তিমিরে_ফোটা_গোলাপ পর্ব–৪৫

0
777

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৪৫
Writer তানিয়া শেখ

ওই ঘটনার পরদিনই মাদাম আদলৌনা মাতভেই এবং ইসাবেলাকে নিয়ে গ্রাম ছাড়েন। কয়েক ক্রোশ দূরে মাতভেইর এক চাচার বাড়ি। সেখানেই আশ্রয় নেন মাতভেই এবং ইসাবেলাকে নিয়ে। ও বাড়ির কর্তা অর্থাৎ মাতভেইর চাচা বেনাস বেশ ধনীলোক। যুদ্ধের এই কঠিন সময়ে যখন লোকে না খেতে পেরে হাহাকার করছে, তখন বেনাস বড়ো সুচতুরভাবে নিজের বিত্তবৈভব ধরে রেখেছেন। এ ক্ষেত্রে অবশ্য তাঁর তোষামোদি স্বভাব বেশ কাজে দিয়েছে। দেশের বড়ো বড়ো লোকের সাথে তাঁর ওঠা বসা। এ বাড়িতে রোজ আনাগোনা চলে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, রাজনৈতিক কর্মীদের। সেই সব উচ্চপর্যায়ের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের আশীর্বাদেই বেনাসের আর্থিক সম্পদ কমেনি বরং বেড়েছে খানিকটা।

আজ পঁচিশে ডিসেম্বর। ক্রিসমাস উপলক্ষ্যে এ বাড়িতে পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। বেনাসের বাড়িটিকে মহল বললে ভুল হবে না। দ্বিতল এই বিরাট বড়ো বাড়িটিই বেনাসের বিত্তবান হওয়ার পরিচয় বহন করে। জাঁকজমক আলোক বাতিতে সাজানো হয়েছে বাড়িটিকে আজ। হল ঘরের একপাশে বসানো হয়েছে বড়োসড়ো এক ক্রিসমাস ট্রি। রান্নাঘরে চলছে রান্নার ধুম। মাদাম আদলৌনা সকাল থেকে রান্নাঘরে। এ বাড়ির আসার পর নিজ ইচ্ছাতে একদিন রান্নাঘরে রাঁধুনিকে সাহায্য করতে গিয়েছিলেন তিনি। টুকিটাকি কাজ করে ফ্রীতে থাকা খাওয়ার খোঁটা শোনার থেকে বাঁচতে চেয়েছিলেন। এদিকে কম চতুর নন বেনাস। বসিয়ে বসিয়ে কাওকে তিনি খাওয়াবেন না। সেদিন মাদামের হাতের রান্না খেয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। ঠিক তার পরেরদিন মিথ্যা টাকা চুরির দায়ে বিদায় করেন পুরোনো রাঁধুনিকে। স্ত্রীকে দিয়ে মাদামকে বলে পাঠান, নতুন কোনো রাঁধুনি না পাওয়া অব্দি মাদাম যেন নিজের হেঁশেলের মতো রান্নাঘরের দায়িত্ব নেয়। মাদাম সব বুঝতে পেরেও চুপচাপ মাথা নেড়ে রাজি হলেন। ছেলের জন্য এ বাড়ির আশ্রয় তাঁর দরকার। বেনাস ফ্রীতে বেশিদিন রাখবেন না। কাজ করে যদি এ বাড়িতে বেশিদিন থাকা যায় তাতে ভালোই হয় মাদামের। সপ্তাহন্তে তিনি হয়ে গেলেন এ বাড়ির পার্মানেন্ট রাঁধুনি। এ কাজে ইসাবেলা তাঁকে সাহায্য করে মাঝে মাঝে৷ মাদামের কষ্ট কমাতে দু একটা পদ নিজেই রান্না করে। মাদামের যোগ্য শিষ্য যেন এ ক্ষেত্রে ও। এই রান্না ওকে ভুলিয়ে রাখে ডাইনি বধের সেই দুঃসহ স্মৃতি। ভুলিয়ে থাকে আরো অনেক কিছু, কিন্তু চাইলে কি সব ভোলা সম্ভব? বিভৎস স্মৃতিরা নিরালায় চুপি চুপি এসে হানা দেয়। ইসাবেলার এক একটা রজনী দীর্ঘ হয় চোখের জলে, যন্ত্রণা কাতর হৃদয়কে তিরস্কার করে।

