#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৪০
Writer তানিয়া শেখ
ইসাবেলা নিজের রুমে ফিরে এলো। ওর ভয়, অস্থিরতা ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে। এই শীতেও ঘামছে। মাতভেইর রুমের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ওর শেষ কথাগুলো শুনেছে। পিশাচিনী! হ্যাঁ, তাই তো বলল ও। মাতভেইর বলা পিশাচিনীদের সাথে কি নিকোলাসের কোনো যোগসূত্র আছে? ইসাবেলার সন্দেহের তীর নিকোলাসের দিকে ছোটে। সেদিন রাতে নিকোলাস ওর রুমে এসেছিল। আর তারপরেই এসব ঘটনা! কাকতালীয় বলে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিতে পারে না। ওর মন আর মস্তিষ্কে বিবাদ শুরু হয়। মন বলে ইসাবেলাকে এরা সাহায্য করেছে জানার পর নিকোলাস মাতভেইর সাথে এমনটা করবে না। মস্তিষ্ক বলছে, পিশাচ ও। ওর মধ্যে মানবিকতা নেই। ও সব পারে। রক্তের নেশার কাছে সব তুচ্ছ। মস্তিষ্কের এই যুক্তি উপেক্ষা করতে পারে না ইসাবেলা, আবার মানতেও চায় না। মন মস্তিষ্কের এই বিবাদ একপাশে সরিয়ে তাশা আর তাতিয়ানার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে লাগল। পিতার ছায়া ছাড়া তাশার ভবিষ্যৎ সহজ হবে না। পদে পদে মানুষের কথা শুনতে হবে। তাশার জন্মের পর তাতিয়ানার উচ্ছৃঙ্খল জীবনে অনেকটা শৃঙ্খলতা এসেছে। মাতভেইর ভালোবাসা হয়তো ওকে পুরোপুরি বদলে দেবে। সুন্দর একটা সংসার হবে তাতিয়ানার। আন্না মেরিও, ওলেগসহ বাড়ির সকলে খুশি হবে তাতিয়ানাকে সংসারি দেখে। মাতভেই ফিরে পাবে প্রিয়তমাকে। বেচারা জানেও না ওর একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তান আছে। প্রিয়তমার গর্ভে নিজের সন্তান হয়েছে জানলে ও বুঝি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাবে। আর তাশা, সে বাবাকে পেলে কতোই না খুশি হবে। মাদাম আদলৌনা একমাত্র পুত্রের মুখ চেয়ে বেঁচে আছেন। ছেলেকে সুস্থ হতে দেখার স্বপ্নে প্রহর গুনছেন। মাতভেইর যদি কিছু হয়ে যায় তবে এতগুলো মানুষের জীবনের খুশিগুলো মুছে যাবে। তাশা কখনো বাবাকে পাবে না। মাতভেই জানবে না মেয়ের কথা। তাতিয়ানার জীবন স্বাভাবিক হবে না। মায়ের উচ্ছৃঙ্খল জীবনের প্রভাব পড়বে তাশার ওপর।
“আমার তাশার ভবিষ্যৎ নষ্ট হতে দেবো না আমি। মাতভেইর কিছু হবে না। কিছু হতে দেবোই না আমি।”
“কী করবে তবে?” পরিচিত গলা শুনে পাশ ফিরে তাকায়। আগাথা বসে আছেন।
“আপনি? কেন এসেছেন আবার? বলেছি তো আপনার কথামতো কিছু করব না।”
ইসাবেলা রাগ মুখে উঠে দাঁড়ায়। আগাথা হতাশ গলায় বলেন,
“আমি জানি।”
“জানেন তবে কেন এসেছেন? নতুন করে মিথ্যা বলতে? আমার ইমোশন নিয়ে খেলা করতে?”
ইসাবেলার রাগ গলে অশ্রুজল জমে চোখের কার্নিশে। আগাথা বলেন,
“তুমি ভুল বুঝছ আমায় ইসাবেলা। আমি তো কেবল তোমাকে সাহায্য করতে চেয়েছি এবং চাচ্ছি।”
তাচ্ছিল্যভরে হাসল ইসাবেলা।
“তাই! মিথ্যা বলা, আমার অনুভূতি নিয়ে খেলা করা বুঝি আপনার সাহায্য আগাথা?”
