#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৪৭
Writer তানিয়া শেখ
ইদানীং বেনাসের বাড়িতে নিয়মিত আসা যাওয়া চলছে নিকোলাসের। বাড়ির সকলের ধারণা ভিক্টোরিজার নতুন প্রেমিক সে। বেনাসের এতে অবশ্য আপত্তি নেই। স্থানীয় জার্মান এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সূত্রে নিকোলাসের সাথে পরিচয়। জার্মানদের মিত্র এবং ধনী বনিক হওয়াতে বেনাসের বাড়িতে নিকোলাসের বেশ খাতির। ভিক্টোরিজার সাথে যদি কোনোভাবে নিকোলাসের সম্পর্কটা বিয়ে পর্যন্ত গড়ায় তাহলে খুশিই হন বেনাস এবং তাঁর স্ত্রী। মেয়েকে তারা উৎসাহ দিয়েছেন নিকোলাসের সাথে সম্পর্ক পাকাপোক্ত করতে। ভিক্টোরিজা অতদূর পর্যন্ত ভাবেনি, আপাতত ভাবতেও চায় না। ওর পছন্দের পুরুষের মতো নয় ঠিক নিকোলাস। একদম জেন্টেলম্যান টাইপ। অন্য পুরুষদের মতো ওর মধ্যে দেহক্ষুধা নেই। প্রেমিক প্রেমিক ভাব আছে। দেহের চেয়ে মনকে গুরুত্ব দেয়। প্রথম রাতে তেমন কিছু হয়নি ওদের মধ্যে। নেশায় বুঁদ হয়ে ছিল। কিছু মনেও করতে পারছে না। নিকোলাসকে দেখে ও আকৃষ্ট হয়েছে। দিনে দিনে বেড়েই যাচ্ছে সে আকর্ষণ। নিকোলাসের হাসি, ওর চাহনি এবং ওর সুঠাম দেহগঠন ভিক্টোরিজাকে লোলুপ করে তুলছে। প্রবল হচ্ছে কাছে পাবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। নিকোলাসকে পাশে পেয়েও আকাঙ্ক্ষা পূরণ হচ্ছে না। দিনগুলো কীভাবে যে কাটছে ওই জানে! অধীর ভাবে অপেক্ষা করতে শারীরিক শুচিতার। ততদিন নিকোলাস যেভাবে চাইছে সেভাবেই চলুক। এসব কারণে ওর ধারণা ও বুঝি কামবাইগ্রস্থ স্ত্রীলোকে পরিণত হচ্ছে। কিংবা এতদিন তাই ছিল, নিকোলাসের কারণে এখন উপলব্ধি করতে পারছে সমস্যাটা।
“মিস, আপনার গলায় এ কীসের ক্ষত?”
জুজানির প্রশ্নে সচকিত হয় ভিক্টোরিজা। আয়নার দিকে ঝুঁকে গলার ক্ষতে হাত বুলিয়ে নিলো। ক্ষতটও তাজা, কিন্তু কীভাবে এর সৃষ্টি ভিক্টোরিজা ভেবে পেল না। আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল। মুখে হাত বুলিয়ে বলল,
“আমার ত্বকটা কেমন সাদাটে হয়ে গেছে, তাই না রে? আমার কি কোনো কঠিন রোগ হলো রে অ্যানি?”
গলার স্বর কেঁপে ওঠে ভিক্টোরিজার। মৃত্যু এখনই চায় না। কত আনন্দ এই সংসারে! এত আনন্দ ফেলে মৃত্যুপুরিতে যেতে রাজি না। অনেকদিন বাঁচার সাধ ওর। মনিব কন্যার চিন্তা দূর করতে জুজানি বলল,
“কী যে বলেন না মিস! রোগ টোগ কিছু না। আজকাল যে ঠাণ্ডা পড়েছে। ঠাণ্ডাতে এমন হয়। এ স্বাভাবিক।”
“আর এই গলার ক্ষত?”
“বোধহয় কোথাও আঘাত টাঘাত পেয়েছিলেন।”
“আমার তো মনে পড়ছে না।”
“আঘাতটা হয়তো বেখেয়ালেই লেগেছে৷ ছাড়ুন তো এসব গম্ভীর কথাবার্তা। ওই যুবকের কথা বলুন। আজও কী আসবেন তিনি?”
