#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–১০০(অন্তিম পর্ব)
Writer তানিয়া শেখ
সিস্টার মারির হাত থেকে না চাইতেও চিঠিটা গ্রহণ করল ইসাবেলা। হাতে নিয়ে তেমনই ফেলে রাখে নিজের টেবিলের ওপর। ওটা যেন অস্পৃশ্য কিছু। সিস্টার আসতে যেতে ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেন। একদিন বললেন,
“তুমি জানো ওতে কি লেখা?”
ইসাবেলা মাথা নাড়ায় ওপর নিচে। সিস্টার মারি বললেন,
“আমাকে বলা যাবে? জোর করছি না। বন্ধুর মতো জানতে চাচ্ছি। ক’দিন ধরে বেশ অশান্তি লক্ষ্য করছি তোমার মাঝে। জানি এর কারণ ওই চিঠিটা। বলবে?”
ইসাবেলা ইতস্তত করে প্রথমে তারপর সব খুলে বলল। আশ্রমে আসার পর সিস্টার মারি ওর বৈরাগ্যতার কারণ জানতে চেয়েছিলেন। এই একজনের সাথে অল্প সময়েই ভাব হয়েছে ইসাবেলার। ও ধোঁয়াশা করে নিজের জীবনের দুঃখ গাঁথা শুনিয়েছিল। আজ খোলাখুলি ভাবে বলল। কেবল নিকোলাসের পিশাচ হওয়ার সত্যিটা লুকায়। সব শুনে সিস্টার সহানুভূতি প্রকাশ করলেন। কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বললেন,
“আমার মন বলে নানাকে দেখতে যাওয়া উচিত তোমার। নানা বলে না হলেও একজন মৃত্যুশয্যায় শায়িত মানুষের শেষ ইচ্ছে মনে করে যেতে পারো। ঈশ্বর খুশি হবেন। তাঁকে খুশি করলে নিরাশ হবে না তুমি। আর যদি তোমার মন সায় না দেয় তো যেয়ো না। কিন্তু রাগ বা ক্ষোভে সিদ্ধান্ত না নেওয়াটাই উপযুক্ত। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। সহায় হোন।”
সিস্টার মারির কথা ভাবালো। মনেও হাজারো প্রশ্ন। পরিবারের এত মানুষ থাকতে নানা ওকেই কেন যেতে বললেন? কোন মুখে? নতুন কোনো ষড়যন্ত্র করছেন? আবার কেন? না কি ড্যামিয়ান ফিরে এসেছে! তা কী করে সম্ভব। ওর সামনেই তো খাদে হারিয়ে গেল ড্যামিয়ান। ওত গভীর খাদে পড়ে বেঁচে ফেরার কথা নয় ওর। তাহলে কেন ইসাবেলাকে যেতে বলেছেন নানা মার্কোভিক। কী এমন জরুরি কথা তাঁর? ক্ষমা চাইবেন? ক্ষমা চাইলেই পাওয়া যায়? দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলো যাবেই না। কিন্তু স্থির থাকতে পারছে না কেন যেন। মন বলছে যাওয়া উচিত। নানার প্রতি মায়া? একটুও নেই এখন। দায়বদ্ধতা। তাও না। বাইবেলে আছে,
“Be kind and compassionate to one another, forgiving each other, just as in Christ God forgave you.”