“আমি তোমায় মিথ্যা বলিনি__”
“আচ্ছা? বলেছিলেন বিকেলের পরে ছাড়া আপনি পৃথিবীতে আসেন না। অথচ, সেদিন দুপুরের আগে এসেছিলেন। ভেবেছিলেন নেশায় বুঁদ হয়ে ছিলাম খেয়াল থাকবে না সময়ের হিসাব। তারপর ম্যাক্সের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক আছে কি না জানতে চাইলে এড়িয়ে গেলেন। এসবের অর্থ কী দাঁড়ায় বলুন আগাথা? আপনি জানেন ভ্যালেরি আমার হৃদয়ে কতখানি জুড়ে আছে। আর তাই ওর মৃত্যুকে হাতিয়ার করে আমাকে দিয়ে নিজের কাজগুলো করিয়ে নিতে চেয়েছিলেন, ঠিক না?”
আগাথার নিরুত্তর মুখে চেয়ে কাষ্ঠ হাসল ইসাবেলা।
“আমার মন সরল আগাথা, কিন্তু বোকা নই আমি।দেরিতে বুঝলেও অনেক কিছুই বুঝি। ভ্যালেরি মৃত্যু সামনে দেখেও আমাকে পালাতে বলেছিল। ও বলেনি প্রতিশোধ নিতে৷ কারণ আমার ভ্যালেরি আমাকে কোনোদিন বিপদের মুখে ঠেলে দিতে চায়নি। আপনি নিজের স্বার্থে আমাকে বিপদের দিকে যেতে উৎসাহ দিয়েছেন। আমার বাঁচা মরাতে আপনার কিছু এসে যায় না, তাই না আগাথা?”
“আমার সব কথায় এখন মিথ্যা মনে হবে। তাই জবাব আজ আর দেবো না আমি। একদিন আমাকে বুঝবে। এই নিরুত্তর থাকার কারণ সেদিন তুমি উপলব্ধি করবে ইসাবেলা। আজ শুধু মাতভেইকে বাঁচানোর কথা ভাবো।”
ইসাবেলা সরাসরি তাকাল এবার আগাথার দিকে।
“আপনি মাতভেইর ব্যাপারটা জানেন?”
“হ্যাঁ, আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই এই ব্যাপারে। যদি তুমি রাজি হও।”
ইসাবেলা এই মুহূর্তে আর কোনো পথ দেখে না।
“কীভাবে বাঁচাব মাতভেইকে? ও যে আমাকে কিছুই বলছে না।” হতাশ মুখে বসল আগাথার পাশে।
“ওর বলার প্রয়োজন নেই। আজ রাতে আমি তোমাকে সব দেখাব। তৈরি থেকো।”
মাথা নাড়ায় ইসাবেলা। আগাথা অদৃশ্য হবে তখনই বলল,
“বিনিময়ে কী চান?”
আগাথা বললেন,
“আপাতত বিনিময়ের কথা না হয় থাক। মাতভেইকে বাঁচাতে হবে আমাদের। ওটাই মাথায় রেখো। আসি।”
আগাথা চলে যেতে মাদাম আদলৌনা ডিনারের জন্য ডাকলেন। ইসাবেলা নিচে গেল। মাতভেইকে ডাকতে সে জানায় আজ নিজের রুমে খাবে। মাদাম আদলৌনা বেশ বুঝতে পারছেন ইসাবেলা এবং মাতভেইর মধ্যে গুরুতর কিছু একটা হয়েছে। নয়তো মাতভেই একা একা ডিনার করতে চাইবে কেন? ইসাবেলাও প্রতিবাদ করছে না। ইসাবেলাকে আরেকবার জিজ্ঞেস করলেন ওদের মধ্যে কিছু হয়েছে কি না। আগের মতোই বলল, কিছু হয়নি। ইসাবেলার গম্ভীরতা দেখে আর বেশি প্রশ্ন করলেন না। খাবার আজ নিজেই নিয়ে গেলেন ছেলের রুমে। বিছানায় আধশোয়া হয়ে চোখ মুদে ছিল মাতভেই। মাকে দেখে স্বভাবসুলভ মৃদু হাসল। মায়ের সাথে অন্যদিনের মতো স্বাভাবিক কথাবার্তা বলল। তবুও কোথাও একটা খটকা লাগছে মাদামের। মাতভেই স্যুপ খাচ্ছে। মাদাম ওর অসাড় পা’টাতে হাত বুলিয়ে বললেন,
“ইসাবেলাকে কিছু বলেছ তুমি? মেয়েটা মুখ ভার করে আছে।”
ঠোঁটের কাছে নেওয়া স্যুপভর্তি চামচটা থেমে গেল। মায়ের দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা এড়াতে তাড়াতাড়ি আবার মুখে দিলো চামচ। শূন্য চামচ বাটিতে নামিয়ে হেসে বলল,
“তখন একটু মজা করেছিলাম তাতেই ওমন রেগে আছে। একটু পরে ডেকে মানিয়ে নেবো। চিন্তা করো না।”
মাদাম মাথা দোলালেন। চামচে স্যুপ নাড়াচাড়া করতে করতে একটুখানি ভেবে বলল,
“ও কী কিছু তোমাকে বলেছে মা?”
