#স্বপ_কেনার_দামে
#দ্বিতীয়_খন্ড
পর্ব ২
রিদম ভাবতে পারেনি অরণী বিয়ের পরও এতটা অটল থাকবে। বিস্ময়কর হলেও দুইদিন আগে অরণীর উপর যতটা রাগ ছিল এখন কেন জানি তা আর নেই । বরং কেমন যেন ভালোই লাগে অরণীর চরিত্রের এই দৃঢ় দিকগুলো ভেবে। আজকাল যেখানে অনেকের কাছে চলাফেরায় কেয়ারলেস ভাব থাকাই “বোল্ড এন্ড বিউটিফুল”। এবং “লিভইন” সম্পর্কের দিকে তরুণ সমাজ যখন খুব সহজেই হেলে পড়ছে, সেখানে অরণীর মতোও কেউ আছে, আর সেই কেউটা রিদমের ঝুলিতেই এসে পড়েছে ভেবে নিজেকে ভাগ্যবান লাগে রিদমের।
তবে সেদিন পার্কে সেই মুহূর্তে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে ভীষণ বেগ পেতে হয়েছিল।
কামনা বাসনার সেই তীব্র আবেগের সময় অরণীর প্রত্যাখ্যানে এক মুহূর্তের জন্য অভিমানে আড়ষ্ট করে ফেলেছিল রিদমকে। তাই তো অরণীকে আটকানোর চেষ্টা করেনি। অরণীর হাত ধরে স্যরি বলতে পারেনি। দুইদিন সময় লেগেছে রিদমের অভিমান আর অভিযোগের ঝাল নামতে। গত দুইদিনে রিদম অরণীর সাথে যোগাযোগ করেনি, অরণী প্রথমদিন ফোন দিয়ে মান ভাঙানোর চেষ্টা করেছে, ম্যাসেজ করেছে। কিন্তু রিদমের রেসপন্স নেই দেখে হাল ছেড়ে দিয়ে রিদমের রাগ নামার অপেক্ষা করাই ঠিক মনে করেছে। শেষ চেষ্টা হিসেবে ম্যাসেজ করে বর্তমান করণীয়টুকু মনে করিয়ে দিয়েছে অরণী। জানুয়ারিতে রিদমের এফসিপিএস, ম্যাসেজ করে অনুরোধ করেছে সব ভুলে শেষ কয়টাদিন জানপ্রাণ দিয়ে পড়তে। বাকি সবকিছু এখন তোলা থাক। ফেব্রুয়ারিতে অরণীরও প্রফ শুরু হবে, এই সময় ওদের কারও দম ফেলার সময় নেই। ঝগড়া মান অভিমান সব পরীক্ষার পর হোক।
অরণীর এই বোঝানোতে কাজ হয়েছে। মন শান্ত হয়েছে রিদমের। এখন আসলেই পড়ার বিকল্প কিছু মাথায় না আসা ভালো। রিদম সকালে লাইব্রেরিতে চলে যায়, সারাদিন সেখানে পড়ে। বাসায় পড়ার পরিবেশ নেই। সারাদিন হৈচৈ লেগেই আছে।।রিদমের আম্মার সাথে ফুপুর এখন নিত্য ঝামেলা লেগে থাকে। বাবা তো কোন পক্ষের হয়ে কিছু বলতে পারেন না। যাকে থামতে বলেন, সেই অভিমান করে। কখনো বোনের কাছে ‘স্ত্রৈণ’ উপাধি পান, কখনো স্ত্রীর কাছে ‘কাপুরষ’। এরমাঝে কিছুদিন পর পর বড়ো বোন বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে এসে থাকে। প্রথম দু’দিন ভালোই থাকে তারপর মা আর ছোট বোনের সাথে ঝগড়া করে।
বাসা থেকে যতটা সম্ভব তাই বাইরেই থাকে রিদম। ঘরোয়া ঝামেলা সমাধান করার চেয়ে, এসব এড়িয়ে যাওয়াই ওর শ্রেয় মনে হয়।
অরণীর ক্লাস নেই এখন। নিয়মিত কলেজ যেতে হয় না। সময়ে সময়ে প্রাকটিকাল ক্লাস থাকলে যেতে হচ্ছে। রিদমের ইন্টার্নি শেষ। আগের মতো দু’জনের দেখা হওয়ার সুযোগ কমে গিয়েছে। বাসায় ফোনে কথা বলার সুযোগ হয় না, চ্যাটই ভরসা। তবে পরীক্ষার আগে এই দূরত্ব খুব একটা পোড়াতে পারছে না। যে যে যার যার পড়াশোনায় ব্যস্ত। ডাক্তারদের জীবনটাই বোধহয় এমন। অনেক বেশি প্রাকটিকাল না হলে বিপদ। মনের উপর মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ না থাকলে বারবার পা হড়কাতে হয়।
“হ্যালো অরণী।”
“হ্যাঁ হ্যালো, রিক্তা বল। কোথায় তুই?”
