তিমিরে ফোটা গোলাপ
পর্বঃ ১২
Writer Taniya Sheikh
ইদানীং ওই তপ্তকাঞ্চনবর্ণ সূর্যটাকে ইসাবেলা প্রচন্ড ভালোবাসে। যতক্ষণ ওই সূর্য জ্বলে নির্ভয়ে, স্বস্তিতে নিঃশ্বাস নেয় ও। কিন্তু গোধূলি নামলে ভয়ে ভেতরটা শুকিয়ে আসতে শুরু করে। প্রতি মুহূর্ত আতঙ্কে কাটে। যদিও নিকোলাস জেগে ওঠে দুপুরের পরপরই। কিন্তু এ ঘরে সে সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে এলেই প্রবেশ করে। তখন এক চাঁদের ক্ষীণ আলো ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনো আলোয় থাকে না। পছন্দের চাঁদের আলো আজকাল আতঙ্কিত করে ইসাবেলাকে। জ্যোৎস্নার প্লাবনে চোখে ঘোর লাগে না, বরং ভীষণ এক ভয়ে চোখজোড়া বুঁজে রয়। কিন্তু সর্বক্ষণ চোখ বুঁজে রাখা বিপজ্জনক। এক নিকোলাস তার শত্রু নয়, এই চার দেয়ালের প্রতিটি ইট যেন ইসাবেলার রক্ত পানের আশায় লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। অসতর্কতায় ওরা ঝাঁপিয়ে পড়বে একসাথে। রক্ত শুষে, ছিঁড়ে খাবে ওর দেহটাকে। একটা চাপা আর্তনাদে সচকিত হয় ইসাবেলা। শব্দটা আসছে নিচ হতে। আবার একটা শিকার ধরেছে নিকোলাস। আবার একটা মনুষ্য প্রাণ শেষ হলো ওর তৃষ্ণা মিটাতে। প্রায় এমনই আর্তনাদ শুনতে পায়। কখনও নারীর, কখনও পুরুষের তো কখনও শিশুর। ওরা বাঁচার আকুতিভরা রোদন করে। এই সুন্দর ভুবন ছেড়ে কে-ই বা যেতে চায়? কত মায়া এখানে! ইসাবেলা দু-হাঁটু বুকের সাথে জড়ো করে দু’হাতে কান চেপে ধরেছে। নিকোলাস নিষ্ঠুর, নিমর্ম। ঘৃণা করে ইসাবেলা ওকে, প্রচন্ড ঘৃণা করে। নিচ থেকে আসা আর্তনাদ থেমে গেছে। আবার সেই কঠিন নিস্তব্ধতা। ফুঁপিয়ে ওঠে ইসাবেলা। আজকাল প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছেটা মরে গেছে। মৃত্যু কামনা করে নিজের। বেঁচে থেকে রোজ রোজ এই নির্মমতা সে আর সহ্য করতে পারছে না। ইসাবেলা জানে নিকোলাস এত সহজ মৃত্যু দেবে না তাকে। আরো শাস্তি দেবে আরো। নিকোলাসের সামনে হাঁটু ভেঙে করজোড়ে মৃত্যু ভিক্ষা না চাওয়া অব্দি বুঝি মুক্তি নেই ওর। কিন্তু ভ্যালেরিয়ার শিক্ষাকে সে অপমানিত করতে পারবে না। চাইবে না মৃত্যু ভিক্ষা।
বাড়ির কথা ভীষণ মনে পড়ে ইসাবেলার। পিটার! সে কী ফিরে এসেছে? তার কী মনে পড়ে ইসাবেলাকে? মা-বাবা, তাতিয়ানা, ভ্লাদিমি, দাদু-দিদিমা সকলে কেমন আছে? ইসাবেলার জন্য নিশ্চয়ই সবাই কষ্ট পাচ্ছে। ধীর পায়ে বিছানা ছেড়ে নামে সে। দূর্বল পায়ে গিয়ে দাঁড়ায় ব্যালকনির রেলিং ঘেঁষে। সেদিন নিজের তৃষ্ণা মিটিয়ে নিকোলাস সেখানেই বন্দি করে রাখে ইসাবেলাকে। কখন যে কার্পেটের ওপরই নিদ্রা গিয়েছিল মনে নেই। নিদ্রা ভাঙতে নিজেকে এই কক্ষের বিছানায় আবিষ্কার করে। এটা যে একটা প্রাসাদ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আন্দাজ করেছে। জমিন থেকে বেশ উঁচুতে এই কক্ষ। এদিকটার বাইরের দেয়ালের পলেস্তারা খসে ইটগুলো দাঁতের মতো বেরিয়ে এসেছে। স্থানে স্থানে শেওলা পড়া, পরগাছার অবাধ বসতি। দেখেই অনুমেয় এটি প্রাচীন প্রাসাদ। কত প্রাচীন? জানার আগ্রহ বাড়ে এই প্রাসাদ সম্পর্কে।