“কোন ব্যাপারে?”
মাতভেই মায়ের ভুরু কুঁচকে যাওয়া মুখটা দেখে জবাবটা বদলে ফেলল।
“ওর বাড়িতে চিঠি পাঠানোর ব্যাপারে?”
“চিঠি পাঠাবে না কি?”
“ভাবছিলাম আরকি।”
“ওহ! কিন্তু তা সহজ হবে না। জানোই তো লিথুনিয়া এখন জার্মানদের কব্জায়। ও দেশে চিঠি চালাচালি করছ টের পেলে ঝামেলা হবে। চিঠি পাঠানোও তো সহজ কাজ নয়। কে যাবে পোষ্ট অফিস?”
“আমিও সেকথা ভাবছিলাম। তবুও একটা চেষ্টা করে দেখব। এতদিন আপনজন ছেড়ে মেয়েটার কষ্ট হচ্ছে। কোনোভাবে রিগাতে পৌঁছে দিতে পারলেও ম,,মনে শান্তি পেতাম।”
“যাই করো সাবধানে। নতুন কোনো বিপদ আমি আর চাচ্ছি না বাবা।”
মাতভেই শেষ চামচ স্যুপ মুখে দিয়ে মাথা নাড়ায় হ্যাঁ সূচক। মাদাম আদলৌনা ট্রে হাতে উঠে দাঁড়ান। তাঁর যাওয়ার পথে চেয়ে থাকতে থাকতে চোখ ভিজে এলো মাতভেইর। ঠোঁট চেপে কেঁদেই দিলো একসময়। মা বড়ো একা হয়ে যাবে ভাবতেই কান্নার জল বাড়ল আরো।
তখন প্রায় মধ্য রাত। আগাথাকে অনুসরণ করে মাতভেইর রুমের দিকে চলল ইসাবেলা। নিঃশব্দে ভেজানো দরজা আরেকটু ফাঁক করে। উঁকি দিলো দুজন রুমের ভেতর। করিডোরের আলো নিভানো। মাতভেইর রুম অন্ধকার। জানালার পর্দা টানা। কিছুই দেখতে পাচ্ছে না ইসাবেলা। আগাথা অদৃশ্য হয়ে যায়। হঠাৎ জানালার পর্দা উড়ে সরে গেল একপাশে। পূর্ণ চাঁদ আকাশে। সেই আলোতে মাতভেইর রুমটা আস্তে আস্তে পরিষ্কার ইসাবেলার সামনে৷ দৃষ্টি থামল মাতভেইর বিছানার ওপর। নগ্ন দুটো নারীমূর্তি মাতভেইর ওপরে। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে ওরা। ইসাবেলা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে মাতভেইর চাপা গোঙানির শব্দ। নারীমূর্তি দুটির মুখ মাতভেইর গলায় ডুবে আছে। কিছুক্ষণ যেন শ্বাস ফেলতে ভুলে গেল ইসাবেলা। পিশাচিনীদের একজন মিহি হাসির শব্দ তুলে সরে এলো মাতভেইর গলার কাছ থেকে। ওদের মতো নির্বস্ত্র মাতভেই। চোখ নামিয়ে নিলো ইসাবেলা। এখন ও বুঝেছে কেন তখন মাতভেই সত্যি বলতে চায়নি। এই লজ্জা ঢাকতে এড়িয়ে গেছে সকল প্রশ্ন। আবার তাকাল সামনে। সরে আসা ডাইনিটা মাতভেইর কোলে বসেছে। কামনার সুখে ওর মাথাটা খানিক ঝুঁকে গেছে পেছনে। চাঁদের আলোয় ওকে চিনতে একটুও সময় লাগল না ইসাবেলার। নামটা মনে করার চেষ্টা করল।
“গ্যাব্রিয়েল্লা!” ক্রোধে ব্রম্মতালু জ্বলে ওঠে। ক্ষিপ্র গতিতে পা বাড়াতে কেউ টেনে ধরে। চেঁচিয়ে উঠতে গেলে মুখ চেপে ধরে পরিচিত হাতটা।
“বোকামি করো না। খালি হাতে লড়াইয়ে পেরে উঠবে না ওদের সাথে। ছিঁড়ে খাবে মুহূর্তে তোমাকে।”
