তিমিরে_ফোটা_গোলাপ পর্ব-২২

0
695

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব-২২
Writer Taniya Sheikh

সন্ধ্যার কুজ্ঝটিকা গাঢ় অন্ধকারে রূপ নিয়েছে। ট্রেনের হুইসেল বাজতে প্লাটফর্ম ফাঁকা হয়ে গেল। ট্রেন থেকে নেমে আগাথাকে অনুসরণ করল ইসাবেলা। কাছাকাছি বেশ নির্জন একটা স্থানে গিয়ে থামে আগাথা। পেছনে ইসাবেলা। ভীষণ খুশি আগাথা। যেমন ভেবেছিল তেমনই হচ্ছে। ইসাবেলার মস্তিষ্কের কিছুটা হলেও এখন তাঁর আয়ত্বে। আস্তে আস্তে পুরোটা আয়ত্বে নেবে। আর তারপর এই মেয়েকে দিয়েই হবে সন্তানদের শাপমোচন। শত জনমের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণতা পাবে এবার। তৃপ্ত হবে আত্মা। ইসাবেলা এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে,

“কোন একটা শহরের নাম বলেছিল নোভা। নামই তো মনে নেই, সেখানে যাব কীভাবে?”

“ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না তোমাকে। প্লাটফর্মের বাইরে ঠিক যেখানে টমটম দাঁড়িয়েছিল, গিয়ে দেখো সেটা এখনও সেখানে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে।”

“পল! তবে কি সেও আপনাকে দেখেছে?”

“না, আর কোনো প্রশ্ন নয় এখন। দ্রুত যাও।”

ইসাবেলা দু কদম এগিয়ে ফের ঘুরে দাঁড়ায়। বলে,

“আমি একা কীভাবে পারব ওদের সাথে? আমার বড্ড ভয় করছে। নিকোলাস জানলে মেরেই ফেলবে।”

“তুমি একা নও ইসাবেলা। আমি আছি তোমার সাথে। নিকোলাস টের পাওয়ার আগেই তুমি আমি মিলে ওদের শেষ করব।”

“কিন্তু কীভাবে?”

“সময় হলে সব জানতে পারবে। আর সময় নষ্ট করো না। যাও এখন।”

অসংখ্য প্রশ্ন মাথায় করে ইসাবেলা প্লাটফর্মের বাইরে এসে থামে। আশ্চর্য! ওই তো পলের সেই টমটম। সত্যি বলতে আগাথাকে ইসাবেলা ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না। প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে তাঁর কথায় রাজি হয়েছে কেন? ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। মনের গহীনে সে এখনও বাড়ি ফিরে যাওয়ার পক্ষে। কিন্তু ভ্যালেরিয়ার প্রতি ওর দায়িত্ব ওকে ট্রেন থেকে নামিয়ে এনেছে। প্রিয় ভ্যালেরির মৃত্যুর দিন সে যে শপথ করেছিল, তাই মনে করে আগাথাকে অনুসরণ করে। আগাথার অতীত শুনে কষ্ট হয়েছে। সাহায্য করতেও ইচ্ছে হয়। তবে নিজেকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে না। ভ্যালেরিয়া পুরোটা জীবন উৎসর্গ করেছে ঈশ্বরের সমীপে। ঈশ্বরের সৃষ্টি মানুষের দুঃখ, কষ্ট দূরে নিয়োজিত ছিল। কিন্তু সে সব হেলা করে ইসাবেলাকে বাঁচাতে শেষমেশ প্রাণ দিলো। চাইলে একাই নিরাপদে ফিরে যেতে পারত। সমাজে ওর প্রয়োজন ছিল। ইসাবেলা জানে সেটা। ভ্যালেরিয়া সে দায়িত্ব হেলা করেছে কেবল ওর জন্য। তাকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছাতে গিয়ে নিজের মৃত্যু ডেকে আনল ভ্যালেরিয়া। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সে ইসাবেলার নিরাপত্তার কথা ভেবেছে। অন্যদিকে ইসাবেলা কেবল নিজেকেই নিয়ে ভাবছে। প্রিয় ভ্যালেরির মৃত্যুর প্রতিশোধ নয়, নিজের জীবন বাঁচানোকে প্রাধান্য দিচ্ছে সে। ধিক্কার দেয় নিজেকে। চোখ দুটো ভীষণ জ্বলছে। ফের নোনা বর্ষণ হবে বুঝি।

“তুমি!”

