#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৯৯
Writer তানিয়া শেখ
এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়। তাপমাত্রার পারদ ষাট এর কাছাকাছি নেমে গেছে। তীব্র ঠান্ডার সাথে মাঝে মাঝে গায়ে কাঁটা দেওয়া বাতাস বইছে। কখন না আবার দানবীয় তুষারঝটিকা শুরু হয়!
“আজ আবহাওয়া বেশ খারাপ। সকাল সকাল বাড়ি থেকে বের হলে ভালো হতো। সব কাজে ঢিলেমি তোমার। পথে ঝড়ের কবলে পড়লে কী হবে?” অনুযোগ মাতভেইর। দৃষ্টি এখনও গাড়ির বাইরে। পাশে বসা তাতিয়ানা তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বলে,
“দোষ কার শুনি? তুমি আর তোমার মেয়ে মিলে সারা সকাল কিচেনে কাটালে। কত করে বললাম ওকে কিচেনে যেতে দিয়ো না। না, উনি শুনলে তো! মেয়ের যাতে খুশি তিনি তাই করেন। মেয়েটাও বাপের মতো হয়েছে। একটা কথা যদি শোনে আমার। এমনিতেই হুইলচেয়ারে বসে। তারওপর এত নড়াচড়া দেহে সহ্য হয়? অসুস্থ হয়ে পড়ল না? ভাগ্যিস রেইনি ছিল। নয়তো এই অবস্থায় একা সামলে উঠি তোমাদের দুটোকে নিয়ে!”
গলা ভিজে আসে তাতিয়ানার। মাতভেইর ইচ্ছে হচ্ছে কপাল চাপড়াতে। কেন যে কথাগুলো বলতে গেল। প্রেগন্যান্ট তাতিয়ানার মুড চেঞ্জ হলে সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় এমনিতেও মেয়েদের মুড চেঞ্জ হয় সেকেন্ডে সেকেন্ডে। তারপর যা ঘটে! মাতভেই কান ধরে বলল,
“সব দোষ আমার। এই দেখো কানে ধরছি।”
“ঢং করবে না। সরে বসো আমার পাশ থেকে।” তাতিয়ানা মুখ ঘুরিয়ে নেয় জানালার দিকে। মাতভেই আরও কাছে সরে এলো। আবৃত্তির ঢঙে বলে,
“তোমা থেকে সরলে দূরে
মন আমার কেমন কেমন জানি করে।
এই যে তোমার দেহের উষ্ণতা, চুলের ঘ্রাণ
আমার শ্বাস বায়ুতে মিশে থাকা অক্সিজেন।
প্রিয়তমা, জায়া,
তোমার মন খারাপের অপরাহ্ণে পড়ুক প্রফুল্লতার ছায়া।
ছাড়ো মান, হাসো না জান!
ডার্লিং প্লীজ! ফেরাও না ও চাঁদমুখখান।”
মাতভেই আস্তে আস্তে তাতিয়ানার থুতনি ধরে নিজের দিকে ঘুরালো। সলজ্জে তাকালো তাতিয়ানা। মাতভেইর ঠোঁটে সেই নির্মল, মুগ্ধ করা হাসি। গাঢ় চুম্বনে শুষে নিলো স্ত্রীর মান। গোলফ্রেমের চশমা পরা চোখে তাকালে আজও হৃদয়ে কাঁপুনি ধরে তাতিয়ানার।
মাতভেই আঁজলা ভরে ওর মুখ তুললো।
“প্রেমে পড়লে?”
“সেই কবেই তো।”
গাড়ি এসে থামল আলেক্সিভ মহলের সামনে। ঝিরিঝিরি তুষার পড়ছে। ক্রমে ক্রমে বাড়ছে আবহাওয়ার ক্ষুব্ধভাব। সারা রাস্তা মাতভেই প্রার্থনা করেছে ঝড় না উঠুক। নিরাপদে পৌঁছে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। প্রথমে নামল ও। তারপরে হাত ধরে নামালো তাতিয়ানাকে। সামনে তাকালো দুজন। কত স্মৃতিতে মোড়া এই বাড়িটি! এত বছরে খানিক পরিবর্তন এসেছে। অনেকদিন পর পিত্রালয়ে এলো তাতিয়ানা। মাতভেই ব্যবসার কাজে খুব ব্যস্ত ছিল। তবে শ্বশুরবাড়ির খোঁজ খবর নিয়মিত রাখে। হাত ধরে দুজনে এগোতে লাগল।
“আমার না চিন্তা হচ্ছে মাতভেই। হঠাৎ এমন জরুরি তলব করল কেন মা?”
