#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৫৩
Writer তানিয়া শেখ
ড্যামিয়ানই প্রথমে শত্রুতার সূচনা করেছিল। ফাদার জালোনভকে ও পরোক্ষভাবে সাহায্য করত। পিশাচ কমিউনিটির অনেক পিশাচকে কৌশলে শেষ করেছে৷ নোভাকে একবার বন্দি করে নিয়ে গিয়েছিল রাশিয়া। ওকে খুব নির্যাতন করেছিল ড্যামিয়ান। নিজেকে মুক্ত করতে খুব লড়েছিল নোভা। নিকোলাসের সঙ্গী মার্গারেটাকে বধেও পরোক্ষভাবে ড্যামিয়ানের হাত ছিল। এই সত্যটা মাত্র কয়েক মাস আগে জেনেছে নিকোলাস। ইসাবেলা সেদিন ড্যামিয়ানের আসল পরিচয় প্রকাশ না করলে এই শত্রুতার মূল কারণ খুঁজে পেত না ও। বুঝত না ড্যামিয়ানের অভিসন্ধি। কমিউনিটির সকলের ধারণা নিকোলাস প্রেমে মজে সব ভুলে আছে। আগে পিছে ভাবছে না। ওকে মারা শত্রু পক্ষের জন্য তুড়ি বাজানোর মতো সহজ। ওদের ধারণা নিকোলাসকে হাসায়। প্রেমে ও ঠিকই মজেছে কিন্তু প্রেমে বোকা হয়নি, অন্ধও না। বরং প্রেম ওর অন্ধকারে আলোর স্ফূরণ।
ম্যাক্সওয়েলের বংশধরদের সাথে বহু বছরের শত্রুতা নিকোলাসের। এরা একে অপরের প্রাণ নিতে দু’বার ভাবে না। ম্যাক্সের বড়ো ছেলে ইগো নিকোলাসকে মারার পণ করেছিল। ইগোর মতে নিকোলাস ওর পিতৃহন্তারক। বেশ অবাক হয়েছিল ওর অভিযোগ শুনে নিকোলাস। ম্যাক্স মরেছে তা ও জানত না। ম্যাক্সের সাথে শেষ দেখা হয়েছিল ওই গুহার মধ্যে। যেদিন ম্যাক্স স্ত্রী হত্যার প্রতিশোধ নিতে ওর বুকে তলোয়ার বসিয়েছিল। এরপর তো নিকোলাসের জীবন আর জীবন থাকেনি। নরককুণ্ডে পরিণত হয়েছিল। একজন নির্দোষী নারী এবং তার অনাগত সন্তানকে হত্যা করে পাপের আগুনে জ্বলেপুড়ে খাক হয়। এক পাপ ভুলতে আরো পাপ করে। শান্ত মন অশান্ত হয়। কিছুতেই আর শান্তি পায় না। মনের অশান্তিতে উন্মাদের মতো মাটিতে গড়াগড়ি করে। চোখের সামনে আলো দেখতে পায় না৷ পাপ আলো দেখায় না। রাতের ঘুম হারাম হয়, মুখে খাবার যায় না। ভদ্র ছেলেটি দুধের গ্লাস ছেড়ে মদের বোতল ধরে। কলম ছেড়ে তলোয়ার হাতে নেয়। যে হাতে কোনোদিন বাইবেল ধরেছিল, সেই হাত শত শত নিষ্পাপ প্রাণ কেড়ে নেয়৷ নিষ্পাপ, সরল হৃদয় পাপের ভারে ক্রমে ক্রমে পাথরে রূপ নিলো। সেই পাথর গলে দুচোখ ফেটে জল পড়েছিল ম্যাক্স আর নেই জেনে। কিন্তু ইগোর চোখ ওই অশ্রু দেখেনি৷ নিকোলাসকে মেরেই সে দম নেবে। আত্মরক্ষার্থে নিকোলাস ইগোকে হত্যা করে। যুদ্ধের ময়দানে আপন পর থাকে না। হয় মরো নয় মারো। সেই থেকে নিকোলাস ম্যাক্সওয়েলদের দুশমন। বংশপরম্পরায় এই শত্রুতা এখনো চলে আসছে। নিকোলাস