#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব—৮২,৮৩
Writer তানিয়া শেখ
৮২
পুরো দু সপ্তাহ ঘুরানোর পর অবশেষে দেখা দিলো ড্যামিয়ান। রিচার্ড বসা থেকে উঠে দাঁড়ান। দু সপ্তাহের চেপে রাখা ক্ষোভ চোখেমুখে প্রকাশ পেল। ভয় পান বলে তা চেপে রাখবেন না। তাঁকে এভাবে অপদস্ত করার কোনো হক ড্যামিয়ানের নেই। নেহাৎ সিংহাসনটা চান বলে ওর কাছে নত হয়েছেন। নিকোলাসটা যদি তাঁর প্রতিপক্ষ হয়ে না যেত তবে কি এই ড্যামিয়ানের সাহায্য ভিক্ষা চাইতেন? সিংহাসন একবার দখলে আসুক সব শালাকে দেখে নেবেন।
ক্ষমতা, লোভ মানুষকে যেমন নীচ করে তেমনই মস্তিষ্কের সুস্থতা বিনষ্টেও বড়ো ভূমিকা রাখে। লোভের চাকচিক্যে নিজের বোকামিও দেখতে পায় না।
“তুমি নিজেকে কী __”
“পার্টনার, পার্টনার, ভীষণ মিস করেছি তোমাকে আমি।”
এমনভাবে ড্যামিয়ান তাঁকে আলিঙ্গন করল যেন পুরোনো কোনো বন্ধুকে বহুদিন পর দেখতে পেয়েছে। রিচার্ড রাগটা বাধ্য হয়েই গিলে ফেললেন। স্বার্থের জন্য এইটুকু না করে উপায় কী। রাগটা জমা থাক ভেতরে। সিংহাসনের জন্য কত কীই না করতে হবে। আলিঙ্গন মুহূর্ত বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। রিচার্ডকে আসন দেখিয়ে নিজ চেয়ারে গিয়ে বসল ড্যামিয়ান। টি টেবিলের দুপাশে দুজন। রিচার্ড কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ভেতর ঘর থেকে একজন সুশ্রী তরুণীর আগমনে থেমে গেলেন। তরুণীটির পরনে খোলামেলা দু টুকরো ছোটো পোশাক। উৎকট সাজ। হাতে মদিরা ও পানপাত্রের ট্রে। মেয়েটি তাঁকে একটি সুরা পাত্র ধরিয়ে দিয়ে আরেকটা নিয়ে বসল ড্যামিয়ানের উরুর ওপর। আদর সোহাগ দিয়ে সুরা পাত্রটি ড্যামিয়ানের ঠোঁটের ওপর ধরছে। লক্ষী ছেলের মতো সেও বসে বসে মেয়েটিকে সন্তুষ্ট করছে বলে মনে হবে। লক্ষী ছেলে! মনে মনে শ্লেষের সাথে হাসলেন রিচার্ড। লক্ষী ছেলেদের গুন থেকে লক্ষ ক্রোশ দূরের চরিত্র এই শয়তানটার। সুদর্শন চেহারার আড়ালে লুকিয়ে আছে ভয়ংকর এক শয়তান। খুব সাবধানে ওদেরকে দেখছিলেন রিচার্ড। কোনো তরুণীকে এখন পর্যন্ত দ্বিতীয়বার ড্যামিয়ানের সাথে দেখেননি। এই মেয়েটি নতুন। বাকিদের মতো এর ভবিষ্যতে কী লেখা আছে তার কিছুটা হয়তো ধারণা করতে পারছেন তিনি।
“তারপর বলো পার্টনার, হঠাৎ কী মনে করে?”
“হঠাৎ? তুমি কি ভুলে গিয়েছো আমাদের মাঝের চুক্তি? আজ একটা বছর হতে চললো অথচ, নিকোলাসকে হারানোর কোনো লক্ষণ বা চেষ্টা কিছুই দেখছি না৷ তুমি যদি ভাবো আমাকে ধোঁকা দেবে তবে মনে রেখো তা অত সহজ নয়।”
“চুক্তি, ধোঁকা? শব্দদুটো বলার আগে একবার ভেবে নিলে না পার্টনার?”