“হয়তো অনেকদিন যাই না বলে।”
“আমার তেমন মনে হচ্ছে না।”
“তুমি খামোখা চিন্তা করছো। এই তো চলে এসেছি। এখনই সব জানা যাবে।”
সদর দরজা ভেজানো ছিল। ওরা ঢুকতে ভ্লাদিমির স্ত্রী ইলিয়া হলঘর থেকে এগিয়ে এলো। সোনালি চুল, লাল মুখশ্রী, কটা চোখের মণি। আন্তরিকতায় স্বতঃস্ফূর্ত থাকে যেন সব সময়। ভ্লাদিমি ওর পেছনে এলো। ইলিয়া তাতিয়ানার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। মাতভেই ওর কুশলাদি জেনে ভ্লাদিমির সাথে কথা বলতে বলতে আগে আগে চললো। একটু পিছনে ইলিয়া তাতিয়ানার বাড়ন্ত পেটে চেয়ে বলল,
“কেমন আছো তোমরা?”
“ভালো।” মুচকি হেসে বলল তাতিয়ানা। এদিক -ওদিক তাকিয়ে বলল,
“তোমার বিচ্ছুটি কই?”
“ঘুম থেকে এখনও জাগেনি। সন্ধ্যার আগে উঠবে না। ছেলেটা ভীষণ দুষ্টু হয়েছে। শাশুড়ী মা বলে বড়ো ফুপির মতো। তুমি না কি ছোটোবেলা দুষ্টু ছিলে?”
“আরে ধুর! মা ওমন আমার নামে বাড়িয়ে বলে। যত দোষ এই নন্দ ঘোষের। বড়ো হওয়ার এই জ্বালা বুঝলে? মায়ের কাছে ভালো ছেলে তাঁর ভ্লাদিমি আর সবচেয়ে ভালো মেয়েটি ইসা..বেলা। ইসাবেলা!” ইসাবেলার নামটা ফিসফিস করে বলতে বলতে মুখ বিমর্ষ হয়ে যায়। ইলিয়ার মুখেও পড়ল সেই ছায়া। ইসাবেলাকে ও সরাসরি দেখেনি। কিন্তু ওর ঘরের দেওয়ালে টাঙানো বড়ো ছবিটা দেখেছে। শুচিস্মিতা, মায়াবী মুখ! বিয়ের পর এ বাড়িতে এসে অব্দি ওর নামটা শুনেছে আর ঠিক এভাবে বিমর্ষ হতে দেখে এদের। শাশুড়ী ও শ্বশুরকে কতবার ছোটো মেয়েকে স্মরণ করে চোখের জল ফেলতে দেখেছে! কারণ জিজ্ঞেস করলে ভ্লাদিমি গম্ভীর হয়। অপরাধবোধ ফুটে ওঠে চোখেমুখে। স্পষ্ট কারণ আর জানা হয় না।ইসাবেলা না থেকেও যেন আছে এ বাড়িতে। ইলিয়া চট করে প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলল,
“সরাসরি মায়ের ঘরে যাবে না একটু বিশ্রাম নেবে?”
হাঁপ ছেড়ে তাতিয়ানা বলল,
“মায়ের ঘরেই যাই।”
“চলো।”
“বাবার শরীর কেমন এখন? মায়ের বুকে ব্যথা কি খুব হয় এখনও?”
“বাবার শরীর আগের মতোই। খুব বেশি হাঁটা-চলা করলে অসুস্থ হয়ে বিছানা নেন। মায়ের বুকে ব্যথা কমেছিল। চিঠিটা পেয়ে বেজায় বেড়েছে।”
সিঁড়ির দু’ধাপ উঠে থামল তাতিয়ানা,
“চিঠি!”
খুব সতর্কে চাপা গলায় ইলিয়া বলল,
“হ্যাঁ, তোমাকে তো বলতেই ভুলে গেছি। মস্কো থেকে চিঠি এসেছে।”
“মস্কো থেকে! এই জন্য জরুরি তলব! চিঠি পড়েছে মা?” আবার ওপরে উঠতে লাগল তাতিয়ানা। ইলিয়া বলল,
“জানি না। কাওকে কিছু বলেনি চিঠি সম্পর্কে। বললেন সকলে এলে একবারে বলবেন। তোমার কী মনে হয়? কী হতে পারে?”