রান্না প্রায় শেষ হতেই ইসাবেলা সেগুলোর ডেকোরেশন শুরু করে। দুজন চাকর ওর ডেকোরেশন করা খাবারভর্তি প্লেটগুলো হলঘরের বড়ো টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখছে। মাদাম লেটুস চিংড়ি দিয়ে কী একটা সালাদ তৈরি করবেন। এত কাজের চাপে লেটুসপাতা কোথায় রেখেছিলেন ভুলে গেলেন। ইসাবেলা এদিক ওদিক খুঁজতে লাগল।

“ইসাবেল, মিস ভিক্টোরিজা তোমায় ডাকছে।”

রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলল তরুণী দাসী জুজানি। ভিক্টোরিজা বেনাসের কনিষ্ঠ কন্যা। ইসাবেলার চেয়ে মাত্র তিন বছরের বড়ো। অত্যন্ত সুন্দরী। বেনাসের মতো ধনীলোকের মেয়ে হয়েও ওর মধ্যে অহংকার নেই। পরিচয়ের প্রথমদিন থেকেই ইসাবেলার সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন কাজে ওর পরামর্শ এবং সাহায্য নেয় ভিক্টোরিজা। ইসাবেলা জুজানির দিকে মুখ তুলে বলল,

“এই তো যাচ্ছি।”

লেটুসপাতা পেয়ে মাদামের হাতে দিয়ে ও জুজানির সাথে চলল দোতলায়। সিঁড়ির কয়েক ধাপ উঠতে জুজানি বলল,

“মিস খুব রেগে আছে।”

“কেন?”

“পিরিয়ড হয়েছে। এমন একটা দিনে ওটার কারণে অনেক কিছু লস যাবে বেচারির।”
জুজানি আস্তে করে বলে এক চোখ টিপে হাসল। মাথা নাড়িয়ে শুকনো হাসল ইসাবেলা।

“তুমি বড্ড ফাজিল অ্যানি।”

“সে আমি মানি। যা হোক, আজ সাবধানে থেকো ইসাবেল।”

“তা কেন?” থেমে গেল ইসাবেলা। জুজানি চাপা গলায় বলল,

“শহরের সুদর্শন যুবকের ভিড় হবে আজ এ বাড়িতে। কে জানে কার চোখে চোখ আঁটকে যায়। আর তারপরে_”

জুজানি বাক্য শেষ করে না। ইসাবেলার দিকে অশালীন চাহনিতে তাকায়। ওর ওই চাহনিতে গা গুলিয়ে আসে ইসাবেলার।

“ছি!”

“ছি? সেক্সকে ছি বললে? মিস শুনলে তোমার আজ গর্দান যাবেই যাবে। সেক্স যে কী জিনিস মিসকে জিজ্ঞেস কোরো। সে_”

ইসাবেলা জুজানির মুখের ওপর হাত চেপে ধরে,
“চুপ করো। আমার পবিত্র কানদুটোকে অপবিত্র না করলে তোমার বুঝি চলছে না, অ্যানি?”

ইসাবেলার নাক কুঁচকানো দেখে মুখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে ফিক করে হেসে দেয় জুজানি।

“আর কতদিন এভাবে চলবে, হুম? একদিন তো সেক_”

“জুজানি!”