ভেবেছিল সিস্টার ভ্যালেরিয়া হয়তো বর্তমানে সেই পরম্পরা রক্ষা করছে। ভুল ছিল ও। সিস্টার ভ্যালেরিয়া তো সামান্য একজন পেয়াদা। আসল শত্রু হলো ড্যামিয়ান। যে বড়ো কৌশলে নিকোলাসকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কী ভেবেছে ও? নিকোলাস চিনতে পারবে না ওকে? এত সহজ নিকোলাসকে হারানো? কাষ্ঠ হাসি দেখা দিলো ওর ঠোঁটে।
“ড্যামিয়ান, ড্যামিয়ান, তোর সাথে বহু হিসেব বাকি আমার। অনেক লুকাচুরি হয়েছে। এবার মুখোমুখি হওয়ার পালা। শীঘ্রই দেখা হবে আমাদের।”
মাতভেই সাদা খাতা আর পেন্সিলে আঁকিবুঁকি করছিল। আজ বাইরেটা রৌদ্রস্নাত। বরফের ওপরে মিহি মিহি রোদ চিকমিক করছে। মাতভেই তাই আঁকছিল খাতার ওপরে। এর আগে কয়েক পাতা সাদা পৃষ্ঠা ভরে তাতিয়ানার পোট্রের্ট এঁকেছে। কত ভাবে যে প্রিয়াকে ও কল্পনা করে!
“মাতভেই জানো কী হয়েছে?” ইসাবেলা দরজা খুলে খিলখিল করে হেসে ওর সামনে বসলো। হাতের সিরামিকের প্লেটে দুটো আপেল আর ছুরি।
“না বললে জানব কী করে?”
“সেটাও কথা। আচ্ছা শোনো, গতকাল ভিক্টোরিজাকে তার কোনো এক প্রাক্তন একটা বিড়াল আর কিছু লাল গোলাপ পাঠিয়েছিল। বিড়ালটা ভীষণ কিউট বুঝলে? ভিক্টোরিজার বেজায় পছন্দ হয়ে গেল। জুজানির ওপর ভার পড়ল সারাদিন বিড়ালটাকে কোলে করে রাখার। খুব সমাদর চললো বিড়ালের। রাতে ভিক্টোরিজার ঘরের এককোনে তার ঘুমানোর ব্যবস্থা করা হলো। তুমি তো জানোই জুজানি ভিক্টোরিজার ঘরের মেঝেতে বিছানা করে শোয়। ভোরের দিকে হঠাৎ চোখে মুখে পানির ছিটা টের পেতে ঘুম ভেঙে গেল জুজানির। চোখ মেলতেই দেখল পানির ছিটা না বিড়ালটা ওর মুখে হিসু করে দিয়েছে।”
ইসাবেলা হাসতে হাসতে পেট চেপে ধরে। গল্প শুনে নয় ওর হাসি দেখে মাতভেই মুচকি হাসল। ওকে দেখতে দেখতে কী ভেবে পেন্সিলটা হাতে তুলে নেয়। এই প্রাণ খুলে হাসি মুখটা ও ধরে রাখতে চায়। হাসি সামলাতে বেগ পেতে হয় ইসাবেলাকে। তবুও নিজেকে কিছুটা সামলে নিলো। হাসি কিন্তু তখনও ঠোঁটে লেগে আছে। জুজানির চুমসে যাওয়া মুখটা যতবার ভাবছে না হেসে পারছেই না। ভিক্টোরিজার আদেশে এখনো গাল ফুলিয়ে বিড়ালটা কোলে করে ঘুরছে ও। ইসাবেলা নিশ্চিত জানে, বিড়ালটাকে ও পৃথিবীর বিশ্রী, উদ্ভট সব শব্দে বকছে। আর ম্যাঁও ম্যাঁও করে প্রতিবাদ করছে বিড়ালটা। প্রাণীরা মানুষের মুখ দেখলে অনেক কিছু বুঝতে পারে।
মাতভেই দিকে তাকাতেই ভুরু কুঁচকে গেল। হাসতে হাসতে ওর পেট ব্যথা হওয়ার উপক্রম আর মাতভেই হাসলোই না। গল্পটা কি হাসির ছিল না? তাহলে ওর এত হাসি পেল কেন?