পল বিস্মিত হয় ইসাবেলাকে দেখতে পেয়ে। ইসাবেলা অপ্রস্তুতভাবে হেসে বলে,

“হুম।”

“ট্রেন তো ছেড়ে গেল। বাড়ি যাবে না?”

ইসাবেলা না সূচক মাথা নাড়ায়। পল ভুরু কুঁচকে বলে,

“কেন?” তারপর বিস্মিত মুখে বলে,

“খবরদার! বলো না পুনরায় ফিরতে চাও আমার সাথে?”

ইসাবেলা আবার হাসে। সে জানে এই মুহূর্তে তাকে বোকাচন্ডি লাগছে। প্রয়োজন মানুষকে বোকা বানায়, আবার কেউ কেউ ইচ্ছে করে বোকা সাজে।

“মাথা খারাপ হয়েছে তোমার মেয়ে?” পল ধমকের সুরে বলে।

“নোভার সাথে জরুরি কথা আছে আমার। ফিরতেই হবে।” বলল ইসাবেলা। পল বিরক্ত হয়।

“আমি সেসব জানি না। আমাকে রাজকুমারী বলেছেন তোমাকে ট্রেনে তুলে দিতে, দিয়েছি। আমার কাজ শেষ। বিদায়।”

পল গাড়ির দিকে ঘুরতে ইসাবেলা বলে,

“তুমি আমাকে একা ফেলে যেতে পারো না।”

ঘাড়ের ওপর থেকে ইসাবেলার দিকে ফের ভুরু কুঁচকে তাকায় পল। তারপর মুখ সোজা করে কোচওয়ানের সিটে উঠে বসে।

“পরবর্তী ট্রেন ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে এসে পৌঁছাবে। পূর্বদিকে যাত্রী ছাউনি আছে। সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করো, যাও।”

মাছি তাড়ানোর মতো হাত নাড়ায় পল। নিজের ওপর এখন রাগ হচ্ছে ওর। কেন যে ওই গণিকার ফাঁদে পা দিয়েছিল! ইসাবেলাকে ট্রেনে তুলে টমটমে ফেরার পথে মেয়েটির সাথে দেখা। নিকোলাসের কাজের চাপ ইদানীং খুব৷ তার ওপর ইসাবেলার ওপর নজর রাখার দরুন মাস খানেক যৌন সম্ভোগের সুযোগ পায়নি। বোধহয় সে কারণেই মেয়েটির সম্মোহনী ইশারায় দ্রুতই সায় দেয়। প্লাটফর্মের পাশের ঝোপের আড়ালে টেনে নিয়ে যায় মেয়েটি তাকে। দেরি সে কারণেই হয়ে গেল। কে জানত ওই দেরি তাঁকে এমন বিপদে ফেলবে। এই মেয়েকে পুনরায় ফিরিয়ে নেওয়ার অর্থ রাজকুমারীর রোষানলে পড়া। নোভা তাকে এমনিতেই সহ্য করতে পারে না। কেন, কে জানে? এই মেয়েকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে দেখলে কী যে হবে! এসব চিন্তা করতে করতে চাবুকটা হাতে তুলে নেয়। ঘোড়ার পিঠে বাড়ি দেওয়া আগে শেষবারের মতো দেখতে চায় ইসাবেলাকে। কিন্তু কই সে? হাতের চাবুক ততক্ষণে ঘোড়ার পিঠে পড়েছে। ক্ষুরে ধুলো উড়িয়ে রব তুলে ছুটছে ঘোড়া। পল যাত্রী আসনে তাকাতে ইসাবেলাকে দেখল। ঠোঁটে সেই বোকা বোকা হাসি। ঘোড়া থামালো পল। রাগত গলায় বলল,

“নামো বলছি।”

“নাহ!” দৃঢ়তার সঙ্গে জবাব দিলো ইসাবেলা। পল কপাল কুঁচকায়।

“না?”