“কী জানি। কিছু তো বলেনি।”
নিজের ফ্যাকাশে ত্বক আর ক্ষতের কারণ এখনো অনুসন্ধান করছে মনে মনে। জুজানি মিসের চুল খোঁপা করে সরে দাঁড়ায় এককোণে৷
“আমার মন বলছে তিনি আজও আসবেন। আপনার রূপের আকর্ষণই তাঁকে টেনে নিয়ে আসবে এ বাড়িতে, আপনার রুমে।”
শেষটা রসাত্মক সুরে বলল জুজানি। নিজের রূপ নিয়ে গর্ব করে ভিক্টোরিজা। জুজানির মতোই বিশ্বাস, এই রূপের মোহেই নিকোলাস আসে। কে জানে এই রূপের দাসত্ব করতেও চাইবে একদিন।
বাইরে গাড়ির হর্ণে জুজানি দৌড়ে জানালার কাছে যায়। নিকোলাস গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে। জুজানি উত্তেজিত হয়ে ফিরে তাকাল ভিক্টোরিজার দিকে।
“নাম নিতে না নিতেই আপনার প্রেমিক হাজির মিস।”
ভিক্টোরিজা থুতনি উঁচু করে আয়নায় নিজেকে দেখে মুচকি হাসল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“চল, নিচে যাই।”
নিকোলাস সোজা বাড়ির ভেতর ঢুকল। একজন চাকর অভ্যর্থনার সহিত হলঘরে বসতে দেয়। একটু পরেই সিঁড়িতে হিলের শব্দ শুনে উঠে এগিয়ে গেল নিকোলাস। ভিক্টোরিজা কাছাকাছি আসতে ওর ডান হাতের করপুটে চুম্বন করে বলল,
“তুমি আমাকে অনিয়ন্ত্রিত পুরুষ করে ছেড়েছ রিজা। নিজেকে আজকাল বশে আনতে পারছি না। ঘুরেফিরে তোমার দ্বারগৃহে, তোমার কাছেই ফিরে আসতে হচ্ছে।”
“অনুযোগ করছ?” ভিক্টোরিজা হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে পাশ কেটে হলঘরে গেল। জুজানি নত মাথায় অনুসরণ করে। নিকোলাস ঘুরে বলল,
“মোটেও না। আমার হৃদয়ের অবস্থা ব্যক্ত করছি মাত্র।”
ভিক্টোরিজা সদম্ভে বসল হলঘরের সোফাতে। জুজানি পেছনে দাঁড়িয়ে। ভিক্টোরিজা বলল,
“তোমার ভয় হয় না?”
নিকোলাস মুখোমুখির সোফাটাতে বসে মোহাচ্ছন্ন প্রেমিকের ন্যায় হেসে বলল,
“হৃদয়ের অবস্থা অকপটে ব্যক্ত করতে?”
“হ্যাঁ।”
নিকোলাস উঠে এসে ভিক্টোরিজা কাছে বসল।
“ভীষণ ভয় হয়, পাছে তুমি আমাকে প্রত্যাখ্যান করো, আমার হৃদয় ভেঙে দাও।”
ভিক্টোরিজা সম্মোহিত হয়ে যায়। নিকোলাস ঝুঁকে আসতে চোখ বন্ধ করে ঠোঁট আলগা করে। কিন্তু উঞ্চতা পায় না। কানে আসে কর্কশ কাশির শব্দ। চোখ খুলে দেখল নিকোলাস কাশছে।
“কী হলো?”
“পানি, পানি।”
কোনোমতে বলল নিকোলাস। হলঘরের ডাইনিংএ পানি ছিল। জুজানি এনে দিতে বলল,
“ঠাণ্ডা পানিতে আমার অ্যালার্জি। একটু গরম পানির সাথে মধু মিশিয়ে আনলে গলাটা আরাম পেত।”
ভিক্টোরিজা জুজানিকে বলল,
“যা ইসাবেলকে গিয়ে বল।”
জুজানি গরম পানি নিয়ে ফিরে এসে বলল,
“রান্নাঘরের মধু শেষ। ইসাবেল ভাঁড়ার ঘরে মধু আনতে গেছে।”
ভিক্টোরিজা রেগে কিছু বলতে যাচ্ছিল নিকোলাস থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আপাতত তাহলে পানিটুকুই দাও।”
সামান্য একটু পানি মুখে দিতেই কাশি কমে গেল। গ্লাসটা জুজানির হাতে দিয়ে হঠাৎ কপাল কুঁচকে বলল,
“শিট!”
