#স্বপ্ন_কেনার_দামে
#দ্বিতীয়_খন্ড
পর্ব ৫
রিদমের এফসিপিএস হয়নি। কিভাবে হবে, পুলিশি ঝামেলা, বাসায় অশান্তি এইসব কিছুর ভেতর লেখাপড়ার হাল একেবারে খারাপ ছিল। পরীক্ষার দু’সপ্তাহ আগে যে বিপদ এসেছিল তাতে ভেবেছিল পরীক্ষাই দেওয়া হবে না। তবে হয়তো কারও দোয়া ছিল তার উপর, তাই মাদক মামলায় পড়তে পড়তেও বেঁচে গিয়েছে।
সেদিন ফয়সালের সাথে মনোমালিন্যের পর রিদম রুম ছেড়ে বের হয়ে যায়। ওখানে সবাই আনন্দ উপভোগে এতটাই মাতোয়ারা ছিল যে রিদমের দিকে আলাদা করে কেউ খেয়াল করেনি। ব্যাগ বলতে ছোট একটা ব্যাক প্যাক ছিল। সেটা রুমেই ছিল। ঢাকা থেকে ফয়সালের গাড়িতে রিসোর্টে এসেছে, সাথে তেমন কোন টাকা পয়সা আনেনি। ছুটির দিনে ছাড়া অন্য দিন বিকেলে শহর থেকে বাইরে অবস্থিত এই রিসোর্টে আসা যাওয়ার জন্য ব্যক্তিগত বা ভাড়া গাড়িই সুবিধা। রিদম তাই ঠিক করে পুলের পাশে পা ঢুবিয়ে বসে থাকবে। ফয়সাল আর তার বন্ধু বান্ধবদের আনন্দ ফুর্তি শেষ হলে তাদের সাথেই ঢাকা ব্যাক করবে। ফয়সালের সাথে সম্পর্ক খারাপ করে লাভ নেই।
সময় তখন বিকেল চারটা বেজে পনের। কটেজের বাইরে তখন লোক নেই বললেই চলে। কাপল যারা এসেছিল তাদের কেউ কেউ তখন কটেজের বন্ধ দরজার ওপাশে প্রেম নামক অপ্রেমের শরীরী খেলায় মেতেছিল। কেউ হয়তো বিশ্রাম নিচ্ছিল। একটা গ্রুপ রিসোটের প্রমোদ তরী নিয়ে নদী ভ্রমণে বের হয়েছে। রিদম প্যান্ট গুটিয়ে সুইমিং পুলের স্বচ্ছ পানিতে বসে পড়ে।
হঠাৎ রিসোর্টে হইচই পড়ে যায়। স্টাফ, কর্মকর্তা কর্মচারীদের হুড়োহুড়ি, কিছু কটেজে স্টাফরা গিয়ে দরজা ধাক্কাতে থাকে। মুহূর্তে কী কথা হয় কে জানে, কয়েকটা ছেলেকে রিসোর্টের বাম দিকের কাঁটাতারের বেড়ার দিকে দৌঁড়ে যেতে দেখে। ওদিকটায় সবজি আর ফল বাগান করা হয়েছে। বাউন্ডারির বাইরে একটু দূরে স্থানীয় মানুষদের ঘরবাড়ি আছে। পুলিশের লোক দ্রুত কয়েকজনকে ধরে ফেলে। মহিলা পুলিশেরা কটেজ থেকে মেয়েদের আনতে যায়। রিদম স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ এক পুলিশ কর্মকর্তা এসে প্রশ্ন করে, “আপনি এখানে একা কী করেন? সাথে আর কেউ নেই?”
“আছে। বাকিরা রুমে। কী হয়েছে? আপনারা রিসোর্টে কেন এসেছেন? কোন অপরাধী লুকিয়ে আছে এখানে?”
“তাতো আছেই। আপনার সাথে কারা আছ? পরিবারের সদস্য না বন্ধু বান্ধব?”