“না”

মুখটা রুক্ষ কঠিন হলো পলের। বলল,

“তোমাকে টেনেহিঁচড়ে নামাতে পারি, জানো?”

একটু ঘাবড়ে গেল ইসাবেলা। কিন্তু হাসল নিষ্পাপভাবে। বলল,

“আমি জানি, তা তুমি করবে না। জেন্টেলম্যান কি না।”

পল হঠাৎই নেমে এলো। যাত্রী আসনের মুখে এসে দাঁড়ায়। গলা শুকিয়ে যায় ইসাবেলার। পল হাত বাড়াতে সরে গেল পেছনে। কাঁপা গলায় বলল,

“ছোঁবে না। সু, সু।”

পল ওর হাত টেনে নামাতে গেলে আরেক হাতে শক্ত করে সিট ধরে রাখে ইসাবেলা। বেশ তাগড়া পুরুষ পল। বয়সও তো বেশি নয়। বোধহয় ত্রিশ হবে। ইসাবেলা ওর শক্তির সাথে পেরে উঠছে না। সুতরাং কেঁদে দিলো গলা ছেড়ে। পলের হাত থেমে গেল। ও ভাবল টানাটানিতে ইসাবেলা বুঝি ব্যথা পেয়েছে। এই মেয়েটি কাঁদলে পলের খারাপ লাগে। মানুষ হিসেবে হয়তো এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গত এক দশক রক্তপিপাসুদের দাস হয়ে থাকাতে মনুষ্য অনেক দোষ-গুনই ভুলেছে। তাছাড়া মানুষই বা কতটুকু ও। নিকোলাস এবং তার পরিবারের সেবায় সে যে কতশত মানুষকে ভুলিয়ে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলেছে, সঠিক হিসেবটাও আজ মেলাতে পারে না। মৃত্যুকে সামনে দেখে সেসব মানুষদের ভয়, বাঁচার আকুতিভরা রোদনেও সামান্যতম কষ্ট অনুভব করেনি। অথচ, যেদিন এই মেয়েটি ভরা বাজারে লাঞ্ছিত হলো, অসহায়ের মতো চিৎকার করে তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিল। সেদিন জেগে উঠেছিল পলের মৃতপ্রায় মনুষ্যত্ব। নিকোলাসকে সেই প্রথমবার অনুরোধ করেছিল কোনো মানুষকে বাঁচাতে। অবাক হয়েছিল নিকোলাস। কিন্তু কোনো প্রশ্ন করেনি। অনুগত দাসের মন রক্ষার্থে, ইচ্ছে পূরণ করতে ঝুঁকি নিয়ে বাঁচিয়েছিল ইসাবেলাকে। মালিকের নিকট ভীষণরকম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে মনে মনে পল। আজ সেই পুরনো কথা মনে পড়ল ইসাবেলাকে কাঁদতে দেখে। মেয়েটা তাকে জেন্টেলম্যান ভেবেছে। তাচ্ছিল্যের সুরে হাসল। জেন্টেলম্যান আর সে! বোকা মেয়ে।

“হয়েছে। আর কাঁদতে হবে না। যা চাও তাই হবে। তবে মনে রেখো, পস্তাবে তুমি।”

পল উঠে বসল কোচওয়ানের সিটে। ঘোড়া ছুটছে আবার। সিটে বসে তখনও নাক টানছে ইসাবেলা। হাতে সামান্য ব্যথা পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু হাউমাউ করে কাঁদার মতো নয়। নিজের নাটকীয়তায় নিজেই যেন অবাক হলো। কী থেকে কী হয়ে যাচ্ছে সে। শেষমেশ মিথ্যা কান্নার অভিনয়ও করল। তাও আবার নিখুঁতভাবে! ছোটো থেকে এসবে সে বড্ড কাঁচা। তাতিয়ানা বেশ পটু মেকি কান্নায় আর অভিনয়ে। ইসাবেলা মিথ্যা বলতে গিয়ে বারবারই ধরা খেয়েছে। যা হোক, এই মুহূর্তে পলকে বোকা বানাতে পেরেছে এতেই আনন্দিত এখন সে। গাড়ি যত সামনে এগোচ্ছে বুকের ভেতরের ঢিপঢিপানি বাড়ছে। কী বলবে নোভার সামনে গিয়ে? অনেক ভেবেও যুতসই জবাব খুঁজে পেল না। নিকোলাস! এই একটা নাম মনে পড়লে কলিজা শুকিয়ে একটুখানি হয়ে যাচ্ছে। ঘূর্ণাক্ষরেও যদি ও সত্যিটা জানতে পারে ইসাবেলার আর রক্ষা থাকবে না। বিড়বিড় করে একজনকেই স্মরণ করল,

