#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৯৮
Writer তানিয়া শেখ
দিনদিন অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়েছ ইসাবেলা। চারিদিকে কেবল শূন্যতা আর শূন্যতা। অথর্বের মতো নিজ কক্ষের চার দেওয়ালে দিনরাত কেটে যায়। যতক্ষণ চোখ মেলে থাকে একদৃষ্টে জানালার বাইরে তাকিয়ে রয়। কী জন্য কে জানে! অপেক্ষা! আর কীসের? সব তো শেষ ওর। কেউ আসবে না, কেউ না। কেউ বলল কিন্তু নামটা আর নিলো না। নাম নিলেই বুকের ভেতর ঝড় ওঠে। কত কী ভাঙে। চামড়ার আস্তরণের কারণে দেখা যায় না। এতেই ভালো হয়েছে। লোকে দেখলে অস্বস্তি।
অদূর বনে কুয়াশা জড়িয়ে আসে। সন্ধ্যা উতরে রাত নামল। অন্ধকারে আজকাল গা ছমছম করে ইসাবেলার। মৃত্যু ভয় জাগে। আগে কি ভয় পেত? এত নয়। পিটারের দেওয়া আঘাতের পর তো স্বেচ্ছায় মরতে পর্যন্ত রাজি ছিল। সময় পরিবর্তন হয়। ইসাবেলা এখন আর সেই ইসাবেলা নেই। কত বদলে গেছে। কুমারী থেকে স্ত্রী হয়েছে, নারী হয়েছে। আর মাস কয়েক পর মা হবে। আনমনেই ডান হাত বাড়ন্ত পেটের ওপর রাখল। ডাক্তার বলেছেন পাঁচমাস চলছে। কিন্তু পেটের ফুলে ওঠাটা কিছু অস্বাভাবিক। যেন আটমাসের গর্ভবতী। পাঁচমাসে পেট এতটা দেখার কথা নয়। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আশ্বস্ত করেছেন বাচ্চা ঠিক আছে। তবে ডাক্তার কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে আশ্বস্ত ছিলেন না। হয়তো পেটের শিশুটির অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে। কিন্তু সেটা মুখে বলেননি। ইসাবেলা সব বোঝে। সাথে ওর অনাগত সন্তানটিও। ডাক্তার দেখতে এলে একেবারে শান্ত হয়ে যায়। বিপদ টের পায় যেন। মা ছাড়া আর কারো সান্নিধ্যে ভরসা পায় না। মা’কে বুঝিয়ে দেয় ওর নীরবতা দিয়ে। মায়ের ধারে-কাছে কোনো পরপুরুষ বা অসৎ লোক এলে গম্ভীর হয়। একেবারে বাপের মতো! থমকায় ইসাবেলা। মলিন হাসিটুকু উবে যায়। গলাটা কেমন শুকিয়ে আসে। চোখ দুটো উদাস, নির্জীব। সেই ঝড় আবার ওঠে। বড্ড দুর্বল লাগে তখন ওর। চোখ বুঁজে খাটে শোয়। ঘুম খুব কম হয়। তবুও জোর করে চোখ বুঁজে ঘুমানোর চেষ্টা করে। একমাত্র ঘুমই বাস্তব নির্মম স্মৃতিগুলো ভুলিয়ে দেয়। কিন্তু এর সাইড ইফেক্টও আছে। এভাবে শুয়ে থাকলে হাত পায়ে পানি জমে যায়। সুতরাং ফের ওকে উঠতে হয়। পায়ে জোর নেই। ধীরে ধীরে হাঁটে। এই কক্ষে পায়চারি করে, জানালায় বসে দূর আকাশে সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত দেখে। আর সন্তানের সাথে ফিসফিস করে কথা বলে। কত যে কথা! শেষই হতে চায় না। দুজনের মাঝে অদ্ভুত এক মায়ার সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। ইসাবেলার এখন আর একা লাগে না। কিন্তু রাত হলে কেন যেন ভয় ভয় করে। অন্ধকার পেলেই কেউ যেন সেখানে ওঁৎ পাতে। মৃত্যু! কিন্তু ইসাবেলা এখন মরতে চায় না। ইচ্ছে করলেও সে উপায় নেই। এই সন্তানটির জন্য যে বেঁচে থাকতে হবে। মায়েরা বড়ো সেনসিটিভ হয়। ইসাবেলাও হয়েছে। আগের চেয়ে বেশি। অনাগত সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে খুব সতর্ক। ড্যামিয়ানের সেই আক্রমণ স্মরণ করলে গায়ে কাঁটা দেয়। কেন যে বার বার বলছিল,”ও আবার ফিরিয়ে আনতে চাইছে ওই পিশাচকে।” যে ছাই হয়ে বাতাসে মিশে গেছে তাঁকে কী ফিরিয়ে আনা যায়? এ বাড়ির কেউ ওর কথা বিশ্বাস করেনি। আন্না মেরিও দারোয়ান ডেকে জোরপূর্বক বের করে দিতে চেয়েছিলেন। মার্কোভিক বাধা দিলেন। এতেই রেগে যান আন্না মেরিও। তিন-চারদিন বাদে সপরিবারে ফিরে আসেন স্বামীর ভিটাতে। যুদ্ধ পুরোদমে চলছে। রাস্তায় বেশ ভুগান্তি পোহাতে হয়েছিল এজন্য। তবে স্বস্তির কথা ওদের বাড়িটি এখনও বিপদমুক্ত।
