#স্বপ্ন_কেনার_দামে
#দ্বিতীয়_খন্ড
৩
ফয়সালের বাবা বড়ো ব্যবসায়ী। চিটাগং
শহরের ওনার চেইন ফার্মেসি আর ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে। শুরু করেছিলেন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রিএজেন্ট ব্যবসার মাধ্যমে। সময়ের সাথে সাথে ব্যবসার পরিসর বাড়িয়েছেন। শহরের সবচেয়ে পরিচিত ঔষধের চেইন ফার্মেসির পাশাপাশি ট্রমা সেন্টার, ডায়াগনস্টিক সেন্টারেরও মালিক তিনি। একমাত্র ছেলে বলে ফয়সাল বেশ বিত্তবৈভবের ভেতর বড়ো হয়েছে। ঢাকায় ফয়সালের থাকার জন্য কলেজের কাছাকাছি কোন মেস নয়, রীতিমতো আধুনিক ফ্ল্যাট ভাড়া করে দিয়েছেন। ফয়সাল একা না থেকে পূর্বপরিচিত দুই বন্ধুকে নিয়ে থাকে। পার্সোনাল গাড়িও রয়েছে, ফয়সাল নিজেই চালায়। বন্ধুদের পেছনে খরচ করতে পারে বলে বন্ধু মহলে ফয়সালের আলাদা কদর রয়েছে। রিদমদের বন্ধু মহলের বেশিরভাগ আড্ডায় স্পন্সর করে ফয়সাল, প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে টাকাও ধার দেয়।
অরণী তাই ফয়সালকে যতই অপছন্দ করুক, রিদম ফয়সালের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারে না। রিদমের পরিবারে সারাক্ষণ টাকাপয়সার দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে। দু’হাজার চাইলে পাঁচশো টাকা পাওয়া যায় এমন অবস্থা। আর এখন তো পাশ করার পর টাকা চাওয়া দূর, মা বাবা উল্টো আশা করে এখন থেকেই রিদম পরিবারের জন্য আয় করবে।
এমন অবস্থায় জীবনে একটু আনন্দ ফুর্তি করতে হলে ফয়সালের মতো বন্ধু প্রয়োজন। এ জগতে কেউ টাকা আয় করে খুশি, কেউ টাকা উড়িয়ে। ফয়সালের বাবার টাকা আছে, সে বন্ধু বান্ধবের পেছনে উড়ায়। অন্যরা এর মজা নিলে রিদম কেন বাদ যাবে! এমনটাই বোঝায় নিজেকে রিদম। আর পরীক্ষার আগে একদিন একটু রিলাক্স হতে গেলে এমন কোন ক্ষতি হবে না। অযথা অরণীকে বললে রিদমকে বোঝানোর চেষ্টা করে প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করাবে। রিদম তাই অরণীর কাছে চেপে যাবে ঠিক করে, ঘুরে আসার পর বুঝিয়ে বলা যাবে। রিক্তার কাছে সব শুনে অভিমানে অরণীও রিদমকে আর ফোন দেয় না।
রিক্তা আয়নায় নিজেকে দেখে সন্তুষ্ট হয়। পেঁয়াজ কালারের ফ্লোরাল কুর্তি, আর সিগারেট প্যান্টের সাথে নো ‘মেকআপ লুক’ নুড মেকআপে রিক্তাকে স্মার্ট তরুণী হিসেবে দারুণ মানিয়েছে। এই রিসোর্টে যাবে বলে গতকাল পার্লারে গিয়ে চুলে ভলিউম লেয়ার কাট দিয়েছে, হাইলাইট করেছে। সব মিলিয়ে হাজার দশেক টাকা বের হয়ে গিয়েছে। এই মাসে হোস্টেলের ভাড়া দেয়নি এখনো, বাড়ি থেকে কলেজের বাহানায় টাকা আনতে হবে ভাবে। এই কুর্তি, জুতা অবশ্য ফয়সালের সাথে শপিং করতে গিয়ে কেনা। ম্যচিং ব্যাগটা অনলাইন ব্রান্ড থেকে কেনা। প্রথম যখন রিক্তা ঢাকায় এসেছিল, তখনকার সাথে এখনকার রিক্তায় অনেক পার্থক্য। সেই সময় রিক্তার কাছে সাজ মানেই ছিল মুখ চুনের মতো সাদা করে ফেলা, সাথে জমকালো রঙিন পোশাক। তবে এখনকার ফ্যাশন খুব তাড়াতাড়িই রপ্ত করে নিয়েছে রিক্তা। স্কার্ফটা গলায় পেঁচিয়ে নেবে কী নেবে না ভাবতে ভাবতে, হোস্টেলের নিচে হর্ণের আওয়াজ শোনে।
ফয়সাল এসে গিয়েছে, খুশি মনে গলা থেকে স্কার্ফ খুলে রেখে নেমে যায় রিক্তা।