“হেঁয়ালি শুনতে আসেনি। যা বলবে পরিষ্কার করে বলো।”
“চুক্তির শর্তমতে তোমারও কিছু দেওয়া ছিল, দিয়েছ?”
রিচার্ডের মাঝে এখনও তিল পরিমাণ অবশিষ্ট থাকা পিতৃত্ব তাঁকে বাধা দিয়েছে। বলেছে এ অন্যায়, পাপ! রিচার্ড থমকে গেছে। মেয়েটা তাঁদের মতো হয়েও তাঁদের একজন না। ওর মুখটা দেখলে প্রিয়তমা মৃত স্ত্রীর কথা মনে পড়ে। কিন্তু লোভ তাঁকে এমনভাবে দাস বানিয়ে ছেড়েছে যে সকল আত্মীয়তা আজ তুচ্ছ। তুচ্ছ হয়েছে বার বার।নোভালিকে উৎসর্গ না করলে সিংহাসন মিলবে না।
মানুষকে ম্যানুপুলেট করতে তাঁর জুড়ি নেই। কেন যেন ড্যামিয়ানের বেলাতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন। এই ড্যামিয়ানের মস্তিষ্ককে কেন বশ করতে পারেন না? সন্দেহ জাগলেও তা ভেদ করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন৷ ভয় তখনই পান তিনি। যা ভয় জাগায় তা না ঘাটায় ভালো। নোভালির বিনিময়ে যদি কার্যোদ্ধার হয় তাহলে খামোখা ওত ঘাটাঘাটির দরকার কী। ওর মতো দুর্বল মেয়ে পিতার কিছু তো উপকারে আসুক। ভেতরের শয়তানটার আবারও জিত হয়। বলেন,
“বলেছি যখন নোভালিকে তুমি পাবে।”
“পাবে বললে হবে না যে পার্টনার। এই সপ্তান্তে নোভালিকে আমি চাই।”
“তবে সিংহাসন কবে পাব সেটাও নির্দিষ্ট করে বলে দাও। চুক্তি মতে দুজনই সমান লাভ করব। সপ্তাহ শেষে তুমি লাভ করবে আর আমি আশায় থাকব? তা তো হবে না। নির্দিষ্ট দিন চাই।”
ক্লিনসেভ চোয়াল চুলকে ড্যামিয়ান বলল,
“যদি নির্দিষ্ট দিন না দিই কী করবে? চুক্তি ভেঙে দেবে? চলো তাই করি।”
ভড়কে যান রিচার্ড।
“চুক্তি ভাঙবে! না না।”
“কেন নয়? লাভটা যখন আমার বেশি তখন শুধু শুধু তুমি লস করবে কেন? চলো চুক্তি ভাঙি।” বেশ সিরিয়াস শোনাল ড্যামিয়ানের গলা।
“চুক্তি ভাঙলে নোভালিকে তুমি পাবে না।”
“দরকার নেই। ও আর কী! সামান্য এক পিশাচ নারী।”
রিচার্ড দেখলেন প্রয়োজনটা ওঁরই বেশি। যার প্রয়োজন তাকে তো একটু নত হতেই হবে।
“ঠিক আছে, ঠিক আছে।” হতাশা ও অসহায়ত্বে দুহাত শূন্যে তুলে বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। দাঁতে দাঁত পিষে বললেন,
“তুমি নোভালিকে পাবে। যে সময় বলেছ তার মধ্যেই। কিন্তু মনে রেখো তারপর আমারটাও চাই। যত তাড়াতাড়ি দেবে ততই মঙ্গল। শুধু আমার একার নয় তোমার জন্যও। কারণ বেশিদিন বোনের নিখোঁজ সংবাদ গোপন থাকবে না নিকোলাসের কাছে৷ ও জানলে কী হবে আর বোধহয় তোমাকে মুখে বলার প্রয়োজন হবে না। আসি।” একপ্রকার ক্ষুব্ধতার সাথে দরজার দিকে হেঁটে গেলেন।
“ডার্লিং, নোভালিটা কে?” কোলের তরুণীটি আহ্লাদিত গলায় প্রশ্ন করতে ড্যামিয়ান রিচার্ডের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে জবাব দেয়,
