তিমিরে ফোটা গোলাপ
পর্বঃ০৪
Writer- Taniya Sheikh
ক্লান্তি এবং দুর্বলতায় চোখে ঘুম নেমে এসেছে ইসাবেলার। মাথাটা হেলে পড়ল ভ্যালেরিয়ার কাঁধে। ফিটনের সামনের ঘোড়াটা ছুটছে টগবগিয়ে। বাইরে পড়ন্ত বিকেলের রোদের আলো। তাপটুকু প্রখর নয়, মেদুর। জানালার কাঁচ গলে ইসাবেলার বোঁজা নেত্রের উপর এসে পড়েছে সেই স্নিগ্ধ আলো। রাস্তার বড়ো গাছগুলোর সাথে মেদুর রোদের ওই লুকোচুরি খেলা বড়ো বিরক্ত করে ইসাবেলার ঘুমকে। সে একটু নড়েচড়ে ওঠে। ভ্যালেরিয়া বুঝতে পেরে হাতটা ওর চোখের উপর রাখল। ঘুমন্ত ইসাবেলার ঠোঁটের কোনে ক্ষীণ হাসি দেখা যায়। সে আরো নিবিড় হয়ে বসে ভ্যালেরিয়ার সাথে। ভ্যালেরিয়া গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সে চায়নি ইসাবেলাকে সঙ্গে নিতে কিন্তু ভাগ্যের বুঝি এই উদ্দেশ্য ছিল। ভাগ্যকে বড্ড ভয় ভ্যালেরিয়ার। সে মনেপ্রাণে ধর্মপ্রাণ। ঈশ্বরের কাছে সমর্পিত। তথাপি সাধারণ মানুষের মতো ভয়টা তার কিছুতেই কাটে না। ফাদার জালোনভ এই কারণে কতবার সতর্ক করেছে! যে জীবন সমর্পিত তা নিয়ে ভয় কীসের? মরণ তো অনিবার্য। তবে ভয়টা কেন হবে? তাছাড়া গত এক বছরে সে ফাদারের সাথে যেসব বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে তাতে ভয়টা কেটে যাওয়ার কথা। কিন্তু ভ্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে হয়েছে উলটো। এই যে এখন সে ভয়, শঙ্কায় অস্থির। ফাদার বলেছিলেন পিছুটান থাকবে না তোমার। ভ্যালেরিয়া বলেছিল,”নেই।” আজ ভাবছে সেই কথাটা মিথ্যা ছিল। এখানেই তার পাপ। সে পাপী। পাপীদের মৃত্যু ভয় থাকে। ইসাবেলা তার কতটা আপন কেবল সেই জানে। সংসার, পরিজনের মায়া কাটালেও ইসাবেলার মায়া সে কাটাতে ব্যর্থ। ভ্যালেরিয়া জানে ফাদার তাকে এ কারণে তিরস্কৃত করবে। তার সাথীরা তাকে কটাক্ষ করবে। ওই নৃশংসের দল ঘুণাক্ষরেও যদি টের পায় তবে ঘোর সর্বনাশ ঘটে যাবে। ভ্যালেরিয়ার উপর প্রতিশোধ নিতে ওরা মুখিয়ে আছে। ইসাবেলার চোখের উপর থেকে হাতটা নামিয়ে ফর্সা গালের উপর রাখল। অস্ফুটে বলল,
“তোমাকে সব বললাম এই আশায় যে তুমি ভীত হবে, আসতে চাইবে না আমার সাথে। কিন্তু উলটোই ঘটে গেল। কেন এত জেদ করলে ক্রাসিভায়া। আমার যে খুব ভয় করছে এখন। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি যে নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।”
ইসাবেলা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ভ্যালেরিয়া সিটে শরীর এলিয়ে দিলো। অবসন্ন লাগছে। কোচওয়ানকে বলল,
“সন্ধ্যার আগে কী পৌঁছাতে পারব জনাব?”