ইসাবেলার শরীরে আগের মতো বল নেই। শীর্ণকায় হয়ে গেছে। এইটুকু পায়চারি করে হাঁপিয়ে উঠল। বসল বিছানায় হেলান দিয়ে। কক্ষ অন্ধকারে নিমজ্জিত। আলো নিয়ে এখনও কেউ এলো না! অন্ধকার ভালো লাগছে না। ওর সকল প্রার্থনা কবুল না হলেও এটা হলো। তাতিয়ানা নিঃশব্দে কক্ষে ঢুকলো। হাতে জ্বলন্ত বাতিদান। অন্য হাতে খাবারের ট্রে। অন্ধকার ঘরে আলো খেলে গেল পলকে।
“আজ কেমন বোধ করছ?” বাতিদান টেবিলের ওপর রেখে জিজ্ঞেস করল তাতিয়ানা। তারপর ট্রেটা নামালো।
“ভালো।” দুর্বল গলায় বলল ইসাবেলা। মৃদু আলোতে বোনের পাণ্ডুর, শীর্ণ মুখ দেখে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তাতিয়ানার ভেতর থেকে। এগিয়ে ওর কাছে বসতে ইচ্ছে করে কিন্তু সাহস পায় না। এই বোন আজ সেই বোন নেই যাকে মন চাইলে জড়িয়ে ধরা যেত, মজা করে রাগানো যেত। এই বোন কেমন যেন হয়ে গেছে। কিছুটা ভয়ের কারণ, কিছুটা ভয় পাইয়ে দেওয়ার কারণ।
“তোমার খাবার রেখে গেলাম। খেয়ে নিয়ো।”
ইসাবেলা জবাবে মাথা নাড়ল। তাতিয়ানার চলে যাওয়া উচিত। তবুও দাঁড়িয়ে রইল। একদৃষ্টে দেখছে বোনকে।
“তোমাকে আগের চাইতে বেশি রোগা ও দুর্বল দেখাচ্ছে।”
“ওহ!”
“ইসাবেল, জেনেশুনে কেন নিজেকে শেষ করছো বলোতো? আমার ভীষণ কষ্ট হয় তোমাকে এভাবে দেখলে। শুধু আমার নয় আমাদের সকলের। মাতভেই, ভ্লাদিমি, বাবা, মা..”
“তুমি এখন এসো, অ্যানা।”
এমনই হয়। বাবা-মায়ের কথা ইসাবেলা এখন আর শুনতে চায় না। এরা যেন কেউ না ওর। তাতিয়ানা মলিন মুখে দরজার দিকে অগ্রসর হয়। কাঁধের ওপর দিয়ে তাকালো। এখনও পাথরের মতো ঠাঁই আধশোয়া হয়ে আছে ইসাবেলা। বন্ধ চোখের পাতা একটুও নড়েনি।
“তোমাকে আমরা ভালোবাসি ইসাবেল। সারাজীবন বাসব। তুমি মুখ ঘুরিয়ে নিলেও।”
ইসাবেলা নিরুত্তর। হাঁপ ছাড়ে তাতিয়ানা। তারপর নিঃশব্দে দরজা বাইরে দিয়ে বন্ধ করে। একটু পর কড়িডোরে ওর পায়ের শব্দ মিলিয়ে যায়। ইসাবেলা চোখ খুললো। খিদে পেয়েছে বেজায়। পেটেরজন ছটফট করছে খাবে বলে। ধীরে ধীরে উঠে এলো টেবিলের কাছে। ট্রে-তে প্রতিদিনের মতো সব খাবার রাখা। কিন্তু চোখ দুটো চকচক করে ওঠে পাশের বড়ো গ্লাসের দিকে তাকাতে। টকটকে তাজা রক্ত। তাতিয়ানা “আমরা তোমাকে ভালোবাসি” কথাটা মিথ্যা বলেনি। ভালোবাসে বলেই ঘেন্নাপিত্তি সত্ত্বেও রোজ গ্লাসে গ্লাসে রক্ত দিয়ে যায়। আগলে রাখে সমাজ ও ধর্মের নিয়ম উপেক্ষা করে। ইসাবেলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। কিন্তু ও অকৃতজ্ঞের মতো কেবল গ্রহণ করে চলেছে। বিবেক টিবেক ঠিক কাজ করে না আগের মতো। হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা তুলে নেয়। প্রথমে নাকের সামনে আনে। মুহূর্তে তৃষ্ণা প্রবল হয়, নেশা ধরে। পেটের সেই জন হুল্লোড় লাগিয়ে দেয়। নাকের সামনে থেকে ঠোঁটের ফাঁকে গ্লাসের মুখ ঢুকিয়ে গটগট করে গিলে ফেললো। অদ্ভুত এক পৈশাচিক শান্তি পায় পান করার সময়। কিন্তু পুরোটা পেটে চলে যেতে সেই গা ঘিনঘিন করে, বমি পায়। বাকি খাবার আর খেতে ইচ্ছে করে না। শুয়ে পড়ে জানালা মুখো হয়ে। বাইরে ঘন অমাবস্যার রাত। বিয়ে বাড়ির ব্যান্ড পার্টির ন্যায় ঝিঁঝি ডাকছে সুর তুলে। সেই সুর শান্তি নয়, আনন্দ নয় যেন বিষণ্ণতা ছড়ায়। দূরে কালো আকাশ। ইসাবেলার কেন যেন মনে হলো আজ বৃষ্টি হবে, তুমুল বেগে।
