তিমিরে_ফোটা_গোলাপ পর্ব–৫৯ Writer তানিয়া শেখ

0
716

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৫৯
Writer তানিয়া শেখ

মা ভিন্ন হলেও একই পিতার ঔরসজাত বলেই হয়তো ভীষণ মিল রয়েছে আন্দ্রেই এবং নিকোলাসের চেহারায়। দীর্ঘদেহি গড়ন, চাহনিতে একই তীক্ষ্ণতা দুইজনের। দুই ভাইয়ের বৈসাদৃশ্য খুঁজতে গেলে প্রথমেই চোখে পড়ে দুজনের চোখের রঙ। নিকোলাস নীল চোখের অধিকারী। অপরদিকে আন্দ্রেইর চোখের রঙ ওর মায়ের মতো, ফিরোজা। দুই ভাইয়ের বয়সের ব্যবধান আন্দাজ করা মুশকিল। আন্দ্রেই যখন পিশাচে পরিণত হয় তখন ও সদ্য কৈশোর পেরোনো যুবক। পিশাচদের দৈহিক বয়স বাড়ে না। তবে মনোগতভাবে সময়ের সাথে সাথে ওরা আর সবার মতো পরিণত হয়। কিশোর সুলভ দেহে পরিবর্তন এনেছে আন্দ্রেই। শরীরচর্চা করে নিয়মিত। পেশিবহুল দেহ, সেমি লং চুলের কাট, খোঁচা দাড়ি আর পোশাক পরিচ্ছদের কারণে বয়সের তুলনায় বেশ বড়োই মনে হয় এখন ওকে। দুই ভাইয়ের অন্যতম বৈসাদৃশ্য ছিল আন্দ্রেইর তুলনায় নিকোলাস বড়ো বেশি নির্মম আর হিংস্র। কিন্তু আজ সেটা অতীত। আজ আন্দ্রেই নির্মমতার নতুন ইতিহাস গড়েছে। এক মুহূর্তে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছে বেনাস নীলসনের প্রাসাদসম বাড়িটিকে। ভিক্টোরিজাকে নিজের সহচরী বানিয়েছে। এই সবকিছুর মূলে কিছু কারণ অবশ্য রয়েছে। প্রথম কারণ নিকোলাসের কাছ থেকে ইসাবেলা নামক দুর্বলতাকে সরানো। নিকোলাস এখানে থাকলে সেটা অসম্ভব ছিল। তাই তো জরুরি প্রয়োজন দেখিয়ে সুকৌশলে নিকোলাসকে জার্মানি পাঠিয়েছে। এখন ওর পথে আর কোনো বাধা নেই। নিকোলাস ফেরার আগে ইসাবেলাকে এখান থেকে বহুদূরে পাঠিয়ে দেবে। নিকোলাসের ধরাছোঁয়ার বাইরে। একটা মেয়ে মানুষের জন্য কত দিনই বা শোক করবে ওর ভাই? একমাস? এক বছর? কিংবা আরো কিছুদিন। তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।

“আন্দ্রেই!”

ইসাবেলার ভীত গলার স্বর পুনরায় শুনল আন্দ্রেই। মেয়েটার মুখ ভয়ে সাদাটে হয়ে গেছে। আন্দ্রেই ধীর পায়ে ওর দিকে এগোয়। ওকে এগোতে দেখে পিছিয়ে যায় ইসাবেলা। কী করবে ইসাবেলাকে আন্দ্রেই? মেরে ফেলবে? ইসাবেলার রক্তের স্বাদ এখনও জিহ্বায় লেগে আছে। আন্দ্রেইর শ্বদন্ত বেরিয়ে এলো। ফিরোজা চোখের মণি রক্তের নেশায় লাল হয়ে ওঠে। আন্দ্রেইর মনে পড়ে ইসাবেলার সাথে প্রথম দেখা হওয়ার স্মৃতি।পরিচিত মহলে ক্যাসানোভা বলেই খ্যাত আন্দ্রেই। নারীদের মন আর দেহ নিয়ে খেলা ওর শখ, অভ্যাস। মা এবং ছোটোবোন নোভা ছাড়া কোনো মেয়েকে ও সম্মান করে না। নারীমাত্রই ওর কাছে দৈহিক চাহিদার নামান্তর। ইসাবেলাকে ও সেদিন তেমনই করে স্পর্শ করেছিল। আজ সেই ইসাবেলা ওর ভাইয়ের প্রেমিকা। থমকে দাঁড়ায় আন্দ্রেই। কেন যেন অস্বস্তি হচ্ছে এখন ইসাবেলার মুখ দেখে। নিকোলাস নিষ্ঠুরতার দিক দিয়ে মেয়ে-ছেলের বৈষম্য করে না। কিন্তু আন্দ্রেই ভিন্ন। ও প্রেমিক পুরুষ। মারলেও ভালোবেসে বড়ো আদর করে মারে। ইসাবেলার ক্ষেত্রে সেটা হচ্ছে না। সুতরাং আজ ইসাবেলাকে সে নিকোলাসের নিয়মেই মারবে। ও যখন ইসাবেলাকে মারবে বলে মনস্থির করেছে ঠিক তখনই পেছন থেকে কেউ সজোরে আঘাত করল মাথায়। ভুরু কুঁচকে পেছন ফিরে দেখল চশমা পরা এক যুবক ভীত মুখে দূরে সরে দাঁড়িয়েছে। যুবকের গলা চেপে ধরতে গিয়ে থেমে যায়। যুবকের গলার রোজারিওতে ঝুলন্ত ক্রুশটা ওকে থামতে বাধ্য করে। রাগে গজগজ করে পিছিয়ে যায় তিন কদম।

