দেখে বসেও পড়লো খেতে কিন্তু কুসুমের কথা মাথায় আসায় খাওয়া হলোনা।তাই বসে থেকেই ডাক দিয়েছে সে ওকে।কিন্তু কুসুম শুনেও না শুনার ভান করে শুয়ে আছে।অর্ণব উঠে দরজার ফটকের কাছে এসে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,’এই যে! সেদ্ধ ডিমের কুসুম!খেতে আসেন।নাহলে তুলে নিয়ে আসবো’
কুসুম উঠে বসে গোমড়া মুখে জবাব দিলো তাকে একা থাকতে দিতে
অর্ণব মনে মনে নিজেকে বলছে-কন্ট্রোল অর্ণব!! নিজের রাগ বাড়াও!কুসুমকে ভয় দেখাও।রাগ বাড়াও!!নিজের দাপট দেখাও! শক্তি দেখাও!!
“আপনি ওমন বিড়বিড় করে কি বলছেন?’
অর্ণব একটা ধমক মেরে দিয়েছে ততক্ষণে, যার কারণে কুসুমের কথা মাঝ পথেই আটকে গেছে।এরপর ওর কাছে এসে হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,’চলো বলছি!নাহলে মেরে খাওয়াবো তোমায়।আমি তোমার স্বামী হই।আমার কথা শুনতে তুমি বাধ্য!’
—-
সারাদিন নিজের রুমের আলো নিভিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে জুথি শুয়ে থাকে।ওর আম্মু বুঝতে পেরেছেন দেশে কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে যার কারণে ও এখানে ফিরে এসেছে।তাই বেশি জ্বালান না।ওকে একা থাকতে দেন।ফোন চার্জে ফেলে রেখে সারাদিন ঘুমে কাতর থাকে জুথি।অবশ্য এমন ঘুম আসার পেছনে কারণ আছে বৈকি।
গাদা গাদা ঘুমের ঔষুধ খেয়ে ঘুমায় সে।এ কথা কেউ জানেনা।দেশ থেকে আসার সময় কিনে এনেছিল।
মৃদুল বারবার ফোন করেও ওকে না পেয়ে করিম আঙ্কেলের বাসা থেকে জুথির মায়ের নাম্বার জোগাড় করে এনেছে।এরপর কল ও করেছিল।
জুথির মা কল ধরতেই সে প্রথম ১০সেকেন্ড চুপ ছিল পরে হালকা কেশে বললো,’আসসালামু আলাইকুম আন্টি।আমি মৃদুল,হয়ত চিনবেননা।আমি জুথির ফ্রেন্ড’
জুথির আম্মু সালাম নিয়ে বললেন,’তোমাকে চিনি আমি।জুথি বলেছিল’
‘সত্যি?কি বলেছিল?’
‘ছবি দেখিয়েছিল।তা হঠাৎ আমায় কল করলে?’
‘আন্টি একটু জুথিকে ফোনটা দেবেন?আমি ওকে কতবার কল করেছি!ও ধরছেনা’
‘এখন তো মনে হয় ঘুমাচ্ছে।আচ্ছা দাঁড়াও ডেকে দিচ্ছি।মনি!!মনি!!মৃদুল ফোন করেছে।কথা বল ধর’
মৃদুলের নাম শুনে জুথি মাথা তুলে তাকালো।চোখ মুখ ঝাপসা হয়ে আসছে।
চলবে♥
জয়েন হোন আমাদের নতুন গ্রুপে
https://www.facebook.com/groups/676436250036874/