“শুধু প্রাসাদ?” ভেতর থেকে বিদ্রুপ করে কেউ শুধায়। মাথা ঝাকায় ইসাবেলা। নিকোলাস সম্পর্কেও জানতে চায় সে? ওই পিশাচকে ধ্বংস করতে হলে আগে তো জানতে হবে তার সম্পর্কে। কিছু না কিছু তো আছে যা দ্বারা ওর ধ্বংস অনিবার্য। কিন্তু কী সেটা? কীভাবে জানবে সেই সব কিছু ও? এই কক্ষে বন্দি হয়ে থাকলে সেসব প্রশ্নের জবাব সে পাবে না। মনে মনে পরিকল্পনা করে নিলো আগামীকাল প্রত্যুষে প্রাসাদটা ঘুরে দেখবে। কিছু যদি না পাওয়াও যায় অন্তত এখান থেকে পালানোর একটা পথ ও খুঁজে বের করবে।
অদূরের উইলো গাছের আড়ালে সূর্যটা আস্তে আস্তে অস্ত যাচ্ছে। সন্ধ্যা নামবে একটু পরেই। সন্ধ্যা যেন আতঙ্কের নাম! যতদূর চোখ যায় ঘন বন। ক্রমশ ধোঁয়াশার জালে জড়িয়ে যাচ্ছে বন।
এখানে দাঁড়িয়ে কোনো লোকালয় সে দেখতে পায় না। তবে কী লোকালয় বিচ্ছিন্ন এই প্রাসাদ? প্রাসাদের দক্ষিণে ছোট্ট একটা নদীর আংশিকাংশ দেখা যায়। গোধূলির বেলায় ওর জলে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তন্ময় হয় সে। ইতোমধ্যে গোধূলির লালিমা মুছে গিয়ে আঁধার নেমে এসেছে। ইসাবেলা ফিরে এলো বিছানায়। যে কোনো মুহূর্তে নিকোলাসের আগমন ঘটতে পারে। সেটাও সম্ভাব্য। দিন তারিখের সঠিকতা জানা নেই ইসাবেলার। তবে হিসেব করলে প্রায় দুই সপ্তাহ হয় এই প্রাসাদে এসেছে সে। এরমধ্যে মাত্র তিন সন্ধ্যে নিকোলাসের মুখোমুখি হয়েছিল। ঘৃণায়, ক্ষোভে সরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। নিকোলাস ওর খুব কাছে বসে যখন সম্মোহনী গলায়”বেলা” বলে ডাকে, না চাইতেও তাকায় ওর চোখে। আর তারপরেই তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে যায়। কিছুতেই মনে করতে পারে না তখনকার স্মৃতি। শুধু ঘুম ভাঙলে শরীরটা অবসন্ন আর দূর্বল লাগে। কিন্তু তারপরের চার দিন নিকোলাসের দেখা মেলেনি। পরের সপ্তাহে ঘটে আরেক ঘটনা। এক সকালে ঘুম থেকে জেগে রুমের সেলফে কিছু পুরোনো বই দেখতে পায় সে। খুব বেশি বই পড়ুয়া মেয়ে নয় ইসাবেলা। ভাইবোনদের মধ্যে বইয়ের পোকা একমাত্র ভ্লাদিমি। ইসাবেলা টুকটাক অবসরে পড়ত। এখানে ওর অখন্ড অবসর। সারাদিনে তেমন বই না পড়লেও রাতে একটু আধটু পড়ে। তাতে ঘুমটা তাড়াতাড়ি নামে চোখে। ঘুমিয়ে রাতের বিভীষিকা এড়াতে চায় ও। সেদিন রাতে হোমারের ইলিয়ড পড়ছিল। হঠাৎ খিলখিল হাসির শব্দে লাফ দিয়ে বিছানার উপর উঠে বসে। টিমটিপে তেলের বাতির আলোতে স্পষ্ট দেখতে পেল ইভারলির সুশ্রী মুখ। ওর লাল চুলগুলো কতকটা দু-কাঁধ ছাড়িয়ে নেমে গেছে। ডাগর চোখ, লাল টুকটুকে ওষ্ঠজোড়ায় মোহনীয় হাসি। পরনে কালো রঙের অফ সোল্ডার ফ্লোরাল গাউন।
