স্বপ্ন_কেনার_দামে #দ্বিতীয়_খন্ড পর্ব ৯

0
226

#স্বপ্ন_কেনার_দামে
#দ্বিতীয়_খন্ড
পর্ব ৯

লালের উপর সোনালী সুতোয় কাজ করা আশি কাউন্টের জামদানীটার উপর থেকে চোখ সরানো দায়। দামটা অবশ্য আকাশছোঁয়া। এত দামের বিয়ের শাড়ি কেনার কোন শখ নেই অরণীর। কিন্তু এই শাড়িটায় হাত বোলাতে ভীষণ ভালো লাগছে। এমনিতেই বর্তমানে আড়ংয়ের জামদানী আর দশটা জায়গা হতে আলাদা। অনলাইনে তো অনেক বিক্রেতা তাদের জামদানী শাড়ির মান বোঝাতে আড়ং কোয়ালিটির জামদানী শব্দটা ব্যবহার করেন। তারউপর এই সেকশনের জামদানী গুলো আড়ং এর ব্রাইডাল কালেকশন এর। একটার চেয়ে আরেকটা সুন্দর।

“শাড়িটা মারাত্মক সুন্দর। কী বলো?”

অরণী একটু বিব্রত হয়ে যায়। লজ্জা লাগে, আসলেই অনেকক্ষণ হয়েছে শাড়িটা হাতে ধরে আছে। আড়ং বলে হয়তো সেলস গার্লরা কিছু বলছে না, এমনি দোকান হলে এতক্ষণে বলে ফেলতো, ‘আপা না কিনলে শাড়ি ধরে নষ্ট করবেন না’।
এমনিতে অরণী লোভী নয়, দামী কিছু পাওয়ার লালসা কখনো তার চেতনাকে গ্রাস করতে পারেনি। তবে এই জামদানীর সৌন্দর্যটাই এমন যে হাতে নিয়ে নিজেকে সেই লাল জামদানীর সাজে কল্পনা করে ফেলেছে।

“জ্বি সুন্দর। স্যরি আমি আসলে কী যেন ভাবছিলাম।”

“যাই ভেবে থাকো, ভাবার সময় তোমার মুখখানা হাসিহাসি হয়ে ছিল। আজ প্রথম বিয়ের কোন ব্যাপারে তোমাকে উৎসাহী দেখলাম।”

“আপু, এই শাড়িটা কাউন্টারে দিন প্লিজ। আমরা এরা নিচ্ছি।”

একজন সেলস গার্লকে ডেকে বলে মাহিদ।

“না না, এটা আমি নেব না। এত দামে শাড়ি কেনা অপচয়। একটা শাড়ির পেছনে পচাত্তর হাজার খরচ করার কোন মানেই হয় না।”

“অবশ্যই হয়। বিশেষ করে তা যদি কোন বিশেষ দিন উপলক্ষে কেনা বিশেষ শাড়ি হয়। বিয়ে কী রোজ রোজ হয়। বাঙালি নারীর জীবনের সবচেয়ে সুন্দর আর বেদনার দিন নাকি বিয়ের দিন। একই দিনে দুই বিশাল পরিবর্তন আসে মেয়েটার জীবনে। পেছনে সব স্মৃতি বাবার আঙিনায় ফেলে এসে জীবনসঙ্গীর সাথে আরেক অধ্যায়ের শুরু হয়। একদিকে ভাঙনের সুর, অন্য দিকে নতুন গড়ার আয়োজন। বাবার রাজকন্যা হতে স্বামীর রানী হওয়ার সূচনা। এমন দিনে যার যার সাধ্য অনুযায়ী সেই মেয়েটাকে সবচেয়ে সেরা রূপে সাজাতে চাওয়াটা অন্যায় কিছু না। আমি খুব খুশি হবো তুমি শাড়িটা বিয়েতে পরলে।”

