#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব—৮৪,৮৫ ১ম অংশ
Writer তানিয়া শেখ
৮৪
নোভার দরজায় মস্ত এক তালা ঝুলছে। কে লাগিয়েছে পল জানে না। কী মনে করে কয়েকদিন ধরে ভাবছে নোভার কক্ষে ঢুকবে৷ হয়তো ওখানটা ওর স্মৃতি জড়ানো বলে। একটু ছুঁয়ে দেখবে ওর ব্যবহৃত জিনিসপত্র। ব্যর্থ প্রেমিকেরা কত কী করে। তালাটা প্রথম বাধা হয় ওর।
তালার চাবি খুঁজতে যেতে সংকোচ হয়। কারণ কী দেখাবে? প্রেমে না পড়লে সংকোচ থাকত না। কিন্তু কক্ষে এখন ও ঢুকবেই। লুকিয়ে হলেও। ভোরে সকল পিশাচ কফিনে ঢুকতে পল সাবধানে রশির সাহায্যে নোভার কক্ষের বন্ধ জানালা পর্যন্ত এলো। ওর বলিষ্ঠ হাতে জানালার একটা পাল্লা টেনে খুলে ফেলে। ফ্রেঞ্চ জানালা হওয়াতে সুবিধা হয়েছে। বাধাবিঘ্ন ছাড়াই এক লাফে নোভার খালি কক্ষে প্রবেশ করল। এই প্রথম নয় এখানে এসেছে পল, তবুও আজ আবেগতাড়িত হলো। এই কক্ষের জংলী ফুলের ম্লান সুবাস নোভার স্মৃতি বহন করে। পল ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল দেওয়াল, আলমিরা, ফুলদানি, বিছানা, বালিশ শেষে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। টেবিলে এখনও কয়েকটি বই, লেখার খাতা আর কলম পড়ে আছে। মনে পড়ল এই জায়গায় দাঁড়িয়ে জার্নালটা লুকিয়ে ফেলেছিল নোভা। সেই বন্ধ ড্রয়ারে চোখ পড়ল এবার। এখনও বন্ধ সেটা। খুলে দেখবে কী? নোভাকে দেখতে চাওয়া ছাড়া পলের জীবনে এই মুহূর্তে দ্বিতীয় কোনো বাসনা থাকলে তবে তা ওর জার্নালটি পড়া। কিন্তু দুটোই অসম্ভব। নোভা জার্নালটি কাছ ছাড়া করবে না। ওর জীবন্মৃত সময়ের শীত, বসন্ত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সবই ওতে রয়েছে। প্রকৃতি নয় বলেই সব গোপন করে। কিন্তু পলের যে খুব জানতে ইচ্ছে হয় সেসব। বিবেকের সাথে এক চোট লড়ে একসময় ড্রয়ারটা খুললো। হতাশ হবে ভেবে নিশ্চিত ছিল। তবুও কেন খুলতে গেল? সব প্রশ্নের জবাব দেওয়া যায় না।
আশ্চর্য! ওই তো জার্নাল। পল আস্তে আস্তে ওটা হাতে তুলে নেয়। খোলে না। অনিমিখ চেয়ে আছে। হঠাৎ যেন ভাবোদয় হলো এমনভাবে কক্ষের চারিদিকে তাকালো। জার্নালটা রেখে দৌড়ে গেল আলমিরার কাছে৷ খুললো ওটা। কাপড় অগোছালো। কিছু কাপড় নেই। জুয়েলারি বক্স খুলে দেখল এবার। শূন্য। তবে কী সত্যি স্বেচ্ছায় গেল নোভা? পল তবুও ভালো করে আলমিরা ঘেঁটে দেখছে। ঠিক তখনই চোখে পড়ল জিনিসটা। একদম নিচের তাকের অগোছালো কাপড়ের ভাঁজে চকচক করছে। কাপড়টা সরাতে বেরিয়ে এলো নোভার প্রিয় আংটি আর হার। পেঁচিয়ে আছে একটার সাথে অপরটা। পলের সন্দেহ প্রবল হতে লাগল। ভালো করে সবকিছু দেখছে। সব ঠিক নেই। এত তাড়া কীসের ছিল নোভার? ভাইকে ঘৃণা করে, তাই বলে এত তাড়া? গুছিয়ে কিছু নেবে না? এমনকি এই জার্নাল, যা ওর এত প্রিয় সেটাও না! পলের মুখের রক্ত সরে গেল। মনে পড়ল নোভা এর আগেও কিডন্যাপ হয়েছিল। এবারো এমন কিছু হলো কি? জার্নালটা কোমরে গুঁজে বের হয়ে এলো নোভার কক্ষ থেকে। নিকোলাসের জেগে ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। নোভার খারাপ কিছু হওয়ার আশংকায় ও স্থির থাকতে পারছে না।