“ইসাবেল, আমার প্রিয় ইসাবেল।”
দেহটাকে ছন্দোময় করে এগিয়ে এলো ইভারলি। ইসাবেলা দরজার দিকে তাকায়। আশ্চর্য! দরজা ভেতর থেকে দেওয়া। আর্ত হয়ে ওঠে। ভয়ে বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। ইভারলি ঝুঁকে ওর চিবুক তুলে বলল,
“ইসাবেল, তাকাও আমার চোখে, তাকাও প্রিয় আমার।”
ইভারলির সম্মোহনী গলার স্বর উপেক্ষা করতে পারল না ইসাবেলা। তাকাল ওর চোখে। মোহাচ্ছন্ন হয়ে গেল সাথে সাথে। ইভারলি ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে। আঁজলা ভরে ওর মুখটা তুলে বলল,
“তোমায় আমি খুব ভালোবাসি ইসাবেল। নিকোলাস তোমাকে কষ্ট দেয় তা যে আমার সহ্য হয় না। তাই তো এলাম। এবার তোমাকে মুক্তি দেবো আমি। চাও না মুক্তি তুমি? বলো চাও?”
ইসাবেলা ঘোরের মধ্যে মাথা নাড়ায়। ইভারলির হাসি আরো প্রসস্থ হয়। জড়িয়ে ধরে ইসাবেলাকে।
“তোমায় সেদিন খুব কষ্ট দিয়েছিলাম তাই না ডার্লিং? আজ ভালোবেসে সব কষ্ট মুছে দেবো। খুব ভালোবাসব আজ তোমাকে আমি। খুব।”
চাপা মোহমুগ্ধ গলায় বলল ইভারলি। ইসাবেলা ওর উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শ পাচ্ছে গলায়। ভেতরে ভেতরে তীব্র ঘৃণায়, অস্বস্তিতে ছটফট করছে সে। কিন্তু প্রকাশ্যে নিশ্চল, মোহাচ্ছন্ন। ডায়নিটার জালে আঁটকে পড়েছে। ইভারলি উদ্দেশ্য বুঝতে বাকি নেই ওর। নিকোলাসের মতো সেও এসেছে ইসাবেলার রক্ত পান করতে। নিকোলাস বাঁচিয়ে রেখেছিল, ইভারলি তা করবে না। ইভারলি তীক্ষ্ণ শ্বদন্ত ওর রক্তনালিতে ফুটিয়ে দেয়। দু’হাতে ঠেলে সরাতে চাইছে কিন্তু পারছে না। কেউ যেন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। হঠাৎ সামনের দরজা সশব্দে খুলে গেল। রাগে অগ্নিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিকোলাস। আগুনের ন্যায় জ্বলছে ওর চোখজোড়া।
চেঁচিয়ে উঠল,
“লি”
হাওয়ায় মিশে ইভারলির ঘাড় ধরে টেনে সরিয়ে নেয়। ইসাবেলার ঘোর কাটল তখনই। জোরে জোরে শ্বাস নেয়। ইভারলির একটু আগের স্পর্শে গা ঘিন ঘিন করছে। ঘাড়ের কাছে হাত দিতে ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল। নিকোলাস তাকাল ওর দিকে। তারপর ইভারলির গলা চেপে ধরে গর্জে ওঠে,
“এত বড়ো স্পর্ধা তোর? কোন সাহসে এসেছিস এ ঘরে? নিষেধ করেছিলাম কি না? বল নিষেধ করেছিলাম কি না এ ঘরে আসতে?”