ভিক্টোরিজা ভুরু কুঁচকাতে নিকোলাস বলল,
“মাফ করো রিজা, আমাকে এক্ষুণি যেতে হবে। জরুরি একটা কাজ ভুলে ফেলে এসেছি।”
“এই তো এলে!”
“আমি কথা দিচ্ছি আবার আসব, আসতে যে হবেই। তোমাকে না দেখে যে থাকতে পারি না।”
ভিক্টোরিজার চুল কানের পাশে গুঁজে গালে আলতো চুমু দিয়ে বলল নিকোলাস। লাজে লাল হয়ে ওঠে ভিক্টোরিজা। যে মেয়ে বিছানার চাদর পরিবর্তনের মতো পুরুষ পরিবর্তন করে তার কাছে এই লজ্জা বেজায় বেমানান। জুজানি অবাক হয়ে দেখল। নিকোলাসের ঠোঁটে তখন কপট হাসি। এই মেয়েকে না মারার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভুল করেনি ও। তাছাড়া না মেরে যদি প্রয়োজন মেটে তবে মারাটা অনর্থক। অনর্থক কাজ পছন্দ নয় নিকোলাসের।
ভাঁড়ার ঘরের ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। রেড়ির তেলের টিমটিমে আলোতে সামনেটা দেখল। স্তুপের পর স্তুপ বস্তা, পলিথিনে মোড়া তৈজসপত্র, শস্য ভর্তি কাঠের বড়ো বাক্সে ভরা ভাঁড়ার ঘর। এত জিনিসের মধ্যে মধুর পাত্র খুঁজে বের করা ঘাসের মধ্যে সুই খোঁজার মতো ব্যাপার। জুজানিকে এত করে বলল ওর জানা নেই মধু কোথায়। মেয়েটা একটাই জবাব দিলো বার বার,
“গেলেই পাবে, গেলেই পাবে।”
পায়ের কাছ দিয়ে কতগুলো ইদুর দৌড়ে যেতে লাফিয়ে উঠল ইসাবেলা। বাতিটা নিভু নিভু করেও জ্বলে রইল। রাগ হচ্ছে খুব। দাঁতে দাঁত চেপে বিদ্রুপের সুরে বিড়বিড় করে বলল,
“এত কষ্ট কেন করছি? দ্য গ্রেট পিশাচ নিকোলাসের কাশি হচ্ছে। মিস. ভিক্টোরিজা প্রিয়তমের কষ্ট দেখতে পারছেন না। তার প্রিয়তমের জন্য মধু দরকার। মধু না বিষ দেবো৷”
“নিষ্ঠুর, পাষাণ।”
নিস্তব্ধ বদ্ধ ঘরে দ্বিতীয় গলার স্বর শোনামাত্র চমকে ওঠে ইসাবেলা। তারপর যখন বুঝতে পারে গলাটা নিকোলাসের রাগে মুখ শক্ত করে ঘুরে দাঁড়ায়।
“শব্দ দুটো আপনার মুখে মানালো না।”
“আমি পিশাচ বলে?” নিকোলাস বিদ্রুপ করল যেন।
ইসাবেলা সে কথার জবাব না দিয়ে চলে যাচ্ছিল। নিকোলাস পিছু নিলো, কিন্তু নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে। এই মেয়েকে এতবার অনুরোধ করা স্বত্বেও গলার রোজারি খোলেনি। ইসাবেলার বিশ্বাস অর্জনের জন্য ভিক্টোরিজার বাড়িতে অসময়েও আসছে। ভিক্টোরিজাকে না মারার এটাও একটা কারণ।
“বেলা?”
ইসাবেলা নিরুত্তর।
“বেলা?”
“কী?” ঘুরল ইসাবেলা। সামান্য গলা চড়ে গেল এবার। নিকোলাস শান্ত গলায় বলল,
“কতবার অনুরোধ করছি, ওটা খুলে ফেলো প্লিজ।”
“আমিও কতবার একই জবাব দিচ্ছি এবং দেবোও, না, না।”
“এত জেদি কেন তুমি?”
“আপনি এত বেহায়া কেন?”
“বেহায়া?”
“হ্যাঁ, বেহায়া। একটু আগে ভিক্টোরিজার সাথে মাখামাখি করে এসে এখন আবার আমাকে পটানোর চেষ্টা করছেন। কতবড়ো নীচ আপনি জানেন? মন তো চাচ্ছে ক্রুশটা আপনার হৃদয় বরাবর বিদ্ধ করি। আচ্ছা, হৃদয় আছে তো আপনার? ওহ! আমি তো ভুলেই গিয়েছি, হৃদয় আছে আপনার, কিন্তু মিথ্যার আবরণে আবৃত। একটু আগে হৃদয়ের মিথ্যা আবেগ অনুভূতি ব্যক্ত করে এসেছেন মেয়েটাকে। প্রতারক কোথাকার!”
