#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৫৭
Writer তানিয়া শেখ
পরদিন ধোপানি এসে জানাল কবিরাজ মশাই মাদাম আদলৌনাকে সন্ধ্যার পর সেই বাড়িটার সামনে থাকতে বলেছেন। আজ আর ধোপানি মাদামের সাথে যেতে পারবে না। তার কী এক বিশেষ কাজ রয়েছে। কাজ শেষ করে বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরে গেল সে। একা যেতে একটু ভয় ভয়ই করছিল মাদামের। একবার ভাবলো ইসাবেলাকে সাথে করে নেবেন। শেষমেশ ভাবনাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললেন। বেনাস পত্নীর মেজাজ চড়ে আছে। ইসাবেলা এবং মাদাম দুজন একসাথে বাইরে গেছে শুনলে রক্ষে থাকবে না। মাতভেইও রুমে একা। কখন কী প্রয়োজন পড়ে যায় ওর। সুতরাং মাদাম আদলৌনা একাই যাবেন বলে মনস্থির করলেন। কবিরাজের বলা ফুলটার কথা এখনো তিনি ইসাবেলা কিংবা মাতভেইকে বলেননি। মাতভেই এসব মোটেও বিশ্বাস করবে না। উলটো তাঁকে বাধা দেবে। তবে ইসাবেলাকে জানাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শেষ মুহূর্তে কী ভেবে বললেন না আর।
কবিরাজ মশাইকে বাড়ির সামনে পেয়ে গেলেন মাদাম আদলৌনা। কাঁধে মোটা চামড়ার থলে নিয়ে প্রস্তুত হয়েই দাঁড়িয়ে ছিলেন দুয়ারে। গায়ে গতকালের পোশাক। মাদামকে দেখতে তাঁর মুখে দীর্ঘ হাসি ফুটে ওঠে। এগিয়ে এসে অধৈর্য গলায় বললেন,
“চলুন যাওয়া যাক।”
এই লোকটার সান্নিধ্যে এলে মাদামের অস্বাভাবিক কিছু অনুভব হয়। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের সতর্ক বার্তা বুঝেও গ্রাহ্য করেন না তিনি। সন্তানের সুস্থতা ওপরে সব যেন উপেক্ষিত তাঁর কাছে। কিছুদূর পরেই কালো রঙের একটা ফিটন চোখে পড়ে। কোচওয়ান আপাদমস্তক কালো হুডে আবৃত। মাদাম ওর মুখটা দেখতে পেল না। কবিরাজ তাঁকে জানালেন এতে করেই গন্তব্যস্থলে পৌঁছাবেন। কবিরাজ ফিটনে উঠে বসলেন। মাদামের মাথায় আকাশ পাতাল ভাবনা। তাঁর পা যেন বারংবার থেমে যায় অজানা শঙ্কায়। ফিটনের মুখে এসে থেমে রইলেন। কবিরাজ মশাই তাঁর মুখের ভাব বুঝে কিঞ্চিৎ ভুরু কুঁচকে তাকালেন। এদিক ওদিক সতর্কে চেয়ে কোচওয়ানকে ফিসফিসিয়ে বললেন,
“পথ পরিষ্কার তো?”