ইসাবেলা আন্দ্রেইর এই আগমনের কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। কী চায় ও? আন্দ্রেইর রাগত মুখে ক্রূর হাসি দেখা গেল। ইসাবেলার গলা শূন্য। আন্দ্রেই চোখের নিমেষে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

“কী চাই আমি? তোমার মৃত্যু।”

ইসাবেলার প্রশ্নবিদ্ধ মুখ চেয়ে মনে মনে হাসল আন্দ্রেই। তারপর বলল,

“তোমাকে মরতে হবে ইসাবেলা। আমার ভাইয়ের ভালোর জন্য তোমাকে মরতে হবে।”

আচমকা গলা চেপে ধরে। ইসাবেলা ওর হাত থেকে গলা ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। ওর মৃত্যুতে নিকোলাসের কী ভালো হবে? কেন বলল এ কথা আন্দ্রেই? আন্দ্রেই ওর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। ইসাবেলা খুক খুক করে কাশতে কাশতে বলল,

“আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে আন্দ্রেই।”

“বেশ। আরেকটু পর একেবারে নিভে যাবে তোমার প্রাণ প্রদীপ। এই তো চাই আমি।”

আরো জোরে গলায় চাপ দেয় আন্দ্রেই। ইসাবেলা শ্বাস নেওয়ার জন্য ছটফট করছে। মাতভেই কী করবে ভেবে না পেয়ে খালি হাতে এগিয়ে এলো। ইসাবেলা হাত নাড়িয়ে ওকে থামাতে চায়। মাতভেইর কিছু হলে তাশা পিতৃহীন হয়ে যাবে। তাতিয়ানার হয়তো সংসার হবে না। মাতভেইর পাওয়া হবে না প্রিয়তমাকে, জানা হবে না পুতুলের মতো একটি কন্যা আছে ওর। মাতভেই হয়তো ইসাবেলা ছাড়া তখন আর কিছুই ভাবেনি। আন্দ্রেইর চোয়ালের একপাশে সজোরে ঘুষি বসাতেই অদৃশ্য হয়ে যায় আন্দ্রেই। ইসাবেলা দপ করে মেঝেতে পড়ে। খুক খুক করে কেশে ওঠে। হা করে জোরে জোরে শ্বাস প্রশ্বাস নেয়। ভয়ে কাঁপছে রীতিমতো। ভয়কে এখনো জয় করে উঠতে পারেনি ইসাবেলা। কোন মানুষই হয়তো পারে না। নয়তো এই হাতে ও ইভারলি, গ্যাব্রিয়েল্লাকে একদিন নির্ভয়ে মেরেছিল। কিন্তু আজ আন্দ্রেইর সামনে দাঁড়িয়ে ভয় কাটাতে পারছে না কেন? মাতভেই হতবুদ্ধি হয়ে রইল কিছুক্ষণ। ওই যুবক মুহূর্তে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল? পুরো রুমটা ঝড়ের তান্ডবে তছনছ। মাদামের মৃতদেহ খাটের এককোণে পড়ে আছে। মাতভেই ইসাবেলাকে তুলতে ইসাবেলা দুহাতে জড়িয়ে ধরল। বিড়বিড় করে বলে,

“তুমি পালাও মাতভেই, পালাও।”

মাতভেই শুনতে পেল। অঞ্জলি ভরে ওর আর্ত মুখটা তুলে বলল,

“তোমাকে একা রেখে কোথাও যাব না আমি।”