“আমার মিস্ট্রেস।”
রিচার্ডের পা থামে। ড্যামিয়ান মুচকি হাসল তাই দেখে। রিচার্ড বেরিয়ে যেতে তরুণীর ঠোঁটের ওপর ঠোঁট বসিয়ে দিলো।
দিনের চাইতে রাত এখন বেশি প্রিয় ইসাবেলার। কেমন শান্ত আর সুন্দর। সূর্যের প্রখরতার চেয়ে চাঁদের মেদুর আলো ভালো লাগে। পাখির কলতান মিষ্টি কিন্তু নিশাচর আর ঝিঁঝিরডাক মাদকতা মেশানো। রাতটাকে আরও বেশি রোমান্টিক করে। নিকোলাসের সঙ্গ আর নিশীথের এত আয়োজন ইসাবেলার ভাবনা বন্য করে তোলে। কিছুটা নির্লজ্জ, কিছুটা বেপরোয়া। নিজেকে ভিন্ন ভিন্নভাবে আবিষ্কার করে তখন।
আর পাঁচটা কাপলের মতো হানিমুন হয়নি বলে মোটেও আপসোস নেই। নিকোলাস রোজ নতুন নতুন মনোরম স্থানে নিয়ে যায়। চাঁদের আলোয় পরস্পরের কাছে আছে। আজকাল আর ওই কয়েকটা উষ্ণ চুমু আর আলিঙ্গনে মন ভরে না। আরও কাছে চায়। মন ছাড়িয়ে দেহের সেই তীব্র আকর্ষণকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা কার? আদিম শরীরি উন্মত্ততা ওদেরকে সবকিছু ভুলিয়ে দেয়। মনে রাখে কেবল নিজেদের এবং একে ওপরের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা।
গভীর রাতের আঁধার ফিকে হতে লাগল। এবার ঘরে ফেরার পালা। কিছু সময়ের বিচ্ছেদ। ওইটুকু যে কী অসহ্যের তা কেবল ওরাই জানে। গ্রীষ্মের দাবদাহের চেয়েও প্রবল। এত যে কাছে পায় তবুও মন ভরে না। তবুও কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তীব্রতর হয়। এই রাতটাকে যদি মন্ত্র বলে স্থির করতে পারত নিকোলাস! কোথায় গেলো সেই মন্ত্র পাবে? নির্জন রাস্তা ধরে হাঁটছে দুজন। রাস্তার পাশে প্রাচীন বৃক্ষসারি। মাথাটা ভারে ওপর পাশের জমিনে নুয়ে পড়েছে। ছাউনির ন্যায় তৈরি হয়েছে। খানিক দূরে দূরে গাছগুলোর অবস্থান হওয়াতে চাঁদের আলো মাঝে মাঝে আলোকিত করেছে পথটা। পথ চিনতে কষ্ট হয় না। ইসাবেলার হাত নিকোলাসের মুঠোর মধ্যে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা শুকনো ডালের আচর লাগতে উঁহু করে উঠল ইসাবেলা। সামান্য একটা ডালের আচরে আর কী হয়? কিন্তু নিকোলাস তা মানবে না৷ প্রিয়সীর পা আর ছোঁবে না এই পথ।
“তোমার ভর আমার পিঠের ওপর দাও।”
ইসাবেলা জানে প্রতিবাদ করে লাভ হবে না। ভালো বউয়ের মতো কাঁধ জড়িয়ে স্বামীর পিঠে চড়ে বসল। দুজনে আবার পথ চলতে শুরু করে। এই পথ পায়ে হেঁটে না চললেও হয়। কিন্তু তাতে ইসাবেলার সান্নিধ্যে আরেকটু থাকা হবে না যে। পথের সঙ্গিনী হিসেবে ইসাবেলার চেয়ে আর কে উত্তম।
“নিকোলাস।” ইসাবেলা কাঁধের একপাশে মাথা রাখল। ঘুম ঘুম পাচ্ছে ওর। আবেশে চোখের পাতা ভারি হয়। নিকোলাস সামনের পথপানে চেয়ে বলল,
“হুম?”