“কী জানি! ঠিক বুঝতে পারছি না।”
বাকি সিঁড়ি বেশ ভাবতে ভাবতে পার করলো তাতিয়ানা। মস্কোর সাথে এ বাড়ির সম্পর্ক শেষ হয়েছে নয় বছর আগে। প্রথম দু এক বছর বাপের বাড়ি থেকে টুকটাক চিঠি বা টেলিগ্রাম এলেও জবাব দেননি আন্না মেরিও। তারপর আর আসেনি। বাপ-মেয়ের মধ্যে শীতল লড়াই চলছিল। হঠাৎ এত বছর পর চিঠির আসার কারণ কী! সেই চিঠির কারণে আবার এমন জরুরি তলব! নানা বাড়ি মানেই আতঙ্ক ওদের কাছে। অতীত ক্ষত এখনও যে শুকায়নি।
আন্না মেরিওর কক্ষের দরজা খোলা ছিল। মাতভেই সামনের সোফাতে বসে আছে। বাইরে ঝড়ো বাতাস বইছে। এই কক্ষের জানালায় আঘাত করছে সেই বাতাস। ভ্লাদিমি জানালা ঠিক করে লাগিয়ে সোফার অপরপাশে বসল। ইলিয়া গিয়ে স্বামীর পাশে বসে। তাতিয়ানা কক্ষে ঢুকে প্রথমে বাবাকে দেখতে পেল। বিছানায় আধশোয়া তিনি। কথা বলছেন জামাতার সাথে। অথচ, তাঁর মুখে সেই আগের প্রসন্ন হাসি নেই। অসুস্থ দেখাচ্ছে। ওর উপস্থিতি টের পেয়ে তাকালো। হাসি দীর্ঘ হলো,
“কে, অ্যানা এলি মা?”
“হ্যাঁ, বাবা। তোমার শরীর তো আরও খারাপ হয়েছে দেখছি।”
“ও কিছু না। বয়স তো কম হলো না। আয় বাবার কাছে এসে বস। নানা ভাইকে নিয়ে এলি না? কতদিন দেখি না ওকে।”
তাতিয়ানা বাবার পাশে বসল।
“ওর চেকাপের ডেট আজ। একটু পর ডাক্তার আসবে বাড়িতে। রেইনি আছে বলে ভরসা করে একা রেখে এলাম।”
ওলেগ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন,
“মেয়েটার পা দুটোতে হঠাৎ কী যে হলো। ডাক্তার কী বলে? ঠিক হবে তো?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। তুমি ও নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করো না।” মিথ্যা বলল তাতিয়ানা। বাবাকে নতুন করে দুশ্চিন্তা করার উপলক্ষ্য দেয় না। মস্কো থেকে আসার বছরখানেক পরে একটা এক্সিডেন্ট হয় তাশার। তারপর থেকে পা দুটো প্যারালাইজড। ডাক্তার ওদের নিশ্চিত করে কিছু বলেনি। নিয়মিত চিকিৎসা চালিয়ে যেতে বলেছে। তাই করছে। এক ঈশ্বরই এখন ভরসা। বাবার সাথে কথা বলতে বলতে মা’কে দেখল তাতিয়ানা। কক্ষে ঢুকলেন। চিঠি হাতে বিছানার অন্য পাশে বসলেন। মেয়ের কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন। তাতিয়ানা জবাব দিতে দিতে খেয়াল করল মায়ের বয়স যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেছে এই ক’বছরে। কিছুটা কুঁজো হয়ে গেছেন। চোখের নিচে কালো, ফোলা। চামড়ার কুঞ্চন বেড়েছে। বেদনার নিগূঢ় ছাপ তাঁর মুখে। গম্ভীর মুখ তুলে বড়ো মেয়ের পর্যবেক্ষণীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে নিলেন। মৃদু গলা ঝেড়ে বললেন,
“তোমাদের সবাইকে এখানে ডেকেছি একটা বিশেষ কারণে। গতকাল মস্কো থেকে চিঠি এসেছে। তিখন লিখেছে, ম্যাক্সিম নিখোঁজ। বাবা হঠাৎ শয্যা নিয়েছেন।”
“তোমার ইচ্ছে হলে তুমি যেতে পারো মা। আমাকে এসবে টানবে না।”
ভ্লাদিমির সাফ জবাব। জবাবটা যেন তৈরি ছিল। ইলিয়ার চোখ রাঙানিকেও উপেক্ষা করে। আন্না মেরিও মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে গেলে তাতিয়ানাও একই জবাব দেয়। যাদের কারণে বোনকে হারিয়েছে। তাঁদের মুখ দেখার প্রয়োজনীয়তা মনে করে না। ওলেগ স্ত্রীর অসহায় মুখ চেয়ে সন্তানদের বলেন,
“মা’কে কথা শেষ করতে দাও তোমরা। অর্ধেক কথা শুনে আগেভাগে মতামত দিয়ো না।”
ভ্লাদিমি কিছু বলতে যাচ্ছিল। ইলিয়া হাত চেপে চোখে শাসায়। সুতরাং ও চুপ করল। তবে ক্ষোভ দেখা গেল চেহারায়। আন্না মেরিও কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বললেন,
“তোমার নানা তিখনকে দিয়ে লিখে পাঠিয়েছেন, ইসাবেলা যেন তাঁর সাথে শীঘ্রই দেখা করে। খুব প্রয়োজন এখন ওকে তাঁর।”
মুহূর্তে কঠিন নীরবতা নামল ওই কক্ষে। তারপর লাফিয়ে ওঠে ভ্লাদিমি।
“বুড়োর সাহস হয় কী করে আমার বোনের নাম নেওয়ার। আবার বলে খুব প্রয়োজন। কেন? ফের মারার প্লান করছে? একবার শেষ করে মন ভরেনি?”
