#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৬০
Writer তানিয়া শেখ
আন্না মেরিও বসার ঘরের মুখে এসে দাঁড়ালেন। উদাস, বিমর্ষ মুখে জানালার বাইরে একদৃষ্টে চেয়ে আছে ইসাবেলা। কোলের ওপর বইটি খোলা। মেয়ের বিমর্ষতা আন্না মেরিওকে কষ্ট দেয়, ভাবিয়ে তোলে। গত এক বছর মেয়েকে হারিয়ে কেঁদে কেঁদে প্রহর কেটেছে। পিটারের দেওয়া কষ্টে মেয়েটা যখন বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিল, বুকে পাথর রেখে ভ্যালেরিয়াকে অনুরোধ করেছিলেন মেয়েটাকে সাথে নেওয়ার জন্য। মেয়েকে বাঁচাতে তখন ওই একটা পথই দেখেছিলেন। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ ছিল না তাঁর পক্ষে। ইসাবেলাকে তিনি কাছ ছাড়া করতে ভয় পান। ছোটোবেলা একবার কাছ ছাড়া করে চরম ভুল করেছিলেন। আজও ভীত হন সেই দিন স্মরণ করলে। মেয়েকে বাঁচাতে সেদিন ভয়টাকে গিলতে হয়েছিল। কিন্তু হজম করতে পারেননি। ইসাবেলা চলে যাওয়ার পর আন্না মেরিও একটা রাত ঠিকমতো ঘুমাতে পারেননি, এক মুহূর্ত তাঁর স্বস্তিতে কাটেনি। হঠাৎ একদিন ভ্যালেরিয়ার মৃত্যুর খবর এলো। সেই সাথে এলো ইসাবেলার নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ। পাগলপ্রায় হয়ে গেলেন আন্না মেরিও। বোনের মৃত্যু ও মেয়ের নিখোঁজ সংবাদ তাঁকে শোকাভিভূত করল। ওলেগ ছেলেকে সাথে করে কনিষ্ঠ কন্যার খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন। ফিরে এলেন শূন্য হাতে। আন্না মেরিও খেয়াল করলেন তাঁর স্বামী সারাক্ষণ কী এক ভয়ে ভীত থাকে। অজানা এক ভয় তাঁকেও আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে। ওলেগ সেই ভয়টাকে সেদিন বাড়িয়ে দিলেন।
আন্না মেরিওর বংশের প্রতিষ্ঠা পুরুষ ছিলেন একজন নেকড়ে লিডার। কিন্তু তিনি বিয়ে করেন সাধারণ মানবীকে। মেয়েটি জন্ম দেয় তিনটি সন্তান। একটি মেয়ে দুটি ছেলে। এঁরা প্রত্যেকে অর্ধ মানব অর্ধ নেকড়ে। তাঁদের প্রত্যেকের বিয়ে কোনো এক কারণে মানুষের সাথেই হয়। এভাবেই বংশ এগোতে লাগল। অর্ধ মানব থেকে ক্রমশ পুরোপুরি মানুষ হয়ে জন্মাতে লাগল পরবর্তী প্রজন্ম। কিন্তু তাঁদের রক্তধারায় নেকড়ের রক্তপ্রবাহ ঠিকই রয়ে গেল। কারো বেশি কারো-বা কম। কম বা বেশি থাকলেও সেটাকে অর্ধ মানব অর্ধ নেকড়ে বলা যায় না। আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতোই তাঁরা। এঁদের মধ্যে কয়েকজন ছিল লোভী ও অসৎ প্রকৃতির। মানব জীবন যেন তাঁদের ছোটো করত। গর্বের মনে করে নেকড়ে হওয়াকেই। নেকড়ে জীবন পেতে জড়োপাসক গ্রহণ থেকে শুরু করে নরবলির মতো জঘন্য কাজও তাঁরা করেছে। কতটা সফল হয়েছিল সে বিষয়ে পরের বংশধররা স্পষ্ট নন। তবে জনৈক এক সাধু পুরুষ একবার ম্যাক্সওয়েল বংশের একজনকে দেখে বলেছিল,