“মনে হয় না, রাত হয়ে যাবে বোধহয়।”
ভ্যালেরিয়া চোখ বুঁজল। ইসাবেলাকে সব খুলে বলার পর সে নিশ্চুপ হয়ে ছিল সেদিন। ভ্যালেরিয়া ভেবেছিল ও আর যেতে চাইবে না। মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়েছিল। পরদিন ভ্যালেরিয়া খুশি মনে ফাদারকে ফেরার ডেট জানিয়ে একখানা পত্র লিখতে বসে। কিন্তু বিপত্তি বাধে ফের। ইসাবেলাকে আন্না মেরিও কিছুতেই গ্রামে যেতে রাজি করাতে পারছেন না। মায়ের কথার অবাধ্য ইসাবেলা হতো না আগে। ইদানীং সে বারবার মা’কে হতাশ করছে। নাখোশ দেখা গেল আন্না মেরিওকে। মেয়ের এই বদলে যাওয়া পছন্দ করছেন না। কিন্তু মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, ইসাবেলা অসুস্থ। সুস্থ হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। ভ্যালেরিয়াকে এসে ধরেন আন্না মেরিও। ইসাবেলাকে তাঁর পরে কেউ যদি বুঝাতে পারে তবে সে ভ্যালেরিয়া। উদাস চোখে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল ইসাবেলা। ভ্যালেরিয়া বসল ওর পাশে। এই মেয়েটাকে দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। ওর মধ্যে আধুনিকতার সেই উগ্রতা নেই, আছে প্রাচীন প্রকৃতির শুদ্ধতা। মনোহরা, পবিত্র ইসাবেলার সৌন্দর্য। ভ্যালেরিয়া কিছু বলবে তার আগেই ইসাবেলা বলল,
“আমি গতরাতে ঘুমাতে পারিনি জানো ভ্যালেরি। সারারাত ভেবেছি তোমাকে নিয়ে।”
“আমাকে নিয়ে!”
ইসাবেলা এবার ওর মুখের দিকে দৃষ্টি সরিয়ে আনল। ছলছল করছে ওর চোখ। বাদামী চোখের মণি জ্বলজ্বল করছে। ভ্যালেরিয়ার মুখের একপাশে হাত রেখে বলল,
“তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় আমাকে ভীষণভাবে আঁকড়ে ধরেছে। তুমি কেন করো ওসব? তুমি আর ওসবে যাবে না। আমি কোথাও যেতে দেবো না তোমাকে ভ্যালেরি। পিটারকে হারিয়ে আমি নিঃস্ব। এবার তোমাকেও যদি হারিয়ে ফেলি! না, না। তোমাকে কোথাও যেতে দেবো না।” ইসাবেলা দু’বাহুর বাঁধনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে প্রিয় খালাকে। ভ্যালেরিয়া একসময় ভাবতো এই পৃথিবীতে ও বড্ড একা। মা নেই, বাবা নেই। যাকে কৈশোরে ভালোবাসলো সেও ধোঁকা দিলো। তারপর ধীরে ধীরে নির্মোহের জালে জড়িয়ে গেল জীবনটা। অনর্থক জীবনটাকে একটা অর্থ দিতে ঈশ্বরের সামনে সমর্পণ করল নিজেকে। সে এবং ঈশ্বর। ঈশ্বরের সৃষ্টি এই জীবকুল হয়ে উঠল তার সন্তানতুল্য। আজ মনে হচ্ছে সে এবং ঈশ্বরের মাঝে ইসাবেলা জায়গা করে নিয়েছে। নিয়েছে! না, সে আগেই ছিল। ভ্যালেরিয়া তাকে দেখতে পায়নি। চোখ দু’টো জ্বালা করতে লাগল। এখনই নামবে বুঝি ঢল। কিন্তু হঠাৎ নিজের জীবনের কঠিন সত্যিটা উপলব্ধি করতে ছিটকে সরে বসল। ইসাবেলা স্তম্ভিত। ভ্যালেরিয়া অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
“তুমি অযথা ভয় পাচ্ছো। আমি মৃত্যুকে ভয় পাইনা।”
“আমি পাই ভ্যালেরি। ভীষণ ভয় পাই। মৃত্যু মানে হারিয়ে ফেলা। প্রিয় মানুষ, প্রিয় স্বজন হারিয়ে ফেলা। সব নিয়ে নিঃস্ব করে দেয় মৃত্যু। আমি মৃত্যু ভয় পাই ভ্যালেরি।”
“আমার হারিয়ে ফেলার ভয় নেই ইসাবেল।” চোয়াল শক্ত করে বলল ভ্যালেরিয়া। ইসাবেলা একদৃষ্টে চেয়ে রইল। বিস্মিত স্বরে প্রশ্ন করে,
“কেন নেই? তুমি কী জীবন ভালোবাসো না? আমাকে ভালোবাসো না ভ্যালেরি?”
