#স্বপ্ন_কেনার_দামে”
#দ্বিতীয়_খন্ড
৭
“তোমার চুলে যে রোদ—মেঘের মতন চুলে—তোমার চোখে যে রোদ—সেও যে মেঘের মতো চোখ
কেমন বৃষ্টি ঝরে—মধুর বৃষ্টি ঝরে—ঘাসে যে বৃষ্টি ঝরে—রোদে যে বৃষ্টি ঝরে আজ”
অরণী জীবনানন্দ দাশের ‘কেমন বৃষ্টি ঝরে’ কবিতাটা আবৃত্তি করলো আজ। অমিয় বৃষ্টির মধুর শব্দ ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে এড করে দিয়েছে। এই কবিতা অরণীর চ্যানেলের চতুর্থ কবিতা। চ্যানেলে সাবস্ক্রাইবার বলতে শুধু পরিবারের মানুষ আর বন্ধু বান্ধব ছিল। চ্যানেলের কবিতাগুলো নিজের ওয়ালে শেয়ার করেছে। তাতে অল্প কিছু মানুষের নজরে এসেছিল। দুই সপ্তাহ আগে অমিয় অরণীকে চ্যানেলটা খুলে দেয়, তখনও অরণী নিশ্চিত ছিল না কতটা সাড়া পাবে। সাহস করে নামকরা সাহিত্য গ্রুপে প্রথম কবিতাটা পোস্ট করেছে পাঁচদিন আগে। বিস্ময়কর হলো সেখানে অরণীর আবৃত্তি ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। চ্যানেলের পিন পোস্ট নিজের ফেসবুকে পাবলিক করে পোস্ট করা ছিল। ঐ কবিতার লেজ ধরে অনেক অচেনা মানুষ তার চ্যানেলে চলে এসেছে। এই কাজটা অরণী তাই ভীষণ ভাবে উপভোগ করতে শুরু করেছে। মজার ব্যাপার হলো দাদী বাঁধা দিবে মনে হলেও, এইবার অরণীর বাবা জামিল সাহেবের কাছে অরণীর আবৃত্তি করার প্রস্তাবটা বরং দাদীই রাখেন। মায়ের কথা ফেলতে পারেনি জামিল সাহেব। আর আজকাল পড়ালেখার ক্ষতি না করে নাচ, গান, আবৃত্তি, ছবি আঁকা সহ খেলাধুলা করা বরং বাড়তি গুণ হিসেবেই সবাই দেখা শুরু করেছে। একসময় মেয়ের গান গাওয়া নিয়ে আপত্তি থাকলেও আবৃত্তি নিয়ে আপত্তি করেন না। তবে এটাও জানিয়ে দেন, বিয়ের পর অরণীর শ্বশুর বাড়ির আপত্তি থাকলে তখন এই নিয়ে ঝামেলা করতে না!
অরণীর হবু বর মাহিদের সাথে টুকটাক ফোনে কথা বলা শুরু হয়েছে। এই তো কয়েকদিন আগে বাগদান সম্পন্ন হয়েছে। ঘরোয়া অনুষ্ঠানে মাহিদের মা বেন এসে আঙটি পরিয়ে গেলেন। অরণীর মা হুমায়রা জানিয়েছেনন বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়েছে। এখন যেহেতু অরণীর পরীক্ষা শেষ তাই মাহিদের পরিবার দেরি করতে চাইছে না। অরণী জানতো আজ না হয় কাল তার কাছে মাহিদের ফোন আসবে। হয়েছেও তাই। বাগদানের পর মাহিদ নিয়মিত ফোন দিচ্ছে। অরণী বাগদানের কোন ছবি ফেসবুকে দেয়নি। কিন্তু ওর কাজিনরা ওকে ট্যাগ করে বেশ কিছু ছবি দিয়েছে। তেমনি একটা ছবিতে রিদম ‘কংগ্রাচুলেশনস’ কমেন্ট করেছে। অরণী হাসবে না কাঁদবে বোঝে না। সবকিছু খুব দ্রুততার সাথে হচ্ছে। ফুপুরা বাসায় আসছেন যখন তখন। পরিবারে অরণী বড়ো মেয়ে, সবাই ভীষণ আনন্দে অপেক্ষা করছে বিয়ের। ফুপাতো ভাইবোন, মামাতো ভাইবোন সবার উৎসাহের শেষ নেই। হলুদের থিম কী হবে, কোন গানে কে নাচবে তাই নিয়ে আলোচনা, ঝগড়া সব চলছে। হুমায়রা বেগম হাঁপানির টান ভুলে গিয়ে হাসিমুখে মেহমানদারি করছেন। রাশভারি জামিল সাহেবও এই সময় শ্বশুর পক্ষের আত্মীয় স্বজনকের সাথে আন্তরিক ব্যবহার করছেন। একমাত্র মেয়ের বিয়েতে সবাই যেন পারিবারিক দ্বন্দ্ব ভুলে অংশগ্রহণ করে, সেই দিকটা নিজেও মাথায় রেখেছেন।