“অর্ধ নেকড়ে হয়ে ওরা আবার আসছে এই বংশে। একজন শান্তির কপোতি। অপরজন অশুভ, অমঙ্গল আর অধর্মের কপোতারি৷ একজন চন্দ্রদেবীর আশীর্বাদপুষ্ট, অন্যজন শয়তানের। এই দুইয়ের মিলনে জগতের ক্ষতি ছাড়া ভালো হবে না। কোনো এক আষাঢ়ি পূর্ণিমায় কপোতি এই বংশের আশীর্বাদরূপে আবির্ভূত হবে৷ কপোতারি ওকে হাসিল করতে পারলে হয়ে উঠবে মহা ক্ষমতাধর। পৃথিবীর সুখ, শান্তি চিরতরে মুছে দেবে ও৷ বেড়ে যাবে অশান্তি, দারিদ্র্য, দুর্দশা, জরা এবং পীড়া। শয়তানের রাজত্বে মানুষের জীবন হয়ে উঠবে দুর্বিষহ। ধীরে ধীরে পূন্যকে গ্রাস করবে পাপ। সর্বত্র ছড়িয়ে যাবে অনাচারে৷”
এ থেকে মুক্তির উপায় জানতে চাইলে তিনি এক কথায় বারংবার বলেন,
“ওফেলিয়া, ওফেলিয়া।”
এই গল্প বহুকাল পরেও প্রচলিত ছিল। আন্না মেরিও শুনেছিলেন তাঁর দিদার কাছ থেকে। ইসাবেলার যেদিন জন্ম হয় সেদিনও ছিল আষাঢ়ি পূর্ণিমা৷ আন্না মেরিওর দিদা তখনও বেঁচে ছিলেন। ইসাবেলার মুখটা দেখে তিনি খুশিতে আত্মহারা হয়ে যান। চাঁদ যেন ভূমিতে নেমে এসেছিল সেদিন।
পরক্ষণেই তাঁর খুশি ম্লান হতে হতে ভীত হয়ে ওঠে। আন্না মেরিও বুঝতে পারেন দিদার ভয়ের কারণ। এর মাস খানিক পরে দিদা মারা যান। প্রাণত্যাগের আগে আন্না মেরিওকে তিনি উপদেশ দিয়েছিলেন যৌবনে পা রাখলে ইসাবেলার যেন বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। দিদার কথার কারণে ছোটো থেকেই মেয়েকে আন্না মেরিও আগলে রেখেছেন। যৌবনে পা রাখতে পছন্দের পাত্রের সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু বিধিবাম। পিটার ফেরারি হলো। ইসাবেলার বিয়েটা আর হলো না। দিদার কথা আন্না মেরিও কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন কতবার। কিন্তু পরিস্থিতি দিদার কথাকেই যেন সত্য প্রমাণিত করতে চায়। ওলেগ যখন বলল, ভ্যালেরিয়ার মৃত্যুর কারণ স্বাভাবিক নয় তখনই পুরোনো ভয়টা ফিরে এলো। ইসাবেলা যার বাড়িতে ছিল সেই মাদামের গাঁয়ে গিয়েছিলেন ওলেগ। মাদামের অপ্রকৃতস্থতা এবং আত্মহত্যা, ইসাবেলার রক্তশূন্যতা ও ওর ভয় পাওয়ার সব ঘটনা প্রতিবেশীরা তাঁকে সবিস্তারে বলেছে। ভ্যালেরিয়া আসলে কী করত সেটাও ওলেগ ওখানে গিয়ে জানতে পেরেছেন। গ্রামটা থমথমে হয়ে ছিল ওই ঘটনার পর। ওলেগ কুসংস্কারমুক্ত চিন্তাধারার মানুষ। মেয়ের নিখোঁজের শোকেই হয়তো সেদিন গ্রামের লোকদের কথা প্রভাবিত করল তাঁকে। স্ত্রীকে আস্তে আস্তে সব খুলে বললেন তিনি। আন্না মেরিওর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। মেয়ে বিপদে পতিত জেনে তিনি ভেঙে পড়লেন। শয্যাশায়ী হলেন। বাড়ির বাকিদের দিনও চিন্তায় চিন্তায় কাটে।
