#দ্বিতীয়_খন্ড
#স্বপ্ন_কেনার_দামে
#১
ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। ঘরোয়া খাবারঘরের নিচতলায় যেখান থেকে সিঁড়ির শুরু হলো, তার উপর ছোট্ট এক টুকরো টিনের ছাউনি। তাতেই গাদাগাদি করে একদল স্টুডেন্ট দাঁড়িয়ে আছে। রিদম, অরণীকে হাত দিয়ে আগলে রেখেছে, এই ভীরের ভেতর হঠাৎ অসদুপায় নিয়ে কেউ যেন ছুঁয়ে দিতে না পারে। রিদমের এই দায়িত্ব আর অধিকারবোধটা অরণী কিন্তু উপভোগ করছে। আজ কাঁধের উপর আগলে রাখা রিদমের হাতটা অস্বস্তি না বরং ভালোবাসার মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই হাত এভাবেই ওকে আগলে রাখুক।
অরণী এমনিতেও ভীতু ধরনের মেয়ে, স্কুল কলেজ সব জায়গায় সকালে বাবার হাত ধরে গিয়েছে, ছুটির সময় মায়ের হাত ধরে ফিরেছে। মেডিকেলে পড়ার সময় আসা যাওয়ার সময়টুকু ছাড় পেলেও মন থেকে সেই আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি দূর হয়নি। রাস্তায় হোক বা কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় হোক, অরণীর উপর তার পাশের মানুষটার প্রভাব থাকে অনেক বেশি। স্কুল, কলেজ, মেডিকেল কোথাও বাবার অনুমতি ছাড়া পিকনিকেও না যাওয়া মেয়ে অরণী যে কী করে এভাবে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেল, তা রিদমের কাছে বিস্ময়ের হলেও রিদমের বন্ধু ফয়সালের কাছে একদম নয়।
ফয়সাল প্লে বয় ধরনের ছেলে। কোন মেয়ের দৌড় কতটুকু, আর কাকে ধরার জায়গা কোনটা তা সে সহজেই পড়ে ফেলে। ফয়সাল তাই রিদমকে ঠিক বুঝিয়েছিল যে অরণীকে রাগ দেখিয়ে নয়, বরং ইমোশনাল করে পাওয়াটা সহজ। রিদমের আত্মহত্যা করার চেষ্টা, সাথে বন্ধুদের ওকে রিদমকে বিয়ে করতে বোঝানোর সময়টা অরণী পরিষ্কার করে কিছুই চিন্তা করতে পারেনি। বাবা মায়ের কথা ভেবে একেকবার প্রচন্ড অপরাধবোধ হচ্ছে, আবার পরমুহূর্তে মনে হচ্ছে, যদি রিদম আত্মহত্যা করতো, তবে ও কী নিয়ে বাঁচতো, না নিজেকে ক্ষমা করতে পারতো। মন আর বিবেকের যুদ্ধে প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিল অরণী।
তবে এমুহূর্তে রিদমের পাশে স্ত্রী রূপে নিজেকে আবিষ্কার করে অরণীর মনে হয় সে কঠিন কোন অন্যায় করেনি। ঠিকই তো, ফাইনাল প্রফেশনাল এক্সামের পর যদি ও বাসায় রিদমের কথা বলতো, তাহলে কী ওনারা মেনে নিতেন! বরং বাসায় বন্দী করে নিজেদের পছন্দের ছেলের সাথেই বিয়ে দিতেন। এখন তো চাইলেও আর অন্য কারও সাথে বিয়ে দিতে পারবে না, কাবিননামা করা হয়ে গিয়েছে। অরণীর উপর বাবামায়ের মতো এখন রিদমের হকও কম নয়!
“এই অরু, অরণী। কী ভাবছো? বৃষ্টিতে ভিজবে?”
অবাক হয় অরণী। রিদম বলছে এই কথা! এত মানুষের সামনে রাস্তায় ভিজতে চাইছে, যেখানে কলেজ ক্যাম্পাসেও রাজি হয় না।
“কী বলো, এই রাস্তায়? এত লোকজন।”
“এখানে না, রিকশা নিয়ে গুলশান পার্কে যাই চলো। জীবনে তো গেলে না বয়ফ্রেন্ডের সাথে, এখন হ্যাসবেন্ডের সাথে নিশ্চয়ই আপত্তি করবে না। না হলে
যমুনা ফিউচার পার্কের পেছনে কিছুদূর গেলে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বড় জায়গা জুড়ে খোলা মাঠ, আর পিচঢালা রাস্তা আছে। রিকসা নিয়ে অনেক কাপলই সেখানে ঘুরতে যায়। শরতে যখন কাশফুল ফোটে, তখন মানুষের ঢল নামে। সেখানেও যেতে পারি।”
“আবার পার্ক!!! কী অভিজ্ঞতা হয়েছিল মনে নেই? ”
“না বোকা, রমনা পার্ক, গুলশান পার্ক এগুলো নিরাপদ। আর বেশি ভেতরে যাব না। লেকের পাশে বেঞ্চে বসবো আর তোমার হাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজবো। যাবে?”