বিয়ের শাড়ি, তার সাথে এত আবেগ। বিয়ে নিয়ে এত চমৎকার ভাবনা। আহ্ অরণী যে বিয়ে নিয়ে এভাবেই ভাবতো। অথচ রিদমের সাথে বিয়েটা কেমন করে হয়ে গেল। কোন কিছু অনুভব করার আগেই যেন কবুল কবুল কবুল। আচ্ছা রিদম কেমন ভাবতো বিয়ে নিয়ে! রিদমকে অরণী কেন ঠিক বুঝতে পারে না। এই এক মুহূর্তে যেন উদ্দাম প্রেমিক পুরুষ তো, পরমুহূর্তেই তীব্র অভিমানী যুবক।

“তারপরও এত দামের শাড়ি কেন অযথা। একটা জামদানী শাড়ি এত দাম কেন হবে। এই রকম ডিজাইন আরও কম দামেই পাওয়া যায়।”

“মূল্যবান জিনিস বলেই এত দাম। দেখ ফুল তো সবই ফুল। কিন্তু যে আবেদন গোলাপে আছে, সে আবেদন কী গাঁদায় পাওয়া যায়? সৌন্দর্যে কিন্তু কেউ কারও চেয়ে কম নয়। তবুও প্রেমিক হৃদয়ের তৃষ্ণা যেন লাল গোলাপের পাপড়িতে এসেই শেষ হয়। আবার মানুষ দেখ। বাইরে দেখতে সবাই এমন, পরখ করার আগে বোঝা যায় না, কার হৃদয়টা সোনার, আর কে পিতল। তেমনি জামদানী তো কত রকম দামেরই আছে। দেখতে লাগেও একই রকম। হাতে নিলে বোঝা যায় কেন কোনটা পাঁচ হাজার, কেন কোনটা পঞ্চাশ। এটা আশি কাউন্টের জামদানী। এত মিহি আর নিখুঁত যার বুনন, তাকে তুমি হেলা করতে পারো না। কাউন্ট নির্ভর করে সুতোর উপর। যত চিকন সূক্ষ সুতো, তত বেশি দাম।”

“দাম দিয়ে আমি জিনিস বিচার করি না। মানুষ আর শাড়ি কী এক হলো? মানুষের হৃদয় পিতলের হলে ভুগতে হয়। কিন্তু শাড়ি উনিশ-বিশ হলে তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমার কাছে সোনার হৃদয়ধারী ব্যক্তির ভালোবেসে দেওয়া সতেরো টাকার শাড়ি সত্তর হাজারের চেয়ে কম নয়।”

“তোমার কথাও ঠিক, আমার কথাও ঠিক। যাও এই স্বর্ণ হৃদয়ের মাহিদ ভালোবেসেই এই শাড়ি তোমাকে দিচ্ছে। এইবার তো মানা করতে পারবে না, হেলেন অব ট্রয়।”

“আমি হেলেন কেন?”

“তোমার মতো সুন্দরী নারী ডুয়েল লড়াই ছাড়াই পেয়ে যাচ্ছি বিষয়টা অবিশ্বাস্য। আমি তো ভেবেছি মেনেলাউসের সাথে লড়াই করে হেলেনকে জয় করতে হবে ”

“মেনেলাউসকে?”

“হেলেনের স্বামী।”

“হেলেন বিবাহিত ছিল?”

“অবশ্যই। কিন্তু হেলেনের রূপে মুগ্ধ হয়ে ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিস তাকে জয় করতে নেমেছিল।”

“আপনি এতকিছু কী করে জানেন! আপনি কী কবি সাহিত্যিক? কেমন কাব্যিক ভাবে কথা বলেন। আমি জানতাম আপনি বিবিএ এমবিএ করেছেন।”

“বিবিএ, এমবিএ করলে কবি হওয়া যায় না? কবি হতে ডিগ্রি টা কী নিতে হয়? বাংলা সাহিত্য না ইংলিশ লিটারেচার? রবীন্দ্রনাথ কতদূর পড়েছিলেন জানো? কাজী নজরুল ইসলাম কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে ক্লাস সিক্সেই স্কুল ছেড়েছিলেন। ওনার বাংলা ভাষায় দক্ষতা কতখানি বুঝতে হলে ওনার একটা কবিতা পড়লেই যথেষ্ট। অথচ বহু গ্রাজুয়েটকে দেখি তিন লাইন বাংলার স্ট্যাটাস লিখতে, পাঁচটা বানান ভুল করে। তুমি তো ডাক্তার। কিন্তু কী চমৎকার আবৃত্তি করো, তোমার লেখা পড়েছি ফেসবুকে। বাংলা বানানে তোমার দারুণ দক্ষতা আছে।”