“আগাথা”

“আমাকে স্মরণ করেছ তুমি?”

“আগাথা!”

ইসাবেলা বিস্ময়াহত হয় আগাথাকে পাশে বসে থাকতে দেখে। তারপর মনে পড়ল সে তো প্রেতাত্মা। ওর জোরালো শব্দ পলের কান পর্যন্ত যায়। ঘুরে তাকায় সে।

“কী!”

“ব্যথা! আমার হাতটাতে খুব ব্যথা।” হাতের দিকে চেয়ে কাঁদো কাঁদো ভাব করল। পলের দৃষ্টি নমনীয় হয়। তারপর সামনে ঘুরে বসে। নিঃশব্দে হাঁফ ছাড়ল ইসাবেলা। আগাথার মুখের দিকে তাকাতে দেখল, হাসছেন তিনি। একটু লজ্জিত হলো। পলের পিঠের দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল,

“আমার ভীষণ ভয় করছে আগাথা। নোভা আমাকে দেখলে ক্ষেপে যাবে। কে জানে হয়তো মেরেও ফেলবে।”

হাসলেন আগাথা। ঠিক নোভার মতো। চমৎকার, মুগ্ধতা মেশানো সেই হাসি। মাথা দুদিকে নাড়িয়ে আগাথা বললেন,

“ও তোমাকে মারবে না। আর না কাওকে মারতে দেবে। চিন্তা করো না।”

“আপনি কীভাবে সিওর হলেন?”

আগাথার ঠোঁটে সেই মনোমুগ্ধকর হাসি নেই। তার বদলে কুটিল হাসি দেখা গেল। ভুরু কুঁচকে যায় ইসাবেলার। আগাথা সেটা লক্ষ্য করতে মৃদু গলা ঝেড়ে স্বাভাবিক মুখে বললেন,

“আমি তো ওদের মা তাই। আচ্ছা, আমি এখন গেলাম। প্রয়োজন হলে আবার স্মরণ করো।”

ইসাবেলা ওঁর হাতটা চেপে ধরে বলে,

“অন্তত এইটুকু শিখিয়ে দেন নোভা যদি ফিরে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করে, কী বলব তখন?”

ইসাবেলার গালে পরম মমতায় হাত রেখে আগাথা বললেন,

“শান্ত হও, মাই প্রিসিয়াস। আমি আছি তো। এখন একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো।”

ইসাবেলার চোখ দুটো হাত দিয়ে বন্ধ করে ঘুমপাড়ানি ছন্দ আওতাতে লাগলেন। খুব বেশি সময় লাগল না ইসাবেলার চোখে ঘুম নেমে আসতে। ঘুম ভাঙল পলের ডাকে। আড়মোড়া ভেঙে জেগে দেখল গাড়ি থেমে আছে। পল দাঁড়িয়ে টমটমের মুখে।

“পৌঁছে গেছি আমরা। নেমে এসো।”

“এত তাড়াতাড়ি?”

পল মজা পেয়েছে কথাটা শুনে। ওর মুখ দেখে তাই বোঝা গেল। বিদ্রুপ করে বলল,

“হুম, প্রায় আট ঘণ্টা ঘুমালে তো পথ তাড়াতাড়িই শেষ হয়।”

“আট ঘণ্টা!”

তখনই আশপাশটা খেয়ালে এলো। বেশ অন্ধকার চারিদিকে। প্লাটফর্ম ছেড়েছিল তখন ছিল সন্ধ্যা। রাত কত হয়েছে এখন?