“ভ্লাদিমি! সংযত হও।” ওলেগ সতর্ক করেন ছেলেকে। রাগে লাল ভ্লাদিমি। বাবার ওপর কথা বলা চলে না। কিন্তু যেই লোকের সরাসরি হাত রয়েছে ইসাবেলার জীবন নষ্টে তাঁর নাম শোনার পর নিজেকে তো শান্ত বা সংযত রাখা যায় না। আন্না মেরিও মুখ নুয়ে একদৃষ্টে চিঠিটা দেখছেন। তাতিয়ানা রাগ চেপে মা’কে বলল,
“তুমি কী বলো মা?”
সময় নিলেন আন্না মেরিও। তারপর সজল চোখে চেয়ে বললেন,
“একবার ওকে বলেই দেখো কথাটা।”
“খবরদার,অ্যানা।” চোখ রাঙায় ভ্লাদিমি। তাতিয়ানা সে দৃষ্টি উপেক্ষা করে দাঁতে দাঁত কামড়ে বলে,
“তুমি ভেবে বলছ? জানো না কী করেছে ওরা? ওদের কারণে আমাদের মুখ দেখতে চায় না ইসাবেলা। তার পরেও? ওর অতীত ক্ষত কেন ঘাটতে চাইছ মা? ছেড়ে দাও না। বাঁচতে দাও ওকে। বহুকষ্টে ওইটুকু বেঁচে আছে। নতুন করে আর কষ্ট বাড়িয়ো না।”
“তোমরা বুঝতে পারছ না। ওর ওখানে যাওয়াটা হয়তো জরুরি। নয়তো বাবা এত করে অনুরোধ কেন করবেন?”
“আবার নতুন কোনো ষড়যন্ত্র পাকিয়েছে হয়তো। খবরদার কেউ যদি ওর কাছে এই চিঠি নিয়ে গেছ।”
ছেলের চিৎকারে আন্না মেরিও আচমকা হু হু করে কেঁদে উঠলেন। বেশ অবাক হলো সকলে। মা’কে এভাবে কাঁদতে দেখেনি ওরা। সন্দেহজনক লাগল। মা নিশ্চয় আরও কিছু বুঝেছেন। কী? ইসাবেলার বিপদ হবে এমন কিছুতে এত জোর দেবেন না তিনি।জিজ্ঞেস করলে জবাব মিলবে না। বলার মতো হলে কান্নার ছল করতেন না। ওলেগ স্ত্রীকে কাছে টেনে ছেলেকে ধমকের সুরে বললেন,
“চুপ করে বসো ওখানে, ভ্লাদিমি। জিজ্ঞেস না করলে আর একটা কথা বলবে না। বসো।”
ভ্লাদিমি বসল। মা’কে কাঁদতে দেখে মোটেও ভালো লাগল না। তাতিয়ানা কী যেন ভাবছে। মাতভেই এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার ও বলল,
“সবই বুঝলাম। কিন্তু ওর পর্যন্ত পৌছাবে কে এ খবর? ও তো আমাদের কারও সাথে দেখা করতে চাইবে না।”
“সে উপায় আছে।” চোখ মুছলেন আন্না মেরিও।
“কী?” তাতিয়ানার ভুরু কুঁচকায়। সকলের মনে একই প্রশ্ন। ইলিয়ার আরও বেশি। ও পুরো ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করছে। আন্না মেরিও উজ্জ্বল মুখে বলেন,
“পিটার। একমাত্র ওই পারবে আমার বেলার কাছে খবরটা পৌঁছে দিতে।”
পরদিন গির্জার সামনে অপেক্ষারত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় পিটারকে। পরনে ওভারকোট আর মাথায় টুপি। হাত দুটো পকেট বন্দি। নাক পর্যন্ত টুপিতে ঢাকা। তার নিচে অনেকদিনের না কামানো দাড়ি। তাতে শ্রী নেই। বেশ অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগল গির্জার সামনের বারান্দায়। গির্জার ভেতরে গেল না। সামনে খোলা মাঠ। গত কয়েকদিনের তুষার ঝড়ে তুষারের পুরু আস্তরণে ঢেকে আছে। গির্জার সামনের পথে এক হাঁটু জমেছে। চলাচলে ব্যাঘাত ঘটছে পথচারীদের। একজন প্রৌঢ় ফাদার জমে থাকা তুষার সরাচ্ছেন। এই দৃশ্য দেখে পিটার চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। টুপিটা রেলিঙের ওপর রাখে। অবিন্যস্ত সোনালি চুলে হাত বুলিয়ে নেয়। চশমা ঠিক করে দৌড়ে ফাদারকে সাহায্য করতে ছুটল। ফাদারকে দাঁড় করিয়ে একাই রাস্তা পরিষ্কার করছে।
“পিটার!”