ইভারলি কিন্তু একটুও ঘাবড়াল না। হেসে ঢলে পড়ল নিকোলাস গায়ের ওপর। হাতের আঙুল চালাল ওর চোয়ালে। ওর কর্ণ লতিকায় মৃদু কামড়ে প্রলুব্ধ কণ্ঠে বলল,
“নিকো, আমি তো ওর সাথে বন্ধুত্ব করতে এসেছিলাম। ভাবলাম একা থাকে, তাই চলে এলাম সঙ্গ দিতে। তুমি বুঝি রাগ করলে? এসো আমার ভালোবাসায় তোমার সব রাগ ভুলিয়ে দেবো।”
নিকোলাস ওর গলা চেপে ধরে মুখটা দূরে সরিয়ে দেয়। ইভারলির ঠোঁটে আবেদনময়ী হাসি। নিকোলাস ইসাবেলার অশ্রুসিক্ত মুখের দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। ইসাবেলা ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে নিতে ইভারলিকে সাথে করে বেরিয়ে গেল কক্ষ ছেড়ে। এরপর পুরো সপ্তাহে ওর চেহারা দেখেনি ইসাবেলা। তাতে অবশ্য ভালোই আছে সে। শরীরের অবসন্নতা খানিকটা কেটেছে। ঘাড়ের ক্ষততে আজ আবারও হাত বুলাল ইসাবেলা। ব্যথা নেই আগের মতো সেখানে। শুকিয়ে আসছে ক্ষত। এতেই প্রমাণিত আজকাল নিকোলাস ওর রক্ত পান করছে না। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে সোজা হয়ে বসল। নিকোলাস আসেনি। সে কখনও দরজায় কড়া নেড়ে আসে না। ইসাবেলা মৃদু গলায় বলল,
“আসুন।”
কালো পোশাক পরিহিত ভৃত্যটি খাবারের ট্রে হাতে রুমে ঢুকলো। এই ভৃত্যটি ওদের মতো পিশাচ নয়। কিন্তু নিকোলাসের বশীভূত। দেখতে যেন পাথর মানব মনে হয়। মুখ, চোখের হাবভাবে কোনোভাবেই স্বাভাবিক মানুষ বলা যায় না তাকে। কয়েকবার ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু টু শব্দটি করেনি সে। ইসাবেলার মাঝেমধ্যে মনে হয় ও বুঝি মূক। কলের পুতুলের মতো খাবার রেখে দরজার দিকে যাচ্ছিল। ইসাবেলা সাহস করে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি কি এখানেই থাকেন? নাম কী আপনার?”
ভৃত্যটি থমকে দাঁড়াল। নিরস চোখে একবার তাকিয়ে সাথে সাথে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। দ্রুত পদে বেরিয়ে গেল কক্ষ ছেড়ে। হতাশ মুখে খাবারের ট্রের দিকে তাকিয়ে রইল ইসাবেলা। দু-চোখ বন্ধ করে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলো এই খাবারের জন্য, প্রার্থনা করল এই নরক থেকে মুক্তির। কভু কী মুক্তি পাবে সে? ঈশ্বর কী পাঠাবেন কাওকে তাকে মুক্ত করতে? এই অমানিশার মাঝেও আলো খোঁজে ইসাবেলা। এক চিলতে প্রাণের আলোকশ্মি।
চলবে,,,