“আই লাভ ইউ।”
মুচকি হাসল নিকোলাস। ইসাবেলার বলা এই তিনটি শব্দ অধিক প্রিয় নিকোলাসের। তারচেয়েও প্রিয় ইসাবেলা। ঘাড় ঘুরিয়ে প্রিয়তমা স্ত্রীর ঘুমন্ত মুখ দেখে কপালে আলতো করে চুমু দিলো। তারপর বলল,
“আই লাভ ইউ মোর দ্যান আই ক্যান সে, মাই অ্যাঞ্জেল।”
চলবে,,,,
#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব—৮৩
Writer তানিয়া শেখ
নিজ শহরে এসেছে পল। সাথে নিকোলাস। পলের বুক ধুকপুক করছে প্রাসাদের সামনে এসে। আজ ও নোভার সামনে নিজের মনের কথা প্রকাশ করবে। সারা পথ কথাগুলোকে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে। এখন মনে হচ্ছে সব আবার আগের মতো এলোমেলো হয়ে গেল।
নিকোলাস গাড়ি থেকে নেমে কোনো কথা না বলে সোজা নিজ কক্ষে চলে গেল। পুরোটা পথ গম্ভীর হয়ে ছিল। নববধূর থেকে আলাদা হওয়ার বেদনা বুঝি ওই গম্ভীরতা। আগামী একমাস ইসাবেলাকে দেখবে না ও৷ কথা বলারও তো সুযোগ নেই। ওই এক পত্র আলাপ ছাড়া। পল আগে হলে নিকোলাসের বিষণ্নতা বুঝতে পারত না। কিন্তু এখন বোঝে। নোভাকে ভালোবেসে পৃথিবীর সকল প্রেমিকের কষ্ট বোঝে।
গাড়ি পার্কিং করে ধীর পায়ে প্রাসাদে প্রবেশ করল। অপরাহ্ণেও এই প্রাসাদটিতে ভুতুড়ে নিস্তব্ধতা। এতে পল অভ্যস্ত। কিন্তু পদে পদে অগ্রসর হতে যে অস্থিরতার সৃষ্টি হচ্ছে তাতে ও মোটেও অভ্যস্ত নয়। যত যাই হোক আজ ও বলবেই নোভাকে। প্রত্যাখ্যাত হলে হবে। প্রত্যাখ্যান! কয়েক ধাপ ওপরের উঠতে পা থমকে যায় সিঁড়িতে। গলাটা শুকিয়ে আসে। বুকের বা’পাশ মথিত হয় নির্মমভাবে। কিছুক্ষণ লাগল এই দুর্বলতা কাটাতে। তারপর আবার ও একধাপ, দুধাপ এমন করে ওপরে উঠতে লাগল। নোভার কক্ষের দরজা পর্যন্ত আসতে মনে হলো পাহাড় চড়েছে৷ পৃথিবীর সর্বোচ্চ পাহাড়।
“একটা মেয়েকে ভালোবাসিস। একটা মেয়ে! তার সামনে ভালোবাসি বলতে এত ভয়! তুই কি পুরুষ? ছি!”
ওর ভেতর থেকে তিরস্কার এলো। পলের যে লাগল না তা নয়। হাজার হোক পুরুষ তো। সিনা টান করে বলল,
“ভয়? ওকে আমি একটুও ভয় পাই না। পিচ্চি একটা মেয়ে।” কিন্তু তখনই নোভার ক্রুর রক্তিম চোখ মনে পড়তে খুক খুক করে কেশে ওঠে। বুকে ঝড় তোলে ওর ডাগর চোখের কঠোর চাহনি। টানটানে সিনে হয়ে যায় সংকুচিত। তিরস্কৃত ভেতরের জনকে কটমট করে বলল,
“একটা মেয়ে, একটা মেয়ে বলছিস? জীবনে কাউকে ভালোবাসি বলেছিস যে আমার ভয় বুঝবি? ওর চোখে তাকালে কেন যেন আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। হাঁটু ভেঙে আসতে চায়।
“তুই শালা গেছিস। ভয়ে নয় প্রেমে।”
পল একথা অস্বীকার করে কী করে। প্রেমে ও সত্যি ভেসে গেছে। নোভা যদি এখন ওকে কূলে তোলে, নয়তো কোন অকূলদরিয়ায় ভেসে যাবে নিজেও জানে না।
“এখানে কী করছিস তুই?” রিচার্ডের বাজখাঁই গলা শুনে চমকে তাকায় পল। চোর ধরা খাওয়ার মতো কিছুক্ষণ দিশেহারা অবস্থা হয়। দ্রুতই সামলে নেয় নিজেকে। কিছু একটা জবাব দিতে হবে।
“উম.. রাজকুমারীর সাথে একটু কথা ছিল।”
“কী কথা?”