এই বাণীই ওর বিবেককে নাড়া দেয়। হয়তো এই কারণেই ঈশ্বর ওকে ক্ষমা করবে। ফিরিয়ে দেবে সন্তানকে ওর কোলে৷ দ্বিধাদ্বন্দে ঠিকটাক কাজ করতে পারে না, প্রার্থনায় মন বসে না। সিস্টার মারি আবার বুঝায়। গসপেলের উদ্ধৃতি দিয়ে ক্ষমা ও দয়াশীলতার মহত্ত্বের বাণী শোনায়। ইসাবেলা রাজি হয় মস্কো যাওয়ার জন্য। পরদিন সকাল সকাল রওনা হলো।
আজ সকালটা রৌদ্রস্নাত। সাদা তুষারে বিকিরিত রোদ হিরের মতো ঝলমলে। পথের দু’ধারের কিছু বরফ ঢাকা, কিছু শিশির পড়া ঘাসের সমতল পেরিয়ে পাইন বনের মাঝ দিয়ে ছোট্ট গাঁয়ের পথ ধরে চললো ফিটন। বেলা শেষে একটা সরাইখানার সামনে থামিয়ে গাড়োয়ান বলল,
“সামনে আর জনপদ নেই। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। আজ রাতটা এখানেই বরং থাকার ব্যবস্থা করি।”
“ঠিক আছে।” সম্মতি দেয় ইসাবেলা।
গাড়োয়ান নেমে একাই সব ব্যবস্থা করল। সরাইখানার মালিককে বলে ওর জন্য একটা রুম ভাড়া নেয়। ইসাবেলা রুমে ফ্রেশ হয়ে বসেছিল। পঞ্চাশ বর্ষীয় গাড়োয়ান কুর্নিশের ঢঙে এসে বলে,
“খাবার এখানে পাঠাব, জনাবা?”
রুমে বসে খেতে ইচ্ছে করছে না ইসাবেলার। বলল, আজ সরাইখানার খাবার ঘরে গিয়েই খাবে। উঠে গাড়োয়ানের পিছু পিছু সম্মিলিত খাবার ঘরের এককোণে আসন নেয়। বেকন, পাউরুটি আর এক কাপ চা সামনে নিয়ে একটু একটু করে খেতে লাগল। গাড়োয়ান আসছি বলে পানশালার দিকে গেল। মস্কো থেকে এই জায়গা বেশি দূরে নয়। সেই দশবছর আগে এসেছিল আর এই এলো। বুকের ভেতর ভার ভার লাগে। খেতে খেতে ইসাবেলার মনে হলো কেউ ওকে দেখছে। চোখ তুলতে সামনে ওরই কাছাকাছি বয়সীর একজন নারীকে দেখতে পায়। প্রথমে চিনতে পারেনি। মেয়েটি আসন ছেড়ে সহাস্যে উঠে এলো ওর কাছে।
“ইসাবেলা?”
“হ্যাঁ, তুমি?”
নিজ থেকে বসল মেয়েটি। তারপর নিজের পরিচয় দিলো। নিকোলাসের সাথে দূর গাঁয়ে গিয়ে যেই গর্ভবতী মেয়েটির গর্ভপাত দেখেছিল এ হচ্ছে সেই মেয়ে। ওর গর্ভের পিশাচ সন্তানটির করুণ পরিণতি ইসাবেলাকে কাঁদিয়েছিল একদিন। মেয়েটির জন্যও দুঃখ কম ছিল না। মেয়েটি বাঁচবে কি না, সন্তান হারানোর শোক কী করে কাটাবে ইত্যাদি ভয় পেয়েছিল সেদিন। আজ জলজ্যান্ত মেয়েটি বেঁচেবর্তে ওর সামনে বসে আছে। শোকতাপ নেই৷ সময় হয়তো ভুলিয়ে দিয়েছে। সবার ক্ষেত্রে কথাটা যায় না। এই যেমন ইসাবেলার। সময় ওকে কিছুই ভোলাতে পারেনি।
নিকোলাস আর নেই এ কথা মেয়েটি জানে। কী করে ইসাবেলা জানতে চায় না। ও উঠে গেলে বরং খুশি। পুরোনো স্মৃতিজড়ানো মানুষগুলো দেখলে বড়ো কষ্ট হয়। ইসাবেলার দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে থাকে মেয়েটি। কিছু বুঝতে চাইছে যেন। কী? অস্বস্তি হয় ইসাবেলার। মেয়েটি মুখটা এগিয়ে এনে চাপা গলায় বলল,
“একটা গোপন কথা বলব? বিশ্বাস করা না করা তোমার ব্যাপার।”
ইসাবেলা সপ্রশ্নে তাকায়। মেয়েটি আবার সতর্কে এদিক ওদিক চেয়ে বলল,
“আমার গর্ভের সন্তানটিকে কেন ওরা বাঁচতে দেয়নি জানো?”