সে জীবনকে ভালোবাসে না একথা সঠিক, কিন্তু যদি বলে ইসাবেলাকে ভালোবাসে না একথা মিথ্যা। মিথ্যা বলা মহাপাপ। সে চুপ রইল।
ইসাবেলা সরে এলো। ওর হাতদুটো মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলল,
“তুমি আর তাতিয়ানা চোখের নিমেষে বদলে গেলে। কেন বদলে গেলে তোমরা? গতরাতে আমাদের শৈশবের স্মৃতি মনে করছিলাম। হঠাৎ কান্না পেল। শৈশবের সেই মধুরতার রেশ যৌবনের এই ক্ষণে কেন নিরস হলো? তখনকার সুন্দর পৃথিবী আজ এমন বিবর্ণ, বিভৎস কেন হলো ভ্যালেরি? জীবনটা এত অসহ্য কেন হয়ে উঠল আমাদের কাছে?”
ইসাবেলার অশ্রুর কয়েক ফোঁটা এসে পড়ে ভ্যালেরির হাতের উপর। সে শিউরে ওঠে। ইসাবেলাকে জড়িয়ে ধরে নিরবে চোখের জল ফেলে। অতীতের সেই সুপ্ত কষ্ট আজ ফের উঁকি দেয়। ইসাবেলাকে সে বুঝতে দেবে না। কাওকেই নয়। কষ্টগুলো একান্তই তার একার। কাওকে বলতে গেলে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়বে। নিজেকে, নিজের অনুভূতিগুলোকে আর বিক্ষিপ্ত হতে দিতে চায় না সে। ইসাবেলাকেও সেই কণ্টকাকীর্ণ পথে চলতে দেবে না। যদিও ওই পথের মুখেই দাঁড়িয়ে ইসাবেলা। কারো কারো কেবল মনই ভাঙে না, বরং সমস্ত জীবনটাই ভেঙেচুরে অন্তঃসারশূন্য কঙ্কাল হয়ে যায়। নতুন করে তাতে রক্ত মাংসের শরীর প্রতিস্থাপন করা সম্ভব না। ভ্যালেরিয়া চোখের জল মুছে মৃদু হাসির মুখোশ পড়ে। ইসাবেলার মুখটা আঁজলা ভরে তুলে বলে,
“জীবন গতিময়। নদীর তরঙ্গের মতো সামনে ধাবমান। পেছন ফিরে দেখার চেষ্টা করলেই সব এলোমেলো হয়ে যায়। আমি পেছন ফিরে তাকাতে চাইনা। তুমিও তাই করবে। আর শোনো, তোমাকে যা বলেছি সব ভুলে যাও।”
“ভুলে যাব? এতটা সহজভাবে কীভাবে বলতে পারলে?”
“কারণ আমার জন্য সব সহজ। আমাকে যেতে বাধা দেবে না তুমি। এ নিয়েও কাওকে কিছু বলবে না। আমার বিশ্বাস ভাঙবে না তুমি ইসাবেল।”
ইসাবেলা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। তারপর বলল,
“বলব না। কিন্তু তোমাকেও একা ছাড়ব না। আমি যাব তোমার সাথে।”
“ইসাবেল!”