কোচওয়ান মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। কবিরাজ পুনরায় মাদামের দ্বিধান্বিত মুখে চেয়ে মুচকি হাসলেন। খুব সহজে এই মহিলাকে ফাঁদে ফেলেছেন তিনি। এখন লক্ষ্য পর্যন্ত ভালোই ভালোই যেতে পারলে হাঁপ ছাড়েন। তিনি গলা ঝাড়তে মাদাম আদলৌনা সচকিত হলেন। বিব্রতবোধ করলেন নিজের অন্যমনস্কতার কারণে। কবিরাজ মশাই বললেন,
“আর বিলম্ব করলে পরে বিপদ হবে। তাড়াতাড়ি আসুন।”
মাদাম আদলৌনা উঠে বসলেন কবিরাজের সামনের সিটে। পুরো রাস্তা মাদামকে কবিরাজ স্থানটার বর্ণনা দিলেন। এখান থেকে মাইল খানেক দূরে এক পাহাড়ি জঙ্গল। জঙ্গলের একেবারে গহীনে বৃহৎ এক বটবৃক্ষ। তারই কোটরে দ্বিবীজপত্রী লতানো একটি গাছ জন্মায়। প্রতি বিজোড় পূর্ণিমার আলোতে সেই গাছের কুড়ি থেকে লাল রঙের একটি তীব্র সুগন্ধি ফুল ফোটে। ফুলটা দেখতে কতকটা ডেইজি ফুলের আকৃতির মতো। এর তীব্র সুগন্ধের কারণে আশেপাশের বিষাক্ত অনেক প্রাণী আকৃষ্ট হয়। বট তলার সর্বত্র তখন এদের বিচরণ। কবিরাজ কিছু রাসায়নিক দ্রব্য নিয়ে এসেছেন প্রাণীগুলোকে তাড়াতে। মাদামকে তিনি অভয় দিলেন। বললেন, তিনি থাকতে মাদামের চিন্তা নেই। মাদাম আড়চোখে তাঁকে দেখলেন। পৃথিবীতে এমনও নিঃস্বার্থ মানুষ হয়? নিশ্চয়ই হয়। এই তো তাঁর সামনে জলজ্যান্ত প্রমাণ। তবু কোথাও যেন খটকা থেকেই যায়।
ফিটন এসে থামল জঙ্গলের মুখে। জানুয়ারি মাসের তীব্র তুষার পাতে রাস্তার ওপর বরফের পুরু আস্তরণ পড়েছে। এইটুকু আসতে মূল সময়ের অধিক লেগে গেল। রাত বেশ গভীর হয়েছে৷ নেমে দাঁড়ালেন মাদাম। পূর্ণিমার আলোয় বিধৌত সামনের ঘন জঙ্গল। কবিরাজ কোচওয়ানকে অপেক্ষা করতে বলে সামনে এগোলেন। মাদাম একপলক কোচওয়ানের দিকে চেয়ে কবিরাজকে অনুসরণ করেন। এক হাঁটু বরফ মাড়িয়ে সামনে চলাটা বেজায় কষ্টসাধ্য হচ্ছে। তার ওপর হাড় কাঁপানো শীত। শরীর শক্ত হতে লাগল। লম্বা লম্বা পত্র ঝরা সরু গাছের ভিড় ছাড়িয়ে বনের গহীনে প্রবেশ করলেন তাঁরা। সামনের পথটাতে সামান্য বরফের আস্তরণ। নানান আকৃতির বৃক্ষ গুল্ম শ্বেত শুভ্র তুষারে জড়ানো। সাবধানে এগোতে লাগলেন। অনেকদূর হেঁটে হাঁপিয়ে উঠেছেন দুজন। সামনে একটা বৃহৎ বৃক্ষের শেকরের ওপর তুষার ঝেড়ে বসলেন মাদাম। কবিরাজ পাশের একটি গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর দৃষ্টি স্থির নেই। সাবধানি চোখে আশপাশ দেখছেন। একটুখানি জিরিয়ে উঠতে তাড়া দিলেন মাদামকে। আবার চলতে শুরু করেন দুজন। বেশ কিছুদূর চলতে কবিরাজ উচ্ছ্বাস করে উঠলেন।
“ওই তো ফুল গাছ।”
