#স্বপ্ন_কেনার_দামে
#দ্বিতীয়খন্ড
পর্ব১২
অরণী চুপিচুপি ছাদে উঠে এসেছে। বাসায় অনেক মেহমান। সবাই গল্প আড্ডায় ব্যস্ত। অরণী একফাঁকে মোবাইলটা নিয়ে বের হয়ে এসেছে। মাহিদকে ফোন দিতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সব জানিয়ে বিয়ে ভাঙতে হবে। শপিং এর জিনিসগুলোও ফেরত পাঠাবে। এত দামি দামি জিনিস রাখার মানেই হয় না।
অরণী কল করার আগেই আননোন একটা নাম্বার থেকে কল আসে।
“হ্যালো। আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?”
“অরণী, আমি রিক্তা।”
“রিক্তা! কেমন আছিস? এতদিন কই ছিলি? তোর মোবাইল বন্ধ। ফেসবুক ডিএক্টিভেট।”
“বাড়িতে ছিলাম। আববু সব বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে অরণী।”
“ওয়াও। কংগ্রাচুলেশনস। কার সাথে? মানে ভাইয়া কী করেন?”
“ফয়সাল না। আমার কান্নাকাটিতে বাবা ফয়সালের পরিবারে যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু ওর বাবা মা মেনে নিলেন না।”
“আর ফয়সাল? ও কিছু বলেনি?”
“ও তো একটা কাপুরুষ। তার বাবার কাছে তাজ্য হওয়ার ভয়ে ওনারা যা বললো তাই মেনে নিয়েছে।”
“থাক যা গিয়েছে ভালোই হয়েছে। তুই ভালো আছিস তো? এটা নতুন নাম্বার?”
“এটা আব্বুর নাম্বার। আমি বাবার বাড়ি এসেছি। একটু পর আমার স্বামী আজাদ এলে চলে যাব।”
“কেমন লাগছে বিবাহিত জীবন রিক্তা? উত্তর দিলি না। ভালো আছিস?”
“একজনকে ভালোবেসে আরেকজনের সাথে সংসার করা সহজ না অরণী। অস্বীকার করবো না কলেজের সবচেয়ে জনপ্রিয়, ধনী ছেলের গার্লফ্রেন্ড হতে চাওয়ার পেছনে আমার লোভ ছিল ঠিকই। আর তা হলো জীবনটা উপভোগ করতে চাওয়ার লোভ। আমি এই মফস্বলের গলি থেকে বের হতে চেয়েছিলাম। আমি চেয়েছি আমার আম্মুর মতো মাসের শুরুতেই যেন মাস শেষের হিসেব না করতে হয়। একটা ভালো শাড়ি কিনতে যেন ঈদের অপেক্ষা না করতে হয়। ট্যুরে যাওয়ার আগে যেন আমার চিন্তা হয় লাগেজে কী কী নেব। কোন হোটেলে থাকলে কম খরচে থাকতে পারবো সেই হিসেব যেন কষতে না হয়। আর এই সব কিছুর ভেতর আমি ফয়সালকে ভালোবেসেছি। ভালো জীবনের লোভেই বেসেছি। এখন না এই জীবন ভালোবাসতে পারি না এই জীবনের সাথে জড়িত মানুষটাকে।”
“রিক্তা, তোর ভাবনাগুলো অন্যায় বলবো না। জীবনে একেকজনের প্রায়োরিটি একেকরকম থাকে। তুই যে জীবনের স্বপ্ন দেখিস, বাবার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করলে তেমন একটা জীবন হাতের মুঠোয় আসে। কিন্তু আমি যে স্বপ্ন দেখি টোনাটুনির সংসারের। দুই কামরার ছোট্ট ঘর, হিসেবের ভেতর বেহিসাবি ভালোবাসা। আমার বিদেশ ট্যুরের স্বপ্ন নেই। হাওরের উত্তাল বাতাসে ওর হাত ধরে ভেসে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি। আমিও ভালোবেসেছি। এই সবকিছু মিলিয়েই রিদমকে ভালবেসেছি। হয়তো আমারও তোর মতো ভালো থাকার লোভ।”
“তের যদি এটাই স্বপ্ন হয়, তবে তাই পূরণ কর। জানি না ঠিক করছিস না ভুল। বিবাহিত জীবনে এসে বুঝেছি স্বামীর আর্থিক শক্তি না থাকলে আর সব বৃথা মনে হয়। হয়তো বা আমি আজাদকে ভালোবাসি না বলে আরও বেশি মনে হয়। আজাদের শিক্ষা, অর্থ কিছুই আমার সাথে যায় না। খুব সাধারণ জায়গা থেকে অনার্স মাস্টার্স করেছে। কোন চাকরি জোটাতে পারেনি। আমাকে বিয়ে করে আমার বাবার দোকানেই ব্যবসা শুরু করেছে। আমার আব্বুর খুব পছন্দের ছেলে। সে নাকি সৎ, পরিশ্রমী। অথচ আমার কাছে আস্ত একটা কাপুরুষ মনে হয়। এমন লোক যাকে দেখলে মন বা শরীর কিছুই জাগে না। যদি না প্রেগন্যান্ট হতাম, কখনো…”