ইসাবেলার নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ পিটার পর্যন্ত পৌঁছাল। রাতে আঁধারে ছদ্মবেশে এলো আন্না মেরিওর সাথে দেখা করতে। ইসাবেলাকে ও ভালোবাসে। চিরজীবন বাসবে। নিজের দায়িত্ব আর ভালোবাসার মাঝে ভালোবাসাকে বেছে নিয়েছিল। শেষপর্যন্ত সেই সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেনি। দায়িত্বের দায়ে ভালোবাসা বিসর্জিত হয়। দেশ এবং দেশের দারিদ্র্যপীড়িত অসহায় মানুষগুলোকে শুষে খাচ্ছে শোষকশ্রেণী। এদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেমেছে পিটার। পৃথিবীতে যত অনিয়ম, বৈষম্য সবকিছুর বিরুদ্ধে ওর লড়াই। বিপ্লবী ও। যুগের দাবির কাছে সবকিছু তুচ্ছ করে বিপ্লবীরা। ওদের চোখে সংসার দুঃস্বপ্ন, ভালোবাসা বাধা। এসব কারণে কোনোদিন ইসাবেলার সামনে নিজের মনের কথা প্রকাশ করেনি পিটার। প্রকাশ না করলেও বরাবরই ইসাবেলার প্রতি সূক্ষ্ম এক দুর্বলতা ছিল মনে। কখনো কষ্ট দিতে চায়নি মেয়েটাকে। কেবল নিজের দায়িত্বের কারণে ওকে ত্যাগ করেনি। পিটার জানত, ওর মতো বিপ্লবী, গৃহ উদাসী পুরুষের সাথে সংসার করে সুখ পাবে না ইসাবেলা। চিরজীবন দুঃখে জর্জরিত হওয়ার চেয়ে অল্প কিছুদিনের ব্যথা ভালো। কিন্তু কে জানত, ওর দেওয়া ব্যথা এমনভাবে ভাঙবে ইসাবেলাকে। হারিয়ে যাবে সবার কাছ থেকে। ভীষণ অপরাধবোধ হয় পিটারের। চিনচিনে ব্যথা টের পায় বুকের বা’পাশে।
আন্না মেরিও পিটারের প্রতি রাগ করতে পারেন না। বিয়ের কয়েকদিন আগেই ওর বিপ্লবী হওয়ার কথাটা তাঁদের কানে আসে। পিটার অস্বীকার করেনি বরং সেদিন বলেছিল, বিয়ে করা সম্ভব নয় ওর পক্ষে। যে কোনো সময় গ্রেফতার হতে পারে। ইসাবেলার যোগ্য পাত্র ও নয়। ইসাবেলার জীবন নষ্ট হোক পিটার তা কখনোই চায় না। কিন্তু কেউ শোনেনি ওর কথা। বিয়ের আগেই পুলিশ গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে হাজির হলো। পিটারের পালিয়ে যাওয়ার পথ প্রায় বন্ধ। নিজেকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করতে প্রস্তুত হয়। কিন্তু আন্না মেরিও তা হতে দেন না। পিটার তাঁর সন্তান তুল্য। সকলের অগোচরে পিটারকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন।