দৌড়ে গেলেন সামনে। সেখানে গিয়ে অসাধারণ এক দৃশ্য অবলোকন করলেন মাদাম আদলৌনা। রক্ত বেগুনি রঙের রশ্মির ছটা সামনের ঢালু স্থানটিতে। উড়ে বেড়াচ্ছে অসংখ্য রঙ বেরঙের প্রজাপতি৷ জোনাকির টিমটিমে হলদে আলো তাতে যেন সৌন্দর্যবর্ধক। কবিরাজ মশাই ইশারা করলেন আস্তে আস্তে নিচে এগোনোর। মাদাম আদলৌনার চোখে তখনো এই প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের মোহ পুরোপুরি কাটেনি। বিমুগ্ধতার আবেশে জড়িয়ে আছেন। তাঁর এই বিমুগ্ধতা ভীতিতে পরিবর্তন হলো সেই আলোর উৎসের কাছাকাছি গিয়ে। কবিরাজের বলা বটবৃক্ষ মোটেও সাধারণ বটবৃক্ষ নয়। দানব ভেবে প্রথমে আঁতকে উঠেছিলেন মাদাম৷ দূর থেকে হঠাৎ দেখলে পত্রঝরা বটবৃক্ষটাকে তাই মনে হয়। কবিরাজ আঙুল তুলে বললেন,
“ওই যে গাছটা।”
দানবাকৃতির গাছটার কোটরের ফাঁকে অনিন্দ্য সুন্দর সেই ফুলটা দেখতে পেলেন মাদাম। ফুল মাত্রই সুন্দর, কিন্তু এই ফুলটিকে সুন্দর বললেও তা কম বলা হবে৷ চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য ফুলটির। একে ঘিরেই সৃষ্টি হয়েছে এই অসাধারণ আলোক দ্যুতি। মাদাম সম্মোহিত হয়ে গেলেন। পা বাড়ালেন সামনে।
“মাদাম, থামুন।”
চাপা একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো মাদামের গলা দিয়ে। ফুলটির সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে মাদাম সামনের বিপদ খেয়াল করেননি। বটবৃক্ষের দু গজ দুরত্ব পর্যন্ত বৃত্তাকারে বিচরণ করছে বিষধর সাপ, পোকামাকড়। এত সাপ একসাথে কখনও দেখেননি মাদাম। সামনে যেন সর্পসাগর। কবিরাজ মাদামকে নিয়ে গেলেন গাছটার ডান পাশে। এদিকে ছোট্ট নীল জলের ঝিরি। থলি থেকে রাসায়নিক দ্রব্য বের করে ওই জলের পানিতে মিশিয়ে কিছু একটা তৈরি করলেন কবিরাজ। মাদামের দিকে বোতলটা এগিয়ে বললেন,
“এটা ধরুন।” মাদাম কাঁপা হাতে বোতলটা নিলো। তাঁকে আর প্রশ্ন করতে হলো না। কবিরাজ নিজে থেকে বললেন,
“এই ঝিরি নিরাপদ। এটা পার হলে অল্প কিছু পথ থাকে ফুল পর্যন্ত পৌঁছাতে৷ এই দ্রব্যের মিশ্রণ যেখানে ফেলবেন সেখানে আপনাতেই পথ তৈরি হবে আপনার জন্য।” কবিরাজ ঝিরির ওপারের সাপের বিচরণের স্থানটার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলে,
“ওদের ওপর এই দ্রব্য ফেলতে ওরা পথ ছেড়ে দেবে। সহজে ফুল পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবেন। কিন্তু সাবধান। ওরা খুবই শক্তিধর। পাঁচ মিনিটের বেশি ওদের দুর্বল করে রাখতে পারবে না এই দ্রব্য। এই সময়ের মধ্যে ফুলটা তুলে ফিরে আসতে হবে। মনে রাখবেন। ওই ফুলের নিরাপত্তা কেবল সাপগুলো করছে না। ফুলে হাত দিতে দৃশ্য, অদৃশ্য নানান শক্তি আপনাকে বাধা দিতে আসবে। ফুলটা যতক্ষণ আপনার হাতে আছে কোনো শক্তি আপনার ক্ষতি করতে পারবে না। তাই যতদ্রুত পারবেন ফিরে আসবেন ফুলটা নিয়ে।”