অরণী মুখে না বললেও মনে মনে মাহিদের কথাবার্তায় অভিভূত হয়। দারুণ গুছিয়ে কথা বলে মাহিদ। সামনের লোকটার সাথে কোন বিষয়ে মতের অমিল থাকলেও চিত্কার করে জোর গলায় নিজের মত চাপায় না। বরং মন দিয়ে শুনে নিজের মতামত যুক্তি দিয়ে তুলে ধরে। এই জায়গায় রিদম আর মাহিদ একদম আলাদা। রিদম কখনো যুক্তি তর্কের ধার ধারে না। ভুল হলে তা স্বীকার করে না, আর ভুল বুঝলে চিত্কার করে অভিযোগ করে। তারপরও অরণী রিদমকে ভালোবাসে। পাগলাটে, খ্যাপাটে যেমনই হোক ভালোবাসে। যতবার রিদম ওকে আঘাত করেছে, ততবার যেন আরও বেশি অরণী ওকে আঁকড়ে ধরেছে। আজও থাকতো, যদি না রিদম নিজ থেকে ওকে ঝেড়ে ফেলে না দিতো। গত তিনমাসের প্রতিটি দিন অরণী রোজ একটাই প্রার্থনা করেছে। রিদমের মনটা পরিবর্তন হোক, রিদম আর একবার ওকে ‘হৃদমোহিনী’ বলে সম্বোধন করুক। আর একবার বলুক ‘আমার বৌ, তুমি যে স্বপ্নের চেয়েও দামী। তোমাকে যে আমি পেয়েছি স্বপ্ন কেনার দামে।”

মাহিদ বিল পে করার জন্য কাউন্টারে এগিয়ে গিয়েছে। এতটাকার বিল পেমেন্ট ক্রেডিট কার্ডে করবে। মাহিদ শুধু ব্যাংকার হলে এত টাকা খরচ করতে পারতো না। কিন্তু মাহিদ পেশায় ব্যাংকার হলেও, শুধু তার চাকরির উপর সংসারের আয় নির্ভরশীল নয়। মাহিদের পরিবার শিক্ষা ও অর্থে উচ্চবিত্তের কাতারেই পড়ে। বনেদি পরিবারের সন্তান মাহিদের বাবা অবসর গ্রহণের আগে ছিলেন রেল মন্ত্রণালয়ে সহকারী সচিব। মাহিদের দাদা দেশ স্বাধীনের আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে এসেছিলেন। পারিবারিক ভাবেই শিক্ষা ও অর্থে তাই মাহিদ ও তার বোন দুলাভাই ভালো অবস্থানে আছে। মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটির ছয়তলা বাড়িটাও তাদের নিজেদের। একমাত্র ছেলে হিসেবে পারিবারিক ভাবেই বেশ বড়ো অংশের মালিকানা পাবে মাহিদ। অরণীকে সুতির শাড়ি দেখতে বলে মাহিদ চলে গিয়েছে। শাড়ির সেকশনে দাঁড়িয়ে দূর থেকে মাহিদকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। বিল কাউন্টারে লম্বা লাইন। অমিয় আর মাহিদের বোন দুলাভাই পাঞ্জাবি দেখছে। অরণী একটু আড়ালে সরে সুতির শাড়ি দেখছে। আকাশ নীল একটা শাড়িতে চোখ আটকে যায়। শরতের আকাশে যেন এক টুকরো নীল। অরণী আনমনে হাত বাড়ায় শাড়ির দিকে। শাড়িটা হাত দিয়ে ধরতেই অপরদিক থেকে কেউ খপ করে হাতটা ধরে ওঠে। চিত্কার করে উঠতে গিয়েও, শব্দ গিলে নেয় অরণী। অস্ফুট স্বরে বলে, “রিদম!”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here