“তোমার মৃত্যু হবে তাই।”
“ওটা আসল কারণ নয়।”
“তাহলে?” ভুরু কুঁচকায় ইসাবেলা। মেয়েটি গলা আরও খাদে নামিয়ে বলে,
“ওরা চায়নি ও ফিরে আসুক। ওই সন্তানের রক্তসূত্র ধরেই ও যে আবার ফিরে আসত। ও ফিরলে আমি, আমার পরিবার সবাই মারা পড়তাম।”
“ও? ও-টা কে?কী বলছ তুমি?” দ্বিধাগ্রস্ত ইসাবেলা। মেয়েটি বলে,
“যার কারণে ওই সন্তান গর্ভে এসেছিল। আমার সেই পিশাচ প্রেমিক। ওকে হত্যা করলেও ওর রক্ত যে আমি বহন করছিলাম গর্ভে। একদিন এই সূত্র ধরে ও আবার ফিরে আসত। এমনই হয় ওদের ক্ষেত্রে। ওরা শেষ হয়েও শেষ হয় না।”
হকচকিয়ে তাকায় ইসাবেলা। শেষ হয়েও শেষ হয় না মানে! এই মেয়েটি কেন এসব বলছে? কী প্রমাণ করতে চাইছে ও? ওর বিমূঢ়তা দেখে মেয়েটি বলল,
“তোমার সন্তান হয়েছিল?”
ইসাবেলার চোখ করুণ হয়ে উঠল। মেয়েটি বুঝল।স্মিত হেসে বলে,
“আশা করি সে বেঁচে আছে। যদি তাই হয় নিকোলাস ফিরবে। দেখে নিয়ো।”
ইসাবেলা চমকে তাকায়। হঠাৎ হৃৎস্পন্দনের গতি বেড়ে গেল। মেয়েটি নিশ্চয় পাগল হয়েছে। এমন অবিশ্বাস্য অথচ, মধুর কথা গত দশবছরে কেউ ওকে বলেনি। মেয়েটি ওর বিস্ময়াহত মুখ চেয়ে মুচকি হাসল। রহস্যময় হাসি। গাড়োয়ান এদিকেই আসছে। ওকে দেখে মেয়েটি উঠে দাঁড়ায়,
“আজ চললাম। শীঘ্রই আবার দেখা হবে আমাদের। সেদিন হাসিমুখে অভ্যর্থনা পাব বলে আশা রাখি৷”
মেয়েটি ওর দৃষ্টির বাহিরে যাওয়ার পরও সেখানে ভূতের মতো বসে রইল ইসাবেলা। নিকোলাস ফিরবে! কী করে? সবকিছু এত জটিল আর দুর্বোধ্য কেন? মেয়েটি ওর গোপন ব্যথা বাড়িয়ে দিয়ে গেল। সারারাত ছটফট করেছে ইসাবেলা। ঘুম হলো না। পাগলের মতো মনে মনে বিড়বিড় করল, “নিকোলাস ফিরবে, নিকোলাস ফিরবে!” মেয়েটি ওর মনে মধুর এক জ্বালা ধরিয়ে গেছে৷ নিরাসক্ত জীবনে আশার আলোর দেখা পায়।
পরদিন ভোরে আবার রওয়ানা হলো। মেয়েটির সব কথা একে একে জোড়া লাগাচ্ছে। সন্তান, রক্তসূত্র তারপর শেষ হয়েও শেষ হয় না.. এসবের মধ্যে হঠাৎ দশবছর আগে বলা ড্যামিয়ানের কথাও স্মরণে এলো। ওর গর্ভের সন্তানকে নিয়ে কত ভয় ছিল ড্যামিয়ানের মনে। মেরে ফেলতে চেয়েছিল। বার বার বলছিল,”পিশাচটাকে ও ফিরিয়ে আনতে চাইছে।” মিথ্যা মনে করেছিল কথাগুলো। কিন্তু একইরকম কথা এই মেয়েটি বলল। তবে কি নিকোলাসের ফেরার সম্ভবনা আছে? ওর সন্তানই কি সেই পথ? কিন্তু সেই সন্তান কোথায়? ইসাবেলার দিশেহারা অবস্থা। আচমকা ফিটন ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। ধাতস্থ হয় ইসাবেলা। সামনের ঘোড়াগুলো চিৎকার তুলে লাফিয়ে উঠল। গাড়োয়ান কিছুতেই ওদের বশে আনতে পারছে না। ঠিক তখনই ইসাবেলা খেয়াল করল, একটা নির্জন পথে এসে থেমেছে ফিটনটা। ঘোড়াগুলো অস্বাভাবিক আচরণ করছে। ভয় পেয়েছে যেন। কাছাকাছি নেকড়ের গর্জন শোনা গেল। ঘোড়াগুলো আগের চাইতে বেশি অশান্ত। গাড়োয়ান বোধহয় এমন কিছু আশা করেননি। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে সে। নেকড়ের গর্জন ক্রমশ কাছে আসছে। ঘোড়াগুলো এক পর্যায়ে দড়ি ছিঁড়ে পালিয়ে গেল কোথায়। মালিক তখন হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেন না।
“আপনি এখান থেকে বেরোবেন না। চারপাশ অনিরাপদ। এক্ষুনি ঘোড়াগুলো খুঁজে নিয়ে আসছি আমি।”
গাড়োয়ান নেমে গেলে ইসাবেলা সভয়ে ঘাপটি মেরে বসে রইল সেখানে। বহু বছর এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। আগের মতো সেই সাহসই বা কই? মা বলেছিল, ওর মধ্যে নেকড়ে মানবের রক্ত বইছে। তাহলে নেকড়ে দেখে ভয় পাচ্ছে কেন? ভীরু ও সঙ্গিহীন বলে? তবে এটা ঠিক মাঝে মাঝে অস্বাভাবিক কিছু ঘটে ওর সাথে। ঠিক বুঝানোর মতো না। ইসাবেলা এড়িয়ে যায় সেসব। এই যেমন এখন ভয় ভয় করছে আবার ভেতরে ক্ষুব্ধতা টের পাচ্ছে। কিন্তু অভ্যস্ত সাধারণ মানব জীবনকেই প্রাধান্য দেয়। ক্ষুব্ধতা নয় ভয়টাই প্রকট হয় তখন।
চারপাশ হঠাৎই নিস্তব্ধ। কিছুক্ষণ এমন করে কেটে যায়। গাড়োয়ান ঘোড়া নিয়ে আর ফিরে আসে না। ইসাবেলার বুক ঢিপঢিপ করছে। ঈশ্বরের নাম জপছে অনবরত। আচমকা নিস্তব্ধতা ভেঙে গাড়োয়ানের মৃত্যু চিৎকার এই নির্জনতায় হালচাল ফেলে দিলো। ইসাবেলা কাঠ হয়ে বসে আছে। কী করবে এখন? কিছু একটা জানালায় আছরে পড়তে আতঙ্কিত হলো ও। চেয়ে দেখল ফিটনের চারপাশে হিংস্র নেকড়ের দল ঘিরে ধরেছে। মুখে তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে৷ গাড়োয়ান ও ঘোড়াগুলোর তাজা রক্ত। ইসাবেলার রক্ত হিম হয়ে যায়। নেকড়েগুলোর গর্জন তীব্র হচ্ছে। কান ফাটিয়ে দিতে চায় যেন। ফিটনের ওপর আছরে পড়তে পড়তে ফিটনটা উলটে ফেলে দেয়। ভয়ে চিৎকার করে ওঠে ইসাবেলা। ফিটন উলটে পড়াতে বেশ আঘাত পায় ও। ওকে না মেরে শান্ত হবে না ওরা। ফিটনের জানালার কাঁচে ধারালো নখারাঘাত করছে। ফেটে যেত লাগল কাঁচ। ওদের হিংস্র গর্জনে কানে তালা লেগে যাওয়ার উপক্রম। ইসাবেলা দুহাতে কান বন্ধ করে, কুঁজো হয়ে চোখ বুঁজে পড়ে রইল ফিটনের ভেতর। খালি হাতে এদের সাথে লড়বে কী করে ও? আজ ওর মৃত্যু অনিবার্য। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলেও হায়েনাগুলোর আক্রমণের স্বীকার হলো না দেখে চোখ খুললো। কোথায় হায়েনা! কিছুই নেই আশেপাশে। কানের ওপর থেকে হাত সরিয়ে অবাক হয়। গর্জনের শব্দ নেই। আরও ভালো করে শুনলো ইসাবেলা। সত্যি নেই। তবুও চুপচাপ কিছুক্ষণ সেভাবেই রইল। এদিকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার পথে। এভাবে নির্জন পথে একা থাকা নিরাপদ নয়। সাবধানে ফিটন ছেড়ে বেরিয়ে এলো। আশেপাশে কোনো প্রাণীর চিহ্ন নেই। শুধু এদিক-ওদিক ছোপ ছোপ রক্ত দেখতে পেল। নেকড়েগুলো ওকে শিকার করতে গিয়ে নিজেরাই শিকারে পরিণত হয়েছে। কিন্তু কে সেই শিকারি? সতর্ক হয় ইসাবেলা। হাতের কাছে আত্মরক্ষা করার মতো তেমন কিছু পেল না। একটা মোটা ডাল তুলে নেয়। এটা দিয়ে জীবনরক্ষা! না হোক, তবুও থাক। সেই গহিন নির্জন পথে একা একা চলতে লাগল ও। মাঝে মাঝে মনে হলো কেউ ওকে অনুসরণ করছে। ছোটো ছোটো পায়ে। শুনতে পায় একটা ব্যাঙের ঘ্যাঙরঘ্যাঙ। ও থামলেই আবার নিশ্চুপ৷ দ্রুত পা চালায়। চলতে চলতে প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। তেরাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ায়। কোনোদিকে যাবে এখন? এমন সময় দমকা বাতাস উঠল। রাস্তার দু’পাশের গাছ পর্যন্ত দুলে ওঠে। পাতায় পাতায় তান্ডব নৃত্য। দিক নির্ধারণে স্থির হতে পারে না ইসাবেলা। চোখের ওপর হাত রেখে ডান দিকে পা বাড়ায়। দু’পা যেতে থমকে যায়। শিউরে ওঠে ওর সমস্ত শরীর। বাতাসে ভেসে এলো পরিচিত সুবাস। সোঁদা মাটির গন্ধ! এক মুহূর্তের জন্য ইসাবেলা দম নিতে ভুলে গেল। পরক্ষণেই ওর চিত্তেচাঞ্চল্য শুরু হয়। চকিতে এদিক-ওদিক ঘুরে তাকায়।
“নিকোলাস, নিকোলাস।”
নির্জন পথে প্রতিধ্বনিত হয় তারপর মিলিয়ে যায় নামটা। কিন্তু জবাব আসে না। ইসাবেলার শ্বাস ভারি হয়। বড়ো চেষ্টায় স্বাভাবিক ভাবেই শ্বাস নিলো। হতাশার মেঘ নামে মুখ জুড়ে। নেই সেই সুবাস। তবে কি মনের ভুল! ইসাবেলা মানতে নারাজ। মনের ভুল কিছুতেই না। এত বছরে তো হয়নি এই ভুল। আজ কেন? মেয়েটার কথা মনে পড়ে। “নিকোলাস ফিরবে। দেখো।”
অস্থির হয় ও। এদিক-ওদিক ছোটে পাগলের মতো। অশ্রুরুদ্ধ গলায় চিৎকার করে,
“নিকোলাস, আর বিরহ দিয়ো না। দেখা দাও। দেখা দাও।”
সেখানেই হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে পড়ে ইসাবেলা। ওর পা আর চলে না। ওই সুবাস চলন শক্তি দুর্বল করে দিয়ে গেছে। সন্ধ্যা উতরে রাত নামে। ইসাবেলা তেমনই বসে থাকে সেখানে। কান খাঁড়া করে শুনতে পায় একটু দূরে আবার নেকড়ের গর্জন। ভয় পায় না এখন হিংস্র সেই গর্জন শুনে। ওঠে না। মরবে আজ। মরলে এত আশা-নিরাশা রইবে না, বিরহ, বিচ্ছেদের দহনে পুড়বে না। কিন্তু মেয়ের কথা মনে পড়তে বুকটা খা খা করে উঠল। নেকড়ের গর্জন কাছে আসছে। টের পাচ্ছে ওটা ওর সামনে দাঁড়িয়ে। প্রস্তুতি