“বন্ধু বান্ধব। কিন্তু আপনি এসব প্রশ্ন করছেন কেন? আমরা কোন অপরাধের সাথে জড়িত না। আমি ডাক্তার, মাত্রই ইন্টার্নি শেষ করলাম। আমার দু’জন বন্ধু আছে কটেজে, তারাও একজন ডাক্তার অন্যজন ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। অন্য বন্ধুরাও ভালো জায়গায় লেখাপড়া করে। আমরা কেউ খারাপ পরিবারের ছেলেমেয়ে না।”
ততক্ষণে পুলিশ সদস্যরা অনেকেই কটেজ থেকে বের করে এনেছেন। প্রমোদতরীকেও রিসোর্টে ভিড়াতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যারা পরিবার নিয়ে এসেছে তাদের আলাদা ভাবে রেখেছে। কিন্তু সবার কটেজেই সার্চ করা হচ্ছে। উপস্থিত অনেকেই ঘুরতে এসে এমন পরিস্থিতিতে পড়ে বিব্রত ও বিরক্ত। কেউ কেউ রাগারাগি শুরু করেছেন। বাকবিতন্ডা চলছে, কেউ বড়ো বড়ো কানেকশনর পরিচয় দিয়ে শাসাচ্ছেন।
“আপনারা ক্ষেপে যাচ্ছেন কেন? একটা অভিযোগের ভিত্তিতে সরকারি আদেশে আমরা এখানে অভিজানে এসেছি। আমাদের সাথে আইনের লোকজন আছেন। বিনা অপরাধে কাউকে সামান্যতম হেনস্তা করা হবে না নিশ্চিত থাকুন। আমরা অভিযোগ পেয়েছি এখানে ম*দ ও মা*দকদ্রব্য আছে। কলগার্ল নিয়ে অসামাজিক কার্যকলাপ হচ্ছে রিসোর্টের স্টাফদের সহায়তায়। একটা সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করতে এই অভিজান। একজন সুনাগরিক হিসেবে আপনারা আমাদের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করুন।”
অভিযান শেষে বেশ কয়েকজন উঠতি বয়সী তরুণ তরুণীর সাথে ফয়সাল, রিক্তা, রিদমসহ দলের বাকি সবাইকেও গাড়িতে ওঠানো হয়। ফয়সালের বন্ধু রাসেলের ব্যাগে ভ*দকা, রা*মের বোতলের পাশাপাশি এল*এসডি আর ইয়া*বাও পাওয়া গিয়েছে। আসলে রাসেল স্টুডেন্ট পরিচয়ের আড়ালে বেশকিছুদিন হলো মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে গিয়েছে। অল্প সময়ে অনেক আয়ের লোভে পড়ে এসব শুরু করেছে। টার্গেটে থাকে অবস্থা ভালো বন্ধু বান্ধব। শুরুতেই ইয়াবা, এলএসডির নাম নিলে অনেকেই ভয় পেয়ে যায়। তাই শুরুটা হয় গাঁ*জা ভর্তি সিগারেট বা ভদ*কার মতো পানীয় দিয়ে। আস্তে আস্তে ইয়া*বার টোপ ফেলে। এখনো ছোট ব্যবসায়ী তাই দামী মাদক বেশি আনতে পারে না। ইদানীং এসএ*ডির বেশ চর্চা হচ্ছে বলে সেটাও জোগাড় করেছে। একবার কাউকে নে*শা ধরিয়ে দিতে পারলেই হলো। বাকিটা এমনিই হয়, বিক্রেতা নয়, ক্রেতাই ওকে খুঁজে বের করে। ফয়সালের সাথে রাসেলের তেমন কোন ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল না। রাসেলই ফেসবুকে নিজ থেকে নক করে একদিন রিসোর্টে ফুর্তি করার আমন্ত্রণ দেয়। হালকা পানীয়র লোভ দেখায়। তবে অন্য সব মাদ*কের ব্যাপারে ফয়সালেরও কোন ধারণা ছিল না।