“তোমাকে বাঁচতে হবে মাতভেই।”

“বাঁচলে দু’জনই বাঁচব নয়তো মৃত্যু ভালো।”

ইসাবেলা ওর চোখে চেয়ে চোখের জল ছেড়ে দিলো। আজ নিজেকে বড্ড দুর্বল মনে হচ্ছে। মাদাম আদলৌনার মৃত্যুতে শোকাভিভূত ও। শোক সবসময় শক্তি হয় না। মাতভেইর বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

“আমি মরতে চাই না মাতভেই। কত কী দেখার বাকি আমার। তোমাকে আর তাতিয়ানাকে একসাথে দেখতে চাই। আরো একজন আছে যাকে দেখলে তুমি হয়তো বাকরুদ্ধ হয়ে যাবে আনন্দে। আমি তোমার সেই আননঘন মুহূর্তের সাক্ষী হতে চাই মাতভেই। ও মাতভেই, আমি যে এখনও নিকোলাসকে বলিনি আমার মনের কথা। বলিনি আমি ওকে ভালোবাসি। আমি এখনই মরতে চাই না মাতভেই। নিকোলাসকে ভালোবাসাময় পৃথিবী না দেখিয়ে মরতে চাই না আমি।”

“তোমার কিছু হবে না বেল। আমি আছি তো।” মাতভেই ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। চোখ ছলছল করছে। ও কী পারবে ইসাবেলাকে বাঁচাতে? হঠাৎ পাশ থেকে কারো হাত তালিতে চমকে তাকায় দুজন। আন্দ্রেই আবার ফিরে এসেছে।

“চমৎকার দৃশ্য। কিন্তু আপসোস বেশিক্ষণ এই দৃশ্য স্থায়ী হবে না। অন্তিম যাত্রার সময় হলো। পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নাও।” ওদের দিকে রহস্যময় হাসি হেসে ডাকল,

“রিজা।”

পলকেই অদৃশ্য এক শক্তি ইসাবেলাকে মাতভেইর বুকের ওপর থেকে টেনে ছুঁড়ে ফেলে দরজার মুখে। মেঝেতে আছরে পড়ে ইসাবেলার দেহ। তীব্র যন্ত্রণায় চিৎকার করে ওঠে। মাতভেই ওকে বাঁচাতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। কালো ধোঁয়া ক্রমশ ইসাবেলার বুকের ওপর জড়ো হচ্ছে। ক্ষণিকের মধ্যে সেটা একটা নারী অবয়ব নিলো। কাজিন হওয়ার সুবাদে ভিক্টোরিজাকে ও আগে থেকেই চিনত। আজও চিনতে ভুল হলো না। কিন্তু আগের দেখার ভিক্টোরিজা আর এই ভিক্টোরিজাতে মিল কোথায়? এ যে হিংস্র এক ডাইনিতে পরিণত হয়েছে। ইসাবেলার বুকের ওপর বসে লোলুপ চোখে চেয়ে আছে। রক্তিম ঠোঁটের দুপাশে চকচক করছে ধারালো দুটো সাদা সূঁচালো দাঁত। এই একই দাঁত এই যুবকেরও আছে। তবে কী এও পিশাচ? মাতভেই আন্দ্রেইর দিকে ঘুরতে আন্দ্রেই ওর একেবারে সন্নিকটে এসে দাঁড়ায়। মাতভেই কিছু বুঝে ওঠার আগে ওকে সম্মোহিত করে ফেলল। চাইলেও এখন আর একচুল নড়তে পারছে না মাতভেই। আন্দ্রেই ওর ঘাড় ধরে মুখটা কানের কাছে নিয়ে বলে,