মার্কোভিকের ওপর খুব চটলো ড্যামিয়ান। ওর এতকালের সুপরিকল্পিত প্লানে পানি ঢালতে চাইছে বুড়োটা। আজ নয় কাল করে করে অযথা সময় নষ্ট করছে। বুঝতে চাইছে না গত হওয়া এক একটা দিন ওদের জন্য বিপদ ঘনিয়ে আনছে। ওই শিশুর জন্ম বিপদ বৈ আর কী। কিন্তু বুড়োটা বুঝলে তো! আন্না মেরিওর ওপরও কম ক্ষোভ না। মাথামোটা মহিলা একটা কথা শুনলো না। সকল কিছু উপেক্ষা করে মেয়েকে নিয়ে ফিরে গেল রিগাতে। এখান থেকে চলে গেলে ড্যামিয়ান হার মানবে ভেবেছে? রাতে ঘুম হয় না। নিকোলাস বেঁচে ছিল সে একরকম অশান্তি ছিল। প্রতিশোধের আগুনে রোজ পুড়ত ড্যামিয়ান। মরেছে এখন দুঃস্বপ্ন হয়ে ঘুমের মধ্যে হানা দেয়।
জ্যোতিষী মহাশয় বলেছেন, ওই শিশুই ইসাবেলা নামক নক্ষত্রের পাশে দেখা দ্বিতীয় নক্ষত্র। ওই শিশুই হবে ড্যামিয়ানের প্রতিদ্বন্দ্বী ও সর্বনাশের কারণ। এতকিছু জানার পর চুপ থাকা মহা বোকামি যা ড্যামিয়ান করবে না। মার্কোভিকের বাধা উপেক্ষা করে রওয়ানা হলো ইসাবেলার গর্ভের শিশুটিকে হত্যার উদ্দেশ্যে।
রিগা পৌঁছাতে খুব বেশি ঝামেলা হলো না ওর মতো ধূর্ত, হিংস্র অর্ধ নেকড়ের। বিশেষ ক্ষমতাবলে দুই রাত পর হাজির হলো রিগাতে। আলেক্সিভ মহলের পেছনে যখন পৌঁছালো তখন মধ্য রাত। একটু আগে ঝুমবৃষ্টি হয়েছে। এখন ঝিরিঝিরি পড়ছ। ভেজা আলখেল্লার হুড কাঁধে নামিয়ে লন থেকে সদর দরজার সামনে এলো। হাতের কসরতে সহজে সদর দরজা খুলে ফেললো। বহুবার এসেছে এখানে। অন্ধকার হলঘর পেরিয়ে দ্রুত পায়ে ওপরে উঠে এলো৷ তারপর সোজা ইসাবেলার কক্ষের সামনে৷ শব্দ না করে ইসাবেলার কক্ষের দরজা খোলে। পা টিপে এগিয়ে দাঁড়াল ওর শিওরে। বাইরে মেঘ গুড় গুড় করছে। বিদ্যুৎস্ফুরণের এক ঝলক আলো এসে পড়ল এ কক্ষে। সেই আলোতে ইসাবেলাকে দেখে চমকে যায় ড্যামিয়ান। এ কী দেখছে! এ তো ইসাবেলা নয়৷ হতেই পারে না। সেই সতেজ, সুশ্রী সুদর্শনা কই? সামনে শুয়ে থাকা শীর্ণকায়, কুৎসিত নারীটি কিছুতেই ইসাবেলা হতে পারে না। বুকের বা’পাশ কেউ যেন খামচে ধরলো ওর। যে রাগ নিয়ে এসেছিল তা ভেঙেচুরে ক্ষোভ আর অভিমান পর্যবসিত হয়। ঝুঁকে গেল ইসাবেলার মুখের দিকে। ক্রমে ক্রমে চোয়াল কঠিন হয়। বিড়বিড় করে বলল,
“তোমাকে তো এমন করে নিজের ওপর অবিচার করতে দিতে পারি না আমি, বেবিগার্ল। তোমার ওপর যে অধিকার আমারও কিছুটা রয়েছে। তা তোমাকে দিতেই হবে।”
ইসাবেলা যেন শুনতে পেল। ঘুমের মধ্যে নড়ে ওঠে। চোখ খুলবে অমনি ড্যামিয়ান একটা কাপড় ওর নাকে চেপে ধরতে একটু ছটফট করে নিস্তেজ হয়ে যায়। তারপর কাঁধে তুলে নেয় ইসাবেলার দেহখানি। পা বাড়ায় দরজার বাইরে।
পরদিন দ্বিপ্রহরে চেতনা ফিরতে নিজেকে কুটিরে আবিষ্কার করে। নড়াচড়া করতে গিয়ে টের পায় হাত পা বাঁধা। একটু ধাতস্থ হতে আশপাশের পাখির কূজন, গাছের পাতায় পাতায় ঘর্ষণে আন্দাজ করে নেয় কুটিরটি বনমধ্যে। নিজের জন্য ওর ভয় করে না। বাঁচা- মরা আজ ওর কাছে সমান। যত ভয় পেটের সন্তানটিকে নিয়ে। ওর এই অবস্থা কে করেছে তা বুঝতে সময় লাগল না। একজনই আছে যে ওর শত্রু, ওর অনাগত সন্তানের মৃত্যুকাঙ্খী।
“সারপ্রাইজ! ঘুম ভাঙল তবে, বেবিগার্ল?” ড্যামিয়ান দুহাত মেলে মুচকি হেসে কুটিরে প্রবেশ করে। মনে মনে কাষ্ঠ হাসল ইসাবেলা। একচুল ভুল হয়নি। ড্যামিয়ান ওর সামনে এসে এক হাঁটু ভেঙে বসল।
