#স্বপ্ন_কেনার_দামে
#দ্বিতীয়_খন্ড
পর্ব ১০
“রিদম, এখানে কী করো? কেউ দেখে ফেললে সমস্যা হবে। হাত ছেড়ে দাও প্লিজ।”
“আশ্চর্য অরু, আমি তোমার হাত ধরেছি এটা কেউ দেখে ফেললে সমস্যা হবে? অথচ তোমার হাত ধরার অধিকার যদি কারও থেকে থাকে তাহলে সেটা একমাত্র আমার অরু। ভুলে যেও না আমরা এখনো স্বামী স্ত্রী।”
“আমি তো ভুলিনি রিদম। তোমার কাছে স্ত্রী শব্দের মানে কী আমি জানি না। তবে আমার কাছে স্বামী শব্দের মানে সবসময় রিদমই ছিল। চায়ের কাপ হাতে ছাদে জ্যোৎস্না দেখার স্বপ্ন রিদমই ছিল, শরতের কাশবনে আকাশ নীল শাড়ি আর চুড়ি পরে হাত ধরে হাঁটার হাতটা রিদমেরই ছিল। কিংবা আমার কবিতা পড়ার প্রহরগুলোয় যদি কারও কোলে মাথা রাখার কথা ভেবেছি, তাও রিদম ছিল। তুমিই আমাকে বুঝিয়েছ, আমার ভাবনাগুলো বড্ড বাচ্চামিতে ভরা। আমার খেয়ালগুলো সব খেয়ালি সুতোয় বোনা। আমাকে তুমিই বলেছ ভালোবাসা বড়ো বিনিময়ের খেলা। সবকিছু অস্বীকার করে একদিন তুমিই আমাকে ফিরিয়েছ। অথচ সবসময়ের মতো আজও এখানে দাঁড়িয়ে আমাকেই অভিযোগ করছো।”
“এখন আমি আর নেই অরণী? এখন বুঝি তোমার সব খেয়ালি স্বপ্নগুলো অন্য মানুষ খুঁজে পেয়েছে?”
কথা বলতে বলতে অরণীর চোখ ইতিউতি খোঁজে। মাহিদ এখন কাউন্টারের সামনে। বিল দিচ্ছে। মাহিদের বোন দুলাভাই সম্ভবত আড়ংয়ের অন্য ফ্লোরে চলে গিয়েছেন। এই ফ্লোরে দেখা যাচ্ছে না। অমিয় কই আছে কে জানে। নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে অরণী রিদমকে বলে, “আমি জানি না এখন তুমি এসব কেন বলছো রিদম। তোমার খারাপ লাগছে আমাকে মাহিদের সাথে দেখে? অথচ বারবার তোমার কাছে ছুটে গিয়েছি আমি আর বারবার প্রত্যাখ্যান করেছ। এখন আর এসব বলার সময় নেই। তুমি যখন যেভাবে কাগজ দেবে আমি সাইন করে দেব। তোমার সব অপূর্ণতা আর ক্ষতির কারণ আর নাই বা হলাম।”
“মানুষ মাত্রই ভুল করে অরু। আমরাও করেছি। বিয়ে তো ছেলেখেলা না তাই না। অথচ আমরা পাগলামি করে বিয়ে করলাম, এখন আবার বিয়ে ভাঙতে চলেছি। এসব কী করছি আমরা।”
“সবসময়ের মতো এখনো তুমি আমাকে দোষ দিচ্ছ! অথচ বিয়ে করা বা ভাঙা কোনটাই আমি চাইনি। বিয়ে করার জন্য জীবন দিতে তুমি গিয়েছিলে। তুমি বাধ্য করেছিলে এভাবে বিয়ে করতে। আবার সেই বিয়ে ভাঙতে তুমিই চাপ দিয়েছ। আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না রিদম। আমার বাসায় বিয়ের আয়োজন চলছে। আতংকে আমি অস্থির হয়ে আছি। পনেরদিন পর কী হবে আমি জানি না।”
“অথচ সেই বিয়ের জন্য লাখ টাকার শাড়ি কিনছো অরু। মাহিদের অর্থ আর মিষ্টি কথা তুমি তোমার রিদমকে ভুলে গেলে? কিন্তু জানো কী তালাক এতো সহজ নয় অরণী। বিয়ে ভাঙা, বিয়ে করার চেয়েও বেশি কঠিন। লোক জানাজানি ছাড়া এত সহজ হবে না সবকিছু। নাটক সিনেমায় যেমন সব সহজ দেখায়, তেমনটা নয় মোটেও। দশজন জানবে, তোমার নাম খারাপ হবে। আজ যে এখানে এত মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছে, লাখ টাকার কেনাকাটা করে দিচ্ছে, কাল তোমার একটা বিয়ে হয়েছিল শুনলে তোমাকে ছেড়ে দিতে দ্বিধা করবে না। কিন্তু আমি সবসময় তোমার পাশে ছিলাম, আছি থাকবো।”
অরণী কাউন্টারের দিকে তাকিয়ে দেখে মাহিদ নেই। রিদমের কথার আর জবাব দেওয়া হয় না। ছুটে চলে যায় লিফটের দিকে। রিদম পেছন পেছন যেতে যেতে থমকে দাঁড়ায়। অমিয় আর মাহিদের আপা দুলাভাই চলে এসেছেন। মাহিদ নেই আশেপাশে। রিদম দূর থেকেই ফলো করতে থাকে। সমস্ত কেনাকাটা শেষ অমিয় আর অরণীকে বাসায় নামিয়ে দিতে আসে মাহিদ। বোন, দুলাভাই অন্য গাড়িতে বাসায় চলে গিয়েছে। অরণীর কাছে বিদায় নেওয়ার সময় মাহিদ বলে, “অরণী, তুমি জানো হেলেন মেনেলাউসের স্ত্রী ছিল ঠিকই। কিন্তু ভালোবেসেছিল ট্রয়ের প্যারিসকে। তাই তো প্যারিস হেলেনকে নিয়ে ট্রয়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হেলেন কারও হয়নি। বরং ধ্বংস হয়েছিল প্যারিস ও মেনেলাউস দু’জনই। হেলেন হওয়াটা সবসময় ভালো কথাও নয় বোধহয়।”
“আর হেলেন? সে কী সুখী ছিল? তার সৌন্দর্য কী তাকে সুখী হতে দিয়েছিল? ইতিহাস হোক আর বর্তমান। আপনারা পুরুষেরা সব ধ্বংস, ক্ষয় আর হারের পেছনে শুধু নারীকেই খুঁজে পন কেন? ট্রয় কী শুধু হেলেনের জন্য ধ্বংস হয়েছে? মেনেলাউস বা প্যারিসের কোন কোন অপরাধ ছিল না? আপনি আমার সাথে যাকে দেখেছেন, সে রিদম। তার ব্যাপারে কথা বলার জন্যই আজ গিয়েছিলাম। কিন্তু সময় সুযোগ কিছুই পাইনি। আমি সব সত্য বলতে চাই। যদি বিশ্বাস করে শুনতে চান তবে চলুন কোথাও কফি খেতে খেতে কথা বলি। অমিয় লিফটের সামনে অপেক্ষা করছে। ওকে ব্যাগগুলো নিয়ে উপরে যেতে বলি?”