“তুমি আমাকে নেবে সাথে করে ভ্যালেরি। যদি না নাও তবে আমার মরা মুখ দেখবে।”
“তুমি অসুস্থ। কী বলছো বুঝতে পারছো না।”
“বেশ হয়েছে অসুস্থ আমি। বলো আমায় নেবে কি না?”
“না”
“তবে ঠিকই বলেছো তোমার হারানোর ভয় নেই। বেশ যাও। কালই চলে যাও। আর ফিরবে না। যদিওবা ফেরো আমাকে পাবে না।”
ইসাবেলা উঠে দাঁড়ায় পাশের দেয়াল ধরে। ওর চোখের নিচে বসে গেছে। চামড়া ফেটে গেছে ঠোঁট দু’টো শুকিয়ে। মাথার বাদামী চুলগুলো অবিন্যস্ত। বার বার চোখের পানি মুছছে। দু’ কদম এগোতেই পড়ে যাচ্ছিল। ভ্যালেরিয়া ছুটে গিয়ে ধরতে ইসাবেলা ডুকরে কেঁদে উঠল ওর বুকে।
“ও ভ্যালেরি, আমাকে একা ফেলে যেয়ো না এখানে। আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। আমাকে সাথে করে নিয়ে যাও। পিটার নেই, তুমিও চলে যাবে ওই বিপদের মুখে। আমি কীভাবে থাকব এখানে?”
ভ্যালেরিয়ার কোনো পথ রাখেনি ইসাবেলা। বাড়ির সকলের অনুরোধ উপেক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। অনন্যোপায় হয়ে শেষে সাথে করে নিয়ে আসতে হলো। আগের চিঠি ছিঁড়ে নতুন করে ফাদারকে লিখে পাঠিয়েছিল সব জানিয়ে। ফিরতি চিঠি এলো দেরিতে। তিনদিন পরেই। রেগে আছেন ফাদার। সে এতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন হবে ফাদার জানলে এখানে আসতে দিতেন না৷ ভ্যালেরিয়া জানে, ফাদার অন্য সবার থেকে তাকে স্নেহ করে বেশি। তাইতো রাগ স্বত্বে তিনি ইসাবেলাকে সঙ্গে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। তবে শর্ত জুড়ে দিয়েছেন ইসাবেলা তাঁদের সাথে থাকতে পারবে না। মাইল দশেক দূরের একটি গ্রামে ওর থাকার ব্যবস্থা করা হবে। ভ্যালেরিয়া মাঝেমধ্যে দেখে আসতে পারবে। ইসাবেলাকে অবশ্য এসব জানায়নি সে। পৌঁছে জানাবে। ফাদারকে সে বিশ্বাস করে। কিন্তু ভয়টাকে তাড়াবে কী করে? আচমকা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল ফিটনটা। অশ্বরব শোনা গেল তখনই। চমকে চোখ মেলে ভ্যালেরিয়া। আর্ত কণ্ঠে কোচওয়ানকে জিজ্ঞেস করে,
“কী হলো?”