“কতদিন বাদে তোমায় আবার দেখলাম। খুশি হওনি? যাঃ একটু খুশি হও। আমি কিন্তু বেজার হয়েছি তোমাকে দেখে। নিজের কি হাল করেছ দেখেছ! তুমি তো আমার। তোমার রূপ, যৌবন এমনকি তোমার আত্মা পর্যন্ত আমার। তাহলে আমার অনুমতি ছাড়া এসব নষ্ট করার সাহস তুমি কী করে পেলে, হুঁ? কঠিন শাস্তি হবে তোমার, কঠিন শাস্তি।”
ইসাবেলা শুকনো ঠোঁট দুটো চেপে ধরে আছে। তাকায় না ড্যামিয়ানের মুখে। কিন্তু ড্যামিয়ান এত সহজে নিস্তার দেবে? চেপে ধরে ওর হাড় বেরোনো চোয়াল। অন্যসময় হলে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠত ইসাবেলা। এখন শক্ত হয়ে যায়।
“কথা বলবি না? সেদিন তো খুব মুখ চলছিল। আজ চুপ কেন? না কি কিছু না করলে মুখ খুলবি না।”
ড্যামিয়ান ওর বাড়ন্ত পেটের দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকাতে ইসাবেলা শঙ্কিত হয়। কোনোমতে বলে,
“ও তোমার পথে কোনোদিন বাধা হবে না। ওয়াদা করছি ওর পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবে না। জানতে দেবো না ওকে কিছু। যেতে দাও আমাকে। বাঁচতে দাও আমার সন্তানকে।”
ড্যামিয়ান কী যেন ভাবল। তারপর বলল,
“বাঁচাতে চাস তোর সন্তানকে?”
“অবশ্যই।”
“এক শর্তে। তুই আমার সহধর্মিণী হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে তোর সন্তানকে আমি ছেড়ে দেবো। রাজি?”
ইসাবেলার নির্জীব চোখে আগুন ঝরে।
“মাথাখারাপ হয়ে গেছে তোর? তোর সহধর্মিণী হওয়ার চাইতে মৃত্যু পছন্দ করব।”
“কার মৃত্যু? তোর সন্তানের? আচ্ছা তাহলে তাই হবে।”
ড্যামিয়ান উঠে দাঁড়ায়। কুটিরের এককোণে ছুরি আর কিছু ভেষজ পাতা নিয়ে ওর সামনে এসে থামে আবার। বসল ঠিক ওর বাড়ন্ত পেট মুখোমুখি। ইসাবেলা কিছু বলার আগে একটানে ওর পরনের ঢিলে জামাটা ছিঁড়ে ফেলে। ভেতরে কেবল সাদা অন্তর্বাস। এই দেহের প্রতি ড্যামিয়ানের লোভ আছে কিন্তু এখন তত প্রবল নয়। বাড়ন্ত পেটটাই ওর চোখের কাঁটা। তীক্ষ্ণ চোখে বাড়ন্ত পেটের দিকে তাকিয়ে আছে। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করতে গেলে কুঁকড়ে গেল ইসাবেলা। আর্ত গলায় বলল,
“আমি রাজি।”
এত সহজে! ড্যামিয়ান অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো। মনে মনে খানিক হতাশ হলো কি! আরেকটু ভয়, আরেকটু ব্যথা না দেখতে পারার আফসোস রয়ে গেল। কিন্তু বিয়েতে রাজি হলো এই আনন্দও কম নয়। রাজি না হয়েও উপায় নেই ইসাবেলার। জ্যোতিষী খামোখা ওকে ভয় দেখিয়েছে। এই তো কত সহজে ইসাবেলা ওর হবে। আজই অর্ধেক। কাল পুরোপুরি। ড্যামিয়ান হাসিমুখে নিজের পরনের আলখেল্লা খুলে ওকে ঢেকে দিলো। তারপর কপালে চুমু দেয়। ঘা ঘিনঘিন করে ওঠে ইসাবেলার। দাঁতে দাঁত কামড়ে ঘৃণাবোধ গিলে ফেললো। গতবারের মতো বোকামি আজ ও করবে না। দুর্বলকে গায়ের জোরে নয় বুদ্ধিতে এগোতে হয়।
“এখন আমার হাত-পায়ের বাধন খুলে দাও।” বলল ইসাবেলা। যতটা সম্ভব মনভোলানো হাসি হাসল। কিন্তু শুকনো সাদাটে ঠোঁটের সেই হাসি ড্যামিয়ানের ভালো লাগল না। আলখেল্লার পকেট হাতড়াতে হাতড়াতে বলল,
“এত তাড়া কীসের? এই অবস্থায় দেখতে কিন্তু বেশ লাগছে আমার।”