নিচ্ছে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে। ইসাবেলা ধীরে ধীরে মুখ তোলে। নেকড়েটার বুভুক্ষু দৃষ্টি বিচলিত করে না ওকে। শিকারের চোখে ভয় নেই। দাঁত খিঁচিয়ে ওঠে নেকড়েটা। তারপর লাফিয়ে পড়ে ওর দিকে। এবার ভয়ে অসাড় হয়ে যায় ইসাবেলা। দু’হাতে হাঁটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। চিৎকার বেরিয়ে আসে গলা দিয়ে। চোখ বিস্ফোরিত। নেকড়ের থাবা ওর মুখ স্পর্শ করবে তখনই চোখ বন্ধ করল ইসাবেলা। টের পেল নেকড়েটাকে কেউ ঝড়ো গতিতে ওর সামনে থেকে ছুঁড়ে ফেললো। বাতাসের দাপটে চিৎ হয়ে পড়ল ও। নেকড়েটার মৃত্যু গোঙানি শুনতে পায়। আর, আর.. নাক টানছে বারবার। এবার স্পষ্ট এবং খুব কাছে টের পেল সোঁদা মাটির গন্ধ। চোখ খুললো না। একপাশে কাত হয়ে মড়ার মতো পড়ে রইল। অশ্রুপাত হয় গাল বেয়ে। ভয় করছে। চোখ খুললে যদি আবার সব মিথ্যা হয়ে যায়? আবার মিলিয়ে যায় সুবাসটা।
“বেলা।”
ইসাবেলার সর্ব শরীর হিম হয়ে গেল। বিপরীত কেবল হৃদয়। ভীষণ তার গতি। মিথ্যা নয়। ওই যে ডাকছে নিকোলাস। কত বছর পর ওর কণ্ঠে শুনতে পাচ্ছে নিজের নাম। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে ইসাবেলা। পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে ওর সামনে এসে শেষ হয়। সোঁদা মাটির গন্ধ তীব্র হয়ে নাসিকাপথ ভেদ করে ভেতরটা উতালপাতাল করে দিচ্ছে।
“বেলা, চোখ খোলো। দেখো এসেছি আমি। তোমার নিকোলাস ফিরে এসেছে।”
কী কাতরতা ওই গলায়! জোরে কেঁদে ওঠে ইসাবেলা। ধীরে ধীরে সিক্ত চোখের পাতা খুললো।
আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। সেই আলোতে বহুবছর পর দু জোড়া তৃষ্ণিত চাহনি এক হয়। বিরহ হৃদয়ে মিলন গীতের বীণা ঝংকার তোলে। ইসাবেলা উঠে বসে। মুখোমুখি ওরা। একটুও বদলায়নি নিকোলাস। ঠিক দশবছর আগের মতোই সুদর্শন। সেই নীল চোখের অতল সমুদ্রে আজও হারালো ইসাবেলা। সভয়ে কম্পিত হাতটি বাড়ায়। ভয় হয় স্পর্শ করলে যদি হাওয়া হয়ে উড়ে যায়! কিন্তু হলো না তেমন। মরীচিকা নয়, নিকোলাস সত্যি ওর সামনে বসে আছে। মানবীয় শরীরে। তবে কি ফিরে এলো ও? আনন্দ আর কান্না মিলে শব্দ তৈরি হয়। নিকোলাসের বুকের ওপর আছরে পড়ে। দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। স্বপ্নে নয়, কল্পনায় নয়। এই তো সত্যি সত্যি দু হাতের মাঝে নিকোলাসকে পেয়েছে আবার। নিকোলাস ওর মুখটা দু’হাতে তুললো। চোখের পানি মুছে বলল,
“মন ভরে দেখতে দাও তোমায়।”
“নিকোলাস!” অস্ফুটে বলল ইসাবেলা। ঠোঁট দুটো কাঁপছে। নিকোলাসের ঠোঁটে সম্মোহনী হাসি। অনিমেষ তাকিয়ে বলল,
“এইতো আমি।”
“আর ছেড়ে যাবে না তো?”