হঠাৎ পেছন থেকে ডেকে ওঠা প্রিয় গলা শুনে ঘুরে তাকায়। হাসি ওর চোখ পর্যন্ত পৌঁছায়।
“ইসাবেল!”
ফাদার বাকিটা একলা পারবেন বলে আশ্বস্ত করতে পিটার ফের বারান্দায় উঠে এলো, ইসাবেলার সামনে।
বিয়ের আগে যেই পবিত্র, সৌন্দর্যের প্রতিমা মুখ হৃদয়ে করে ফেরারি হয়েছিল তা আর অবিকল নেই। বিষাদে বিবর্ণ সেই সৌন্দর্য। ওকে খুঁজতে গিয়ে পিটার বন্দি হলো জার্মান সৈন্য কর্তৃক। দীর্ঘ কারাবাসের প্রতি মিনিটে হৃদয়ে আঁকা প্রিয় মানবীর নিষ্পাপ মুখ মনে করে দিনরাত অতিবাহিত করেছিল। কেমন আছে? কোথায় আছে? ভেবে ভেবে অস্থির ছিল। দুঃশ্চিন্তা ও অপরাধবোধে জর্জরিত। ওর কারণে ইসাবেলাকে ঘর ছাড়তে হয়েছে। মন ভেঙেছে, কাঁদিয়েছে। এই পাপ দগ্ধ করে। ওর কিছু হলে পিটার বাঁচবে কী করে? সময় কত বদলে দিয়েছে এই মেয়েটিকে। শুধু সময়? ওর নিজের দায় কি কম। খুব আছে, খুব। নিজেকে ভর্ৎসনা করে মনে মনে পিটার। ইসাবেলার পরনের সাদামাটা ধূসর কালো লম্বা স্কার্ট, মাথায় সাদা স্কার্ফ। পায়ে সাধারণ একজোড়া চপ্পল। চেহারার স্নিগ্ধতায় সন্ধ্যার মলিন আলো পড়েছে। ওর উদাস, নির্মোহ চোখে তাকাতে পারে না পিটার। বুক মথিত হয়।
“কেমন আছো?”
মুচকি হাসল ওর প্রশ্ন শুনে ইসাবেলা। যে হাসিতে নিস্পৃহতা বেশি। এই হাসি ফের পিটারকে বুঝিয়ে দেয় ও আজ সেই বান্ধবী, ভালোবাসার মানবীর সামনে দাঁড়িয়ে নেই। এই ইসাবেলার ওপর ওর কোনো হক নেই।
পিটারের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারে না ইসাবেলা। কত চেষ্টা করে জাগতিক সকল বন্ধন মুক্ত হওয়ার, ফেলে আসা অতীত ও সেই অতীতস্মৃতি জড়ানো মানুষগুলোর জন্য সৃষ্ট অনুভূতি চাপা রাখতে, ভুলে থাকতে। এদের চোখে তাকালে সেসব গোপন করতে কষ্ট হয়। এই জন্য তো কারো সাথে দেখা করতে চায় না। কিন্তু পিটার বরাবরই একরোখা। দেখা না করে যায়ই না। একসময়ের ভালোবাসা অস্বীকার করতে পারে ইসাবেলা, কিন্তু বন্ধুত্ব? বন্ধুত্বে জোড়া লাগাতে আসে পিটার। একজনের প্রচেষ্টায় কি হয় তা? ইসাবেলার সংকল্প ভাঙতে চায়। ফিরিয়ে নিতে চায় আগের জীবনে। ওরটা কি ভাঙতে পেরেছিল ইসাবেলা? মনে মনে হাসে। পিটারকে এবার বুঝিয়ে দেবে ও আর সেই ইসাবেলা নেই। যে কিশোরী ওকে ভালোবেসেছিল। ওর চলে যাওয়ার আঘাত সহ্য করতে না পেরে কেঁদে কেঁদে দিনরাত এক করেছিল। এই ইসাবেলা কাঁদে না। কান্না মানুষকে দুর্বল করে। নিঃস্বের আবার দুর্বলতা কীসের?