ইসাবেলা চুপ রইল। ড্যামিয়ান একটা ছোট্ট কৌটা বের করল পকেট থেকে। কৌটার মুখ খুলতে জ্বলজ্বলে হিরের আংটি দেখা যায়। ইসাবেলা বা’হাতের দুর্বল মুষ্টি প্রাণপণে শক্ত করে ধরে। ড্যামিয়ান যেন বুঝল। বক্রিম হাসি দেখা গেল ওর ঠোঁটের কোণে। তারপর ইসাবেলার হাতের বাঁধন খুলে দেয়। টেনে সোজা বসালো। দুর্বল ইসাবেলা সোজা হয়ে বসতে পারল না। মেরুদণ্ডে জোর নেই। ড্যামিয়ান বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। সরে যেতে চায় ইসাবেলা। কিন্তু সেই জোর কই! বা’হাতের মুষ্টি আলগা করতে একটু কষ্ট হলো না ড্যামিয়ান। হঠাৎ রাগে ওর মুখ কঠিন। অনামিকায় এখনও নিকোলাসের নামের আংটি সগৌরবে আছে। রূঢ়তার সাথে টেনে খুলতে গেলে ইসাবেলা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে।
“যার চিহ্ন আর নেই তার স্মৃতি রাখাও ঠিক না। বরং যে আছে ও থাকবে তার স্মৃতি এখন থেকে বহন করবে। খুলে ফেলো ওই জঞ্জাল।” বলল ড্যামিয়ান।
নিকোলাসের নামের আংটিটি খুলে জোর করে নিজের নামের আংটি পরিয়ে দেয় ড্যামিয়ান। মুখটা আঁজলা ভরে তুলে ঠোঁটে চুমু খায়। এই চুমু ওকে অধিকারের প্রথম নিদর্শন। যদিও ওমন নিরস, শুষ্ক ঠোঁটে চুমু খেয়ে কেমন যেন বিস্বাদ ঠেকল।
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে থাকে ইসাবেলা। সমস্ত শরীর রি রি করে উঠল। বহুদিন বাদে চোখে পানি এলো। অসহায়ত্বে, ঘৃণায় ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে লাগল।
“খিদে পেয়েছে? খাবে কিছু?”
ওর মুখে ওপর থেকে চুল সরিয়ে বলল ড্যামিয়ান। ইসাবেলার পেট গড়গড় করে ওঠে খিদের চোটে। ঠিক খিদে নয় তৃষ্ণা। রক্ত তৃষ্ণা। ইসাবেলা দাঁত কামড়ে নীরব থাকে। ড্যামিয়ানের হাত থেকে কিছু খাবে না। ওর নীরবতায় ড্যামিয়ান ভুরু কুঁচকে বলে,
“খাবে না? কেন? ভয় হয় পাছে কিছু খাইয়ে পেটেরটাকে মেরে ফেলব বলে? ভয় করো না। কথা দিয়েছি ওর কোনো ক্ষতি করব না আমি। বিশ্বাস রাখতে পারো।”
তীব্র চাহনি ইসাবেলার। বিশ্বাস! ওর মতো শয়তানকে কখনও বিশ্বাস করবে না ও। কিন্তু ভান করে যেতে হবে। ড্যামিয়ান আবার উঠে কুটিরের বাইরে গেল। ও বেরিয়ে যেতে একটানে নিজের শরীর থেকে ওর আলখেল্লা খুলে ফেললো। ছেঁড়া জামায় নিজের লজ্জা ঢাকার চেষ্টা করে। অন্যহাতের পাতায় ঠোঁট মুছতে মুছতে চামড়া ছিঁড়ে রক্ত বের করে ফেললো ইসাবেলা। অশুচিতা সর্বাঙ্গে৷ সামনেই ড্যামিয়ানের ছুরি। বিয়ের খুশিতে ভুলে গেছে হয়তো। আজ ওকে বিয়ের সাধ মিটিয়ে দেবে। লুকিয়ে ফেললো ইসাবেলা ওটা। দুহাতের যা শক্তি তাতে ড্যামিয়ানের সাথে লড়াই করে পেরে উঠবে না। মনের শক্তি সঞ্চয় করে। মনবল দৃঢ় হলে ক্ষুদ্র জীবও বৃহৎ জন্তুর সাথে লড়ে যায়, জয়ী হয়।
প্রায় মিনিট খানেক সময় পরে ড্যামিয়ান ফিরল। হাতে তাজা রক্ত ভরা পাত্র। সাথে আরও কিছু সাধারণ খাবার।
“খেয়ে নাও। কাল আমাদের বিয়ে। কত কাজ! এই শরীরে পেরে উঠবে না। শক্তি দরকার তো।”
খাবারগুলো রাখল ওর সামনে। মেঝেতে পড়ে থাকা আলখেল্লা, ইসাবেলার ঠোঁটের রক্ত দেখার পরও উচ্চবাচ্য করলো না। যেন দেখেইনি। ইসাবেলা খায় না। কিন্তু রক্ত দেখে লোলুপ হয়ে ওঠে। মনের সাথে যুদ্ধ চলে। খাবে না, খাবে না। ও জানে হারবে। ড্যামিয়ানের ওই বিদ্রুপের হাসি তাই তো বলে।
“আমার খিদে নেই এখন। রেখে দাও পরে খাব।”
বলেই উলটো দিকে শুতে যায়। ড্যামিয়ান ওর হাত চেপে ধরে।
“এই অনিয়ম তো হতে দিতে পারব না হবু স্ত্রী আমার। খেতে হবে তোমাকে। হা করো। হা।”
ইসাবেলা মুখ খোলে না। ড্যামিয়ান রাগ রাগ গলায় বলল,
“হা করো ইসাবেলা।”
ইসাবেলা তবুও হা করল না দেখে ধৈর্য হারায় ড্যামিয়ান। ওর চোয়াল চেপে ধরে জোর করে ঠোঁট আলগা করে।