“হ্যাঁ, পিশাচ আমি। রক্তপিশাচ।” মাতভেইকে কিছু ভাবার অবসর না দিয়ে শ্বদন্ত ফুটিয়ে দেয় ওর গলার কাছে। ব্যথায় গোঙানি দিয়ে ওঠে মাতভেই। মাতভেইর রক্ত গলায় যেতে বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন আন্দ্রেইর শরীরে। মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। ওর গলায় উজ্জ্বল এক দ্রুতি দেখা গেল। ভীষণ অদ্ভুত অনুভূতি হলো ওর। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো মাতভেইর দেহটাকে মেঝের ওপর। পড়ামাত্রই অচৈতন্য হলো। গলা জ্বলছে আন্দ্রেইর। শব্দ করে কয়েকবার গলা ঝাড়ল। না জ্বলুনি কমছেই না। মাতভেইর দিকে ক্রোধিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। এই মানবের রক্তে কি লঙ্কা মেশানো? এত জ্বলছে কেন গলা? ঝড়ো হাওয়ার কারণে শূন্যে ভাসমান দ্যুতিময় পাপড়িবিচ্ছিন ফুলটা ছাঁদের সাথে লেগে ছিল। সবার অলক্ষ্যে একটা একটা করে শুকিয়ে যাচ্ছে এখন। শুকনো পাপড়িগুলো ভস্মীভূতের ন্যায় হাওয়ায় মিলিয়ে গেল একটা পর একটা। বাকি রইল পুষ্পবৃন্ত। সবুজ রঙের পুষ্পবৃন্তটি শুকিয়ে শূন্যে ভাসতে ভাসতে সেটি নেমে এলো নিচে। পড়ল ঠিক আন্দ্রেইর পায়ের কাছে। আন্দ্রেই খেয়াল করল না। পাশ কাটিয়ে চলে এলো মাতভেইর অচেতন দেহের সামনে। এই পর্যন্ত কত মানুষের রক্তই তো ও পান করল৷ কোনোদিন এমন গলা জ্বলেনি। আন্দ্রেই ভাবনায় পড়ল।

ইসাবেলা ভিক্টোরিজার এই রূপ দেখে স্তব্ধ হয়ে রইল। প্রথমে মাদাম আদলৌনার মৃত্যু, এখন আবার ভিক্টোরিজার পিশাচরূপ দেখে মনটা বিষাদে ভরে ওঠে। হঠাৎ ভাবে, বাড়ির বাকিরা ঠিক আছে তো? মনে পড়ে দরজার বাইরে শোনা সেই আর্তনাদ। এখন এই বাড়িটা নিস্তব্ধতা এক মৃত্যুপুরী মনে হতে লাগল ওর কাছে। এই মৃত্যুপুরীতে কেবল ও আর মাতভেই বুঝি বেঁচে আছে। মাতভেই! ভিক্টোরিজা আক্রমণ করতে উদ্যত হলে ইসাবেলা সমস্ত শক্তি দিয়ে ওকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। ডাইনিদের শরীরে অসুরের শক্তি। ইসাবেলা পরাজিত হওয়ার পথে। হঠাৎ ওর নজর যায় একটু দূরের মেঝেতে। মাতভেইর গলার রোজারিও ছিঁড়ে পড়ে আছে। কীভাবে ছিঁড়ল ওটা? বোধহয় ভিক্টোরিজা ওকে মাতভেইর বুক থেকে টেনে আনার সময় অসাবধানে ইসাবেলার হাতের টানে ছিঁড়ে গেছে। মাতভেইকে খুঁজতে লাগল। জানালার পাশের মেঝেতে পড়ে আছে ওর অচেতন দেহ। ওর দেহ খানিক আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে আন্দ্রেইর দীঘল দেহ। ও কী মেরে ফেলল মাতভেইকে? ইসাবেলা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে,

“মাতভেই, মাতভেই!”

না কোনো সাড়া নেই। ভিক্টোরিজা জিতে গেল। দাঁত বসিয়ে দিলো ওর ঘাড়ের কাছে। ইসাবেলা কী করবে এখন? মৃত্যুকে বরণ করে নেবে? এই জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে একজনকেই ওর মনে পড়ল। অস্ফুটে ডাকল,

“নিকোলাস।”

বন্ধ চোখে ভাস্বর হয় নিকোলাসের হাসিমুখ, ওর সাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলো। আর ওকে দেখবে না ভাবতেই সশব্দে কেঁদে ওঠে। এই জনমে বুঝি অপূর্ণই রয়ে গেল ওদের প্রেম। না, এভাবে মরবে না ও। শেষ লড়াইটা করবে ইসাবেলা।জামার ভেতরে কাঠের সূচালো টুকরোটা এখনও আছে। ভিক্টোরিজাকে মারতে ওর বড়ো কষ্ট হবে। অল্প সময়ে খুব কাছের মানুষদের একজন হয়ে উঠেছিল ও। মনকে সান্ত্বনা দিলো এই বলে যে, এ ওর চেনা সেই ভিক্টোরিজা নয় রক্তপিপাসু এক ডাইনি। চোখ মেলে গভীর শ্বাস নিলো। তারপর জামার ভেতর থেকে বের করে আনে কাঠের টুকরো। ঢুকিয়ে দিলো ভিক্টোরিজার হৃদপিণ্ড বরাবর। আর্তচিৎকারে ছিটকে সরে পড়ল দূরে। বেশ খানিক রক্ত পান করেছে। বড্ড দুর্বল লাগছে ইসাবেলার শরীর। আন্দ্রেই এদিকে আসার আগেই কোনোরকমে রোজারিও হাতে তুলে নেয়। রাগে হিংস্র হায়েনার মতো গর্জন করে আন্দ্রেই। ভিক্টোরিজার কাছে ঘেঁষতে পারছে না। কাঠের টুকরো এখনও ভিক্টোরিজার বুকের মধ্যে গেঁথে আছে। ইসাবেলা এই সুযোগ নিলো। থলেটা কাছাকাছি কোথাও পেল না। খালি হাতেই ও গিয়ে দাঁড়ায় ভিক্টোরিজার পেছনে। ইসাবেলার সাথে পেরে ওঠে না ভিক্টোরিজা। এক হাত ওর থুতনি নিচে রাখল আর অন্য হাতে গলা জড়িয়ে ধরে। আন্দ্রেই ওর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে চোখ রাঙিয়ে বলে,