“যাব।”
প্রথম যেদিন পার্কে এসেছিল, কী ভীষণ ভয়, লজ্জা আর অস্বস্তি ছিল। কিন্তু আজ অরণীর অনেক বেশি নির্ভার লাগছে। মনে হচ্ছে তার হ্যাসবেন্ডের সাথে আছে, এখন তারা বৈধ স্বামী স্ত্রী। কার অধিকার আছে কটু কথা বলার।
লেডিস পার্কে এসেছে অরণী আর রিদম। বেশিক্ষণ বসতে পারবে না। কিছুক্ষণ পর পার্ক দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ করে দেবে, শুধু যারা হাঁটবে তারাই ঢুকতে পারবে।অরণী আর রিদম শান বাঁধানো ঘাটের এক কোণায় বসেছে। এদিকটা নিরিবিলি। বৃষ্টি এখনো পড়ছে, তবে আগের মতো তীব্র না। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোঁটা আর ঠান্ডা বাতাসে কেমন কাঁপুনি লাগছে। কিন্তু অরণী আর রিদমের এত ভালো লাগছে, মনে হচ্ছে সময়টা যদি এখানেই থেমে যেত। অরণীকে আর বাসায় ফিরতে না হতো, রিদমের মাথায় মধ্যবিত্তের বড় সন্তান হওয়ার এত চাপ না থাকতো। সব ভুলে যদি এখানেই সময়টা থেমে যেত, কী ভালোই না হতো।
হঠাৎ শব্দ করে দূরে কোথাও বাজ পড়ে। অরণী ভয়ে রিদমের আরও কাছে ঘেঁষে বসে। যতটা কাছাকাছি বসলে নিঃশ্বাসের উষ্ণতা টের পাওয়া যায়৷ যতটা কাছাকাছি বসলে শরীর নিজের ভাষায় কথা বলতে থাকে। মৌন সম্মতির সাথে সেই শরীরী ভাষা পড়তে রিদমের দেরি হয় না। অরণীর ঠোঁটে আঁকা হয়ে যায় ভালোবাসা আর বৃষ্টিতে মাখামাখি প্রথম চুম্বন। ঠান্ডায় না শিহরণে বারবার কেঁপে কেঁপে ওঠে অরণী, তা বোঝার আগেই নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়।
“আজ উঠি রিদম। এমন খোলামেলা জায়গায় এসব ঠিক না। মানুষ নোংরা কথা বলবে। সবাই তো আর জনে না আমরা স্বামী স্ত্রী।”
রিদমও নিজেকে সামলে নেয়, “স্যরি অরণী। আসলে তুমি এতটা কাছে আসলে। আর এখন তো সামাজিক বাঁধাও নেই। অরণী, ফয়সালের মেসে যাবে? আমি ফোন করলে ও রুম ছেড়ে দেবে।”
অরণী এক জটকায় উঠে দাঁড়ায়। “রিদম, আমরা বিয়ে কিন্তু এই জন্য করি নাই যে ঝোপ ঝাড়ে, মেসে কাছাকাছি আসতে পারবো।আমাদের বিয়ে করার কারণ ছিল একে অন্যকে যেন হারাতে না হয়। বাকি এখন আর আমার অন্য কারও হওয়ার ভয় নেই। এখন এসব নিয়ে অস্থির না হও প্লিজ। সামনে আমার প্রফ, তোমার এফসিপিএস পরীক্ষা। একসাথে থাকতে হলে আমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।”
“অরণী, এখনো বাহানা করে আমাকে দূরে ঠেলে দিবে? এখনো তোমাকে কাছে পাওয়ার অধিকার হয়নি?”
“অবশ্যই হয়েছে। কিন্তু তার জন্য আমাকে তোমাদের বাসায় তুলে নাও। এছাড়া আমি অন্য কারও বাসায়, মেসে যেতে পারব না। প্লিজ রিদম, আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু ভালোবাসার জন্য আমার সম্মান বিসর্জন দিতে বলো না।”
“আমার বাসার অবস্থা তো তুমি জানো অরণী। এখন তোমাকে ওঠানো সম্ভব না। বাবা মা আশা করে আছেন। আমার ছোটবোনের বিয়ে বাকি।”
“আমি অপেক্ষা করবো রিদম। তুমিও করো।”
অরণী গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করে। রিদম কষ্ট পেয়েছে বুঝতে পারছে। কিন্তু রিদম যা চাইছে তা অরণীর পক্ষে সম্ভব না। আবার রিদমকে এভাবে ফেলে যেতেও মনটা ভেঙে যাচ্ছে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে ধন্যবাদ দেয় অরণী। চোখের জলগুলো ধুয়ে ফেলেছে, রিদমের কাছে ওকে দুর্বল করে দেয়নি।