“আজও জবাব দিলে না।” বলল পিটার।
এসে ওর পাশে রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়ায়। এককালে পিটারের নাম শুনলে, দেখলে বা পাশে দাঁড়ালে ইসাবেলার বুক ঢিপঢিপ করত। লজ্জায় লাল হতো যৌবনে প্রেমের ছোঁয়া পাওয়া কিশোরীর মতো। আজ ও কিশোরী নেই। আবেগের আতিশয্য নেই। প্রথম প্রেমিকের সান্নিধ্যে মন দোলে না। বড়ো অস্বস্তি হয়। কিন্তু বুঝতে দেয় না।
দৃষ্টি সামনে স্থির রেখে বলে,
“অনর্থক প্রশ্নের জবাব তো দিই না আমি মি.মিখায়লোভ। তুমি যা সহজে দেখতে পাচ্ছো তা মুখ থেকে জানতে চাওয়া অর্নথক।”
“উফ! আবার মিখায়লোভ। এই সন্ন্যাসিনীদের সাথে থাকতে থাকতে ওদের মতো হচ্ছো। উদাসীনতা বাসা বাঁধছে পাকাপোক্তভাবে। নয়তো সামান্য একটা জবাবে এমন হেঁয়ালি করবে কেন?”
কথাটা অভিমানের। কাষ্ঠ হাসল ইসাবেলা,
“উদাসীনতা? কী যে বলো না। ওসবের সময় কই। তাছাড়া উদাসীনতা তোমাকেই মানায়।”
খোঁচাটা নীরবে হজম করল পিটার। হেসে বলল,
“খুব ব্যস্ত বুঝি আজকাল?”
“গতকাল পেরনাউ থেকে ফিরলাম। মানুষগুলো ভালো নেই পিটার। চারিদিকে এত দুঃখ, জরা। পেটের দায় মানুষদের খারাপ পথে ঠেলে দিচ্ছে। ঈশ্বর নিছক কল্পনা হয়ে আছে ওদের কাছে। যুদ্ধ শেষের দশ বছর গত হলো। কিন্তু এখনও দেশ ও দেশের মানুষ বয়ে বেড়াচ্ছে সেই ক্ষত। দুর্বিষহ জীবন তাদের। আমাদের অনেক কাজ পিটার। এই ক্ষত আমরাই সৃষ্টি করেছি। একে সারিয়ে তোলাও আমাদের কাজ। সমাজের দুঃখী, বঞ্চিত, শোষিত মানুষগুলোর প্রতিনিধি হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। তুমি হয়ে দেখিয়েছ। অনেক কিছু শিখি আমি তোমার থেকে। একসময় তোমার কাজগুলো বুঝতাম না। এখন বুঝি।”
“আর আমাকে?” মুখ ফসকে বলে ফেললো পিটার। যতই সে বিপ্লবী হোক, সংসারধর্ম না করার পণ নিয়ে থাক। কিন্তু ইসাবেলাকে দেখলে হৃদয় গহিনে লুকানো প্রেম প্রদীপ জ্বলে ওঠে। সেই শিখা জ্বালিয়ে মারে। এ পাপ। তবুও তাই করে বারেবারে। ইসাবেলা বিস্ময়ে তাকায়,
“তোমাকে?”
“হ্যাঁ, আমাকে। বুঝতে চেষ্টা করেছ ধোঁকাবাজ, ভীরু-কাপুরুষ, হৃদয় ভেঙে দেওয়া নিষ্ঠুর পিটার ছাড়া আমাকে?”