ভয়ে মাদামের হাত পা অসাড় হয়ে এলো। কবিরাজ তাঁকে অভয় দিলেন। সন্তানের কথা স্মরণ করিয়ে তাঁর ভয়টা দূর করার চেষ্টা করলেন। সফল হলেন কিছুটা। মাদাম একবুক ভয় নিয়ে ঝিরির দিকে পা বাড়ায়। এই ঠাণ্ডাতেও ঝিরির জল কবোষ্ণ। চাঁদের পূর্ণ আলো পড়েছে ঝিরির জলে। মাদামের সাথে সাথেই চলল চাঁদটা। ঝিরির পাড়ে এসে মাদামের গলা শুকিয়ে এলো। সাপের বিষাক্ত নিঃশ্বাসে মাদামের কর্ণকুহর ঝা ঝা করে ওঠে। কাঁপা হাতে বোতলের ছিপি খুলে রাসায়নিক দ্রব্যটি সামনের সাপের ঢেউয়ে ফেললেন৷ আশ্চর্য! মুহূর্তে সেগুলো গড়াগড়ি করতে করতে সরে গেল। রাসায়নিক দ্রব্যের কারণে সাপের চামড়া পুড়ে ধোঁয়া সৃষ্টি হয়। ওদের যন্ত্রণাকাতর ছটফটনি দেখে অপরাধবোধ জন্মালো মাদামের। তিনি থেমে আছেন বলে পেছন থেকে কবিরাজ চিৎকার করে এগিয়ে যাওয়ার হুকুম করেন। মাদাম আদলৌনা এগিয়ে যান। সত্যি এই রাসায়নিক দ্রব্যের কারণে সাপগুলো তাঁর পথ ছেড়ে দিয়েছে। ফুলটার একদম কাছে চলে এলেন। সবুজ পাতার মাঝ থেকে ছিঁড়ে নিলেন হাত বাড়িয়ে। সাথে সাথে ভূতুড়ে সব কাণ্ডকারখানা শুরু হলো। প্রচণ্ড জোরে বাতাস বইতে শুরু করে। আচমকা গায়েবি গলায় মেয়েলি সুরে কেউ আহাজারি করে ওঠে, বটবৃক্ষ সত্যি সত্যি দানবে পরিণত হয়। ঝুঁকে এলো আক্রমণ করতে। বনের হিংস্র সব প্রাণীর গর্জনে আকাশ ভারি হয়ে ওঠে। কবিরাজ মাদামকে ফিরে আসতে বলেন। মাদাম নিজেকে সামলে নিয়ে ছুটে চলে এলো ঝিরির এপারে। কাছে আসতে কবিরাজ ফুলটা ছোঁ মেরে নিতে চায়। মাদাম আদলৌনা ফুলটা লুকিয়ে ফেললেন পেছনে। কবিরাজ রুষ্ট মুখে তাকায়। তখনই গায়েবি গলাটি কর্কশ কণ্ঠে বলে ওঠে,
“আজ তুমি যে পাপ করলে তার শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে। মরবে তুমি। অভিশপ্ত হবে তোমার বংশের কন্যারা। যে ব্যথা আমায় দিলে তার হাজারগুন পাবে তোমার বংশের কন্যারা। ধ্বংস হও তুমি, ধ্বংস হও।”
এই অভিশাপে মাদাম ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন। তিনি ক্ষমা চাইতে যাবেন কিন্তু তার পূর্বে কবিরাজ তাঁর হাত ধরে সেখান থেকে পালাতে শুরু করে। পেছনে সেই বিষাক্ত সাপ, আর পোকামাকড় তেড়ে আসছে। গায়েবি কণ্ঠে এবার রাগত পৈশাচিক অট্টহাসি। মাদাম কাঁদতে লাগলেন। তাঁর মন বলছে ওই অভিশাপ ফলে যাবে। তাঁর বংশে কোনো কন্যাসন্তান নেই। এদিক থেকে তিনি স্বস্তি পেলেও নিজের মৃত্যুর কথা ভেবে ভেঙে পড়েন। ফিটনের কাছাকাছি আসতে দম নেন কবিরাজ। পেছনে এখনো বিপদ তাড়া করে আসছে। চট করে ফিটনে উঠে পড়লেন দুজন। পথে নানা ভাবে ফুলটা নেওয়ার চেষ্টা করে কবিরাজ। মাদাম কিছুতেই ফুলটা হাতছাড়া করলেন না। কবিরাজের বাড়ির সামনে এসে ফিটন থামল। দু’জনই নেমে দাঁড়ালেন। কবিরাজ বললেন,
“এবার ফুলটা আমায় দেন। এ থেকে তৈরি ঔষধই আপনার ছেলের পা ঠিক করবে।”