“খবরদার ইসাবেলা।”

“তোমার মা আমারই সামনে আমার ভ্যালেরিয়াকে মেরেছে। আর আজকে তুমি আমার ভাগ্নির বাবাকে মারলে। খবরদার করছ? না শুনলে মেরে ফেলবে? বেশ তাই কোরো। নিকোলাস তোমাকে ছাড়বে না আন্দ্রেই। শেষ করে ফেলবে তোমাকে ও।”

আন্দ্রেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।

“বোকা মেয়ে। তোমার ধারণা ও তোমাকে ভালোবাসে? হাসালে। পিশাচরা নিজেকে ছাড়া কাওকে ভালোবাসে না। তোমাকে তো ও স্বার্থের জন্য ব্যবহার করেছে৷”

“তুমি বললে আর আমি বিশ্বাস করে নিলাম, হুম? আমার বিশ্বাস এত ঠুনকো না আন্দ্রেই।”

আন্দ্রেই বিছানার একপাশে এসে বসল। পায়ের ওপর পা তুলে গলায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“ঠুনকো নয় তবে অন্ধ। তুমি ভালো করেই জানো ও তোমার বংশকে ঘৃণা করে৷ জানো না বলো?”

“আমাকে ভালোবাসে ও।”

“মুখে বলেছে কখনও?”

ইসাবেলা জবাব খুঁজে পেল না সহসা৷ আন্দ্রেইর ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসি দেখা দিলো। ইসাবেলা কপট রাগে বলল,

“সবকিছু মুখে বলার প্রয়োজন পড়ে না আন্দ্রেই। আমি জানি নিকোলাস আমাকে ভালোবাসে।”

“ভ্রম তোমার। যে ভালোবাসে সে প্রকাশ না করে থাকতেই পারে না। নিকোলাস কোনোদিন তোমাকে ভালোবাসেনি আর না বাসবে৷ ও তোমাকে হাসিল করে ড্যামিয়ানকে শিক্ষা দিতে চায়। ড্যামিয়ানকে চেনো তো? আমি শতভাগ নিশ্চিত আমার চেয়ে বেশ ভালোভাবেই চেনা আছে ওকে তোমার। ঠিক বলেছি না ইসাবেলা?”

“স্টপ!”

আন্দ্রেই দু হাত শূন্যে তুলে মেকি অনুতাপের ভঙ্গিতে বলে,

“ওকে আ’ম সরি। রিয়েলি।”

“বাস্টার্ড, প্রথমে ভিক্টোরিজাকে শেষ করব। তারপর তোর ধড় থেকে গলাটা আলাদা করে নরকে পাঠাব তোকে আমি।”

“ওহ! আমি সত্যি ভয় পেয়েছি ইসাবেলা, সত্যি!”

মেকি ভয়ের মুখোশ ছেড়ে দাঁত বের করে হাসল আন্দ্রেই। রাগে মুখ লাল হয়ে ওঠে ইসাবেলার। ওর এই হাসি মুছে দেবে ইসাবেলা। ভিক্টেরিজার ধড় থেকে গলাটা আলাদা করে ছুঁড়ে ফেলে আন্দ্রেইর পায়ের কাছে। সোজা হয়ে বসল আন্দ্রেই। চোয়াল শক্ত করে চাইল ইসাবেলার কঠিন মুখের দিকে। রুমের এককোণে নিভু নিভু হ্যারিকেন এনে আগুন ধরিয়ে দিলো ভিক্টোরিজার মাথা বিহীন দেহে। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। আন্দ্রেই ভিক্টেরিজার মাথাটা হাতে তুলে ফুটবলের মতো আঙুলের ওপর ঘুরিয়ে বলল,