বাসার কাছেই সুন্দর একটা কফি হাউজ হয়েছে। অনেকদিন ধরে অরণীর ইচ্ছে ছিল এখানে আসবে। এদের ল্যাটেটা নাকি বেশ হয়। মাহিদও তাই অর্ডার করলো। দু’জনের কেউই খেয়াল করেনি। মাথাটা ক্যাপে ঢেকে দূর থেকে কেউ একজন ওাের অনুসরণ করে এখানেই এসে ঢুকেছে।
মাহিদ অরণীকে আটকায় না। কথাগুলো বলতে বলতে অরণী যখন চোখের জলে টলমল হয়ে ওঠে, তখনও টিস্যুগুলো এগিয়ে দেয় সহজ ভাবেই। অরণীর কথাগুলো মন দিয়েই শুনতে থাকে মাহিদ।
মাহিদের এতটা সহজ রিয়েকশন অরণী আশা করেনি। দূর থেকে ওাের দুজনকেই দেখছে রিদম। অরণীর সাথে মাহিদের কী কথা হচ্ছে বুঝতে পারছে না। তবে মাহিদ যখন অরণীর হাত ধরে ওকে স্বান্তনা দেয় তখন আর নিজেকে আটকাতে পারে না। এক ঝটকায় অরণী আর মাহিদের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায় রিদম। টেবিলের উপর থেকে একটা কাঁটা চামচ নিয়ে নিজের গলায় চেপে ধরে রিদম।
“রিদম, তুমি এখানে কী করো? আর এসব কী করছো। প্লিজ নামাও গলা থেকে।”
“অরু, তুমি কী করছো? আমার স্ত্রী হয়ে আরেকজনের হাত ধরে বসে আছ। এই জীবন আমি রেখে কী করবো। তোমার সামনেই আমি জীবন দেব। তাহলে আর তালাকের চিন্তাও থাকবে না। তুমি শান্তিতে বিয়ে করতে পারবে।”
মাহিদ বিব্রত হয়। রেস্টুরেন্টের সবাই হা করে তাকিয়ে আছে। কেউ কেউ মোবাইল বের করে ভিডিও করতে শুরু করেছে।
“রিদম সাহেব, সিনক্রিয়েট করবেন না প্লিজ। আমরা শান্ত হয়ে কথা বলি। আপনি ভুল বুঝছেন। অরণী আপনার ব্যাপারেই সব বলছিল আমাকে। আমি হাতটা শুধু স্বান্তনা দিতে ধরেছি। আর আপনারা ভিডিও করছেন কেন? মানুষের পার্সোনাল লাইফের প্রাইভেসি বোঝেন না।”
কয়েকজন খিক খিক করে হেসে ওঠে। যেন খুব মজার কথা বলছে মাহিদ।
“ভাই আপনারা দুই জন এক মেয়ে নিয়ে পাবলিক প্লেসে টানাটানি করছেন। আর আমাদের প্রাইভেসি শিখান? মেয়ে তো ভালোই খেলোয়াড়।”
অরণী কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু রিদম শান্ত হওয়ার নাম নেই।
“অরণী কোন কিছু ভাবার দরকার নেই। তোমার মনে নেই তুমি কী বলতে? তুমি বলতে, রিদম সারা দুনিয়ার সমস্ত সুখের বিনিময়ে আমি তোমাকে চেয়েছি। তোমাকে পেয়েছি আমি স্বপ্ন কেনার দামে। আর আজ অরণী অন্য স্বপ্নের কাছে তোমার রিদমকে হারাবে তুমি? চলো এই মুহূর্তে আমি তোমাকে নিয়ে যাব। চলো আমার সাথে। প্লিজ অরণী। না হলে এখানেই তোমার সামনে আমি নিজেকে শেষ করে দেব।”
অরণীর চিন্তা চেতনা আর একবার লোপ পাচ্ছে। চোখের সামনে রিদম নামক পর্দ ছাড়া যেন আর কিছু নেই। আর একবার কী চোরাবালিতে পা রাখতে চলেছে অরণী!
(চলবে)