মাদাম ভয় পাচ্ছে ফুলটা হাতছাড়া করতে। ফুলটার দিকে চেয়ে কবিরাজের চোখ দুটো লোভে চকচক করছে। হাত বাড়িয়ে বললেন,
“দেন।”
মাদাম ফুলটা দিতে কবিরাজ আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলেন। যেন ফুল নয় সাত রাজার ধন পেয়েছেন। এই মাত্রাধিক খুশির কারণ মাদাম বুঝে ওঠেন না। মাদামের ভুরু কুঞ্চিত মুখ দেখে কবিরাজের মুখ বদলে গেল। ফুলটা থেকে বিচ্ছুরিত রশ্মিতে স্পষ্ট দেখতে পেলেন সেই অস্বাভাবিকতা মাদাম। ফুলটাকে সাবধানে বুক পকেটে রাখলেন কবিরাজ। ক্রূর হাসি তাঁর ঠোঁটের কোণে। মাদাম কিছু বুঝে ওঠার আগেই পেছন থেকে কেউ ছুরিকাঘাত করল তাঁকে। ব্যথায় আর্তচিৎকার করে উঠলেন। হতবিহ্বলতা কাটিয়ে পেছন ফিরতে কোচওয়ানের পোশাক পরিহিত মানুষটাকে দেখতে পেলেন। মানুষটা আর কেউ নয় ধোপানি। এগিয়ে এসে এবার ও মাদামের বুকে ছুরি বসিয়ে দিলো। তারপর ঠেলে ফেলে দেয় নিচে। মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলেন মাদাম। এতবড়ো ধোঁকা কল্পনাও করেননি। এরা তাঁকে ফুলটা পেতে ব্যবহার করেছে। তাঁর বিশ্বাসের, অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়েছে। মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে মাদাম ছেলের মুখ মনে করে অঝোরে কাঁদছেন। তাঁর বুক আর পিঠের ক্ষত থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে। শ্বাস ভারি হয়। সে শুনতে পাচ্ছে ধোপানি কবিরাজকে বলছে,
“অবশেষে সফল হলাম আমরা। কিন্তু এখনও আমি বুঝতে পারছি না, এই সামান্য একটা ফুল তোমাকে ধনী আর ক্ষমতাধর কী করে করবে?”
“মূর্খ নারী, এ কোনো সামান্য ফুল না। আসলে এ কোনো ফুলই নয়।”
ধোপানি হতবুদ্ধি হয়ে বলল,
“কী যে বলছ! আমি পরিষ্কার চোখে দেখছি ওটা কেবলমাত্র একটা ফুল।”
কবিরাজ স্মিত হাসেন। বলেন,
“সাধারণ চোখে তাই মনে হবে। এই পৃথিবীতে এমন কিছু আছে যা মানুষের দৃষ্টিতে স্বরূপে ধরা পড়ে না। অনেকসময় সাধারণ দৃষ্টিতে তাদের দেখাও যায় না। এই ফুলটা হচ্ছে আমাদের চোখের ধোঁকা। রাত পোহালেই এই ধোকা কেটে যেত৷ ও ফিরে যেত আপন মুল্লুকে।”
“ও?”
“পরীর দেশের রাজকুমারী ও।”
“কী বলছ!” ধোপানি বিস্ফোরিত চোখে ফুলটার দিকে তাকায়। কবিরাজ আলতো করে ফুলটা ছুঁয়ে মাথা নাড়ালো। বহু বছরের সাধনা সফল হয়েছে তাঁর। আগামীকাল সূর্য উঠতেই রাজকুমারী স্বরুপে ফিরবে৷ কবিরাজ তখন পরী রাজকুমারীকে বন্দি করবেন। ওর ডানাজোড়া কেটে ফেলে জোরপূর্বক বিয়ে করবেন৷ পরীর শক্তি কাজে লাগিয়ে তিনি হয়ে উঠবেন পৃথিবীর ক্ষমতাধর ব্যক্তি এবং ধনীলোক। ধোপানিকে এখন আর তাঁর প্রয়োজন নেই। মূর্খ রমনী ভেবেছে কবিরাজ ওকে বিয়ে করবে? ধোপানির বিস্ময়তা কাটে কবিরাজের হাতে পিস্তল দেখে। গলা শুকিয়ে যায়।
“কী করছ তুমি?”