ইসাবেলার নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ শুনে সব বিপদ উপেক্ষা করে ও আবার এ বাড়িতে পা দিয়েছিল। যাওয়ার সময় পিটার কথা দিয়ে যায় ইসাবেলাকে খুঁজে বের করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। কয়েক মাস বাদে ওর একটা চিঠি পেয়েছিলেন তিনি। ইসাবেলার খোঁজে সূদুর জার্মানি পর্যন্ত গেছে পিটার। সংক্ষিপ্ত ছিল চিঠিটা। লিখেছিল, পরের চিঠিতে বিস্তারিত জানাবে। এরপরে বিশ্বযুদ্ধ ভয়াবহ রূপ নিলো। না পেলেন পিটারের চিঠি আর না পেলেন ওর কোনো খোঁজ। মাস গেল, বছর ফুরালো। আন্না মেরিও মেয়ের শোক কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারলেন না। রোজ চার্চে গিয়ে প্রার্থনা করেন মেয়ের মঙ্গল কামনায়। সন্তানকে ফিরে পাওয়ার আকুল প্রার্থনা করেন ঈশ্বরের কাছে। ঈশ্বর তাঁর প্রার্থনা অবশেষে শুনেছেন। ইসাবেলা ফিরে এসেছে আবার। সন্তানকে বুকে জড়িয়ে বুকের জ্বালা জুড়িয়েছেন আন্না মেরিও। মনে মনে ভাবলেন, দিদার কথা গল্পকাহিনী ছাড়া কিছু না। কিন্তু, কয়েকদিন যেতে তিনি লক্ষ্য করলেন ইসাবেলা তাঁদের মাঝে থেকেও যেন নেই। বুঝতে পারলেন গত এক বছরে খুব বদলে গেছে ও। যখন তখন হাসির মুখোশে ভেতরের ব্যথা, চিন্তা সব ঢেকে ফেলে। আগের ইসাবেলার আবেগ-অনুভূতি সহজে মুখের ক্যানভাসে ফুটে উঠত। এই ইসাবেলা ক্ষণে ক্ষণে মুখোশ পরে। কখনো হাসির, কখনো উচ্ছ্বলতার। কিন্তু এখনও সে মা’কে পুরোপুরি ফাঁকি দেওয়া শিখে ওঠেনি। কোনো সন্তানই হয়তো পারে না। ইসাবেলার উদাসিনতা, বারিধারা শেষে আরক্ত চোখ আন্না মেরিও দেখতে পান। দিনের বেশিরভাগ সময়ই ও এই জানালা অথবা নিজ কক্ষের জানালার পাশে বসে দূর রাস্তার পানে চেয়ে থাকতে থাকতে উদাস হয়৷ তিনি মেয়ের এই উদাসীনতার কারণ জানতে উদগ্রীব। কিন্তু ইসাবেলা বললে তো। কেউ সামনে এলেই ওর মুখ বদলে যায়। আন্না মেরিও ধীর পদে রুমের ভেতরে ঢোকেন।
“বেলা।”
বুকের ভেতর মুচড়ে ওঠে যতবার মায়ের মুখে নিজের এই ডাক নামটা শুনতে পায় ইসাবেলা। খুব বেশি মনে পড়ে তখন নিকোলাসকে। ও কি মনে করে ইসাবেলাকে?
“বেলা।”
মেয়ের জবাব না পেয়ে আবার ডাকলেন আন্না মেরিও। তাঁর পায়ের শব্দ ক্রমশ কাছে আসছে। ইসাবেলার মনটা বড়ো বিষণ্ণ, কাতর। এখনও একদৃষ্টে জানালার বাইরে চেয়ে আছে। আন্না মেরিও মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। পরম মমতায় শুধালেন,
“সারাদিন কী এত ভাবিস, মা?”
ইসাবেলা নীরবে শ্বাস ছেড়ে মায়ের মুখের দিকে তাকায়।
“কিছু না তো।”
জোরপূর্বক মুচকি হেসে দু’হাতে মায়ের কোমর জড়িয়ে বুকে মাথা রাখে। বরাবরের মতো মিথ্যা বলল। মা’কে মিথ্যা বললে খুব অপরাধবোধে ভোগে। কিন্তু সত্যিটাই বা বলবে কী করে? মা’র চোখে পিশাচরা পাপী, অভিশপ্ত। নিকোলাসকে যে মেনে নেবেন না তিনি। নিকোলাস! ওর কী মনে পড়ে ইসাবেলাকে?