এই সবকিছুর ভেতর যদি কেউ ভীষণ অস্থিরতায় ভুগে তিলতিল করে ক্ষয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে তা অরণী। একজনের নামকাওয়াস্তে স্ত্রী হয়ে আরেকজনের দেওয়া বাগদানের আঙটি পরে ঘুরছে। সময়ে সময়ে আঙটিটা খুলে রাখে, যতক্ষণ সেটা হাতে থাকে, যেন কাঁটার মতো বিঁধতে থাকো। অরণীর সমস্ত ব্যথা, ভয়, চিন্তা যেন আবৃত্তির আঙিনায় আছড়ে পড়ছে। শব্দের গাঁথুনি আর উচ্চারণে ছড়িয়ে পড়ে হাহাকার আর মায়া। চোখের ভাষায় যেন জীবনের আবেদন। অরণীর আবৃত্তির ভক্তদের একজন মাহিদ। সত্যি বলতে অরণীকে প্রথম দেখায় মাহিদের ভীষণ ভালো লেগেছিল। আর যত দিন যাচ্ছে তত যেন মাহিদের চিন্তা চেতনার জগত অরণী গ্রাস করে নিচ্ছে। কিন্তু কোথাও যেন কী নেই। ফোনের এই প্রান্তে মাহিদের যতটা উচ্ছ্বাস, অপর প্রান্তে অরণী যেন ততটাই নিস্তরঙ্গ। মাহিদের মাঝেমাঝে মনে হয় সে একাই কথা বলছে, অরণী থেকেও নেই। বিয়ে নিয়ে, কেনাকাটা নিয়ে কোনকিছু নিয়েই যেন অরণীর আগ্রহ নেই। তবুও তো মাহিদের আকর্ষণ কমে না। অরণীর মেঘ কালো পিঠ ছাপানো চুল, কাজল কালো চোখ, শ্যামল মুখের মায়া, আর ঠোঁটের উপর কালো তিলের ছোঁয়া যেন চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। যেভাবে আলো টেনে আনে পতঙ্গ। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও পতঙ্গ নিজেকে আটকাতে পারে না। তেমনি অরণী নামক আলো ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মাহিদকে।
“হ্যালো।”
“হ্যালো অরণী, মাই গড। কী চমৎকার আবৃত্তি করলে তুমি। বিশ্বাস করো অন্তত পাঁচ বার শুনে ফেলেছি একঘন্টায়। আমার আপা, দুলাভাই সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। বলছে, আমি না কী কবিতা শুনছি না, তোমাকে দেখছি। অবশ্য তোমাকে দেখছি বললেও ভুল না। কলাপাতা রঙে তোমায় খুব মানিয়েছে। কাজল কালো চোখ, খোলা চুল, আর কলাপাতা রঙের শাড়িতে তুমি যেন বনলতা সেন।”
“তাই নাকি! ভালোই তো। ধন্যবাদ।”
মাহিদ একটু দমে যায়। সত্যি অরণীকে খুব সুন্দর লাগছিল। মাহিদ ভেবেছিল এমন প্রশংসায় অরণী খুশি হবে। কিন্তু এমন নিষ্প্রাণ ধন্যবাদে সমস্ত উত্সাহে ভাটা পড়ে যায়।
“অরণী, একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল। আজ বাদে কাল হলুদ। কিন্তু তোমাকে একটুও খুশি মনে হচ্ছে না। বিয়ের কেনাকাটা নিয়েও কোন আগ্রহ নেই। আমাদের তো শপিং এ যেতে হবে। আচ্ছা আমাকে কী তোমার পছন্দ হয়নি? তোমার কী ডাক্তার ছেলে পছন্দ ছিল।”
অরণী একবার ভাবে মাহিদকে সব সত্যি বলে দেবে যে ওর ডাক্তার ছেলে নয় পছন্দ নয়, বরং ওর নিজের একজন ভালোবাসা মানুষ আছে। যার সাথে সে কখনো এই সময়গুলোর স্বপ্ন দেখেছিল। হলুদে পড়বে গাড় সবুজ ঢাকাই জামদানি, সাথে কাঁচা ফুলের গয়না। বিয়েতে ট্রেডিশনাল লাল বেনারসি সাথে সনাতনী ডিজাইনের কাটাইয়ের গহনা, আর একমাথা বেলীফুল দিবে খোঁপায়। সাজটা হবে ভীষণ সাধারণ, কিন্তু স্নিগ্ধতায় ভরপুর। অফহোয়াইট পাঞ্জাবিতে বরের চেহারা যখন কল্পনা করে, রিদম ছাড়া সেখানে আর কারও চেহারা যে আসে না।
“অরণী, আছ?”
“জ্বি। শপিং এ কবে যেতে হবে? আপনার সাথে কিছু কথাও ছিল।”
“কাল অফিস শেষে তোমাকে নিয়ে যাই? চারটার দিকে আসবো। আমার সাথে আমার বোন দুলাভাই আসবে। তুমি কাকে নিবে?”
“আমার ছোট ফুপু যাবেন। অমিয়কেও নিতে পারি।”
“ঠিক আছে কাল দেখা হবে। চিন্তা করতেও ভালো লাগছে। অরণী তোমার কথা জানি না। আমি কিন্তু তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আমাকে চেনার আর বোঝার চেষ্টা করো। আমার বিশ্বাস আমাকেও তোমার ভালো লাগবে।”
টিক টিক টিক। ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে এখন রাত দশটা। অরণী ঠিক করে আর নয় লুকোচুরি। কিন্তু কী বলবে মাহিদকে, আর কতটুকু বলবে!
(চলবে)