আগাথার কথাতে নিজের ক্রোধের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনে ইসাবেলা। ফিরে তাকায় আরেকবার। দ্বিতীয় ডাইনিটা মাতভেইর ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে আছে। ওর মুখ ঠিক দেখতে পাচ্ছে না ইসাবেলা।
“ইভারলি।” আগাথা বললেন। ইসাবেলা দুহাতের মুষ্টি শক্ত করল। ওর সাধ্য থাকলে এক্ষুণি এই দুটোকে ও শেষ করে ফেলে। আগাথা টেনে নিয়ে এলো পাশের রুমে।
“নিকোলাস এর সাথে জড়িত?” রুমে ঢুকেই প্রশ্ন করল ইসাবেলা। মনে মনে একটু হাসলেন আগাথা। মুখটা স্বাভাবিক রেখে বললেন,
“হতে পারে আবার নাও পারে।”
“এতকিছু জানেন আর এটাতে দোনোমোনো?”
“নিকোলাসের আশেপাশে যাই না আমি।”
“কেন?”
আগাথা জবাব দিলেন না দেখে চাপা রাগটা বেরিয়ে এলো ইসাবেলার।
“এ কথারও জবাব দেবেন না? বাহ! চমৎকার। শুনে রাখুন, মাতভেইর সাথে যা হচ্ছে তাতে আপনার ছেলের সামান্যও যদি হাত থাকে ওকে আমি শেষ করে ফেলব।”
আগাথা জানালার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন৷ তাঁর ঠোঁটে ঝিলিক দিলো এক চিলতে হাসি। পেছনে দাঁড়িয়ে অধৈর্য হয়ে উঠল ইসাবেলা,
“বলুন কী করে ওদের শেষ করব আমি।”
“আমি ভেবেছি তুমি মাতভেইকে বাঁচানোর উপায় জানতে চাইবে।”
ইসাবেলা কপাল কুঁচকে বলে,
“কথা তো একই।”
“তুমি বললে তাই।”
“কী বলতে চাইছেন?”
“গ্যাব্রিয়েল্লাকে এই রূপে দেখে অবাক হয়েছে, না?”
“না, অবাক কেন হব? ও যে আপনার ছেলের রক্ষিতা ছিল তা তো আমি জানতামই৷ এখন আপনার ছেলের ভালোবাসার পিশাচী হয়েছে এতে অবাক হওয়ার তো কিছু নেই। আগে ইভারলি ছিল এখন গ্যাব্রিয়েল্লা যোগ হয়েছে। কদিন বাদে আরো মেয়ে হবে। আপনার ছেলের মতো পিশাচের কাছে এই তো আশা করা যায়। মোটেও অবাক হইনি আমি।”
ইসাবেলা বিছানার একপাশে গিয়ে বসল। দুহাতে শক্ত করে ধরল বিছানার কোণা। পা দুটো অস্থিরভাবে ফ্লোরে আঘাত করছে। আগাথা এসে বসলেন ওর পাশে। কাঁধে হাত রাখতে ইসাবেলা অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠল,
“মাতভেইকে আমি মরতে দিতে পারব না। আমার বোন, বোনের মেয়ের ভবিষ্যৎ জড়িত ওর সাথে। ওকে বাঁচানোর উপায় বলুন। আমি আজ ওয়াদা করছি এর বিনিময়ে যা বলবেন তাই করব।”
আগাথা হাসলেন,
“তুমি সত্যি দেখি আমাকে স্বার্থপর ভেবে নিলে ইসাবেলা। একদিন প্রমাণ করে দেবো যতখানি স্বার্থপর আমায় তুমি ভাবো ততখানি আমি নই। তোমার বাঁচা এবং মরা দুটোতেই আমার এসে যায়।”
চলবে,,,