“তুই বেকুব বলে।” ভেতরের জন বলে উঠতে ইসাবেলা ধমক দিলো,
“হুশ! মোটেও না। হয়তো আমার বলাটা হাস্যকর ছিল না।”
আপেল কেটে দু টুকরো মুখে পুড়ে মাতভেইকে বলল,
“কী আঁকছ?” মুখ এগিয়ে নিতে খাতাটা সরিয়ে নিলো মাতভেই। বলল,
“এখন না। চুপ করে বসো তো।”
“এ মা! তুমি আমার আপেল খাওয়ার ছবি আঁকছ?” নাক কুঁচকে বলল ইসাবেলা। মাতভেই বলল,
“না।”
“তবে দেখাও।”
“বলেছি তো এখন না।”
“কখন?”
“শেষ হোক তারপরে।”
“কিন্তু আমার এখনই যে দেখা লাগবে।”
“উফ! ইসাবেল, তুমি এমন কেন?”
“কেমন?”
“জেদি, অবাধ্য।”
“নিকোলাসও তাই বলে।”
ইসাবেলা লাজুক মুখে হাসল আনত মুখে। ওর ফর্সা গাল দুটো ক্রমশ লাল হয়ে ওঠে। মাতভেই মুচকি হেসে বলে,
“আহ! নিকোলাস। এই এক নাম বেলকে লজ্জায় লাল করে দিলো দেখছি। মানুষটাকে দেখার খুব ইচ্ছে আমার। কবে দেখাবে বলো তো।”
ইসাবেলা দুদিকে মাথা নাড়ায়। মাতভেই বলল,
“দেখাবে না? কেন?”
“এমনি।”
“বেল?”
“না, না।”
মাতভেই নাখোশ হতে ইসাবেলা উঠে দাঁড়ায়। লজ্জা লজ্জা মুখে বলে,
“শীঘ্রই দেখা করাবো। এবার খুশি তো?”
মাতভেই মৃদু হাসল। তারপর স্কেচ তুলে দেয় ইসাবেলার হাতে।
“ওয়াও! হাসলে আমায় এত সুন্দর লাগে মাতভেই?”
“তুমি সবসময়ই সুন্দর, আমার খরগোশ।” ইসাবেলার এক গাল টেনে হেসে বলল মাতভেই। গাল টানলে ভীষণ রাগ হয় ইসাবেলার। খরগোশ বলাতে আরো ক্ষেপে গেল।
“মাতভেই!”
প্রতিদিনের মতো আজ রাতেও সবাই ঘুমিয়ে পড়তে ইসাবেলা বেরিয়ে এলো। মাতভেই আজ ঘুমায়নি। চোখ বন্ধ করে ছিল। ইসাবেলা বেরোতেই চোখ খুললো ও। একটু পরে জানালার বাইরে পায়ের শব্দ শুনতে পায়। ক্রাচটা পাশেই ছিল। ওটাতে ভর করে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। জানালার বাইরের কাঁচে বরফ জমে আছে। বাইরেটা দেখা যাচ্ছে না। কৌতূহল দমাতে জানালাটা সামান্য খুললো। এদিক ওদিক দেখার চেষ্টা করে। ক্ষীণ চাঁদের আলোতে অদূরে ইসাবেলার ছায়া দেখতে পায়। এই ঠাণ্ডার মাঝে এত রাতে মেয়েটা বাইরে কী করছে? তখনই ইসাবেলার গলা শুনতে পেল।
“নিকোলাস!”
