#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৪২
Writer তানিয়া শেখ
প্রচন্ড উত্তেজনায় কাঁপছে ইসাবেলার সর্ব শরীর। যে মেয়েটি ক্ষতিকর মশা-মাছি ছাড়া কোনো প্রাণী হত্যা করেনি, আজ সে কি না এক ডাইনি বধ করে এসেছে! ডাইনি হলেও তো ওর রূপ মানবীয়। শক্ত করে মুষ্টিযুদ্ধ দু-হাতের দিকে তাকাল। ইসাবেলার পবিত্র মন এই ঘটনা কিছুতেই সহজভাবে নিতে পারছে না। অনুভূতিরা সব জমে আছে বরফের ন্যায়। জীবন ওকে এ কোন মোড়ে এনে ছাড়ল? এই মোড়ে না আনলেই কি হতো না? ইভারলিকে ওকেই কেন মারতে হলো? ইসাবেলার কান্না আসছে না। বুকের ভেতর ভার হয়ে আছে। বারবার চোখে ভাসছে ইভারলিকে মারার ঘটনা। এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, ওমন নিষ্ঠুরভাবে কাওকে ও শেষ করেছে। মনটা স্তব্ধতায় ঢেকে আছে। হাতদুটো পেছনে আড়াল করে নিলো। উদভ্রান্তের মতো বেরিয়ে এলো প্রাসাদ থেকে। গ্যাব্রিয়েল্লার কথা সেই মুহূর্তে আর মনে পড়ল না। একপ্রকার দৌড়ে গেল লেকের দিকে। ওর দমবন্ধ হয়ে আসছে এখানে৷ থলে নৌকায় ফেলে নৌকা লেকের জলে ভাসালো। বৈঠা চালাতে গিয়ে বার বার হাত ফসকে যায়। কোনোরকমে লেকের এ পাশে এসে থলে কাঁধে তুলে দৌড়াতে লাগল সামনে৷
মাদাম আদলৌনা চার্চ থেকে ফিরছিলেন। হাতে ফাদারের দেওয়া পবিত্র জলভর্তি পাত্র। বাড়ির কাছাকাছি আসতে থেমে দাঁড়ালেন ইসাবেলার ফ্যাকাশে, বিপন্ন মুখ দেখে। ইসাবেলা অন্যমনস্ক হয়ে বাড়ির দিকে এগোচ্ছিল। মাদামকে প্রথমে খেয়াল করেনি।
“ইসাবেলা?”
নিকটে আসতে মাদাম আদলৌনার ডাকে চেতনা ফেরে। ক্ষণিক থমকে দাঁড়িয়ে রইল। ক্রমেই ওর মুখের ভাব বদলে যেতে লাগল। আতঙ্কিত হয়ে ওঠে ও। দৌড়ে এলো মাদামের কাছে। তাঁকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাত ধরে টেনে বাড়ির ভেতর নিয়ে এলো। দরজা ভেতর থেকে এঁটে দিয়ে ছুটল কিচেনে। মাদাম ওর এই আচরণে বিস্মিত হলেন। কিছুক্ষণ পরেই বেরিয়ে এলো ইসাবেলা। হাতে এক ঝুড়ি রসুন। ঝুড়িটা মেঝেতে রেখে হড়বড়িয়ে বলল,
“মাদাম, সুই আর সুতো নিয়ে আসুন।”
বিস্ময় পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠেননি মাদাম। সহজ গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
“কেন? আর এই রসুন দিয়ে কী করবে?”
“পরে বলছি, আগে সুই সুতো আনুন প্লিজ।”
সুই সুতোর বাক্সটা বসার ঘরের এককোণে রাখা সেলফেই ছিল। পবিত্র জলের পাত্রটা টেবিলে রেখে মাদাম এনে দিলেন সুই সুতো। পালিত প্রাণীগুলোর আকস্মিক মৃত্যুতে তাঁর মনটা এমনিতেই ভীষণ খারাপ। খানিকক্ষণ একা, নীরবে থাকতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু
এখন ইসাবেলার এই অদ্ভুত আচরণে বিরক্তই হচ্ছেন। ইসাবেলা সুই সুতো নিয়ে রসুনের মালা তৈরি করছে। তাড়াহুড়োতে ওর আঙুলে সুই ঢুকে রক্ত বের হলো। ব্যথায় “উহু” করে উঠল। মাদাম চুপচাপ দাঁড়িয়ে এই পাগলামি দেখতে পারলেন না। ওর হাত থেকে রসুনের মালাটা টেনে নিয়ে রাগত গলায় বললেন,
“কী করছ এসব? হয়েছে কী?”
