#স্বপ্ন_কেনার_দামে
#দ্বিতীয়_খন্ড
৬
“যখনি গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ, মরিবার হলো তার সাধ”
জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কবিতা ‘আট বছর আগের একদিন’। সেই কবিতারই লাইনগুলোই আবৃত্তি করছিল অরণী। একসময় খেলাঘরে আবৃত্তি শিখতে যেত অরণী। মাকে অনেক বুঝিয়ে গান আর আবৃত্তির ক্লাসে ভর্তি হয়েছিল। কোচিং এর পর মায়ের হাত ধরেই ক্লাসে যেত। কিন্তু দাদী টের পেয়ে যান, অরণীর ফুপু খেলাঘরের বাহিরে দেখে ফেলেছিল অরণী আর হুমায়রা বেগমকে। বাসায় না জানিয়ে ক্লাস এইটে পড়া মেয়েকে এসব শিখতে দিচ্ছে বলে সবাই ভীষণ ক্ষেপে উঠেছিল অরণীর মা হুমায়রা বেগমের উপর। হুমায়রার ভাই প্রেম করে বিয়ে করেছে, কবে তার পরিবারের কোন সদস্য পালিয়ে গিয়েছে সেসব ইতিহাস তুলে আচ্ছামতো অপমান করেছে। জামিল সাহেব বরাবরের মতো মাকে সমর্থন করেছেন। তাছাড়া ওনার কাছে পড়ার বাইরে আর যেকোন কাজই আউট ওয়ার্ক মনে করেন। ছবি আঁকা, গান গাওয়া, নাচ শেখা, গল্পের বই পড়া সবকিছু অপ্রয়োজনীয় কাজ, সময় নষ্ট। তিনমাসের মাথায় তাই অরণীর গান আবৃত্তি শেখার সমাপ্তি হয়। গান চর্চা ছাড়া গলায় ভালো বসে না, তবে আবৃত্তি অরণী এখনো চালিয়ে যাচ্ছে। অনেকটা একাকী নিভৃতে, বারান্দায় ঝোলানো বেতের দোলনায় দুলতে দুলতে অরণী আবৃত্তি করে। ঘরের ভেতর সেই আবৃত্তির মুগ্ধ তিনজন শ্রোতা আছে। মা, অমিয় আর দাদাী! বিস্ময়কর হলেও অরণীর দাদী অরণীর ভরাট কণ্ঠের আবৃত্তিতে মুগ্ধ হোন প্রতিবার। এখন ওনার মাঝেমাঝে মনে হয় নাতনিকে গানটাও শিখতে দিতে পারতেন। একসময় মানুষ বলতো নাচ গান ভালো পরিবারের ছেলেমেয়েরা করে না। কিন্তু এখন এসব গুণকে ভীষণ উৎসাহ দেওয়া হয় স্কুল,কলেজ, ভার্সিটিতে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অরণীর শাহানা ফুপু তখন এসবের ঘোর বিরোধী থাকলেও পরবর্তীতে নিজের ছেলে রাতুলকে ঠিক ভর্তি করিয়েছিলেন গান শিখতে। কিন্তু কিছু গুণ, কিছু কলা ঈশ্বরপ্রদত্ত, তাই হয়তো শাহানা খুব চাইলেও রাতুলের গলায় গান আসেনি। রাতুলের ইচ্ছেই ছিল না। অরণীর কাছে যা আরাধ্য ছিল, রাতুলের কাছে তা অবহেলার। কিন্তু অরণীকে ছাড়তে হয়েছে পরিবারের চাপে, আর রাতুলকে ছয়মাস টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে শেষে শাহানা নিজেই ক্ষান্ত দিয়েছেন।
“শোনা গেল লাসকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে— ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হ’লো তার সাধ;
বধূ শুয়েছিলো পাশে— শিশুটিও ছিলো;
প্রেম ছিলো, আশা ছিলো— জ্যোৎস্নায়– তবু সে দেখিল
কোন্ ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল— লাসকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।
এই ঘুম চেয়েছিলো বুঝি!
রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি
আঁধার ঘুঁজির বুকে ঘুমায় এবার;
কোনোদিন জাগিবে না আর।”
“অরু, কাঁদিস কেন?”