মায়ের বুকে মাথা রেখে বড়ো শান্তি লাগে ওর। অশান্ত মন খানিক শান্ত হলো। মায়ের ছায়া যেন ওর বিরহ কাতর হৃদয়ে যন্ত্রণা উপশম প্রলেপ লাগিয়ে দেয়। বাড়ি ফেরার জন্য কত কী করেছিল গত এক বছরে। এই মাকে, পুরো পরিবারকে দেখবে বলে চোখ ক্ষয়ে যাচ্ছিল। আজ সবাই ওর কাছে তবুও কোথাও যেন নিগূঢ় শূন্যতা।
আন্না মেরিও মেয়ের মেকি হাসি বুঝতে পেরেও প্রকাশ করলেন না। মা মেয়ে দীর্ঘক্ষণ পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে রইল। দরজার কাছে পায়ের শব্দ পেতে দুজনই সেদিকে তাকায়। মাতভেই দাঁড়িয়ে আছে। ওর বুকের ওপর তাশা। বাবা- মেয়েকে দেখে আন্না মেরিও মুচকি হাসেন।
“এসো বাবা।”
মাতভেই ভেতরে ঢুকলো। মুখে আঙুল পুরে বাবার বুকে মাথা রেখে রুগ্ন চোখে চেয়ে আছে তাশা। কয়েকদিন যাবত ওর শরীর ভালো যাচ্ছে না। ঠিকমতো খাচ্ছে না, ঘুমাচ্ছে না। হঠাৎ হঠাৎ কেঁদে ওঠে। যেন কিছু দেখে ভীষণ ভয় পেয়েছে। ডাক্তার দেখিয়েও লাভ হয়নি। ইসাবেলা উঠে দাঁড়িয়ে তাশার সামনে দুহাত বাড়িয়ে বলে,
“খালামনির কোলে আয় সোনা আমার।”
তাশা ড্যাবড্যাব করে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর ঝুঁকে পড়ল খালার দিকে। ইসাবেলা কোলে তুলে নেয়। এই কদিনে তাশার ওজন যেন আরও কমে গেছে। সুশ্রী, কোমল মুখখানা রক্তশূণ্য ম্লান দেখায়।
“ও এত রোগা হয়ে যাচ্ছে কেন, মা?”
“আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। ডাক্তার কবিরাজ তো কম করছি না। তোর দিদা বলল, চার্চে গিয়ে ফাদারকে একবার দেখিয়ে আনতে। বাবা মাতভেই, তুমি আর তাতিয়ানা কাল সকালে একবার ওকে নিয়ে চার্চে যেয়ো।”
মাতভেই কিছু বলবে, পেছন থেকে তাতিয়ানা বলে উঠল,
“আমি একাই যাব। ওকে সাথে যেতে হবে না।”
মাতভেই আহত মুখে তাকাল ওর দিকে। বড়ো আশা নিয়ে এ বাড়িতে এসেছিল। ভেবেছিল তাতিয়ানার ভালোবাসা পাবে। কিন্তু পেয়েছে প্রত্যাখ্যান। এ বাড়িতে না এলে হয়তো জানা হতো না তাশার কথা। প্রথম দেখেই মেয়েকে চিনতে পারে মাতভেই। বাবা-মেয়ের মুখে বেজায় মিল। কিন্তু তাতিয়ানা মুখের ওপর অস্বীকার করল। যে কেউ এক দেখায় বলে দিতে পারবে এ যে ওরই ঔরসজাত। সুতরাং ওর অস্বীকার কেউ বিশ্বাস করেনি। বাড়ির সকলে মাতভেইকে তাশার বাবা বলে স্বীকার করেছে। তাশার মুখ চেয়ে মাতভেইকে গ্রহন করার পরামর্শ দেয় বাড়ির বড়োরা। তাতিয়ানাকে একরোখা, জেদি। মাতভেইকে কিছুতেই মেনে নেবে না ওর জীবনে। তাতিয়ানার ব্যবহারে মন ভেঙে যায় মাতভেইর। ওর চোখে মাতভেই একবিন্দু ভালোবাসা, ভালোলাগা খুঁজে পায় না। যদি কিছু পায় তা কেবল অপছন্দ। তাশার মুখ চেয়ে মাতভেই সব সহ্য করার সিদ্ধান্ত নিলো। পিতা হিসেবে তাশার জীবনে থাকার অধিকার ওরও আছে। তাতিয়ানা সেই অধিকার কেড়ে নিতে পারে না। মাতভেই তা কিছুতেই হতে দেবে না। রুষ্ট মুখে তাতিয়ানাকে বলল,
“কেন নয়? তাশা আমারও মেয়ে। ওর সাথে যাওয়ার অধিকার আমার আছে এবং আমি যাব।”
“তোমার মেয়ে? ভুলে যেয়ো না দশমাস দশদিন ওকে আমি গর্ভে ধারণ করে জন্ম দিয়েছিলাম। ও কেবল আমার মেয়ে।”
“রিয়েলি? তা তোমার গর্ভে ও এলো কী করে? তাতিয়ানা মারিয়া আলেক্সিভ, আমার বীর্য তোমার জরায়ুতে প্রবেশ করেছে বলেই তুমি তাশাকে গর্ভে ধারণ করতে পেরেছ। হ্যাঁ, আমি মানছি দোষ আমার আছে। তোমার গর্ভকালীন সময়ে আমি ছিলাম না। কিন্তু এই না থাকাটা তো ইচ্ছাকৃত ছিল না তাতিয়ানা। সেই অনিচ্ছাকৃত ভুলের শাস্তি আমার সন্তানের জীবন থেকে আমাকে তাড়িয়ে দিয়ে দিতে পারো না তুমি। এত কেন অপছন্দ করো আমাকে তুমি তাতিয়ানা?”