পুলিশের গাড়িতে রিক্তা ভয়ে কান্না করতে থাকে। ফয়সাল অনেক চেষ্টা করেছিল, পরিচয় ব্যবহার করে, টাকা দিয়ে হলেও এখান থেকে উদ্ধার পেতে। তবে সরাসরি মাদ*ক সহ ধরা পড়ায় তা সম্ভব হয় না। তাছাড়া তারা সবাই যে ড্রিংস করেছে তা স্পষ্ট। রিদমের আইডি কার্ডসহ ব্যাগ রুমে পাওয়া যাওয়ায় রিদমকেও সাথে নেওয়া হয়। থানায় গিয়ে অনেক কাকুতিমিনতি করায় রিদমকে মিডিয়ার সামনে দেয়নি পুলিশ। যেহেতু অভিযানের সময় সে রুমে ছিল না, তাছাড়া তার মুখে পরীক্ষা করে ম*দের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তবে পুলিশ তাকে সহজে ছেড়েও দেয়নি। ভালো পরিমাণ থানা পুলিশের চক্কর কাটতে হয়েছে, মুচলেকা দিতে হয়েছে বড়ো পরিমাণ অর্থের। আর এইসব কিছু হয়েছে গত পনের দিনে।
এই পনেরদিনে জীবনের এক অন্য রূপ দেখে ফেলেছে রিদম। রিক্তার পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। ওদের ঘটনা ভাইরাল হতে সময় লাগেনি। কলেজের সিনিয়র, জুনিয়র সবার মুহুর্মুহ ভিডিও ক্লিপস শেয়ারে খুব সহজেই রিক্তা আর ফয়সালের ঘটনা ছড়িয়ে পড়েছিল। রিদমও যে সেই দলে ছিল, চাপা পড়ে না সেই ঘটনাও। রিদমকে মিডিয়ার সামনে না আনার কারণ নিয়ে হয় নানা জল্পনা। কেউ বলে রিদমের কোন প্রভাবশালী আত্মীয় সাহায্য করেছে, কেউ বলে প্রচুর টাকা ঢেলেছে। পুরো দলে সবচেয়ে কম সামর্থ্য আর ক্ষমতার পরিবার রিদমেরই ছিল। ভাগ্য ভালো আরও খারাপ ভাবে ফাঁসেনি। তবে টাকা খরচ হয়েছে। যে ফুপুর সাথে মায়ের বনিবনা হয় না, সেই ফুপা ফুপিই সবকিছু করলেন। রিদমের মা রীতিমতো ননদের কাছে কৃতজ্ঞতায় নুয়ে গেলেন। তবে ছেলেকে শাপশাপান্ত করতে ভুলেননি। রিক্তাকে সোলায়মান সাহেব বাড়িতে নিয়ে গিয়েছেন। ফাইনাল প্রফেশনাল পরীক্ষা দিতে পারবে না রিক্তা। কলেজ থেকে ছয়মাসের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। ফয়সালের যেহেতু ইন্টার্নি শেষ তাই কলেজে কোন সমস্যা হয়নি, তবে ফয়সালের বাবাও ছেলেকে চিটাগং নিয়ে গিয়েছেন।
এই এক ঘটনায় আরেকজন মানুষের জীবনেও চলে এসেছে উথাল পাতাল পরিবর্তন। অরণী সেদিন ফোন ধরেনি বলে রিদমের মনে জন্ম নিয়েছে ক্ষোভ। অরণী ব্যাখ্যা করার সুযোগটাও পায়নি। সামনাসামনি দেখা করবে সে সুযোগও পাচ্ছে না। রিক্তার ঘটনার পর অরণীর বাবা জামিল সাহেব অরণীকে যখন তখন বের হতে অনুমতি দিচ্ছেন না। পরীক্ষার আগে কোন বাহানা ছাড়া বেরও হওয়া যায় না।
অরণী আর রিদমের ভালোবাসার নৌকা যেন হঠাৎ নদী ছেড়ে মোহনায় চলে এসেছে। ডুবোডুবো নৌকাটা যেন হেলে পড়ছে অথৈ সাগরের দিকে। নদীর স্রোতেই যার গতিপথ বন্ধুর ছিল, সে কী পারবে সাগরের সাথে পাল্লা দিতে! সেই নৌকার মাঝি যেন একাকী অরণী। একবুক অভিমান নিয়ে রিদম দূরে সরে আছে। অরণী যত চেষ্টা করছে রিদমের বুকে নোঙর ফেলতে, রিদম যেন ততই স্রোতের সাথে হারিয়ে যাচ্ছে। মাঝেমাঝে ঘুমের ভেতর অরণীর মনে হয় ও ডুবে যাচ্ছে, নাকেমুখে পানি ঢুকে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আঁকড়ে ধরতে চাইছে রিদমকে, যে কখনো বলেছিল, অরণী তার হৃৎস্পন্দন। অথচ আজ এই স্পদনকে দূরে ঠেলে রিদম কিভাবে বেঁচে আছে! অপরাধবোধ, কষ্ট আর অভিমানের জ্বালায় জ্বলে মরছে দুটো হৃদয়। কে অপরাধী আর কার অপরাধ কেউ জানে না, কিন্তু দুজনেই বুঝতে পারছে তাদের সামনে গড়ে উঠেছে দেয়াল। অরণী কী পারবে সেই দেয়াল ভাঙতে!
(চলবে)