ইসাবেলা ওর ভাসা ভাসা চোখে তাকায়। দৃষ্টি সরিয়ে জড়ানো গলায় বলে,
“তোমাকে বুঝতে গেলে যে কত কী বুঝতে হবে আমায় পিটার। কত ব্যথা, কত কী হারানোর শোক! থাক না। থাক ওসব।”
বিড়বিড় করে বললেও পিটার শুনতে পায়। এই কত কী কথার আড়ালে ইসাবেলার অতীত শোক রয়েছে। অতীত! কিছু মানুষ অতীতকে বর্তমান করে বাঁচে। পিটার নিজেকে মনে করাতে গিয়ে ইসাবেলার আহত হৃদয়কে খোঁচা দিয়ে দগদগে করল। ওর চোখের ওই শূন্যতা, ওই ব্যথা নিকোলাসের শোক তাজা করে। ঈর্ষা কি হয় না পিটারের? ইসাবেলার মন থেকে যে ওর ভালোবাসা মুছে দিয়ে নিজেরটা পোক্ত করে গেছে তাকে একটু ঈর্ষা না করে পারে না। তবুও নিকোলাসের প্রতি ক্ষোভ নেই, রাগ নেই। একরাশ কৃতজ্ঞতা। ওর অনুপস্থিতিতে ইসাবেলাকে আগলে রেখেছে। অবশ্যই ওর চেয়ে বেশি ভালোবেসেছে। পিটার ভালোবাসা বিসর্জন দিয়েছিল। নিকোলাস নিজেকেই বিসর্জন দিয়ে ভালোবাসা বাঁচিয়েছে। ওর প্রতি শ্রদ্ধা জন্মে পিটারের। ওর পিশাচরূপ সেখানে একটুও বাধা হয় না।
ইসাবেলা আকাশের দিকে তাকায়। শূন্য চোখের কার্ণিশ জল টলমল করে। মুহূর্তে সময় যেন দ্রুত পিছিয়ে যায়। দশ বছর আগে। স্বামী ও সন্তান হারিয়ে মুমূর্ষুপ্রায় ইসাবেলা। আন্দ্রেই নিজের রক্ত ওর মুখে না দিলে সেদিন মরে যেত। ভালো কি হতো না? বাঁচতে তো চায়নি। কিন্তু আন্দ্রেই যখন বলল,
“বাঁচতে হবে তোমাকে ভাবি। সন্তানের জন্য অপেক্ষা তোমাকে বাঁচিয়ে রাখবে।”
সব হারিয়েও ইসাবেলা সন্তানের পথ চেয়ে বেঁচে আছে এত বছর। আগাথা একদিন ক্ষমা করবে। ফিরিয়ে দেবে ওর মেয়েকে। সেই একদিন আসতে আর কত দেরি! ঈশ্বরের সেবায়, তাঁর সৃষ্টির সেবায় নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করতে গিয়ে থমকে গেছে শুধুমাত্র মেয়ের জন্য। দশ বছরে কত বড়ো হয়েছ ও! বাবার মতো কতটা দেখতে হয়েছে! এসব ভাবলে ইসাবেলার ব্যাকুলতা বাড়ে। একটু একটু করে চাপা যন্ত্রণা বেড়ে কষ্টের পাহাড় হয়েছে। এই ভার কেমন করে যে বইছে একমাত্র ওই জানে।
“তোমারই জিত হয়েছে। আমার সকল চেষ্টা বিফল হলো। আমার সকল দুঃখ আজ জাগ্রত, মুখের ওপর তার প্রকাশ ঘটেছে। এই তো দেখতে চেয়েছিলে? দেখো। খুশি হও। কিন্তু এও জেনে রাখো, ইসাবেলা তোমাদের আর কোনোদিন হবে না। তোমরা বহু আগেই মেরে ফেলেছ সেই ইসাবেলাকে। এই যেটুকু আছি তা একজনের জন্য।” বলতে বলতে ওর চোখের জল শুকিয়ে গেল। ফিরে এলো সেই গম্ভীর নির্মোহ মুখাভাব। পিটার দুঃখ পেল। বলল,
“আমি জিততে আসি না। তোমাকে হারিয়ে জিতে যাওয়া আমারই হার ইসাবেলা। শুনলে হাসবে। তবুও বলি, আমি আজও তোমাকে ভালোবাসি। সেই আগের মতো। কিন্তু তোমাকে নিজের করে পাওয়ার অধিকার আমার নেই। কোনোকালেই ছিল না। বুঝিনি এই অধিকার না করতে পারার অক্ষমতা তোমাকে এমন করে ব্যথা দেবে। বুঝলে নিজের অক্ষমতাকে হারিয়ে দেওয়ার শেষ প্রচেষ্টাটুকু করতাম। তোমার এই মলিন মুখ, নির্বেদ চোখ আমায় বড়ো অপরাধী করে ইসাবেলা। মনে হয় তোমার সকল কষ্টের কারণ একমাত্র আমি। খুব কঠিন শাস্তি আমার পাওনা। ঈশ্বর আমায় শাস্তি দিন, তোমার কষ্ট দ্বিগুণ করে আমাকে দিক। আর আমার সকল ভালো কাজের প্রতিদানে তোমাকে সুখী করুক। আবার তুমি হাসো। না, এই নিস্পৃহ হাসি নয়। উচ্ছ্বাস খেলে যাক তোমার ঠোঁটে, চোখে জ্যোৎস্না ঝরুক।”
ইসাবেলার বুকের ওপর চাপা পাথরটা কেমন গলতে শুরু করে। ঠোঁট শক্ত করে চেপে ধরে আছে। চট করে ঘুরে দাঁড়ায় গির্জার দরজার দিকে। পিটার ভীত গলায় বলে,
“চলে যাচ্ছ?”