“কটা বাজে?”

নেমে প্রশ্ন করল ইসাবেলা। পল সামনে পা বাড়িয়ে বলল,

“একটু পরেই জানতে পারবে।”

সামনে বিরাট প্যালেস। ইসাবেলার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না, সে একজন প্রেতাত্মার কথায় প্রভাবিত হয়ে আবার ফিরছে পিশাচপুরীতে। বৈদ্যুতিক বাতির স্বল্প আলোতে যতসামান্যই বোঝা যাচ্ছে প্যালেসের বাইরের দিকটা। হঠাৎ ঢংঢং শব্দ করে বেজে উঠল প্যালেসের সামনের মিনারের ঘড়িটা। ঠিক দুটো বাজল। সচারাচর মিনারগুলোর ওপরে ক্রুশচিহ্ন থাকে। এই প্যালেসের সম্মুখভাগের মিনারে সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখা গেল। প্যালেসে এগোতে এগোতে ইসাবেলা এদিক ওদিক এক নজর দেখে নেয়। টমটমের ঠিক পরেই একটি কৃত্রিম ফোয়ারা। তার মাঝে দুটো মূর্তি। ওদিকে বৈদ্যুতিক আলো তেমন না পড়ায় মূর্তিদুটোর মুখ বোঝা যাচ্ছে না। মূর্তি দুটোর মাঝ দিয়েই পানি পড়ছে। প্যালেসের সামনে দিয়ে পাকা রাস্তা। তারই একপাশে দাঁড়িয়ে আছে দুটো ভিন্টেজ কার। একটার হুড খোলা, কিছুটা জিপ আকৃতির। রাস্তার দু’পাশে ছাঁটা সবুজ ঘাস। প্যালেসের শেষ দু মাথায় মাঝারি ধরনের কিছু গাছের সারি। আঁধার নেমেছে ওদিকটাতে। পল প্যালেসের সদর দরজা ঠেলে ঢুকল। ইসাবেলা ভীরু পায়ে এগিয়ে যায়। তখন আগাথা ঘুম পাড়িয়ে যে প্রশ্ন ভুলিয়ে দিয়েছিল, এখন আবার মনে পড়ে গেল। কী বলবে নোভার সামনে দাঁড়িয়ে? প্যালেসের হলঘরের ওপর বৃহৎ ঝাড়বাতি। কিন্তু পুরোপুরি জ্বলছে না ওটা। অনুজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে। সেই আলোতে দেখল পায়ের নিচের দামি মার্বেল পাথরে মোড়ানো পুরো হলঘর। খানিকটা লাল কার্পেটে ঢেকে আছে। হলঘরের একপাশে বিশাল বড়ো ডায়নিং। ঠিক সোজাসুজি সিংহাসন। ইসাবেলা জানে সিংহাসনটি কার? অবশ্যই দ্য গ্রেট পিশাচ নিকোলাসের। ঠোঁট বাঁকিয়ে ভেংচি কাটল ইসাবেলা। হলঘরে এই মুহূর্তে কেউ নেই। পল’কে খুঁজল। দেখা মিলল না কোথাও। একা এখানে ওখানে ভূতের মতো অনেকক্ষণ ঘুরল। দামি দামি আসবাবপত্র আর কিছু প্রতিচিত্র ছাড়া আর কিছুই নেই। হলঘরের মাঝ বরাবর প্রসস্থ সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলো ইসাবেলা। কড়িডোরেও মৃদু আলো। ধীর পায়ে এগোতে লাগল। পায়ে পায়ে ভয় ওর। প্রথম যে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় সেটা বন্ধ। পরের দুটোও তাই। তৃতীয়টাতে তালা নেই। বুক দুরুদুরু করছে। খুলবে কী খুলবে না? ইতস্তত কাটিয়ে দরজাটা ঠেললো। খুলে গেল সেটা। পস্তালো এবার ইসাবেলা। মেয়েলি শীৎকারে কানে আসতে অপ্রস্তুতভাবে জমে গেল সে। এই ঘরে বৈদ্যুতিক আলো নেই। ঘরের এককোনে জ্বলা ফায়ারপ্লেসের আলোতে দেখল বিছানায় হাঁটু মুড়ে বসা অর্ধনগ্ন একটি মেয়ে। মাথাটা পেছনে ঝুঁকে গেছে দৈহিক সুখে। হাতদুটো দিয়ে কাওকে জড়িয়ে ধরে আছে। যার ওপর বসে আছে তাকে অবশ্য দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু ওই দ্বিতীয় ব্যক্তির মাথাটা মেয়েটার ঘাড়ে। ওদিকটা অন্ধকার আর পর্দার ছায়ার কারণে ঠিকমতো দেখতে পেল না। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে মেয়েটি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েছে। তখনই ঠেলে সরিয়ে দিয়েছি দ্বিতীয় ব্যক্তি মেয়েটিকে। কিন্তু এখনও তাকে আড়াল করে আছে মেয়েটির শরীরের একাংশ। মেয়েটির বুক উন্মুক্ত। গলার পাশ দিয়ে তাজা রক্ত বেয়ে পড়ছে। শিউরে ওঠে ইসাবেলা। দ্রুত দৃষ্টি নামিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। বিছানা ছেড়ে নেমে রাগত মুখে মেয়েটি জিজ্ঞেস করে,