পল ভ্রু কুঁচকে তাকায়। তারপর চোয়াল শক্ত করে বলল,
“কথাটা রাজকুমারীর সাথে ছিল আপনার সাথে না।”
রিচার্ড যে ওর কথার ভঙ্গি পছন্দ করলেন না তাঁর মুখ দেখে বেশ বুঝতে পারে পল। তাতে ওর বয়েই গেল। এই মহলে নিকোলাস, নোভা আর আন্দ্রেই ওর কাছে সম্মানিত। বাকি পিয়েতর সহ কয়েকজনকে শ্রদ্ধা করে। কিন্তু রিচার্ড বা সোফিয়া তাদের মধ্যে পড়ে না। এঁদেরকে এমনিতেও পছন্দ করে না পল। দরজার দিকে ঘুরে কড়া নাড়ল। একবার, দু’বার। না, ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ এলো না। আড়চোখে পাশে তাকায়। রিচার্ড দুহাত বুকের ওপর ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে ও ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের রেশ। দাঁতে দাঁত পিষল পল। নোভা দরজা খুলছে না কেন?
“রাজকুমারী, রাজকুমারী?”
“খুলছে না? আহা! কী করে খুলবে বলো তো বাছা! ও কি আর এই কক্ষে আছে? চোখ দেওয়ার সাথে সাথে তোমার ঈশ্বর যদি মাথায় একটু বুদ্ধি দিতো তো দেখতে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। দেখো।”
সত্যিই প্রেম ওকে বোকাসোকার ক্যাটাগরিতে নামিয়ে নিয়েছে। বাইরে থেকে বন্ধ তা ও খেয়ালই করেনি! নোভা তবে কোথায়? জবাবটা এলো রিচার্ডের কাছ থেকে।
“ও আমাদের ছেড়ে আন্দ্রেইর কাছে চলে গেছে।” পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“চিঠিটা নিকোলাসকে দিয়ো। আমিই দিতাম কিন্তু বিশেষ একটি কাজে এই মুহূর্তে দেশের বাইরে যেতে হবে আমাকে। চিঠিটা পড়লেই নিকোলাস বুঝবে কেন নোভা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
পল চিঠিটা হাতে নিলো। সমস্ত শরীর ঠাণ্ডা হয়ে এলো। নোভা চলে গেছে! ওর মনের কথা না শুনেই চলে গেল! বুকের ভেতর এই অব্যক্ত ভালোবাসা চেপে নিঃশ্বাস নেবে কি করে এখন?