“এই তো একটু বাইর যাচ্ছি।”
“কলেজে? ক্লাস হবে নাকি? জানতাম না তো।”
“না রে অরণী। ধ্যুত! আমি ফয়সালদের সাথে পূর্বাচল যাচ্ছি। ডে লং রিসোর্টে থাকবো আমরা। সন্ধ্যায় ফিরে আসবো। তোকে বলে তো লাভ নেই, তুই কখনো রাজি হবি না। এখন যে জন্য ফোন দিলাম, আমি বাসায় ফোনে বলেছি কলেজে প্রাকটিকাল আছে। আর তারপর তোর সাথে তোর বাসায় গ্রুপ স্টাডি করবো, তাই হোস্টেলে ফিরতে দেরি হবে। আম্মু ফোন দিলে তোকে কনফারেন্স কলে নিয়ে নেব, তুই আম্মুর সাথে সামলে কথা বলবি কিন্তু।”
“রিক্তা, তুই কী পাগল! কী বলিস এসব?” ফিসফিসিয়ে বলে অরণী, মা শুনলে দশটা প্রশ্ন করবে।
“উফ্ অরণী, জ্ঞান দিতে আসিস না প্লিজ। কিছু হবে না। ফয়সাল তো আছেই। একটু বিশ্বাস না থাকলে সম্পর্ক কিসের। আর আমরা নোংরা কিছু করতে যাচ্ছি না। রিদম ভাই যাচ্ছে, শাহবাজ ভাই যাচ্ছে, ওনার গার্লফ্রেন্ডও আসবে সাথে। আরও দু’জন ভাইয়া আসবে গার্লফ্রেন্ড নিয়ে। একটা বড় পিকনিক হবে।”
“রিদম যাচ্ছে? কই আমি তো জানি না।”
“জানলে কী করতি? তুই তো আসবি না জানা কথা। বরং রিদম ভাইকেও পরীক্ষার বাহানা দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করতিস। ফয়সাল তাই নিষেধ করছে বলতে। আরে পরীক্ষার আগে সবার রিফ্রেশমেন্ট লাগে। একদিন ঘুরে আসলে ভাইয়ারও ভালো লাগবে। খরচ তো ফয়সাল দিচ্ছে।”
ফোন রেখে কান্না পায় অরণীর। রিদম কী সবসময় এমন থাকবে! বন্ধুদের প্রভাব ওর উপর এতটাই বেশি যে ভালোমন্দ চিন্তা করার ক্ষমতাও নাই হয়ে যায়। ফয়সাল ধনী ঘরের ছেলে, ওর বাবার টাকায় আধুনিক চেম্বার দেওয়া, বাইরে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করতে যাওয়া সবকিছু ফয়সালের জন্য সহজ। তার মাথায় আয়ের চিন্তা, দেশে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করার চিন্তা, সংসারের চিন্তা নেই। কিন্তু তার সাথে থেকে রিদম নিজের বর্তমান কেন ভুলে যায়! কেন ভুলে যায় ওর আর ফয়সালের চলার রাস্তা এক রকম নয়। একটা রিসোর্টে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার টাকা ফয়সালের আছে, এখানে সে খরচ করআে। কিন্তু রিদমের সংসার চালানোর দায়িত্ব ফয়সাল কখনো নেবে না। রাগ ওঠে অরণীর, রিদমকে ফোন দেবে না ঠিক করে। যাক যেখানে মন চায়।
অরণীর ফোন রেখে রিক্তারও বিরক্ত লাগে। অরণী মেয়েটা বেশি দাদী আম্মা ধরনের। শুধু ভালো ছাত্রী দেখে বন্ধুত্ব ধরে রাখা, ক্লাস নোটস, গ্রুপ স্টাডির জন্য অরণীকে প্রয়োজন। না হলে এমন বোরিং মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব রাখা কষ্টকর। সবসময় একটা ন্যাকা ভাব, কিন্তু তলে তলে বহুদূর। না হলে লুকিয়ে বিয়ে পর্যন্ত করে ফেলে! এত মা বাবার বাধ্য মেয়ে ভাব নেয়, অথচ বিয়ে তো ঠিকই লুকিয়ে করে ফেললো। শুধু ফয়সাল রাগ করবে বলে, না হলে রিক্তা কবেই কলেজে এসব কথা রটিয়ে দিতে পারতো। আঙ্কেল আন্টির কানে গেলে মজাটা হতো। কিন্তু এখন একটু ধৈর্য ধরতে হবে, ফয়সালের মতো প্লেবয় অবশেষে তার জন্য নরম হয়েছে। ফয়সালের সবচেয়ে কাছের বন্ধু রিদম। তাই উল্টাপাল্টা কিছু করে ফয়সালকে রাগাতে চায় না।
রিক্তার পরিবার মফস্বলে থাকে। দুই বোন। রিক্তাকে ঢাকায় রেখে পড়াচ্ছেন তার বাবা। মফস্বলে ওদের মুদি দোকান আছে। পারিবারিক ব্যবসা বলে দীর্ঘদিনের দোকান, আয় খারাপ না। তবে একটা মেয়েকে ঢাকায় রেখে পড়ানোর খরচ কম না। রিক্তার বাবা তাই মাপা টাকা পয়সা পাঠান। রিক্তার ঢাকায় আসার পর চোখ খুলে গিয়েছে। ছাত্রী সে বরাবরই ভালো। কিন্তু পাশাপাশি জীবন উপভোগও করতে চায়। এখানে এসে দেখে আনন্দের এত উপকরণ চারদিকে, শুধু প্রয়োজন নিজের বাড়তি অর্থ না হয় ধনী একজন বয়ফ্রেন্ড। ফার্স্ট ইয়ারে সব বুঝতে বুঝতেই সময় চলে গেল। সেকেন্ড ইয়ারে বয়ফ্রেন্ড হলেও সম্পর্ক বেশিদূর গড়ায়নি। অবশেষে ফয়সালের মতো ছেলের সাথে সম্পর্ক হয়েছে। স্মার্ট, ধনী, ফান লাভিং ছেলে ফয়সাল। আর কিছু নিয়ে ভাবার সময় নেই রিক্তার।
বিরক্ত মুখে গালে ব্লাশঅন ঘষে রিক্তা, ফয়সাল আসার সময় হয়ে গিয়েছে।
(চলবে)