নিকোলাস ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। তারপর ক্রমেই ঠোঁট প্রসস্থ হলো দু’পাশে।
“জেলাস, হুম?”
“এটাকে জেলাসি বলে না, তিরস্কার বলে।” ইসাবেলা প্রতিবাদ করে। নিকোলাস হাসি চাপার চেষ্টা করে করে মাথা নাড়িয়ে বলে,
“তুমি যদি দিনকে রাত বলো এখন আমি সেটাও মেনে নেবো, বেলা।”
ইসাবেলার এখন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। নিকোলাস কেন উঠে পড়ে লেগেছে ওর পিছনে? কী এমন কথা যা দূর থেকে বলতে পারছে না? ইসাবেলা যে ওর কাছে যেতে ভয় পায়। না, মৃত্যুর ভয় নেই। নিকোলাসকে ভালোবেসে ফেলার ভয়ে ভীত ও। এমনিতেই মন বড্ড দুর্বল হয়ে আছে। জীবনটা ইতোমধ্যে কমপ্লিকেশনে ভরপুর। আর কমপ্লিকেশন চাচ্ছে না। নিকোলাসকে ভালোবাসতে চাচ্ছে না ও। এ যে পাপ, অবৈধ।একজন মানুষ পিশাচকে ভালোবাসতে পারে না।
বিরক্ত প্রকাশ করে নাক মুখ কুঁচকে ফেলল। তারপর রাগত গলায় বলে,
“আই হেইট ইউ।”
“আমি জানি।”
ইসাবেলার মুখ বদলে যায়। দরজার দিকে ঘুরে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে আসে। নিকোলাসের ধৈর্যের বাধ ভাঙল। অনেক হয়েছে অনুরোধ। ইসাবেলাকে কাছে চায়। সে ভাবেই হোক। অন্য মেয়েদের যেভাবে চেয়েছে সেভাবে চায় না ইসাবেলাকে। অঞ্জলিপুটে ওর মুখশ্রী তুলে চোখে চোখ রেখে ওকে পড়তে চায়, দুবাহুতে জড়িয়ে ধরে সময় ভুলতে চায়, হাতে হাত রেখে হাঁটতে চায় বহুপথ, ওর কাঁধে মুখ লুকিয়ে, চুলের ঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে ওর ভেতর নিজেকে হারাতে চায়।
“বেলা?”
ভাঁড়ার ঘরের সামনের অন্ধকার দাঁড়িয়ে দুজন। ইসাবেলা না ঘুরেই বলল,
“আমার জবাব কোনোদিন বদলাবে না নিকোলাস।”
“এখনই বদলাবে।”
ইসাবেলার পা আবার থামল। নিকোলাস বলল,
“যখন মাতভেই এবং ওর মায়ের জীবনে বিপদ ঘনিয়ে আসবে। বিপদ? উহু, ঠিক বিপদ নয়। মৃত্যুর যে ছায়া থেকে ওদের বাঁচিয়েছ তাই যখন ফিরে আসবে তখন__”
নিকোলাসের কথা শেষ হওয়ার আগেই ইসাবেলা ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলে ওঠে,
“খবরদার নিকোলাস, ওদের ক্ষতির চিন্তা করলে আমি আপনাকে শেষ করে ফেলব।”
নিকোলাসের কপালের রগ দপদপ করে। মনে মনে ভাবে, এত আপন ওই মাতভেই তোমার? ওর জন্য আমাকে মারতে চাও? কিন্তু গলার স্বর শান্ত রেখে বলে,
“সে তোমার সাধ্যের বাইরে। আজ রাতটা সময় দিলাম। আগামীকাল যখন আসব তোমার গলায় ওই জিনিস থাকবে না। আর যদি এই কথা অমান্য করেছ বেলা, আমাকে তুমি ভালো করেই চেনো।”
কথাগুলো বলে এক মুহূর্ত দাঁড়াল না নিকোলাস। পরাজিত মুখে সামনের আবছায়াতে চেয়ে রইল ইসাবেলা। ঠোঁট ঈষৎ কেঁপে উঠল। অস্ফুটে ভর্ৎসনার সুরে বলল,
“পিশাচ, পিশাচ।”
চলবে,,,