দুহাতে কান বন্ধ করে ইসাবেলা। জুজানি ঠোঁট টিপে হাসি রোধ করে ওর গলা জড়িয়ে ধরে কান থেকে এক হাত সরানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। গলা থেকে জুজানির হাত ছাড়িয়ে গটগট করে আগে আগে চললো ইসাবেলা। জুজানি পেছন থেকে ডাকতে ডাকতে এগোয়। ইসাবেলা তাকায়ো না ওর দিকে আর।

রুষ্ট মুখে বসে আছে আয়নার সামনে ভিক্টোরিজা। ওর কাঁধের ওপর অবিন্যস্ত পড়ে আছে সোনালি চুল। মুখে একটার পর একটা কুকিজ পুরছে। ইসাবেলা রুমে ঢুকে ওর এই অবস্থা দেখে অবাক। ভিক্টোরিজাকে ও সর্বদা পরিপাটি হয়ে থাকতে দেখেছে। চালচলনে বেশ স্মার্ট। আজ একেবারে ব্যতিক্রম এক ভিক্টোরিজাকে দেখল।

“এত দেরি হলো কেন আসতে তোমার? আমি তৈরি হব কখন? একটা কাজ যদি তোমাদের দিয়ে হয়। সবগুলো অকর্মা, অপদার্থ।” ভিক্টোরিজার ধমকে মুখ নামিয়ে নিলো ইসাবেলা। এর আগে এমন স্বরে কথা বলেনি ওর সাথে ভিক্টোরিজা। হঠাৎ কান্নার শব্দ শুনতে পেল। মুখ তুলতে দেখে ভিক্টোরিজা কাঁদছে।

“আর একটু পরে অতিথিরা সব চলে আসবে৷ আমার চুল দেখো, আমার ড্রেস দেখো, আমার মুখটাও দেখো। কী বিশ্রী লাগছে আমায়। নিজের গলায় নিজে ছুরি চালাতে ইচ্ছে করছে এখন।”

ইসাবেলা হাঁপ ছেড়ে আলমিরার দিকে যায়। নতুন এবং সুন্দর লাল রঙা বলগাউনটা বের করল। ওর সাথে ম্যাচিং হিরের কানের দুল, হার আর জুতো বের রাখল বিছানার ওপর। ভিক্টোরিজা রাগ রাগ ধূসর চোখে চেয়ে বলল,

“আমি ঘৃণা করি লাল রং, জাস্ট ঘৃণা করি।”

ইসাবেলা ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,

“ওঠো। আর সময় নষ্ট করলে চলবে না।”

“আমি নিচে যাব না।”

“তোমার বাবা কিন্তু রাগ করবেন রিজা।”

“আমি ঘৃণা করি আমার বাবাকে, জাস্ট ঘৃণা করি।”

ভিক্টোরিজার মিশ্র অনুভূতি প্রকাশ করে ড্রেস পরে নিলো। ওকে তৈরি হতে সাহায্য করল ইসাবেলা এবং জুজানি। আয়নায় দাঁড়িয়ে শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

“ওরকম ব্যবহারের জন্য দুঃখিত আমি, ইসাবেল। আমার মনটা আজ ভীষণ খারাপ বুঝলে।”

ইসাবেলা মুচকি হেসে বলল,

“আমি জানি, ইচ্ছে করো ওমনটা করোনি তুমি।”

“তবুও খারাপ লাগছে আমার।”

“ইটস ওকে রিজা। আমি কিছু মনে করিনি।”

“এক শর্তে বিশ্বাস করব যদি আমার সাথে নিচে চলো।”

“না না।”

“প্লিজ, ইসাবেল।”

“রিজা, তোমার বাবা রাগ করবেন।”

“তুমি না গেলে আমিও যাব না।”

ভিক্টোরিজা গোঁ ধরে বসে রইল। অগত্যা রাজি হলো ইসাবেলা। তবে শর্ত দিলো সে একা নয় সাথে জুজানিও যাবে। জুজানি সাথে সাথে না করতে ভিক্টোরিজা ধমক দিলো। ভিক্টোরিজার কথা অমান্য করার সাধ্য জুজানির নেই। ওর চুপসে যাওয়া মুখ দেখে ঠিক একই হাসি হাসল যা খানিক আগে জুজানি হেসেছে।