“কিছু না আম্মু। কবিতা আবৃত্তি করতে করতে একটু আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়েছিলাম।”
“কী বোকার মতো কথা বলিস। এগুলো পড়ে কান্না করতে আছে! তবে তুই খুব দরদ নিয়ে আবৃত্তি করছিলি।”
অমিয়ও বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। অমিয় বেশ মুখচোরা। কথা বলে কম, শোনে বেশি। সারাদিন বাসায় থাকলেও কেউ বলতে পারবে না ঘরে একটা ছেলে আছে। নিজের দুনিয়া বানিয়ে নিয়েছে রুমে, নিভৃতে সেখানেই সারাদিন কাটায়।
“আপু, এই কতিতার মানে কী?”
“আট বছর আগে আত্মহত্যা করা এক ব্যক্তির, আত্মহত্যা করার কারণ খুঁজছে কবি। জাগতিক নিত্য পরিচিত কোন কারণে লোকটা আত্মহত্যা করেনি, তবে কেন করলো! তারই উত্তর খোঁজা হচ্ছে।”
“আপু, তুমি কিন্তু ইউটিউবে আবৃত্তির চ্যানেল খুলতে পারো। ব্যাকগ্রাউন্ডে মিউজিক দিয়ে আবৃত্তি করবে। অনেকেই এখন গান, আবৃত্তি, ছবি আঁকার চ্যানেল খুলে অনেকেই পরিচিত পাচ্ছে।”
“চুপ কর অমিয়। তোর আব্বু আর দাদী শুনলে রাগ করবে। এমনি নিজের ভালো লাগার জন্য আবৃত্তি করছে তাই করুক।”
অরণীর দাদীও পায়ে পায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন। হুমায়রার কথা শুনে বলেন, “জামিলের বৌ, সারা জীবন খালি নাতি, নাতনির কানে দাদীর নামে বিষ ঢাইল্লা গেলা। আমি কী খারাপ চাই? আমি অরণীরে ভালোবাসি না? অরণী কবিতা কয়, এইটার আমি কোনদিন বদনাম করছি? কিন্তু মেয়ে বিয়া দিবা, সেখানে তারা যদি নাচ গান করা পছন্দ না করে, তখন ছাড়তে মেয়েরই কষ্ট হইতো। সেই জন্য ছোট থাকতেই গান বাজনা নিষেধ করছিলাম।”
“আম্মা, আমি বদনাম করলাম কই? সামান্য কথা বললেই বিষ ঢালা হইলো? আপনি সারাক্ষণ আমার কথার ভুল মানে বের করেন।”
দাদী, আর মা, কেউ কাউকে সহ্যই করতে পারে না। চোখের ইশারায় অরণী অমিয়কে সরে যেতে বলে। নিজেও উঠে যায়। “হইছে আম্মু, দাদী বাদ দাও তো। আমার গানের শখ কবেই মরে গিয়েছে। এখন শখ করে একটু কবিতা আবৃত্তি করি, তোমাদের যন্ত্রণায় সেটাও বাদ দিতে হবে।”
পড়ার টেবিলে বসে অমিয়র কথাটা ভেবে দেখে অরণী। বিষয়টা খারাপ না, আজকাল অনেক সাহিত্য গ্রুপেও কবিতা আবৃত্তি বিষয়টাকে উৎসাহ দিতে দেখছে। ছোট গল্প, কবিতা এসব সুন্দর করে পাঠ করে আপলোড করে অনেকেই। অরণীর প্রফের রিটেন শেষ, ভাইবা আছে আর একটা। সেটা হয়ে গেলে শান্ত ভাবে অমিয়কে সাথে নিয়ে একটা ভিডিও করে দেখবে কেমন হয়। পরীক্ষার সময় এতটাই মনকে পড়ায় ব্যস্ত রেখেছে যে রিদমকে ভেবে কষ্ট পাওয়ার প্রহরটা কমে গিয়েছিল। শুধু রাতের পর রাত ঘুমাতে পারেনি। বালিশে মাথা রাখলেই একরাশ চোখের জলে কখন বালিশ ভিজে গিয়েছে বলতে পারে না। চোখের নিচে জমে থাকা কালি, আর মলিন মুখ দেখে দাদী রোজ আফসোস করেন। বলেন পড়তে পড়তে নাতনির সোনার মুখ যেন মলিন হয়ে গেল। “ও অরণী। আর পড়িস না। এত পড়লে পাগল হয়ে যাবি। মাথায় কাকের বাসা, চোখে কালি। কে বলবে এই মেয়ের কয়দিন পর বিয়ে হবে। জামাইয়ের পরিবার বলবে মেয়ের কোন যত্ন নেই নাই আমরা।”