ইসাবেলা মাদামের মুখের দিকে কিছুসময় ভাবলেশহীন চেয়ে রইল। তারপর হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল দুহাতে মুখ ঢেকে। মাদাম আদলৌনার দৃষ্টি নরম হলো। কাছে এসে ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন।
“মাদাম, আমার ভয় করছে।”
ইসাবেলার এই ভয় কেবল মৃত্যুকে ঘিরে নয়। নিজের পবিত্র সত্ত্বাকে হারিয়ে ফেলার ভয়, মাদাম আর মাতভেইর জীবনে করুণ পরিণতি দর্শনের ভয় ওকে কাতর করে তুলেছে। ভয়কে জয় করতে গিয়েও পরাজিত হয়ে ফিরেছে। এই পরাজয়ের গ্লানি ওকে কাঁদিয়ে ছাড়ে। দুর্বল হয়ে পড়ে আগের চাইতে বেশি। মাদাম আদলৌনা ভাবলেন প্রতিবেশিনীর কথাতে বুঝি ভয় পেয়েছে মেয়েটা। যে সান্ত্বনা নিজেকে দিতে পারেননি তাই ওকে দিলেন,
“ওসব শোনা কথায় ভয় পেলে হয় না কি? ভয় পেয়ো না। ওগুলো ভিত্তিহীন কথা। ওসবের সত্যতা নেই।”
ইসাবেলা মাদামকে বুঝাতে চাইল নিজের ভয়ে কারণ, কিন্তু এই মুহূর্তে ওর মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোলো না। মাদাম ওর চোখ মুছিয়ে দিলেন।
“নাস্তা করেছে?”
দুদিকে মাথা নাড়ায় ইসাবেলা।
“মাতভেই?” পুনরায় প্রশ্ন করলেন মাদাম।
“না।”
মাদাম উঠে কিচেনে গেলেন। ইসাবেলা একদৃষ্টে চেয়ে রইল মেঝের দিকে। ঘড়ির পেন্ডুলামের ঢং ঢং শব্দে চমকে ওঠে। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল ফের। অর্ধেক বানানো রসুনের মালাটা হাতে তুলে নিলো। মাদাম নাস্তার ট্রে হাতে ওর সামনে এসে বসলেন। টোস্ট, ডিম পোচ আর কফির দিকে ফিরেও তাকাল না ইসাবেলা। মাদাম রসুনের মালার দিকে চেয়ে বললেন,
“এটা দিয়ে কী হবে?”
“ডাইনির পথ রোধ হবে।”
মাথা না তুলে থমথমে গলায় জবাব দিলো ইসাবেলা। মাদাম ভুরু কুঁচকালেন।
“ডাইনি?”
ইসাবেলা সে-কথার জবাব না দিয়ে মালা তিনটে থলেতে ভরে নিলো। হাতে নিলো কিছু রসুন আর থলেটা। দাঁড়িয়ে বলল,
“আসুন আমার সাথে।”
“নাস্তা করবে না?”
“এখন ওসবের সময় নেই।”
ইসাবেলা সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায়। মাদাম বড়ো বিভ্রান্তবোধ করছেন আজ। কিচেনে গিয়ে মাতভেইর নাস্তার ট্রে হাতে করে ওপরে এলেন। মাতভেইর রুমে এসে তাঁর হৃদপিণ্ড থেমে যাওয়ার উপক্রম। বিছানায় শুয়ে থাকা ছেলের মুখে চেয়ে স্তম্ভিত। গতকালও মাতভেইকে তিনি সুস্থ দেখেছেন। একরাতের ব্যবধানে ছেলের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে, মুখ সাদাটে হয়ে গেছে। ট্রে’টা টেবিলে রেখে ছেলের পাশে বসলেন মাদাম।
“মাতভেই, মাতভেই।”
পিটপিট করে দুর্বল চোখের পাতা খুললো মাতভেই। অস্ফুটে জবাব ডাকল,
“মা, মা।”
“বাছা আমার! এ কী হয়েছে তোর?”
কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলেন মাদাম আদলৌনা। মাতভেই উঠে বসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। মাদাম বসতে সাহায্য করলেন। মাতভেইর নজর তখন গেল জানালায় দাঁড়ানো ইসাবেলার দিকে৷ জানালার কাচে কিছু ঘষছে ও।
“কী করছ বেল?” ইসাবেলা শুনতে পেল না ওর ভগ্ন গলার স্বর। মায়ের দিকে তাকাল মাতভেই। মাদাম আদলৌনার মনে পড়ে জেভিয়ারের ছেলের কথা। পুত্রহারানোর ভয় পেয়ে বসল তাঁকে। হাওমাও করে কাঁদতে শুরু করলেন এবার। মাতভেই কিছুতেই মাকে শান্ত করতে পারছে না। অন্যদিকে ইসাবেলা জানালায় কী সব করছে। এত যে ডাকছে মেয়েটা সাড়া দিচ্ছে না। ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে এলো শরীর। মায়ের হাতটা কোলে নিয়ে চোখ মুদে বিড়বিড় করে বলে,
“কেঁদো না মা, কেঁদো না।”
জানালা আর দরজায় রসুন ঘষে মাতভেইর কাছে এসে দাঁড়ায় ইসাবেলা। মাদাম আদলৌনা সিক্ত চোখে তাকালেন ওর মুখে তারপর ওর হাতের রসুনের মালার দিকে। ইসাবেলা হাতের মালাটা গলায় পরিয়ে দিতে চকিতে তাকাল মাতভেই।
“এ কী!” বিরক্তি এবং বিস্ময় দুটোই স্পষ্ট মাতভেইর গলার স্বরে। টেনে ছিঁড়ে ফেলতে গেলে ধমকে ওঠে ইসাবেলা,
“খবরদার ওটা যদি ছিঁড়েছ! এটা গলায় থাকলে ডাইনিটা তোমার ধারের কাছে আসবে না।”
মাতভেইর চোখ বড়ো হয়ে যায়।
“কীভাবে জানলে?”
“গতরাতে সব দেখেছি। তাছাড়া আমিও একদিন তোমার জায়গায় ছিলাম মাতভেই। আমার গল্পটা অন্যদিন একদিন বলব। আজ আমাকে বিশ্বাস করে যা বলি শোনো প্লিজ। শুনবে তো?”
মাতভেইর চোখ ছলছল করে। মাথা নাড়িয়ে বলে,
“হ্যাঁ, শুনব। আমি মরতে চাই না বেল। আমাকে প্লিজ বাঁচাও।”
ইসাবেলা হাঁটু মুড়ে বিছানার পাশে বসে। ওর হাতটা ধরে বলে,
“আমাকে বিশ্বাস করো মাতভেই?”
“হ্যাঁ।”
“তবে বিশ্বাস রাখো, তোমাকে আমি মরতে দেবো না। তোমাদের আমি মরতে দেবো না।” মাদামের সিক্ত চোখে চেয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে বলল ইসাবেলা।
সারাটাদিন উদ্বিগ্নতায় কেটেছে তিনজনের। ইভারলিরকে শেষ করার ঘটনা শুনে মাতভেই এবং মাদাম আদলৌনা কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন। কিন্তু বিপদ এখনো মাথার ওপর। ইসাবেলা প্রাসাদের নিচটা ভালো করে খুঁজেও গ্যাব্রিয়েল্লার কফিন পায়নি। ইসাবেলা জানে গ্যাব্রিয়েল্লা আজ আবার আসবে মাতভেইর রুমে। প্রথমে ভেবেছিল ওরা বুঝি কেবল মাতভেইকে মারতে চায়। কিন্তু না, ওরা মাতভেইকে ওদের অন্ধকার জগতে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। গ্যাব্রিয়েল্লা যে কোনো মূল্যে এই পরিকল্পনা সফল করতে চাইবে। ইসাবেলা রাত হওয়ার অপেক্ষা করছে। বসার ঘরের পেন্ডুলাম বেজে ওঠে আবার। জানান দেয় মধ্যরাত হওয়ার। বসে বসে ঝিমুনিভাব এসেছিল