“তোমাকে এখন আর আমার প্রয়োজন নেই। আলবিদা।”
হাসতে হাসতে ধোপানির বুকে গুলি চালিয়ে দেয় কবিরাজ।
“আমায় তুমি ধোঁকা দিলে? ছাড়ব না তোমাকে আমি।” গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ঝাপিয়ে পড়ে কবিরাজের ওপর। হাতের ছুরি দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে লাগল। কবিরাজ ওর হাতের ছুরি কেড়ে ফেলে দেয়৷ কিন্তু ততক্ষণে শরীরের কয়েক স্থানে আঘাত পেয়েছেন। ধোপানির আহত শরীর নিচে ফেলে ওর ওপর উঠে বসেন। শ্বাসরোধ করতে লাগলেন গলা টিপে। মাদাম আদলৌনা বহুকষ্টে উঠে দাঁড়ায়। ধোপানির ছুরি পড়ে আছে সামনে। হাতে তুলে নিলেন সেটা। কবিরাজ তাঁকে দেখেনি। তিনি যখন ধোপানিকে মারতে ব্যস্ত সেই সুযোগে মাদাম পেছন থেকে তাঁর ঘাড়ের রগবরাবর ছুরি চালিয়ে দেন। ধোপানির নিস্তব্ধ দেহের পাশে লুটিয়ে পড়েন কবিরাজ। ব্যথায় আর্তনাদ করে ওঠেন। অবাক হলেন মাদামকে জীবিত দেখে৷ পরক্ষণেই রেগে আক্রমণ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু এবার তাঁকে সফল হতে দেয় না মাদাম। পড়ে থাকা পিস্তল তুলে তাঁর কপালে শ্যুট করে দিলেন। সাথে সাথে মরে যায় কবিরাজ। কিন্তু ওর বিস্ফোরিত খোলা চোখে তখনো পৈশাচিকতা চকচক করছে। মৃত্যুর যন্ত্রণা নেই ওতে।
মাদাম পিস্তল ফেলে কবিরাজের পকেট থেকে ফুলটা তুলে নিলেন। ঝাপসা চোখে ফুলটার দিকে তাকালেন। কবিরাজের কথা স্মরণ হলো। এ কী সত্যি পরী রাজকুমারী? পরী রাজকুমারী ফুল হলো কী করে? কী করবেন ভেবে পেলেন না মাদাম। তাঁর ভীষণ অনুতাপ হচ্ছে ফুলটা ছিঁড়ে। ফুলটা হাতে নিয়ে অনেক কষ্টে উঠে বসেন ফিটনের কোচওয়ানের আসনে। এখান থেকে বেনাসের বাড়ি বেশি দূরে নয়। ফিটন চালিয়ে দ্রুতই পৌঁছে গেলেন। কিন্তু তার শরীরে শক্তি ফুরিয়ে আসছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে দেহ দুর্বল হতে লাগল। বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে তিনি কোনোরকমে ভেতরে ঢুকলেন। হল ঘরের ঘড়ির পেন্ডুলাম বেজে ওঠে। জানান দেয় মধ্যরাত হয়েছে। থমকে দাঁড়ালেন বাড়ির ভেতরের বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে। হলঘরে আসবাবপত্র ভাঙাচোরা। মাদাম আদলৌনা দেওয়াল ধরে ধীর পদে নিজের কক্ষের দিকে এগোলেন। সামনে যেতে যেতে হলঘরের মাঝে বেনাসপত্নী ও কয়েকজন ভৃত্যের মৃতদেহ নজরে পড়ল। মাতভেই আর ইসাবেলার চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠলেন তিনি। অবশিষ্ট শক্তি ব্যয়ে নিজ কক্ষের দরজার সামনে হাজির হলেন। আর পারছেন না তিনি। নেতিয়ে পড়লেন দরজার সামনে। দুর্বল গলায় ডাকলেন,
“ইসাবেল, ইসাবেল।”
খুট করে দরজা খুলে গেল। ইসাবেলা মাদামের রক্তাক্ত অবস্থা দেখে কেঁদে ওঠে,
“মাদাম, এই অবস্থা কী করে হলো আপনার?”