“বরফে আঁটকে গেছে চাকা।”
“এখন উপায়?” ব্যাপারটা খুব বেশি ভয়ের নয়। কিন্তু ভ্যালেরিয়ার গলার স্বরটা খুব বেশি ভীত শোনাল। কোচওয়ান অভয় দেয়,
“ভয়ের কিছু নেই সিস্টার। এখনই বরফ সরিয়ে ফেলছি।” লজ্জিত বোধ করল ভ্যালেরিয়া। স্বাভাবিক গলায় বলল,
“ঠিক আছে।” শুকনো হাসল। কোচওয়ান নেমে পেছনে দাঁড়িয়েছে। ভ্যালেরিয়া গাড়ির জানালার বাইরে তাকায়। সন্ধ্যা নেমেছে প্রায়। গন্তব্য খুব বেশি দূরে নয়। এ অঞ্চল শীত প্রধান। প্রায় সারা বছর বরফাচ্ছন্ন থাকে। যতদূর চোখ যায় শ্বেত শুভ্র বরফ। আশপাশে দেখে বুঝল জনারণ্য থেকে দূরে আছে। গ্রীষ্মে এই জায়গাটা বিস্তৃণ সমতল ভূমিই মনে হবে। সবুজ ঘাসের আচ্ছাদিত থাকবে সবটা। ওই অদূরে পাতা ঝরা নগ্ন গাছগুলো মূর্তির মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। গায়ে লেগে আছে বরফ। কোচওয়ানকে জানালার বাইরে দেখতে পেল। বয়স চল্লিশ হবে হয়তো। মুখে দাঁড়ি নেই, পুরু মোছ। গায়ে ময়লাটে শীতবস্ত্র, মাথায় পশমি জার্মানি টুপি। সে জানাল গাড়ির চাকা বরফ থেকে তোলা হয়েছে। ভ্যালেরিয়া অনুমতি দিতে নিজের সিটে গিয়ে বসল কোচওয়ান। একটু পরে ঘোড়ার পিঠে চাবুকের হিস হিস ধ্বনি শোনা গেল। ঘোড়ার আর্ত অশ্বরবে ইসাবেলা ঘুমের ঘোরে খানিক কেঁপে ওঠে। ভ্যালেরিয়া বুকে জড়িয়ে গায়ে হাত বুলাতে আবার আগের মতো শান্ত হয়ে এলো ইসাবেলার শরীর।
ইসাবেলার ঘুম ভাঙল ভেজা হিম বাতাস গায়ে লাগতে। থরথর করে কাঁপছে সে। ফিটন দাঁড়িয়ে আছে মূল ফটকের বাইরের রাস্তায়। বরফ পড়ে সামনের রাস্তা চেনা মুশকিল। পা দেবে যাচ্ছে বরফে। গোড়ালির একটু উপর অব্দি বরফে ঢেকে যায়। ভ্যালেরিয়া ওর হাত ধরে নিয়ে চললো সামনে কাঠের বাড়ির মূল ফটক ধরে দরজার সামনে। এই বাড়িটির আশেপাশে দু’তিনটে বাড়ি। বেশ দূরে দূরে বসতি। চারপাশটা বরফে ঢাকা। এই মুহূর্তে তুষার বৃষ্টি পড়ছে। ভ্যালেরিয়া সামনের কাঠের দরজায় তিনবার টোকা দিতে এক প্রৌঢ়া দরজাটা হালকা ফাঁক করে উঁকি দিলেন। সারল্যের অভাব তাঁর মুখে। রুক্ষ গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
“কাকে চায়?”
“মাদাম ডলি, আমি সিস্টার ভ্যালেরিয়া। ফাদার জালোনভ আমাকে পাঠিয়েছেন।”
প্রৌঢ়া তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। অবজ্ঞার ভঙ্গিতে বললেন,
“ওহ, মেয়েটি কোথায়?”