ইসাবেলার। পেন্ডুলামের শব্দে সজাগ হয়। বিছানায় ঘুমিয়ে আছে মাতভেই। মাদামও বসে ঢুলছেন। তাঁর গলায় দ্বিতীয় রসুনের মালাটা। শেষটা এখনো থলেতে। সারাদিন কিছু খায়নি ও। পেট গুড়গুড় করছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। সারাদিন কেউ ই এই রুম ছেড়ে বেরোয়নি। মাতভেইর জন্য আনা খাবার দুপুরেই শেষ করেছে ও। এক ফোঁটা পানি নেই গ্লাসে। ইসাবেলা উঠে দাঁড়ায়। দরজার কাছে গিয়ে আবার ঘুরল। কী ভেবে থলেটা কাঁধে নিলো। সাহস বাড়ল এতে। মাদামকে আস্তে করে ডাকল,
“মাদাম, মাদাম।”
ধড়ফড়িয়ে উঠতে গেলেন মাদাম। ইসাবেলা চট করে তাঁকে শান্ত করল।
“হুঁশ। মাতভেই জেগে যাবে মাদাম।”
“কী হয়েছে?” আর্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন মাদাম। ইসাবেলা বলল,
“আমি নিচ থেকে পানির জগটা আনতে যাচ্ছি। আপনি ভেতর থেকে দরজা দিয়ে বসুন। আমি না ডাকলে খুলবেন না কিন্তু।”
ইসাবেলা দরজা খুলে মাথা বাড়িয়ে করিডোর দেখে নিলো। আজ কড়িডোরে আলো জ্বালানো হয়নি। ঘুটঘুটে আঁধার জমে আছে। মোমটা জ্বালিয়ে নিলো। মনে মনে ঈশ্বরের নাম নিয়ে বেরিয়ে এলো কড়িডোরে। মাদাম আদলৌনা দরজা লাগাবেন তখনই ইসাবেলা বলল,
“গলা থেকে রসুনের মালা খুলবেন না ভুলেও। আর হ্যাঁ, জানালাও খুলবেন না।”
“ঠিক আছে। তুমি তাড়াতাড়ি এসো মা।”
“আমি যাব আর আসব। দরজা লাগিয়ে দিন এখন।”
মাদাম দরজা লাগিয়ে দিতে ইসাবেলা মোমের আলো হাতে সাবধানে নেমে এলো নিচে। প্রথমেই হ্যাজাকটা জ্বালালো। তারপর কিচেনে থাকা সকালের তৈরি টোস্ট আর ডিম গপাগপ গিলে পানি পান করে। জগটা ভরে হ্যাজাক হাতে কিচেন থেকে বেরিয়ে আসতে দপ করে সদর দরজা খুলে গেল। প্রবল বেগে দমকা হাওয়া ঢুকল খোলা দরজা দিয়ে। ইসাবেলার বিপদ টের পেয়ে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে পা বেঁধে হুড়মুড়িয়ে পড়ল। হাতের হ্যাজাকটা গড়িয়ে পড়ে নিচে। জগটা পড়ে পানি ছড়িয়ে পড়ল সিঁড়িতে। ব্যাগটা কাঁধ থেকে খসে পড়ে। ইসাবেলা উঠে দাঁড়ায় সিঁড়ির রেলিং ধরে। হ্যাজাকটা নেবে বলে ব্যাগটা রেখে নিচে আসতে হাতটা গলার কাছে গেল। গলা শূন্য। রোজারি নেই। ভয়ে ওর জানটা লাফ দিয়ে গলায় কাছে চলে এলো৷ দ্রুত ঘুরে দাঁড়ায়। ওই তো সিঁড়িতে ছিঁড়ে পড়ে আছে রোজারি। সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতে কেউ পেছন থেকে ওর চুলের মুঠি চেপে ধরে শূন্যে তুলে ছুঁড়ে ফেলে সদর দরজার মুখে।
“আহ!”
আর্তনাদ করে ওঠে ইসাবেলা। ওর আর্তনাদের শব্দ ঢাকা পড়ে যায় গ্যাব্রিয়েল্লার হাসির খিলখিলানিতে। ইসাবেলা মুখ তুলতে সামনে একজোড়া পলিশ করা জুতো দেখতে পায়। ভেবেছিল নিকোলাস, কিন্তু নিকোলাস নয় ওর সামনে দাঁড়িয়ে রিচার্ডের ভয়ংকর পিশাচমূর্তি।
চলবে,,,
আপনারা ঠিকমতো রেসপন্স করেন না কেন? ☹️