“ভালো কথার মেয়ে নস তুই। জোর করি মনে মনে এটাই বুঝি চাস? বেশ…”
ড্যামিয়ান থেমে যায় ওর বুকের ভেতর ধারালো কিছু আঘাত করতে। নিচে তাকিয়ে দেখল রেখে যাওয়া ছুরিটি ইসাবেলা বুকে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ব্যথায় মুখ বিকৃত হয়ে যায়। ছেড়ে দেয় ইসাবেলার চোয়াল। সুযোগ পেয়ে উঠে দাঁড়ায় ইসাবেলা। কালক্ষেপণ না করে ছুটে বেরিয়ে আসে কুটিরের বাইরে। পায়ে জোর নেই তবুও বনমধ্যে ছুটতে লাগল দিশাহীন। কুটিরের ভেতর থেকে ড্যামিয়ানের হুঙ্কার ভেসে আসছে। ইসাবেলা আরও জোরে ছোটে। পড়তে পড়তে কোনোমতে সামলায় বার কয়েক। কিছুদূর গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠে। আর পারছে না ছুটতে। পেট ধরে একটা গাছের আড়ালে বসে। খুব নড়াচড়া করছে ওর অনাগত সন্তান। ইসাবেলা হাত বুলিয়ে বলল,
“বড্ড খিদে পেয়েছে না তোর? একটু কষ্ট কর সোনা। মা এখান থেকে বেরিয়েই তোকে খাওয়াবে। একটু সবুর কর।”
ইসাবেলা অবাক হয় পেটের নড়াচড়া থামতে। যে সন্তান গর্ভাবস্থায় মায়ের দুঃখ বোঝে সে মানুষের কষ্টের কারণ হবে! ইসাবেলার চোখ ছলছল করে।
“লক্ষী আমার, তুই তো মায়ের ভালো বাচ্চা। ওরা মিছেই তোকে নিয়ে বাজে কথা বলে। তুই কারো ক্ষতির কারণ হতে পারিসই না। ঈশ্বরের আশীর্বাদ যে তুই।”
“ইসাবেলা!” একটু দূরে ড্যামিয়ানের চিৎকার শুনে উঠে দাঁড়ায় ইসাবেলা। আবার সামনের ঝোপঝাড় সরিয়ে এগিয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে এসে থামল পাহাড়ের চূড়ায়। সামনে গভীর খাদ। এখানে থাকা নিরাপদ নয়। ইসাবেলা ঘুরে দাঁড়ায় জঙ্গলের দিকে। কিন্তু হায়! সামনে যে বিপদ স্বয়ং ক্ষুব্ধ মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
“ভেবেছিলি পালিয়ে বাঁচবি? বোকা মেয়ে, তোর পরীক্ষা নিচ্ছিলাম তো আমি। ড্যামিয়ান ছুরি ফেলে রেখে গেছে। এই সুযোগ! ওকে শেষ করে পালিয়ে যাব। সাপও মরবে লাঠিও বেঁচে যাবে। আহ! বেচারী! সাপ মরেনি আর লাঠিটিও অর্থাৎ তোর সন্তানও বাঁচবে না।”
ড্যামিয়ান এগিয়ে এলো। ওর বুকে কোনো আঘাতের চিহ্নই নেই। ইসাবেলা এর কারণ উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়। পিছিয়ে যায় সভয়ে। এত শ্রম ওর শরীর নিতে পারছে না। চোখের সামনে ঝাপসা, মাথা ঘুরে উঠছে। অবসন্নতায় ভেঙে পড়ছে হাঁটু।
“আমাদের বাঁচতে দাও ড্যামিয়ান, ছেড়ে দাও আমাকে।” অনুনয় করে বলল ইসাবেলা। ও আর জোর পাচ্ছে না কোনোভাবে। ড্যামিয়ান হাসল ওর অসহায়ত্বে। তারপর মুখ ভার করে বলল,
“আমিও তো চাই তুমি বাঁচো বেবিগার্ল। কিন্তু ওই অনাগত শিশুটি তা তো হতে দেবে না। ও তোমার কী দশা করেছে দেখেছ? আমি তোমার ভালো চাইছি বলেই বলছি, শেষ করতে দাও ওকে। ও তোমার ভেতর থেকে গেলেই তুমি আবার আগের মতো হয়ে যাবে। নয়তো মরে যাবে। মেরে ফেলবে ও তোমাকে।”
“তুমি কিছু জানো না। সন্তান মায়ের মৃত্যুর কারণ হয় না।”
“হয়, হয়।” ড্যামিয়ান চেঁচিয়ে ওঠে। মনে মনে বলল,”আমি নিজেই তো আমার মায়ের মৃত্যুর কারণ হয়েছি। জেনেশুনে তোমাকে মরতে দেবো না। তুমি ছাড়া আমি যে কিছুই না।”
ইসাবেলা ওকে বুঝানোর চেষ্টা করে। ড্যামিয়ান বোঝে না। ফেলে দেয় ঘাসের ওপর ইসাবেলাকে। জোর করে ওর পেটের কাপড় সরিয়ে খামচে ধরে পেটটা।
“না, না। দোহাই আমার সন্তানকে ছেড়ে দাও ড্যামিয়ান। আমি সত্যি সত্যি তোমার হয়ে যাব। বিশ্বাস করো আমাকে। বাঁচতে দাও আমার সন্তানকে। চিরজীবন তোমার দাসী হয়ে থাকব আমি। দয়া করো।”