মাতভেইর গলা সামান্য চড়ে যায়। বাবা-মায়ের ঝগড়া দেখে তাশা কাঁদতে আরম্ভ করে। ইসাবেলা মাতভেইর বাহুতে হাত রাখতে শান্ত হলো ও। ভুলেই গিয়েছিল তিনজনের উপস্থিতি। তাতিয়ানা মুখ ফিরিয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে কান্না থামাতে লাগল। আন্না মেরিও আর ইসাবেলার দিকে চেয়ে মাতভেই লজ্জিত হয়। নিজের আচরণে অনুতপ্ত হয়ে আন্না মেরিওকে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করবেন মিসেস আলেক্সিভ।”
শেষবার মেয়ের ক্রন্দনরত মুখটার দিকে চেয়ে বিমর্ষ হয়ে বেরিয়ে গেল রুমের বাইরে। তাতিয়ানা ওর যাওয়ার পথে গম্ভীর মুখে তাকিয়ে থাকে। সত্যি বলতে মাতভেইকে ও অপছন্দ করে না, ওর জীবনে মাতভেইর উপস্থিতিকে অপছন্দ করে। ও চায় না মাতভেই ওর আর তাশার জীবনে থাকুক। কোনো পুরুষকে তাতিয়ানার প্রয়োজন নেই। একসময় হয়তো ছিল, সেটা অন্য কারণে। এখন ও একাই ভালো আছে। মাতভেই কেন ওকে ভালো থাকতে দিচ্ছে না?
আন্না মেরিও মেয়ের জেদটাকে বড়ো বেশি অপছন্দ করেন। মাতভেইর মতো ছেলেকে ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে পাপ করছে। ওর চোখে মেয়ের জন্য অগাধ ভালোবাসা দেখেছেন তিনি। অথচ, তাতিয়ানা ওকে অবজ্ঞা, অপমান করছে। মেয়েকে ভর্ৎসনার সুরে বলেন,
“তুমি ওর সাথে খুব খারাপ করছ তাতিয়ানা। এমনটা ও ডিজার্ভ করে না। জেদে অন্ধ হয়ে গেছো তুমি। তোমার কাওকে প্রয়োজন না হলেও তাশার জীবনে একজন বাবার খুব দরকার। ও বেচারা সব হারিয়ে এই মেয়ের মুখ চেয়ে বাঁচার অবলম্বন খোঁজে। তুমি তা থেকেও তাকে বঞ্চিত করছ। এত নির্দয় কী করে হলে তাতিয়ানা? তুমি কি সত্যি দেখতে পাওয়া না তোমার প্রতি ওর ভালোবাসা? অহংকার তোমাকে এতটাই অন্ধ করে দিয়েছে? এখনও সময় আছে শুধরে যাও। ভাগ্য যা দিচ্ছে হাত পেতে নাও কৃতজ্ঞতার সাথে। নয়তো পরে পস্তাবে।”
আন্না মেরিও রাগ করে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
তাতিয়ানা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে চুপচাপ রইল। ইসাবেলা ওর কাছে গিয়ে বলে,