সন্ধ্যার পরপরই হলঘর লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠল। ভিক্টোরিজা এসব পার্টিতে সব সময় মধ্যমণি হয়। আগত যুবক, বৃদ্ধ সকলের নজর ওর দিকে স্থির থাকে। ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে কত কী করে ওরা! আজ ভিক্টোরিজা এককোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ওয়াইনের গ্লাস। এ নিয়ে চার গ্লাস গলাধঃকরণ করেছে। সামনে সুদর্শন যুবকের ভিড় অথচ, ও এত দূরে! এই ক্ষোভে ড্রিংক যেন একটু বেশিই করছে। ইসাবেলা আর জুজানি নিজেদের যথাসাধ্য আড়াল করে ভিক্টোরিজার পাশে দাঁড়ানো। ইসাবেলার এত লোকের ভিড় ভালো লাগছে না। এরচেয়ে মাতভেইর পাশে বসে কবিতা শুনলেও ভালো হতো। মাতভেইর স্বাস্থ্যের উন্নতি হচ্ছে আস্তে আস্তে। ও পুরোপুরি সুস্থ হলেই তাতিয়ানার কথাটা বলবে ইসাবেলা।

“ইসাবেল?” জুজানি ডাকল।

“কী?”

“খিদে পেয়েছে।”

টেবিলের খাবারের দিকে ইশারা করে বলল জুজানি। আগত অতিথিদের থেকে টেবিলের খাবারের প্রতি আগ্রহ ওর বেশি। ইসাবেলা লক্ষ্য করেছে ওদের রান্না খাবার ছাড়াও আরো কিছু খাবার আনা হয়েছে বাইরে থেকে।

“ও মাই গড।”

ভিক্টোরিজার বিস্মিত গলার স্বরে সামনের দিকে তাকাল ইসাবেলা আর জুজানি। তেমন কিছু চোখে পড়ল না। ভিক্টোরিজা এক ঢোকে পুরোটা গ্লাস খালি করে মাথা ঝাঁকায়। নেশা পুরোপুরি চেপে ধরেছে। গ্লাস ইসাবেলার হাতে ধরিয়ে বলল,

“ফাক মাই পিরিয়ড। আই নিড দ্যাট সেক্স সিম্বল।”

ভিক্টোরিজা টলতে টলতে এগিয়ে গেল সামনে। কালো টাক্সিডো পরিহিত যুবকের কাঁধে হাত রাখতে যুবক ঘুরে দাঁড়ায় ভিক্টোরিজার দিকে। যুবকের চেহারা দেখে ইসাবেলার হৃৎস্পন্দনের গতি তীব্র বেগে বেড়ে যায়, মুখ হয় ফ্যাকাশে। গ্লাসে হাতের চাপ দৃঢ় হলো। অস্ফুটে ওর গলা থেকে বেরিয়ে এলো,

“নিকোলাস!”

যুবক যেন শুনল। তখনই তাকাল ওর দিকে। সমস্ত হলঘর সেই মুহূর্তে থমকে গেল। ওদের অপলক দু’জোড়া চোখ স্থির হয়।

“চোখ বন্ধ কর, চোখ বন্ধ কর।”

বিড়বিড় করে নিজেকেই নিজে বলল ইসাবেলা। বড়ো চেষ্টায় চোখের পাতা বন্ধ করে। শ্বাস পড়তে টের পেল এতক্ষণ নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে ছিল। চোখ খুলবে না, খুলবে না করেও চোখের পাতা উঠল। অদূরে ভিড়ের মাঝে দাঁড়ানো নিকোলাসের ঠোঁটে চমৎকার দীর্ঘ হাসি। এ হাসিতে ক্রূরতা নেই, সম্মোহনীও নয়। এ হাসি সাধারণ তবুও কী অসাধারণ!

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here