ভ্যালেরিয়া ইসাবেলাকে কাছে এনে বলল,
“এ হচ্ছে ইসাবেলা অ্যালেক্সিভ, আমার ভাগ্নি। ওর কথায় ফাদার বলেছিলেন।”
প্রৌঢ়া নাকের ডগার চশমাটা আরেকটু উপরে তুলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আপাদমস্তক দেখলেন ইসাবেলাকে। ইসাবেলা একটুখানি সহবতসুলভ হাসল। প্রৌঢ়া সেই হাসি রীতিমতো উপেক্ষা করে দরজা খুলে দিলেন সম্পূর্ণভাবে।
“এসো।” তাঁর গলার স্বরে অভ্যর্থনার বালাই নেই। মনে হচ্ছে ওরা দুজন অযাচিত। ভ্যালেরিয়ার কেমন যেন ঠেকছে। কোচওয়ান ব্যাগ রেখে বাইরে দাঁড়ায়। প্রৌঢ়া ওদের বসার ঘর দেখিয়ে বসতে বললেন। সামনের ফায়ারপ্লেসের আগুনের তাপে এ ঘর বেশ গরম। ইসাবেলার কাঁপুনি একটু কমলো। ঘরটি বেশ পরিপাটি করে সাজানো। এ ঘরে একটাই জানালা তাতে মোটা রঙিন পর্দা, মাথার উপর সেজবাতি জ্বলছে। সোফার ডানদিকের দেয়ালে দু’টো বড়ো ফ্রেমবন্দী ছবি। একজন বয়স্ক, আরেকজন মাঝবয়সী পুরুষ। নিচের ছোটো ফ্রেমে একটি হাস্যোজ্জ্বল যুবতী মেয়ের ছবি। প্রৌঢ়া সামান্য কেশে উঠতে ইসাবেলা সামনে তাকাল। প্রৌঢ়া ওরই দিকে চেয়ে আছেন। সারল্যে নেই ওতে। বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল ইসাবেলা। প্রৌঢ়া দৃষ্টি সরিয়ে তাকালেন ভ্যালেরিয়ার দিকে। গলা পরিষ্কার করে বললেন,
“আপনি কখন যাবেন?”
ভ্যালেরিয়া মুচকি হেসে বলল,
“একটু পরেই মাদাম।”
“ওহ! তুমি তবে এসো, তোমার থাকার রুমটা দেখিয়ে দিই।”
“আমার থাকার রুম? এখানে একা থাকব আমি? ভ্যালেরি!” ইসাবেলা আর্ত হয়ে ওঠে।
প্রৌঢ়া ভ্রু কুঁচকে তাকান চশমার ফাঁক দিয়ে। ভ্যালেরিয়া তাঁর দিকে চেয়ে বলল,
“আমি একা ওর সাথে একটু কথা বলতে চাই।”
বৃদ্ধা চলে যেতে ইসাবেলাকে সব খুলে বলল ভ্যালেরিয়া। সব শুনে ইসাবেলা কাঁদতে শুরু করে। সে একা এই অপরিচিত স্থানে কী করে থাকবে! বৃদ্ধার আচরণ তাকে আরো বেশি বিব্রত করছে। ভ্যালেরিয়া নিজের সমস্যা বুঝাতে লাগল। তার আর উপায় নেই। তবে সময় পেলেই সে ওকে দেখতে আসবে। ইসাবেলার ইচ্ছা অনুযায়ী নিয়ে এসেছে। এবার তাকেও ভ্যালেরিয়ার কথা শুনতে হবে। বৃদ্ধা যখন, যেভাবে বলবে সেভাবেই চলতে হবে ইসাবেলাকে। ইসাবেলার মন মানতে চায় না, কিন্তু না মেনেও উপায় নেই। জোর করে এতদূর এসেছে। আর বেশি জোর ভ্যালেরিয়ার কষ্টের কারণ হবে জেনে চুপচাপ মেনে নিলো। ভ্যালেরিয়া হাঁফ ছাড়ে। ফাদার বলেছেন, মাদাম ডলি ইসাবেলার সেবা শুশ্রূষার দায়িত্ব নিয়েছেন। স্থানীয় বৈদ্য হিসেবে তাঁর বেশ সুনাম রয়েছে। ইসাবেলাকে তিনি ঠিক সুস্থ করে তুলবেন। তবে মনটা কেন যেন চাইছে না ইসাবেলাকে একা ছাড়তে। মনকে বশে আনলো ভ্যালেরিয়া, আনতেই হলো।
চলবে,,,
আমার ভাইভা পরীক্ষার জন্য পর্ব ৪ দিতে দেরি হলো। চেষ্টা করব পরবর্তী পর্বগুলো তাড়াতাড়ি দেওয়ার।