“তোমার কী ধারণা এই মেয়ের মৃত্যুতে আমার কিছু এসে যায়? না, না। মেয়েদের দেহ আর রক্ত ছাড়া আর কিছুতেই এই আন্দ্রেইর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। ও আমার পেয়াদা ছিল। ওর কাজ শেষ। এখন ও থাকল কি নরকে গেল তাতে আমার বয়েই গেল।”

ভিক্টোরিজার মুন্ডুটা ছুঁড়ে মারল ওর দেহ পোড়া জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে। ভিক্টোরিজার চোখ খোলা। আগুনে পুড়তে পুড়তেও ওই দুজোড়া চোখ যেন ইসাবেলাকেই দেখছে। ভীষণ কান্না পেল ইসাবেলার। কিন্তু কাঁদল না। ক্ষুব্ধ চোখে তাকাল আন্দ্রেইর দিকে। বলল,

“এমনই করে তুমিও একদিন জ্বলবে আন্দ্রেই। ঠিক জ্বলবে।”

“তোমার অভিশাপ বৃথা গেল। তোমার বলার আগেই জ্বলছি।” গলায় হাত বুলিয়ে বিরক্ত মুখে মনে মনে ভাবল। ইসাবেলা মাতভেইর অচেতন দেহের দিকে পা বাড়াতে আন্দ্রেই হাওয়ায় মিশে ওর কাছে আগে পৌঁছায়। ভিক্টোরিজাকে যেভাবে ধরে মাথা আলাদা করেছিল, তেমনইভাবে মাতভেইকে ধরেছে। ইসাবেলা আতঙ্কিত হয়ে থেমে যায়। আন্দ্রেই হাসে।

“ওকে আমি এখনও মারিনি ইসাবেলা। কেন জানো? কারণ আমার শিকার ও নয় তুমি। সিদ্ধান্ত এবার তোমার। হয় তুমি নয় ও।”

“ওকে তুমি মারবে না আন্দ্রেই।”

“আচ্ছা?” থুতনির নিচে চাপ দিয়ে মাথাটা পেছনে ঠেলতে ইসবেলা চেঁচিয়ে ওঠে,

“আমাকে মেরে ফেলো। ওকে ছেড়ে দাও প্লিজ।”

আন্দ্রেই ইসাবেলার হাতে প্যাঁচানো রোজারিওর দিকে তাকাতে ইসাবেলা ইতস্তত করে। মাতভেইর গলায় ফের টান পড়তে হাত থেকে খুলে ফেলে ওটা। সেকেন্ড সময়ও লাগে না মাতভেইকে ছেড়ে ইসাবেলার কাছে আসতে আন্দ্রেইর। গলা চেপে ধরে গর্জে ওঠে,

“এখন তুমি মরবে। তৈরি হও পরপারে যাবার জন্য।”

ইসাবেলার শ্বাসরোধ হয়ে আসে। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে,

“মৃত্যুর পূর্বে সত্যি বলবে আমায় আন্দ্রেই? নিকোলাস সত্যি কি ভালোবাসেনি আমাকে?”

আন্দ্রেইর হিংস্র চোখজোড়া এক মুহূর্তের জন্য নমনীয় হয়। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে পূর্বের রূপ ধরে বলে,

“সত্যি জেনে মরলে কি শান্তি হবে তোমার?”

“খুব হবে।”

আন্দ্রেই কেন যেন মিথ্যা বলতে পারল না।

“হ্যাঁ, ভালোবাসে ও তোমাকে। তোমার জন্য বদলে যাচ্ছে আমার ভাই। আমি চাই না ও বদলাক। তাই তো তোমাকে ওর কাছ থেকে দূর করব।”

ইসাবেলা আনন্দে কাঁদল। আন্দ্রেইর চোখে চোখ রেখে নির্ভয়ে বলল,

“তবে মারো আমায়। আমিও দেখতে চাই আমার মৃত্যু আমাদের মাঝে দুরত্ব আনতে পারে কি না। দূর করতে পারে কি না আমাকে নিকোলাসের কাছ থেকে। তুমি ভালোবাসোনি আন্দ্রেই। তাই জানো না এর শক্তি। দেহের সীমানা ছাড়িয়ে বহু উর্ধ্বে উঠে গেছে আমাদের প্রেম। আমাদের আত্মা ভালোবাসার রজ্জুতে পরস্পরের সাথে বাঁধা। আজ তুমি আমার কথা বুঝবে না আন্দ্রেই। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি, এই দিন তোমারও আসুক। ভালোবাসা তোমারও হোক, প্রেম তোমার হৃদয়েও দোলা দিক।”