“মাতভেই এখানে আসার আগে একমাত্র আপনজন মা’কে হারিয়েছে। তাশাই এখন ওর সব। ওর থেকে মেয়েটাকে আলাদা কোরো না তাতিয়ানা। তোমার মতো হয়তো পুরুষমানুষ চেনার চোখ আমার নেই। কিন্তু যতটুকু আছে তা দিয়ে যাচাই করে দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, মাতভেই খুব ভালো ছেলে তাতিয়ানা। ও তোমায় খুব ভালোবাসে। ছোটোবোন হিসেবে একটা অনুরোধ রাখো আমার, মাতভেইকে একটা সুযোগ দাও। তোমার ভগ্ন হৃদয় ও ঠিক যত্ন করে জোড়া দিয়ে দেবে। প্রকৃত তাতিয়ানাকে ফিরিয়ে আনার একটা সুযোগ ওকে দিয়ো তুমি।”
তাতিয়ানা বোনের দিকে নিস্প্রভ চোখে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর নিরুত্তর মেয়েকে কোলে করে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ইসাবেলা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বইটা হাতে তুলে রুমের দিকে পা বাড়ায়। কড়িডোরে দাঁড়িয়ে দেখতে পায় তাতিয়ানা তাশাকে কোলে করে মাতভেইর রুমের দিকে যাচ্ছে। এক চিলতে ক্ষীণ হাসি জেগে ওঠে ইসাবেলার ঠোঁটের কোণে। রুমে এসে বইটা বুকসেলফে রেখে জানালার পাশে বসল।
বসন্তের মৃদুমন্দ সমীরণ ইসাবেলাকে ছুঁয়ে যায়। লনের একপাশে ফুটে আছে অসংখ্য সাদা হলুদে মিশানো ডেইজি, রঙ বেরঙের বুনো ফুল। গাছে গাছে সবুজ পাতা দুলে দুলে ওঠে বসন্ত বাতাসে। একটু দূরে চেরি ব্লোসমের সেই অপার সৌন্দর্য। শাখে শাখে থোকায় থোকায় ফুটে আছে হালকা গোলাপি ফুল। বাতাসে মিষ্টি সুবাস ভেসে বেড়ায়। নীল আকাশটার দিকে তাকায় ইসাবেলা। আকাশ আর জমিন যেন সমস্বরে করছে বসন্ত বন্দনা। কিন্তু ইসাবেলার মনে বিরহের বেহালা বাজে। বেদনা বেধুর হয়ে ওঠে সমস্ত হৃদয়। নিকোলাসকে দেখে না প্রায় পাঁচ মাস। এই পাঁচটা মাস পাঁচ সহস্রাব্দের সমান ওর কাছে। কত রাতে চোখের জলে বালিশ ভিজিয়েছে। কত দিন বিগত হয়েছে বিরহের যন্ত্রণায় ছটফট করে। আজও একফোঁটা কমেনি সেই যন্ত্রণা। বরং দিনেদিনে বেড়ে যাচ্ছে। পাঁচ মাস আগে যে ভালোবাসা কুঁড়ি ছিল, এখন তা পরিণত হয়েছে। দুরত্বে ভালোবাসা কমে না। বহুগুণে বেড়ে যায়। তার অনুপস্থিতি তাকে আরো বেশি মনে করিয়ে দেয়। এত ফুলের বাহার, প্রজাপতির রঙ, পাখির কূজন, ভোরের শিশির বিন্দু, ওই নীল আকাশ, সন্ধ্যাতারা আর নিশুতিরাতে ডাকা ডাহুকের বিরহী গান সবকিছুতে তাকেই খুঁজে পায়। দৃষ্টিসীমার আড়ালে থেকেও সে যেন দৃষ্টির সর্বত্র। ইসাবেলা এমন করে কাওকে ভালোবাসেনি। কখনো দিনরাত জপেনি একই নাম,
“নিকোলাস, নিকোলাস।”
চলবে,,,
কপোতারি=বাজপাখি