চিঠি পড়ে থম ধরে বসে আছে নিকোলাস। মুখ শক্ত হয়ে উঠেছে। হাতের মুষ্ঠিতে দুমড়ে-মুচড়ে ফেললো চিঠিটা। নোভা মাত্র পাঁচ লাইনে বুঝিয়ে দিয়েছে নিকোলাসের থেকে আন্দ্রেই ওর আপন। নিকোলাস স্বার্থপর, নিষ্ঠুর। যে ছোটো ভাই-বোনের ভুল ক্ষমা করতে পারে না, নিষ্ঠুরভাবে ত্যাগ করে তাকেও নোভা ভাই বলে স্বীকার করবে না আর। মাঝে মাঝে শব্দ তলোয়ারের চেয়েও ধারালো হয়। নোভার চিঠির শব্দ তেমনই ছিল। নিকোলাসের অপরাধী হৃদয়টাকে খণ্ড বিখণ্ড করেছে। যোগ্য শাস্তি দিয়েছে ভাইকে ও। চলে গেছে নিকোলাসকে ছেড়ে। দোষ কার? নোভালির? না, নিকোলাস আবার নিজের দোষে আপনজন হারালো। আপন মায়ের পেটের বোন ওকে ছেড়ে গেল এবার। আর কে রইল ওর পাশে? ইসাবেলা। এক ইসাবেলা ছাড়া আর কেউ রইল না নিকোলাসের। সেও কত দূরে! দুচোখ বুঁজে এলো। রাগটা একপাশে সরিয়ে ভাই-বোনদুটোকে ক্ষমা করলে আজ এই শূন্যতা অনুভব করতে হতো না। এত নিষ্ঠুর, নির্দয় কেন হয়েছিল! অসময়ে অনুশোচনা করে লাভ কী। তাতে তো আর নোভা ফিরে আসবে না। তাছাড়া আন্দ্রেইর কাছেই ভালো থাকব। ওর মতো নোভাকে অবহেলা করবে না, কষ্ট দেবে না ও। যথাযোগ্য সম্মান ও স্নেহ-ভালোবাসা পাবে। আপনজনদের ভালোবাসতে কার্পণ্য করে না আন্দ্রেই। প্রকাশের বেলাতেও না। স্বজনপ্রীতি খুব। বিশেষ করে নোভা ও বড়ো ভাইয়ের প্রতি। এখানেই জিতে গেল ওর থেকে আন্দ্রেই।
“আমাদের ওকে খুঁজতে যাওয়া উচিত। বেশিদূর হয়তো যায়নি।” বলল পল। নিকোলাস চোখ বন্ধ করেই মাথা নাড়ায়,
“কোনো দরকার নেই। থাকতে দে ওদেরকে ওদের মতো।”
“কিন্তু_”
“পল!” সতর্ক করল নিকোলাস,
“এখন যা এখান থেকে। একা থাকতে দে আমাকে। যা।”
পল চুপচাপ মাথা নুয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। ইসাবেলা থাকলে ভালো হতো। একমাত্র ওই তো নিকোলাসের মন গলাতে পারে। দরজার কাছে যেতে নিকোলাস আবার ডেকে ওঠে।
“পল, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ ভাই তাই না রে? খুব খারাপ, খুব খারাপ।”
পল ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। নিকোলাস ঠিক আগের মতোই বসে আছে। শেষ লাইন মন্ত্রের মতো উচ্চারণ করছে। বোন হারানোর ব্যথা ওর মুখে স্পষ্ট দেখতে পেল। পলের মনে হঠাৎ প্রশ্ন জাগল, নোভা কি সত্যি মনে করে ওর ভাই পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ ভাই? এই ভাইকে পরিত্যাগ করাই শ্রেয়? পল কেন তবে একমত হতে পারছে না।
এরপরের কয়েকদিন নিকোলাস এবং পলের মধ্যে নোভালিকে নিয়ে কোনো কথা উঠল না। পল ভেবেছিল আস্তে আস্তে বুকের ব্যথাটা সহনীয় হবে। ক্ষণে ক্ষণে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসার সমস্যাও একসময় ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু দিন যত যায় ততই অসহনীয় হয়ে ওঠে সব। অপ্রকাশিত ভালোবাসা ভারি হতে লাগল বুকের ওপর। এত ভার যে মাঝে মাঝে শ্বাস আঁটকে আসে। রাতে ঘুম হয় না। একদৃষ্টে মূক আসমানে চেয়ে থাকে৷ উফ! সেখানেও সেই হৃদয়হরণীয়ার মুখ, সেই চিত্ত চঞ্চল করা ডাগর চাহনি। বিছানার চাদর কাঁটা মনে হয়। নিদ্রাহীন উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ায় রাতে আবার দিনেও।