“ওয়াও, তুই প্রেগন্যান্ট! এত বড়ো খবরটা এত পরে বললি। কংগ্রাচুলেশনস দোস্ত।”
“সুযোগ থাকলে এই প্রেগন্যান্সি টারমিনেট করতাম। এর জন্য আমি ফেঁসে গিয়েছি এমন একটা সম্পর্কে। বাদ দে অরণী। আমি ভালো নেই। তুই ভালো থাকার চেষ্টা কর। আমি বাসায় ম্যানেজ করার চেষ্টা করছি। সাপ্লি এক্সামে বসার অনুমতি পেলে ঢাকা আসবো। পড়ালেখায় তোর হেল্প চাই। এই অনুমতি পাওয়ার জন্য সব বিষ হাসিমুখে গিলতে হচ্ছে। বিয়ে আর আজাদও তেমনই একটা বিষ।”
রিক্তার সাথে কথা বলে মনটা খারাপ হয়ে যায় অরণীর। কেন যে যা চায় তা পায় না! যার ঝুলিতে ভালোবাসার অপার ভান্ডার থাকে, সে অর্থের জন্য মাথা কুটে মরে। আর যে সবকিছুর বিনিময়েও প্রিয়জন চায়, তার সামনে এসে দাঁড়ায় অর্থের দেয়াল। দুটোর সমন্বয়ে সুখ বোধহয় কারও কারও কপালেই লেখা থাকে।
“আপু ছাদে কী করো? ভাইয়ার সাথে কথা বলছো? নিচে ডাকছে তোমাকে।”
“যা অমিয়। আসছি আমি।”
মাহিদকে আর কল করা হয় না। ছোট করে একটা ম্যাসেজ লিখে। “আপনার সাথে জরুরি কথা ছিল।”
নিচে নামতে নামতেই ম্যাসেজর রিপ্লাই আসে, “আমাদের বোধহয় আর কিছু বলার বাকি নেই। আমি তোমার চোখ পড়েছি। চোখের জলে কার নাম লেখা জেনেছি। ভয় নেই কারও সাথে ডুয়েল লড়বো না। ফিকশন আর বাস্তব তো এক নয়। বাস্তবে যার স্ত্রী তারই থাক। শুধু জামদানী শাড়িটা গ্রহণ করলে ভীষণ খুশি হবো। উপহার হিসেবেই নাও।”
অরণী দাদীর কাঁধে মাথা রেখে আদর নিচ্ছে। দুই ফুপু মামা মামী আর কাজিনেরা মিলে বাসা গমগম করছে। জামিল সাহেব এখনো বাসায় পৌঁছুতে পারেননি। সবাই চলে এসেছে বিয়ের শপিং দেখতে। এখানে অবশ্য বিয়ের লাগেজের জিনিসগুলো নেই। শুধু জামদানী শাড়িটা ছাড়া। ওটা অরণীর কাছেই রাখতে বলেছিল মাহিদ। তখন অবশ্য বলেছিল মিলিয়ে পেটিকোট কিনতে দরকার হবে, আর ব্লাউজও বানাতে লাগবে। সেই ব্যাগটা তাই রয়ে গিয়েছে। শাড়িটা সবার হাতে হাতে ঘুরছে। এত চমৎকার আর দামি শাড়ি, সবার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। অরণীর খারাপ লাগে। বিয়েটা ভেঙে গেলে সবাই অনেক কষ্ট পাবে। সমস্যা নেই, তার আর রিদমের বিয়েতে এরচেয়ে বেশি আনন্দ করবে সবাই। অরণী যখন ওর ভালোবাসার মানুষটাকে পাবে তখন ওর সাথে পরিবারের সবাই নিশ্চয়ই আবারও একই রকম খুশি হবে। হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে অরণী দরজা খুলতে উঠে যায়। সম্ভবত বাবা এসেছে।
কিন্তু না, বড় মামার মেয়ে শিখা এসেছে। শিখা আর অরণীর পিঠাপিঠি বয়সী। শিখা ভার্সিটিতে থেকে সরাসরি এই বাসায় এসেছে। যদিও মামী বলেছিলেন শিখা বোধহয় আসতে পারবে না।
“শিখু, কী ভালো লাগছে তোকে দেখে! মামী বললেন তুই আসবি না।”
শিখা একটানে অরণীকে দরজার বাইরে নিয়ে আলগোছে দরজাটা লাগিয়ে দেয় বাইরে থেকে।
“কী হলো শিখা?”
“কী হয়েছে তুই জানিস না অরণী? তুই ই তো বলবি কী হয়েছে বা কী হচ্ছে। আর তুইও বা এত স্বাভাবিক কী করে!”
শিখা মিউট করে ভিডিওটা দেখায় অরণীকে। ইতোমধ্যে ফেসবুকে ভাইরাল। এক তরুণী দুই তরুণকে নিয়ে ডাবল গেম খেলছে। কাঁটাচামচ গলায় ধরে রিদমের আত্মহত্যা করার হুমকি নিয়ে ব্যাপক হাসাহাসি করছে একদল। আরেকদল অরণীকে ধুয়ে দিচ্ছে, প্রতারক বলে। কেউ কেউ মাহিদের জন্য আফসোস করছে।
(চলবে)