এই রিসোর্টটা শহরের খুব কাছেই, শীতলক্ষ্যা নদীর পাড় ঘেঁষে করা। আকারে অতটা বড় নয়, তবে সুন্দর ছিমছাম। নদীর পাড় ঘেঁষে লাল নীল ছোট ছোট কটেজ করে রাখা। বারান্দাটা নদীর দিকে মুখ করা বলে কটেজের বারান্দায় দাঁড়ালে নদী দেখা যায়। ছোট ট্রলার থেকে মাঝারি লঞ্চ, জাহাজ সবই চলছে। বেশ মনোমুগ্ধকর। রিসোর্টের নিজস্ব ছোট জাহাজ আছে, বিকেলে গেস্টরা চাইলে টিকেট কেটে নদীর আশেপাশে ভ্রমণ করে আসতে পারে। ফয়সাল, রিক্তা, রিদম সহ আরও চারজন সঙ্গী হয়েছে আজকের এই ট্যুরে। ফয়সালের তিন স্কুল বন্ধু, আর তাদের একজনের গার্লফ্রেন্ড। তারা তিনটি কটেজ নিয়েছে। সিঙ্গেলদের জন্য একটা কটেজ, আর দুই কাপলের জন্য দুটো। ফয়সাল রিক্তার এতো কাছাকাছি, খোলামেলা মেলামেশা দেখে অরণীকে খুব মনে পড়ে রিদমের। পুরানো আফসোসটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। অরণীও যদি এভাবে ওর সাথে আসতো, কী চমৎকার সময় কাটাতে পারতো তারা। একটা ছোটখাটো হানিমুন হয়ে যেত।
ফয়সাল বেশ উত্তেজনা বোধ করছে। আজ একটা নতুন ড্রিংকস ট্রাই করবে। হেইনিকেন বিয়ারের সাথে পরিমিত ভদকার মিক্স। বিয়ারের সাথে ভদকার মিক্স নাকি বেশ উপাদেয় পানীয়। এর আগে টুকটাক বিয়ার খেলেও ভদকা খাওয়া হয়নি। ফয়সালের এক স্কুল ফ্রেন্ড রাসেল আবার এসবে সিদ্ধহস্ত। আজকের এই পানীয়র আয়োজন তারই করা। তবে সবাইকে আগে বলেনি, মেয়েরা আছে, ছেলেরাও সবাই খায় না। আগে থেকে জানালে হয়তো ঝামেলা হতে পারে। একবারে সামনে গ্লাসে বরফ কুচি দিয়ে রাখলে, না পান করে যাবে কোথায়!
রিসোর্টে পৌঁছে সবাই পোশাক পাল্টে পুলে নেমে যায়। পানিতে বেশ কিছুক্ষণ মজার সময় কাটানোর পর বুফে লাঞ্চটাও হয় জমজমাট। ছোট রিসোর্ট বলে অল্প সময়েই ঘুরে দেখা হয়ে যায়। জাহাজ বিকেলে ছাড়বে। এই অলস দুপুরে তাই সবাই এক কটেজে জমায়েত করে আড্ডা জমায়। আড্ডায় রিদম আর অরণীর বিষয়টাও উঠে আসে। রিদমের অদ্ভুত বিয়ে, এবং বিয়ের পরও অরণীর কঠিন কুমারী ব্রত পালন নিয়ে সবাই রিদমের সাথে ঠাট্টা করতে থাকে। যদিও সবার সাথে গলা মিলিয়ে রিদমও হাসে, কিন্তু কেন জানি ওদের কথাগুলো অন্তরে জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে।
কাকতালীয় ভাবে অরণীর ফোনটাও সেই সময়ই আসে। কটেজ থেকে বের হয়ে একটু আড়ালে যায় রিদম।
“হ্যালো, রিদম।”
“বলো।” চাইলেও গলায়,বিরক্তি এড়াতে পারে না রিদম। অরণী রিদমের কণ্ঠ শুনেই বোঝে রিদমের গলাটা ঠিক স্বাভাবিক নয়।
“কী হয়েছে রিদম? কোথায় আছ? আমি ফোন দিয়ে বিরক্ত করতাম না, কিন্তু মনে হলো তোমাকে মনে করিয়ে দেই, এফসিপিএস এর ডেট দিয়ে দিয়েছে। এই সময় প্রতিটি ঘন্টাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।”
“অরণী শোন, বিয়ে করেছি বলে বৌ হয়ে সবসময় খবরদারি করবে না প্লিজ। আমার আম্মুও এত দাদী আম্মা ধরনের লেকচার দেয় না, যতটা তুমি দাও। তোমাকে বিয়ে করে বৌ না পেলেও একজন খবরদারি করার মানুষ পেয়েছি মনে হচ্ছে। বিয়ে করাটাই আমার ভুল হয়েছে।”
রিদমের ফোন রেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে অরণী। তবে এসব তার রিদম বলছে না জানে অরণী। রিদমের যেন অনেকগুলো সত্তা। কখনো অরণীর কাছে লক্ষীটি ভালোবাসার মানুষ এই রিদমই কখনো হয়ে যায় নিষ্ঠুর। সেই সময় রিদমের মুখটা অপরিচিত লাগে। কিন্তু বারবার নিজেকে বোঝায় দেয় অরণী, এইটা তার রিদম নয়, এই রূপ সঙ্গদোষে বদলে যাওয়া মানুষের। তার রিদম যখন সবসময় তার পাশে থাকবে, তখন ভালোবাসা আর যত্ন দিয়ে সেই রিদমকে দূরে রাখবে যে তাকে কষ্ট দেয়। অরণী জানে তার সেই স্বপ্ন পূরণ হবে, রিদমকে যে সে কিনেছে তার স্বপ্ন কেনার দামে।
আচ্ছা অরণী কি জানে, রোজ এমন শত শত অরণী নিজেদের টক্সিক রিলেশনশিপকে এভাবে সুগার কোটিং দেয়। আর বোকার মতো নিজেই নিজেকে বোঝায়, একসময় সব সুন্দর হবে, ঠিক যেমনটা সে স্বপ্ন দেখেছিল!