“কে তুমি?”

ভেবেছিল এই দরজাও বুঝি বন্ধ থাকবে ভেতর থেকে। কে জানত দরজার আড়ালে এসব চলছে। ভুলটা ওরই। নক করা উচিত ছিল প্রথমে। পিশাচ প্রাসাদের দরজায় নক? ইসাবেলা পা চালিয়ে দরজার কাছাকাছি যেতে মেয়েটা আবার প্রশ্ন করে। মাথা নাড়িয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুনল পরিচিত গলা।

“তুমি!”

প্রশ্ন ছিল না। আশ্চর্য যেন গলার স্বর। নিকোলাসের কাছে আশাতীত ছিল ইসাবেলার উপস্থিতি। গলা শুকিয়ে এলো ইসাবেলার। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তিটুকু পেল না ও। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে পরিচিত সেই ভারী পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে।

“বেলা!”

থেমে গেল ইসাবেলার হৃৎস্পন্দনের গতি। প্রাণটা যেন উঠে এসেছে গলার কাছে। মুখ তুলে তাকানোর সাহস নেই। নিকোলাস সামনে এসে দাঁড়ায়। পরনে টাউজার ছাড়া কিছু নেই। ওর নগ্ন বুক ইসাবেলার মুখের সামনে। ফায়ারপ্লেসের আগুনের রশ্মির ছটা নগ্ন পিঙ্গলবর্ণের বুকের লোমগুলোকে মোহনীয় করে তুলেছে। সেই গোলাপ আর সিম্বোলিক আকৃতির ট্যাটু খুব কাছ থেকে দেখতে পাচ্ছে আজ। ইসাবেলার ইচ্ছে হলো হাতটা দিয়ে ছুঁয়ে দেখার। কিন্তু একচুল নড়তে পারছে না। চোখের পাতা দুটো কেমন ঢলে ঢলে পড়ছে। অস্পষ্ট হয়ে এলো দৃষ্টি। নিকোলাসের গায়ের সেই সোঁদা মাটির গন্ধ নাকে লাগল। সর্ব শরীর কেমন নিস্তেজ বোধ হচ্ছে। নিকোলাসের হাতটা ইসাবেলার বাহুতে থামে। বেশ উষ্ণ স্পর্শটা। সে ডেকে ওঠে পুনঃপুন,

“বেলা, বেলা।”

ঘোর অমানিশা ছেয়ে যায় ইসাবেলার সামনে। পাখির পালকের ন্যায় মনে হলো শরীরটা। যেন হাওয়ায় ভাসছে। হঠাৎ একটা পেশিবহুল হাত তাকে জড়িয়ে ধরে। গালে লোমশ কিছু অনুভব করল। মাথাটা হালকা বোধ হচ্ছে। নাকে এসে লাগছে সেই সোঁদা মাটির গন্ধ! উঁহু! সোঁদা মাটির সুবাস।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here