“দাসী তো আমার হয়েই আছো। ওই তো তোমার অনামিকার আংটিটি সাক্ষী তার। কিন্তু এই শিশুটিকে আমি বাঁচতে দিতে পারব না। ও আমার এবং আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। ওকে মরতেই হবে।”
ড্যামিয়ান জোর করে ইসাবেলার মুখে কিছু গুঁজে দেয়। গিলতে বাধ্য করে। একটু পর ইসাবেলা শরীরে অনুভূতিবোধ টের পায় না। অবশ সব যেন।
“একটুও ব্যথা পাবে না তুমি বেবিগার্ল। বুঝতেই পারবে না কখন ওই আপদকে তোমার ভেতর থেকে দূর করে ফেলব।” বললো ড্যামিয়ান।
ইসাবেলা সত্যি কিছু টের পায় না। কিন্তু সজল ঝাপসা চোখে দেখতে পায় ড্যামিয়ান ওর পেট ছেদন করে রক্তাক্ত কিছু বের করে আনে। ওর সন্তান! ড্যামিয়ান সত্যি ওকে মেরে ফেললো!
ইসাবেলার পেট সেলাই করে জড়িবুটি বেঁধে দিতে রক্তক্ষরণ বন্ধ হলো। ও চেতন না অচেতন বুঝতে পারল না ড্যামিয়ান। পাশেই গর্ভফুলের ভেতর শিশুটি। পাঁচমাসেই যেন পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে ওর। কিঞ্চিৎ নড়েচড়ে উঠছে ফুলের মধ্যে। আলগোছে হাতে তুলে নেয় গর্ভফুল। হার্টবিট দ্রুতবেগে চলছে শিশুটির। ড্যামিয়ান ভালো করে দেখল। একটা মেয়ে শিশু! মনে মনে হাসল। এই তুচ্ছ মেয়ে শিশু ওর সর্বনাশ করবে! হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের কিনারে এসে থামে। গর্ভফুলসহ শিশুটিকে শূন্যে তুলে ধরে। এখান থেকে ফেললে ওর চিহ্ন থাকবে না। সব ঝামেলার অবসান ঘটবে। কিন্তু আচমকা একটা অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে গেল। গর্ভফুলের মাঝে চোখ মেলে তাকায় শিশুটি। একজোড়া নীল চোখ। ড্যামিয়ানের কঠিন, নির্মম হৃদয় মুহূর্তে নমনীয় হয়। মায়ায় ফেলে দেয় শিশুটির চাহনি। ওর পাপী মন কাঁপিয়ে দেয়। একে তো ড্যামিয়ান মারতে পারবে না, কিছুতেই না। গর্ভফুল হাতে ঘুরতে ইসাবেলার মুখোমুখি হয়। আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে ওর চোখ দিয়ে। হাতে সেই রক্তাক্ত ছোরা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বুকের বসিয়ে দেয় সেটা। ড্যামিয়ান বেসামাল হয়ে পা পিছলে পড়ে গেল পাহাড় থেকে। কিন্তু তার আগে ছো মেরে গর্ভফুলটি নিজের কাছে নিয়ে নিলো ইসাবেলা। ড্যামিয়ান একেবারে নিচে পড়েনি। পাহাড়ের গা ধরে ঝুলে আছে। উঠতে চেষ্টা করল। ইসাবেলা হাতে আঘাত করে। ড্যামিয়ান বলল,
“বেবিগার্ল, আমি তোমার সন্তানকে মারব না। প্লীজ উঠতে দাও আমাকে।”
ইসাবেলা বিশ্বাস করে না। আরও আঘাত করে। ড্যামিয়ানের হাতের শক্তি দুর্বল হয়ে আসে। ভয় দেখিয়ে, অনুনয় করেও ইসাবেলার মন গলাতে পারে না। ঠেলে সরিয়ে দিতে লাগল পাহাড়ের গা থেকে ওকে।
“তোর মতো শয়তানের এই পৃথিবীতে কোনো প্রয়োজন নেই। আমার সব কেঁড়ে নিয়েছিস তুই৷ তোকে সাবধান করেছিলাম,আমলে নিসনি। তুই পিশাচ থেকেও নিকৃষ্ট। তোকে মারলে পাপ নেই। মর তুই।”
পা দিয়ে ড্যামিয়ানের বুকে লাথি দিয়ে ফেলে দিলো। প্রচন্ড আর্তচিৎকার করতে করতে গভীর খাদে হারিয়ে যায় ড্যামিয়ান। ইসাবেলা অনামিকার আংটিটি খুলে ছুঁড়ে ফেলল খাদে। তারপর ঘাসের ওপর নেতিয়ে পড়ে। পেটের সেলাই ছিঁড়ে রক্ত পড়ছে। হাঁটু ভিজে গেছে রক্তে। ইসাবেলার চোখ যায় গর্ভফুলের ভেতর শিশুটির দিকে। দু’হাতে তুলে বুকে টেনে আনল। ও কী বেঁচে আছে? নড়াচড়া করছে না কেন? কেঁদে ওঠে ইসাবেলা।
“ইসাবেলা!”