বিয়ে, এই বিয়ে শব্দটা শুনলে অরণীর মাথায় বাড়ি পড়ে। গিয়েছিল সে রিদমের কাছে, বহু অনুনয় করে পাঁচ মিনিট নিয়েছিল। কত বাহানা করে, জরুরি নোটসের কথা বলে ছুটে গিয়েছিল অরণী। রিদম বিএসএমএমইউতে পিজিটি ট্রেইনিং এ ঢুকেছে ছয় মাসের জন্য। ডিউটি সকাল আটটা থেকে দুইটা। পাশাপাশি একটা চেম্বারে যায়। বিকেল চারটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত সেখানে থাকে। বলতে গেলে রিদমের জীবনেও যেন এখন অরণীর ছায়া আর নেই। মাঝেমাঝে কাগজপত্রের ভেতর কাবিননামাটা চোখে পড়ে, তখন মনে হয় তার একটা বৌ ছিল, বা এখনো আছে। কিন্তু সেই পাগলপারা মাদকের মতো টান আর নেই। এত এত ঘটনা ঘটে গিয়েছে জীবনে যে আর প্রেম প্রেম অনুভূতিটাই অনুভব হয় না।
সেদিন অরণী এসেছিল ভালোবাসার পসরা নিয়ে, আর রিদম সমস্ত অভিযোগ সাথে করে। নিজের ভুলগুলো, না পাওয়াগুলো, অপ্রাপ্তির অভিযোগগুলো দিয়ে শুধু রক্তাক্ত করেছে অরণীকে। অরণী বুঝেছিল সুতো কেটে গিয়েছে। কাগজের এক টুকরায় শুধু বাঁধা আছে ওরা দু’জন, আর সাক্ষী আছে চারজন মানুষ, রিক্তা, ফয়সাল, মামুন ভাই আর শুভ। যারা তাদের বিয়েতে উপস্থিত ছিল সেদিন। রিদমকে জিজ্ঞেস করেছিল অরণী, “রিদম, তুমি কী বিয়েটা ভাঙতে চাইছো তবে? এত অভিযোগ নিয়ে নতুন জীবন কী করে শুরু করবো আমরা।”
“জীবন তো তোমার অরণী। আমার জীবন তো কবেই এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। পরিবারের ভালো ছেলেটা সবার কাছে একদিনে খারাপ হয়ে গেল। মায়ের চোখের দিকে তাকাতে পারি না লজ্জায়। সেই সকালে বের হই, গভীর রাতে ফিরি। মাথার উপর টাকার চাপ, কলঙ্ক। এর ভেতর তোমার এসব প্রেম প্রেম ন্যাকামি আমার ভালো লাগে না আর। কাগজের বিয়ে তুমি চাইলে কাগজেই শেষ হয়ে যাবে। তুমি আব্বুর লক্ষী মেয়ে হয়ে সেটেল্ড পাত্রকে বিয়ে করে নিও। আমি বাঁধা দেব না।”
“তবে তাই হোক রিদম।”
অরণী জানে না পরিণতি কী আছে। তবে খুব শীঘ্রই একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে। প্রফ শেষ হতেই বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হবে। বিবাহিত অরণী চাইলেও আরেকজনকে কবুল বলে চলে যেতে পারবে না। বিয়ে করাটা যত সহজ ছিল, ভাঙাটা ততটাই কঠিন যেন। সবকিছু হঠাৎ ভীষণ জটিল হয়ে গিয়েছে। অরণী কার কাছে সাহায্য চাইবে, কার পরামর্শ নেবে বোঝে না।
(চলবে)