মাদামকে দ্রুত ভেতরে নিয়ে এলো। মাতভেই মায়ের মুমূর্ষু দশা দেখে হুমড়ি খেয়ে নিচে পড়ে।
“মা!”
হামাগুড়ি দিয়ে মায়ের কাছে এলো ও। মাদামের মাথাটা ইসাবেলার কোলে। মাতভেইর গলার রোজারির দিকে চেয়ে রইলেন মাদাম। অশ্রুসজল কণ্ঠে বললেন,
“মাতভেই, মা তোমাকে বুঝি আর রক্ষা করতে পারল না বাবা।”
“এমন কথা বোলো না, মা। আমাকে ছেড়ে যাবে না তুমি। তোমাকে বাঁচতে হবে। বেল, আমার মা’কে হাসপাতালে নেও।”
মাদাম ছেলের মুখে হাত রেখে কাঁদতে লাগলেন। হাতের ফুলটা বের করতে মাতভেই ইসাবেলা বিস্মিত হয়। এই ফুলের সৌন্দর্যে চমকিত, মুগ্ধ হয় ওরা। মাদামের কেন যেন মনে হয়েছে এই ফুলে মাতভেইর পা ঠিক হবে। সেই বিশ্বাসে ফুলটাকে মাতভেইর হাড়জিরজিরে পা’টাতে ছুঁয়ে দিলেন। ফুলটার রশ্মি পায়ের ত্বক ভেদ করে প্রবেশ করল ভেতরে। ধীরে ধীরে পা’টা সুস্থ, স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। মাদামের চোখে আনন্দ অশ্রু ঝরল। তাঁর সন্তান অবশেষে দু’পায়ের ওপর দাঁড়াবে। ইসাবেলা ও মাতভেই তখনও অবাক চোখে চেয়ে আছে সুস্থ পা’টার দিকে। মাদামের গোঙানিতে চেতনা ফিরল ওদের। মাতভেই সব বুঝতে পেরেছে। ওর মা ওকে সুস্থ করার জন্য নিজের জীবনটা বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠা করেনি। মাদাম শেষ সময়ে ইসাবেলাকে বলেন,
“ইসাবেল, আমার ছেলেকে তুমি দেখো।”
“মাদাম প্লিজ, আমাদের ছেড়ে যাবেন না।”
“আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে ইসাবেল। এবার যে আমাকে যেতেই হবে।”
মাদাম মাতভেইর কপালে চুমো দিয়ে ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে। মায়ের প্রাণহীন দেহ জড়িয়ে ধরে মাতভেই চিৎকার করে কাঁদে। ইসাবেলার কান্না গলায় আঁটকে যায় মাদামের হাতের নির্জীব ফুলটাকে ক্রমশ শূন্যে উঠতে দেখে৷ ধীরে ধীরে ওটার পাপড়ি ভাঙছে। ছড়িয়ে যাচ্ছে শূন্যে। ম্লান রশ্মির বিচ্ছুরণ হচ্ছে পাপড়িগুলো থেকে। ঠিক মাতভেইর মাথার ওপর ঘুরপাক খাচ্ছে ওগুলো।
চলবে,,,
আগামী পর্ব শুরু হবে বেনাসের বাড়িতে মাদামের ঢোকার পূর্বে কী ঘটেছে সেখান থেকে। আজকের পর্বটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কেন? ভবিষ্যতে জানতে পারবেন।