#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৪৪
Writer তানিয়া শেখ
একজন যুবক যে ছিল ভীরু, দুর্বল। ব্যথা ভুলতে যে কাপুরুষের মতো মানুষ থেকে পিশাচ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পবিত্র আত্মা পাপের আগুনে পুড়ে ছাইয়ে পরিণত হয়। যে ছাই কেবল অন্ধকারকে অনুভব করেছে। মানবীয় সকল অনুভূতি হারিয়েছিল সেই আঁধারে। যার দৃষ্টিতে আলো আছে সে পৃথিবীটা রঙিন দেখে। যুবকের দৃষ্টিতে আলো নেই, পৃথিবীটা ওর কাছে একরঙা, কালো। ওর হৃদয় পাপের ভারে হলো পাথর। সেই পাথর কারো কান্নায় গলেনি, দুঃখে কাঁদেনি। যে স্বার্থপর পৃথিবী যুবককে পিশাচে পরিণত হতে বাধ্য করেছে, সেই পৃথিবীর আলো মুছে দিতে বেপরোয়া হয়ে উঠল যুবক। জীবন্মৃত নয়, নিজেকে মৃত ভেবেছে সবসময়। মৃতের হারানোর ভয় থাকে না। যুবকেরও আর কোনো ভয় ছিল না। সে নিজেই হয়ে উঠেছিল ভয়ের আরেক নাম। আশ্চর্য! বহুকাল পরে আবার ভয় অনুভব করছে।
ইসাবেলা অ্যালেক্সিভ। এই মেয়েকে প্রথম দেখে নিকোলাসের পাথর হৃদয় জানান দিয়েছিল এখনো খানিক স্পন্দন তাতে অবশিষ্ট। চোখে ঘোর লেগে যায়, হৃদয়ে লাগে দোল। বহুকাল পরে সে এক নতুন অনুভূতির সম্মুখীন হয়। যাকে দুর্বলতা ভেবে বার বার দুরদুর করেছে। বার বারই নতুন উদ্যমে ফিরে এসেছে ওর মনের দুয়ারে। তিক্ত বিরক্ত হয়ে ইসাবেলাকে চিরতরে দূর করতে চায়। রওয়ানা হয় রিগার উদ্দেশ্যে। এই যাত্রা পথে দুজনে কিছুটা কাছে এলো। নিকোলাস বহুকালের স্বভাব ছেড়ে এক মানবীর প্রতি প্রকাশ করল ভালোলাগা। ভালোলাগার মানবীর কিছু হয়ে যায় এই শঙ্কায় শঙ্কিত থাকে। আগলে রাখতে শুরু করে। এদিকে ভেতরে ভেতরে চলে মহাযুদ্ধ। হৃদয়ের সাথে স্বভাবের, মনের সাথে মস্তিষ্কের। এই যুদ্ধে হৃদয়কে তুচ্ছ হতে হয় ম্যাক্সের সাথে ইসাবেলার সম্পর্ক জেনে। আবার নিষ্ঠুরতা দেখায় নিকোলাস। বিপদের মুখে আহত অবস্থায় ফেলে চলে যায়। এই চলে যাওয়া কেবল শরীরের। হৃদয়টা ততদিনে ইসাবেলাকে ধারণ করে নিয়েছে। কত কী করেছে হৃদয় থেকে ওকে ঝেড়ে ফেলতে, কিন্তু পারেনি। ফিরে এসেছে আবার ইসাবেলার দুয়ারে। দূর থেকে মাতভেই আর ইসাবেলার সান্নিধ্য দেখে জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়েছে। মনে মনে আশ্চর্য হয়ে ভেবেছে, মৃতের কি ব্যথাবোধ থাকে? যে বাতাসে ইসাবেলার গন্ধ পাওয়া যায় সেই বাতাস ছেড়ে গিয়েছিল নিকোলাস। ও ইসাবেলার জন্য ঠিক নয়, ইসাবেলাও ওর জন্য বেঠিক। এবার শুধু নিজের ভালো চিন্তা করল না, ইসাবেলার ভালো ভাবল। নিকোলাস জার্মানি বসে খবর পেল ইভারলির পরিণতির কথা। এর পেছনে কে দায়ী রিচার্ড খোলাখুলিভাবে জানায়নি। বলেছিল স্থানীয় কেউ একজনের কাজ। নিকোলাস মারতে আদেশ করে দেয়। ভাবেওনি যাকে মারতে আদেশ দিয়েছে সে আর কেউ না ওরই প্রিয়তমা ইসাবেলা। যখন পল সত্যিটা জানায় ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে৷ লিথুনিয়া এসে ইসাবেলার এই ভয়ংকর নির্মম রূপ ওকে স্তব্ধ করে দেয়। ক্রোধের আগুনে প্রজ্জ্বলিত চোখজোড়া নিকোলাসের হৃদয়ে যন্ত্রণার সৃষ্টি করে। ছুটে গিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করতে চায়, কিন্তু এবার দুরত্বের দেওয়াল তুলে দিয়েছে স্বয়ং ইসাবেলা। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রিচার্ড ইসাবেলাকে মারবে বলে প্রতিজ্ঞা করে। শুধু সে নয়, সমস্ত পিশাচ কমিউনিটির টার্গেট এখন ইসাবেলা। ওকে না মেরে এরা শান্ত হবে না। ভয়, নিকোলাসের ভয় আবার ফিরে এসেছে।