“চুপ করো, চুপ করো।” আন্দ্রেই গলায় চাপ দিতে ইসাবেলা কাশতে লাগল। ওর মুখ বিবর্ণ হয়ে যায়। তবুও হেসে বলে,

“এত ভয় প্রেমকে তোমার? প্রেম তোমার হবে আন্দ্রেই, নিশ্চয়ই হবে।”

আন্দ্রেই ওকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় সামনে। চিৎকার করে বলে,

“প্রেম ভালোবাসা কোনোদিন হবে না আমার। ওসব কেবল দুর্বলদের হয়। আমি দুর্বল নই, শুনেছ তুমি?”

ইসাবেলার চোয়াল চেপে ধরে আবার বলে,

“তোমার মৃত্যু নিকোলাস আর তোমার মাঝের দুরত্ব ঘুচাবে না? ভুলবে না ও তোমাকে?”

“কোনোদিন না।”

“ছয় মাসও লাগবে না তোমাকে ভুলতে ওর। বিশ্বাস হয় না? ঠিক আছে, তবে আমি দেখিয়ে দেবো তোমাদের এসব থিয়েটারি প্রেম ভালোবাসার স্থায়িত্ব। বুঝিয়ে দেবো দুর্বল এক আবেগ এই ভালোবাসা। চোখের আড়াল হলেই যার অস্তিত্ব বলে কিছু থাকে না। মারব না আমি তোমাকে। কিন্তু এখানেও থাকতে দেবো না। নিকোলাসের কাছ থেকে বহুদূরে চলে যাবে তুমি। তোমার দেশ রাশিয়াতে।”

“না, নিকোলাসকে ছেড়ে আমি যাব না।”

“অবশ্যই যাবে। মাতভেইকে বাঁচাতে হলে যেতেই হবে তোমাকে। চাও না ও বাঁচুক? চাও না তাতিয়ানার সংসার হোক। তাশা পিতৃপরিচয়ে পরিচিত হোক? চাও না ইসাবেলা?”

“তোমার দোহাই লাগে আন্দ্রেই। এত নিষ্টুর হয়ো না। নিকোলাসকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকা যে মৃত্যুসম।”

“এই তো চাই আমি। তিলে তিলে তুমি মরো। তারপর যেদিন দেখবে নিকোলাস তোমাকে ভুলে গেছে সেদিন একেবারে মরবে। আমার বিশ্বাস সেদিন যথার্থ অর্থেই মৃত্যু হবে তোমার এবং তোমার বিশ্বাসের। এতেই তো আমার জিত।”

“তুমি পাষাণ, নির্মম। আমাদের কর্ম আমাদের দিকেই ফিরে আসে আন্দ্রেই। আজ আমাকে অসহায় পেয়ে যা করছ একদিন এর উচিত শাস্তি তুমি পাবে। সত্য চাপা থাকে না। নিকোলাস একদিন ঠিক জানতে পারবে। সেদিন ভাইকে মুখ দেখাতে পারবে তো আন্দ্রেই?”

আন্দ্রেইর নিস্পৃহ গলায় বলল,

“আমার চিন্তা তোমাকে করতে হবে না। বলো শর্ত মানবে কি না। মৃত্যু তোমার অবধারিত। বলো কোনভাবে মৃত্যু চাও? পরিবারের মুখে হাসি ফুটিয়ে না এখনই মাতভেইকে সাথে নিয়ে?”