“অনেক কাজ আমার পিটার। আজ বরং তুমি যাও।”
পিটার জানে কাজ দেখানো অজুহাতের কথা। পিটারের সান্নিধ্য ও আর চায় না। বেহায়া মন বোঝে না। ইসাবেলার কাছে এসে নিজের কথা শুধু তোলে। ভুলেই গেল এখানে আসার আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু সেটা ওর সামনে তুললে কীভাবে নেবে তাই ভেবে চিন্তা শুরু হয়। ইসাবেলা দরজার দিকে আরও দু কদম বাড়ায়। পিটার কোথা থেকে শুরু করবে ভেবে অস্থির। কিন্তু বলতে যে হবেই।
“তোমার নানা চিঠি পাঠিয়েছেন ইসাবেলা। শয্যাশায়ী তিনি। চিঠিতে খুব করে অনুরোধ করেছেন একটিবার মস্কোতে তোমায় যাওয়ার জন্য।”
দরজার বেদীতে এসে থমকে দাঁড়ায় ইসাবেলা। চকিতে ঘুরে তাকায়। এখনও আগুন ঠিকরে বেরোয়নি চোখে। কিন্তু রোষের তাপ খানিক বোঝা যায়।
“ওহ! তাহলে এই জন্য আসা তোমার?”
“এই চিঠি অছিলামাত্র। তোমাকে দেখতে আমি ঠিক আসতাম। দুঃখী মানুষগুলো ছাড়া একমাত্র তুমিই আছো যাকে আপন ভাবি। আমায় ভুল বুঝো না তুমি।” এগিয়ে এলো পিটার। ইসাবেলা শ্লেষের সাথে বলে,
“ভুল! সেটার মধ্যে তো এতক্ষণ আমি ছিলাম। মা তোমাকে পাঠিয়েছে না? সব জানার পরও কেন তাঁর কথাতে এই চিঠি নিয়ে এখানে আসতে পারো তুমি পিটার?”
ওর শেষ কথায় ক্ষোভ ঝরল। পিটার বলল,
“বিশ্বাস করো আমাকে তুমি। তোমাকে দুঃখ দেওয়া অভিপ্রায় আমার কোনোকালেই ছিল না।”
“এক ঈশ্বর ছাড়া আর কাওকে বিশ্বাস করি না। চলে যাও আমার সামনে থেকে। কোনোদিন আসবে না।”
পিটার আহত মুখে দাঁড়িয়ে ওকে গির্জার ভেতরে চলে যেতে দেখল। এ ছাড়া কিছু করার নেই ওর। ইসাবেলা দৃষ্টিসীমার আড়ালে যেতে ঘুরে সামনের উর্ধ্ব গগনে তাকিয়ে বলল,
“মানুষের প্রতি ওর বিশ্বাস ফিরিয়ে আনো। সুখী করো। শান্তি দাও প্রাণে প্রাণে। তবেই আমি তোমার কাছে আবার আত্মসমর্পণ করব।”
গির্জার বাইরে এসে হঠাৎ পকেটের চিঠিটার কথা মনে পড়ল। আন্না মেরিও মার্কোভিকের লেখা চিঠিটা দিয়েছিলেন ইসাবেলাকে দেওয়ার জন্য। এতক্ষণে মনে পড়ল সেটা। ইসাবেলার নাগাল আজ আর পাবে না। কী করবে? একজন সিস্টার এদিকেই আসছিলেন। পিটার তাঁর কাছে চিঠিটা দিলো। তারপর যে পথে এসেছিল সেই পথেই রওনা হয়। পথটা দীর্ঘ। একা চলতে চলতে হাজারো মানুষের আশার প্রতীক হয়। একা থাকে না আর। শোষিত, দলিত মানুষগুলোকে বিপ্লবের গান শুনিয়ে বৈষম্যহীন এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে শেখায়। এই স্বপ্ন পূরণের তীব্র আকাঙ্ক্ষা ওকে ঘরছাড়া করে, কেবল একজনে আবদ্ধ হতে দেয় না। ও তো একজনের নয়। সমগ্র নিপীড়িত মানুষের।
চলবে,,