চমকে তাকায় সামনে ইসাবেলা। আগাথা দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর পাশে আন্দ্রেই। ইসাবেলা আহাজারি করে উঠল। ওর অপরাধী মুখ যেন বলে,
“আগাথা, আমার সন্তান আর নেই। আমি কাওকে ধরে রাখতে পারলাম না। তোমাকে দেওয়া ওয়াদা ভেঙে যে পাপ করেছি প্রভু খুব করে তার শাস্তি দিলেন। আমি আজ রিক্ত আগাথা।”
আগাথা কঠিন মুখে চেয়ে রইলেন। আন্দ্রেইর দিকে তাকায় ইসাবেলা।
“তুমি ঠিক ছিলে আন্দ্রেই। সেদিন তোমার কথা শুনলে নিকোলাস অন্তত বেঁচে থাকত। সন্তানহারা হতে হতো না আমাকে। আমাকে শাস্তি দাও। মেরে ফেলো তোমরা।”
আন্দ্রেইর মনে আজ রাগ নেই। সহানুভূতি জেগে ওঠে ইসাবেলার জন্য। ওর কান্না আহত করে। এমনটা ও কোনোদিন চায়নি। ভাই ত্যাগের ব্যথা থেকে হারানোর ব্যথা প্রবল। অপরাধবোধ, শোক ওকে স্তব্ধ করে দেয়। আগাথা এগিয়ে গেলেন। তাকালেন গর্ভফুলের দিকে। দুহাত মেলতে গর্ভফুল শূন্যে ভেসে ওঠে। ইসাবেলা ধরতে যায়,
“হাত বাড়িয়ো না ইসাবেলা। সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে চাও তো ছোঁবে না।”
বেঁচে আছে তবে ওর সন্তান! বেঁচে থাক। বেঁচে থাক। হাত গুটিয়ে নেয় ইসাবেলা।
“ও যে আমার নাড়ি ছেঁড়া ধন। মা হয়ে একটু ছুঁতে পারব না? এমন কঠোর হয়ো না আগাথা।”
আগাথা নিজের হাতে নিলেন গর্ভফুল। নাতনির দিকে তাকিয়ে তাঁর আনন্দ ধরে না। কষ্টও হয়। নিকোলাস মেয়ের মুখটা দেখতে পেল না। সব দোষ এই ইসাবেলার। ওর স্বার্থপরতায় বলি হতে হয়েছে নিকোলাসকে। এখন তাঁর নাতনি মৃত্যু পথে ধাবিত হচ্ছে। দাদি হয়ে তাই কী সহ্য করবেন?
“নাড়িছেঁড়া ধন? আজ বুঝলে আপন সন্তান কোলছাড়া হলে কেমন লাগে? স্বার্থপর মেয়ে! এই শিশু তুমি কোনোদিন কাছে পাবে না। ভেবেছিলাম তুমি আমার বংশ রক্ষা করবে। শাপমোচন করবে আমার সন্তানদের। মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ঠকিয়েছ আমাকে তুমি। নিকোলাসের ভালোবাসা পেয়ে আমাকে দেওয়া ওয়াদা ভুলে গেলে! লোভী! তোমার মতো লোভী, স্বার্থপরের কাছে আমার বংশের শেষ চিহ্ন আমি রাখব না।”
“না, আগাথা। ক্ষমা করো আমাকে। আমার পাপের শাস্তি ওইটুকু শিশুর ওপর তুলো না।”
আগাথা উপেক্ষা করে ওর আকুতি। এত সহজে ইসাবেলাকে ক্ষমা করবেন না তিনি।
“চলো আন্দ্রেই। এখানে সময় নষ্ট করো না।”
“আগাথা মা, ইসাবেলাকে এই অবস্থায় ফেলে গেলে বাঁচবে না ও।”
“মরুক!” কথাটা বলতেই জিহবা কামড়ে ধরে আগাথা। কিন্তু ইসাবেলা শুনতে পায়। ব্যথিত মুখ করে বলে,
“তাই হোক। কিন্তু আমার সন্তানকে বাঁচিয়ো তুমি আগাথা। ও যতটা আমার তোমারও তো কম নয়। তোমার কাছে যদি নিরাপদে থাকে, তবে থাক।”
অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ইসাবেলা মুমূর্ষুপ্রায়। গলার সাথে সাথে প্রাণটাও যেন শুকিয়ে এলো। শূন্য সিক্ত চাহনির সামনে আঁধার নামে। শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ঘোর লাগে। এত ব্যথা, এত নিরাশা মধুর হয় নিকোলাসের মুখখানা কল্পনায় ভেসে উঠতে। বিড়বিড় করে বলল,
“আমার কল্পনা ছেড়ে বাহুডোরে ধরা দাও নিকোলাস। একটু ছুঁয়ে দেখি, একটু অনুভব করি। আর যে তুমিহীন চলে না আমার। একটুও চলে না।”
চলবে,,