ইসাবেলা জানে আন্দ্রেইকে অনুরোধ করে আর লাভ হবে না। ওর হৃদয় পাথর। ওতে মাথা কুটলে ব্যথাই জুটবে। এখনই মরবে না ও। নিজের ভালোবাসার ওপর আস্থা আছে। নিকোলাস ওকে ঠিক খুঁজে নেবে। সত্যিই যদি ইসাবেলাকে ও ভালোবেসে থাকে তবে দেখা আবার হবেই ওদের। ততদিন ইসাবেলা অপেক্ষা করবে। আন্দ্রেই অদৃশ্য হয়ে যায়। মাতভেই এখনও অচেতন। ইসাবেলা ওর মাথাটা কোলের ওপর নিয়ে নীরবে চোখের জলে মুখ ভাসালো। আন্দ্রেই কিছুক্ষণ পরই ফিরে এলো। বাইরে কোচওয়ানসহ ফিটন দাঁড়ানো। আন্দ্রেইর লোক কোচওয়ান। ইসাবেলা এবং মাতভেইরকে নিরাপদে রাশিয়া পৌঁছে দিয়ে আসবে সে। আন্দ্রেই মাতভেইকে কাঁধে তুলে হাওয়ায় মিশে গেল। অসাড় দেহে উঠে দাঁড়ায় ইসাবেলা। শেষবার মাদাম আদলৌনার মুখটা দেখে দু ফোঁটা চোখের পানি ফেলল। টলতে টলতে রুমে বাইরে এলো। হলঘরে পড়ে আছে জাস্টিনা সহ এ বাড়ির কয়েকজন ভৃত্যদের মৃতদেহ। এদের জন্য খারাপ লাগল। ইসাবেলা বাইরে ফিটনের সামনে গিয়ে থামে। আন্দ্রেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ইসাবেলার পা চলতে চায় না। ফিটনে উঠলে নিকোলাসের কাছ থেকে দূরে চলে যাবে। ও ভালোভাবেই জানে আন্দ্রেই নিকোলাসকে বিভ্রান্তকর তথ্য দেবে। রাশিয়া যাওয়ার কথা হয়তো বলবেই না। নিকোলাস কি সত্যিটা জানবে আদৌ? না, বিশ্বাস হারাবে না ইসাবেলা। ওদের ভালোবাসা এত দুর্বল নয়। এত সহজে ভুলে যাবে না নিকোলাস ওকে। ওদের মন ঠিকই একে অপরকে কাছে টেনে আনবে। ইসাবেলা শেষবার বেনাসের বাড়িটিতে চোখ বুলিয়ে ফিটনে উঠে বসে। কোচওয়ান ঘোড়ার পিঠে চাবুক চালাতে সামনে ছুটে চলে ঘোড়া। রাত্রির শেষ প্রহর শেষ হতে চলল। ইসাবেলা ফিটনের জানালা দিয়ে বেনাসের বাগানটা দেখে। কত স্মৃতি ভেসে ওঠে! হাঁটুতে মুখ গুঁজে শব্দ করে কেঁদে উঠল ও। ঘোড়ার খুরে মিশে ওর কান্না রাত্রির অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। পেছন ফিরল আরেকবার বেনাসের বাড়ির দিকে। ওর চোখ বিস্ফোরিত হয়ে যায় জ্বলন্ত বাড়িটিকে দেখে। ওদের থাকার রুমের খোলা জানালা অস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। একটা ছায়া মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। আন্দ্রেই!

ইসাবেলাকে নিয়ে ফিটনটি অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে আন্দ্রেই এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। মেঝেতে পড়ে থাকা মৃদু আলোর একটা জিনিস চোখে পড়তে থেমে গেল। ঝুঁকে হাতে তুলে নেয়। আশ্চর্য! ওর গলার জ্বলুনি একদম সেরে গেল। হাতের জিনিসটা ভালো করে লক্ষ্য করল ও। দেখতে শুকনো পুষ্পবৃন্ত মনে হলেও বেশ ভারী এটি। পাথরটি অনুজ্জ্বল সবুজ রঙের। নীলকান্তমণি নয়তো তো? কিন্তু আকারটা কেমন যেন। এসব পাথর দিয়ে ওর কী কাজ? ফেলে দিলো জানালার বাইরে৷ ওটা ফেলামাত্রই আবার সেই গলা জ্বলা শুরু হলো। এদিকে আগুন এই রুমকেও ঘিরে নিয়েছে। আন্দ্রেই জানালার বাইরে বেরিয়ে এলো। পাথরটা খুঁজতে শুরু করে। কী বিরক্তিকর অবস্থা! এখন কী ওকে এসব পাথর গলায় ঝুলিয়ে থাকতে হবে না কি? পাথরটা পেয়ে গেল বরফের ভেতর। হাতে নিতে গলা জ্বলা গায়েব। বড়ো অদ্ভুত লাগল ব্যাপারটা। এই পাথরের সাথে গলা জ্বলুনির সম্পর্ক কী? সম্পর্ক খুঁজে পাক আর না পাক বাধ্য হয়ে এই পাথর ওকে কাছে রাখতেই হবে৷ সামান্য একটা পাথরই তো। এ অনায়াসে রাখতে পারবে আংটি বানিয়ে কিংবা গলার লকেট করে। পাথরটা দেখতেও তো বেশ। পকেটে পুরে বাড়ির দিকে রওয়ানা হলো ও। ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই। আগামীকাল কত কাজ ওর।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here