“বেলা, আমার বেলা।”
ভরাট পুরুষালি গলার স্বর শুনে কিছুটা বিস্মিত হলো মাতভেই। সরে এলো জানালা থেকে। ইসাবেলা এত রাতে নিকোলাসের সাথে দেখা করতে গিয়েছে? কে এই নিকোলাস? কীভাবে পরিচয় ওর সাথে ইসাবেলার? ছেলেটা কী ভালো? ক্ষতি করবে না তো ইসাবেলার সরলতার সুযোগ নিয়ে! ইসাবেলার মুখ থেকে নিকোলাস সম্পর্কে ওই কথাগুলো শোনার পর থেকে নেগেটিভ চিন্তা ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সামনা-সামনি একবার ছেলেটাকে না দেখে মনে শান্তি পাচ্ছে না মাতভেই। আগের মতো বিছানায় শুয়ে পড়ল। এক মাথা চিন্তা নিয়ে ইসাবেলার ফেরার অপেক্ষা করে।
পাহাড়ি সেই বাড়ির ভেতরে একই কম্বল গায়ে জড়িয়ে নিকোলাসের কোলে ওপর বসে আছে ইসাবেলা। মাথাটা নিকোলাসের কাঁধে। এক হাত নিকোলাসের বুক ছেড়ে বিরতি নিয়ে ওঠা নামা করা গলার অ্যাডাম’স আপেলটা স্পর্শ করে। আঙুল দিয়ে ওটার চারপাশে ঘুরাতে লাগল৷ নিকোলাস খপ হাতটা ধরে বলে,
“কী করছ?”
“আদর করছি।”
“হঠাৎ এটার ওপর আদর করতে ইচ্ছে হলো যে?”
“আমার ভালো লাগল তাই।”
মুখ তুলে নিকোলাসের গলা জড়িয়ে রইল। ইসাবেলার কপালে উড়ে আসা চুলটাকে কানে গুঁজে দিলো। ওর চোখে চেয়ে নিকোলাস বলল,
“আমার আর কিছু ভালো লাগে না?”
“লাগে।” চোখ নামি নিলো ইসাবেলা। নিকোলাস মুচকি হাসল। বলল,
“চলো আজ একটা খেলা খেলি। তুমি বলবে আমার কী কী ভালো লাগে তোমার, আর আমি বলব তোমার কী কী ভালো লাগে আমার। দেখব কার ভালোলাগা বেশি।”
“আমি জিতব।” বিড়বিড় করে বললেও নিকোলাস শুনতে পেল। ভুরু তুলে বলল,
“এত কনফিডেন্স?”
“হুঁ।”
“দেখা যাবে। ওহ! গেমের মূল নিয়মই তো বলতে ভুলে গেছি।”
ইসাবেলার প্রশ্নাতুর দৃষ্টি চেয়ে মুখটা কানের কাছে এনে বলল,
“যার যেটা ভালো লাগবে সেটাকে আদর করে চুমো খেতে হবে।”
“জি, না।” কোল থেকে লাফ দিয়ে নেমে বসে ইসাবেলা। নিকোলাস জোর করে পুনরায় কোলে বসিয়ে বলে,
“জি, হ্যাঁ।”
“এই পঁচা গেম আমি খেলব না। একদম না।”
“তুমি না খেললে নাই। আমি খেলব। অবশ্যই খেলব। ওকে রেডি, ওয়ান, টু__”
ইসাবেলা নিকোলাসের ঠোঁটে হাত চেপে ধরে রুষ্ট মুখে বলে,
“নিকোলাস ভালো হবে না কিন্তু।”
নিকোলাসের দৃষ্টির মাদকতায় ফের চোখ নামিয়ে নেয় ইসাবেলা। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে বসে রইল। নিকোলাস ঠোঁটের ওপর থেকে হাতটা সরিয়ে ওর থুতনি তুলে বলল,
“তোমার ঠোঁট আমার ভীষণ পছন্দ, বেলা। উঁহু শুধু পছন্দ নয়, আই লাভ দেম। তোমার দু’জোড়া ঠোঁট যেন শরতের আকাশে গোধূলির লালিমা, তুষারে জড়ানো রক্তিমা বেরি। আমি আপন ঠোঁটে সেই রঙ ধারণ করতে চাই, আস্বাদন করতে চাই অমৃতের মতো।”
ইসাবেলার বিমোহিত স্থির চোখে চেয়ে দুগালে হাত রেখে ঠোঁটে গভীর চুম্বন দিলো নিকোলাস।
চলবে,,,