“কোনোদিন না প্রিয়তমা। কোনোদিন না।”
গভীর চুম্বন করল ইসাবেলার ঠোঁটে। জানিয়ে দিলো নিজের অস্তিত্বের সত্যতা। দুজনের হুঁশ ফেরে ঘোড়ার খুরের আওয়াজে। ইসাবেলা সলজ্জে তাকাতে নিকোলাসের সেই ঘোড়ার গাড়ি দেখল অদূরে। সামনের সিটে পল ও নোভালি বসে। কী সুন্দর মানিয়েছে ওদের! ওকে দেখে হাত নেড়ে হাসল ওরা। কোলে দুটো শিশু বসে আছে। বাবা-মায়ের কার্বন কপি দুটোই। ইসাবেলার মন আনন্দে ভরে গেল। ঘোড়ার গাড়ির পেছনের সিটে তাকাতে ওর হাসিমুখ বদলে যায়। দশ-বারো বছরের বালিকা বসে আছে। কোলের ওপর একটা সবুজ ব্যাঙ। বালিকার মুখ যে খুব চেনা ওর। ওই তো এঁকেছিল দশবছর আগে। স্বপ্নে দেখা সেই শিশুটি! সেই বাদামি কোঁকড়া চুল, নীল চোখ। ঠোঁটে নিকোলাসের হাসি বাঁধায় করা।
অদূরে আগাথার প্রেতাত্মাকে দেখছে। রাগ নেই ও মুখে। ক্ষমা করে দিয়েছে। শূন্যে হাত তুলে আশীর্বাদ করল ওদের। তারপর বালিকাটিকে কিছু ইশারা করেন। ইসাবেলার দিকে হেসে তাকায় ও। আকাশ কাঁপিয়ে ডেকে ওঠে,
“মা!”
ইসাবেলা আনন্দে ফের অশ্রু বিসর্জন দিলো। নিকোলাসের দিকে তাকায় সজল চোখে। নিকোলাস মুচকি হাসে। মাথা নাড়িয়ে বলে,
“আমাদের মেয়ে।”
“আমাদের মেয়ে!”
ইসাবেলা মেয়ের হাসিমাখা পবিত্র মুখে পুনরায় তাকায়। ওর শূন্য মাতৃহৃদয় কানায় কানায় ভরে ওঠে। নিকোলাস ওকে নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে। মেয়ের হাসিমুখে চেয়ে থাকে দুজনে। মেয়ের নাম জানতে বড়ো ইচ্ছে হলো ইসাবেলার। তখনই নিকোলাসকে বলতে শোনে,
“ওফেলিয়া, ওফেলিয়া।”
.
.
(নোভা ও পলের ব্যাপারটা এখানে এইটুকু। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো বিস্তারিত আসতে পারে। আন্দ্রেইকে নিয়ে নতুন একটি গল্প লেখা হবে ভবিষ্যতে। সেখানে আরও কিছু চরিত্র থাকবে যা এই উপন্যাসে আপনাদের কাছে অসম্পূর্ণ বলে মনে হয়েছে। এই উপন্যাসের কিছু বিষয় আপনাদের ভাবনার ওপর ছেড়ে দেওয়া। যেভাবে ইচ্ছে কল্পনা করে নেবেন। ধন্যবাদ এতদিন ধৈর্য ধরে “তিমিরে ফোটা গোলাপ” পড়ার জন্য। ভালো থাকবেন)