“কাউন্ট, কমিউনিটির নিয়ম অনুযায়ী ওই মেয়েকে আমাদের এখনই শেষ করতে হবে। এ কাজে আপনার অনুমতি চাচ্ছি আমরা।”
কমিউনিটির সদস্যের কথাতে নিকোলাস নিরুত্তর। রিচার্ড খেঁকিয়ে ওঠেন,
“অনুমতি দিচ্ছো না কেন তুমি? কেন ওই মেয়েকে মারতে বিলম্ব করছ নিকোলাস।”
“আপনি ভুলে যাচ্ছেন ছেলে নয় রাজার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। বড্ড বেশি ভুল করছেন ইদানীং।” দাঁতে দাঁত পিষে বলল নিকোলাস। রিচার্ড ছেলের অগ্নিদৃষ্টি দেখে গলা সামান্য নামালেও ঝাঁজ বজায় রেখে বললেন,
“বাহ! বেশ বলেছেন কাউন্ট। আমি ভুল করছি, হুম? এখানে ভুল যদি কেউ করে থাকে তবে সেটা আপনি কাউন্ট। আপনার ভুলে ইভারলি, গ্যাব্রিয়েল্লাকে হারাতে হয়েছে আমাদের। আপনার ভুলে কমিউনিটির দুজন সদস্যের ওমন পরিণতি হয়েছে। ওই মেয়েকে মায়া দেখিয়ে আমাদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে আপনি বাঁচিয়েছিলেন। মনে আছে তো কাউন্ট? এখানের সবার কিন্তু মনে আছে। জিজ্ঞেস করুন।”
নিকোলাস তাকাতে পিশাচ সদস্যেরা দৃষ্টি মেঝেতে সরিয়ে নেয়। পিতার বক্র জবাবে ক্রোধিত হলেও সেটা চেপে গেল নিকোলাস। রিচার্ড ক্রূর হাসল মনে মনে। আবার বলল,
“আজ দুজনকে মেরেছে কাল আরো দুজনকে মারবে ওই মেয়ে। সিস্টার ভ্যালেরিয়ার বংশধর বলে কথা। আমি আগেই সাবধান করেছিলাম। দেখুন এখন কী হলো। পিশাচদের জন্য থ্রেট হয়ে দাঁড়িয়েছে ও। অথচ, এখনো আপনি চুপ করে আছেন। ওই মেয়েকে মারতে আপনার এত ঔদাসিন্যে কেন কাউন্ট?”
“ঔদাসিন্য না ছাই। মরা গাছে বসন্তের হাওয়া লেগেছে।”
সোফিয়ার কটাক্ষে উপস্থিত সকলে ভুরু কুঁচকে তাকাল। নিকোলাসের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে।
“মা!” আন্দ্রেই সতর্ক করল মাকে। নোভা রেগে তাকায়। সোফিয়া নিষ্পাপ ভাব ধরে বসে রইল চুপচাপ। রিচার্ড স্ত্রীর দিকে চেয়ে মুচকি হাসলেন। হাসি স্থির রেখে নিকোলাসকে লক্ষ্য করে বললেন,
“ওহ! তবে এই কারণ? আমাদের কাউন্ট প্রেমে পড়েছেন?”
“রিচার্ড!”
নিকোলাসের চোখে রিচার্ড এবার সম্মান হারালো। বাবা ডাকের সম্মানটুকু ছিল লোক দেখানো। এখন সেটার বালাইও রাখল না নিকোলাস। ওর গর্জনে কেঁপে উঠল কক্ষটি৷ রিচার্ড ঢোক গিললো। কর্কশ গলায় নিকোলাস বলল,
“আপনি যথার্থই বলেছেন ভুল করেছি আমি। হ্যাঁ, করেছি ভুল। আপনাকে সম্মান দেখিয়ে এবং আপনার রক্ষিতাকে আপনার পাশে বসার অনুমতি দিয়ে ভুল করেছি। আজ তার দারুন মাশুল গুনছি। বড়ো বেশি স্পর্ধা দেখালেন আপনারা, বড়ো বেশি। এরপরে ক্ষমা নয় শাস্তি পাবেন আপনি এবং আপনার রক্ষিতা।”
“নিকোলাস! ভুলে যাচ্ছো ও আমার স্ত্রী এবং তোমার মা।”
“আর আপনি ভুলে যাচ্ছেন আমি রাজা, এটা আমার রাজত্ব। এখানে যদি কারো শাসন, হুকুম চলে তবে সেটা একা আমার। আপনি আপনার স্থান ভুলে গেছেন। আমাকে জ্ঞান দেওয়ার বেয়াদবি করছেন একবার নয় বার বার। আপনার সো কলড রক্ষিতা আমার মা নয়। এরপর তাকে আমার মা বলার দুঃসাহস দেখালে চরম শাস্তি পাবেন আপনি। এই রাজ্য আমার। আমার মতের ওপর কথা বলার স্পর্ধা কারো নেই। অথচ, আপনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে সেই নিয়ম বার বার ভঙ্গ করেছেন। আমি কাকে মারব না মারব তার কৈফিয়ত কাওকে দেবো না, কাওকে না। কারো স্পর্ধা থাকলে চেয়ে দেখুক কৈফিয়ত!”