কমিউনিটির বাকিরা আড়ালে আবডালে নোভার চলে যাওয়া নিয়ে কটাক্ষ করে। অনেকে খুশিই হয় ওর মতো দুর্বল সদস্যের চলে যাওয়াতে। নিকোলাস নিয়ম করে রোজ দরবারে আসে, সকলের সুবিধা-অসুবিধার কথা শোনে, আদেশ, নিষেধের ফরমান জারি করে। সবই মনে হয় স্বাভাবিক। নোভার শূন্যতা যেন কাউকে স্পর্শ করেনি। কিন্তু ভুল। নিকোলাসের ভেতরটা তেঁতো হয়ে উঠেছে। সূক্ষ্ম ভোঁতা যন্ত্রণা কোথাও টের পায়। নোভাকে ও মিস করছে। ওর আর আন্দ্রেইর শূন্য আসনে তাকালে বুকের ভেতর হা হা করে ওঠে। রাগ করে বলেছিল ওর মুখ দেখবে না। এখন ঠিকই আর কোনোদিন ও মুখ দেখাবে না।
যে রাজত্ব ও ক্ষমতার জন্য এতকাল এত সর্বনাশ, ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল আজ সব পাপ মনে হয়। পাপের দহন ক্রমাগত ওর পায়ের পাতা ছিদ্র করে শিরায় পৌঁছে জ্বালাচ্ছে। এই তো সেদিনও ভেবেছিল পুরো পৃথিবী দখল করবে। পুরো পৃথিবী চায়, পৃথিবীর মানুষের দাসত্ব চায়। আজ মনে হয় পৃথিবীটা দখল করে হবে কী? এত মানুষের দাসত্বে করবে কী? দাসত্ব নয় ভালোবাসা চায়। যা ও পেয়েছে। সবার নয় কিন্তু ইসাবেলার ভালোবাসা। সাত রাজার ধনও এর সমতুল্য নয়। বড়ো ভাগ্যবানেরা সাধনা করে এমন ভালোবাসা আর ভালোবাসার মানুষ পায়। ও তো বিনা সাধনায় পেয়েছে। কী ভাগ্যবানই না ও! যে ওকে এত দিলো তাঁকে নিকোলাস কী দিয়েছে? অস্বীকৃতি আর অসম্মান! কেউ বলেছিল, সৃষ্টিকর্তার কাছে যাওয়ার অনেক পথ আছে। ভালোবাসার পথ তারমধ্যে অন্যতম। নিকোলাসও জেনে না জেনে সেই পথেই এগোচ্ছে। এত ঔদ্ধত্য, এত পাপের পর সৃষ্টিকর্তা কী গ্রহন করবে ওকে?
“তুমি কি নত হচ্ছো? মানছো তাঁর প্রভুত্ব?”
ভেতর থেকে তিক্ত স্বরে বলল। নিকোলাসের জিহ্বা জড়িয়ে আসে। ছোট্ট জবাব, হ্যাঁ অথবা না। কিন্তু এই দুটো ছোট্ট জবাবের একটাকে আজ বেছে নিতে প্রচণ্ড এক অন্তর্দন্দের সৃষ্টি হলো। যা শেষ পর্যন্ত অমীমাংসিতই রয়ে গেল।
নৈশ তৃষ্ণা মিটিয়ে কক্ষে ফিরল রাতে। বাইরে আর ভালো লাগছে না। বিষণ্ণ মনে ইসাবেলাকে চিঠি লিখতে বসল। কেমন আছো, কী করছো ইত্যাদি ইত্যাদি লিখল। নোভার কথা ওকে লেখে না। খামোখা চিন্তা করবে। নিঃসঙ্গ রাতে ইসাবেলার উষ্ণতার অভাব ভীষণভাবে উপলব্ধি করে।
“তুমিহীন সত্যি আমিই মৃত, বেলা। বড্ড একলা। চারপাশে ঘোর অমানিশা। আন্দ্রেই বলেছিল, তুমি ও তোমার ভালোবাসা আমাকে দুর্বল করে ছাড়বে। আঁতে লেগেছিল ওর কথা। প্রতিবাদ করেছিলাম। এখন দেখছি ঠিকই বলেছিল। তুমি আমার শক্তির উৎস হয়ে গেছো। তুমিহীন দুর্বল আমি। কিন্তু এই দুর্বলতাকে ভালোবাসি। তখন মনে হয় আমি আবার আগের মতো মানুষ হয়ে গেছি। আজকাল মানুষ ভাবতে এত কেন ভালো লাগে বলতে পারো, বেলা?……………”
চলবে,,,,