নিকোলাস উপস্থিত সদস্যদের দিকে চ্যালেঞ্জ করে বলল। রিচার্ড ইশারা করতে নতুন এক পিশাচ যুবক দাঁড়িয়ে যায়।
“আমি চাই। ওই হারামজাদির প্রেমে পড়ে আপনি পুরো কমিউনিটির সবাইকে বিপদে ফেলবেন আর আমরা চুপ করে থাকব? এ হবে না। আমরা ওকে শেষ করে ফেলব আজই। শুধু ওর রক্ত খাব না, ওর দেহকেও ছিড়বে ফেলব। যেন মানুষ ওর লাশ দেখার পর আমাদের বিপক্ষে যাওয়ার সাহস আর কোনোদিন না দেখায়। এই পিশাচ রাজা মানুষ হওয়ার ভং ধরেছে। এর গোলামি আর নয় ভাইয়েরা। চলুন আজই এর বিদ্রোহ করি। ওই সিংহাসনের উপযুক্ত ও নয়। আমার সাথে আসুন। এই কাপুরুষ রাজার দাসত্ব আর নয়।”
যুবক তলোয়ার কোষমুক্ত করে। তলোয়ারের সূঁচালো অংশে রসুন ঘষা। ওর কথাতে আরো দুজন নিকোলাসের বিরুদ্ধাচারণ করল। নিকোলাস শ্লেষাত্মক হাসল। তারপর গর্জে উঠল,
“পল!”
দরজার বাইরে থেকে ছুটে এলো পল। হাতে কোল্ট এম ওয়ান নাইন হান্ড্রেড পিস্তল।
“পায়ে গুলি কর এদের।”
আদেশ করতে যে দেরি পলের হাতের পিস্তলের ট্রিগার চাপতে দেরি হয় না। পিস্তলের গুলিগুলো হলি ওয়াটারে ভেজানো৷ পিশাচ তিনজনের পা পুড়ে কালো ধোঁয়া উঠছে। চিৎকার করে হাঁটুর ওপর বসে পড়ল ওরা। নিকোলাস বিদ্রোহী প্রথম যুবকের সামনে এসে দাঁড়ায়। ওর হিংস্র দৃষ্টি যুবককে ভীত করে। রিচার্ডের দিকে ফিরে তাকায় সাহায্যের জন্য। নিকোলাস ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে। রিচার্ড ভয়ে পিছিয়ে যায়। নিকোলাসের ঠোঁটে ফুটে ওঠে বক্রহাসি।
“আমার গোলামি করবি না? সিংহাসনচ্যুত করবি আমাকে তোরা? এত সাহস?”
“প্রভু ক্ষমা করুন।”
অপর দুজন ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগল। নিকোলাস গর্জে উঠল,
“গোলামি করবি না? বেশ, মুক্ত করব আজ তোদের এই গোলামি থেকে। যা নরকে।”
হাওয়ায় অদৃশ্য হয়ে প্রথম প্রতিবাদি যুবকের পেছনে এসে দাঁড়ায়। মুহূর্তে ওর ধড় থেকে মাথা আলাদা করে। বাকি দুজনেরও একই অবস্থা। পল এসে ওদের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিলো।
নিকোলাস সিংহাসনে গিয়ে বসে। বলল,
“আর কে আছে কৈফিয়ত চায়? আর কে আছে আমার গোলামি থেকে মুক্তি চায়? কে আছে বেলাকে মারতে চায়? বেলা আমার শিকার। ওর সাথে আমি কী করব সেটা আমার ব্যাপার। আমার আদেশ অমান্য করে ওর দিকে কেউ হাত বাড়ালে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। কে আছে আমার বিরুদ্ধে যাবে? কে?”
উপস্থিত সকলে মাথা নত করে। এমনকি রিচার্ড আর সোফিয়াও বাধ্য হয়।
চলবে,,,
দুঃখিত আজ একটু বেশি দেরি হলো এবং কম লেখা হলো। সারাদিন ব্যস্ত ছিলাম