দুপুরের পরে নিকোলাস কফিন ছেড়ে নিজের কক্ষে যেতে চিন্তিত পলকে দেখল।
“কী হয়েছে?” দুর্বল গলায় জানতে চাইল। রক্ত তৃষ্ণা পেয়েছে ওর৷ মনে মনে বাইরে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু পলের মুখ দেখে বুঝল তাতে বাধা পড়বে৷
“নোভা আন্দ্রেইর কাছে যায়নি, মনিব।”
“কী বলতে চাস?” চকিতে ঘুরে তাকাল ওর মুখের দিকে ফের। পল একে একে সব খুলে বলতে গম্ভীর হয়ে যায় নিকোলাস। চেয়ার টেনে বসে পড়ে। কেমন যেন লাগছে৷ তৃষ্ণার্ত বলে নয়।
“দরবারের কোথাও চিঠিটা ফেলে দিয়েছিলাম। সবার শেষে আমিই বের হয়েছি ওখান থেকে। চিঠিটা এখনও দরবারের কোথাও পড়ে আছে। দৌড়ে গিয়ে নিয়ে আয় ওটা। ভালো করে আরেকবার দেখব।”
পল যাচ্ছিল আবার ডাকল,
“জার্নালটা দিয়ে যা।”
জার্নালটা এখনও জামার নিচে লুকিয়ে রেখেছে পল। খুলে দেখেনি৷ কিংবা বলা যায় দেখতে পারেনি। নিকোলাস নিলে খুলে পড়ে দেখবে৷ নোভা যখন জানবে নিশ্চয়ই খুশি হবে না। ওর ইতস্তত দেখে ধমকে ওঠে নিকোলাস।
“আমার মনে হয় জার্নালে ওর নিখোঁজ হওয়া সম্পর্কে তেমন কিছু লেখা নেই।” পল শুকনো ঢোক গিললো। নিকোলাস বলল,
“তবুও ওটা আমার দেখতে হবে। দে এদিকে।”
পলের হাত অসাড় হয়ে আসে। নিকোলাসের চোখের রং বদলে গেছে। ভয়ংকর দেখাচ্ছে। পল কী করবে এখন! ওর দেরি অসহ্য হয়ে ওঠে নিকোলাসের কাছে৷ হাতটা চেয়ারের আর্মরেস্ট খামচে ধরেছে।
“পল!” বজ্রনির্ঘোষের মতো শোনা গেল। পল না চাইতেও দিতে বাধ্য হয়। খপ করে কেড়ে নিয়ে খুলতে গিয়ে আবার পলের পাথর হয়ে থাকা মুখটার দিকে তাকালো।
“এখনও গেলি না?”
পল দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল। যেতে যেতে নিজেকে সহস্র তিরস্কার করে। জার্নালের কথাটা না বললেই হতো। কেন যে বললো? নোভা ফিরে এসে যখন জানবে পলকে আরও বেশি ঘৃণা করবে৷
পুরো দরবার খুঁজেও চিঠির চিহ্ন পেল না। হতাশ হয়ে ফিরে এলো নিকোলাসের কক্ষে। নিকোলাস চোখ বন্ধ করে বসে আছে। জার্নালটা এখনও ওর কোলের ওপর। একহাতে শক্ত করে ধরে আছে। পলের উপস্থিতি টের পেয়েও তেমনই রইল।
“নোভার চিঠিটা পেলাম না।”
নিকোলাস উঠে জার্নালটা সশব্দে পাশের টেবিলের ওপর আছরে ফেলল।
“তুই এটা পড়েছিস?”
“কী?”
“জার্নালটা পড়েছিস তুই?” চিবিয়ে চিবিয়ে বলল নিকোলাস। পল মাথা নাড়ায়,
“না, ওখানে কী নোভার হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কে কিছু লেখা আছে?”
নিকোলাস জবাব দিলো না। চুপ করে ওর দিকে অগ্নিচোখে চেয়ে রইল। পলের মুখে আজ রাজকুমারী নয় নোভা! পল সহজে মনিবের চোখে চোখ রাখে না। দৃষ্টি তাই পায়ের দিকে। কঠিন নীরবতা ভেঙে নিকোলাস বলল,
“রিচার্ডকে ডাক।”
রিচার্ড স্বাভাবিকভাবে এসে দাঁড়ালেন পুত্রের সামনে।
“কী হয়েছে?”
“নোভা কোথায়?” নিকোলাসের প্রশ্নে ভুরু কুঁচকে ফেললেন রিচার্ড।
“কেন চিঠি পাওনি? ওখানে তো সব লিখেছে ও।”
“চিঠি ও আপনাকে নিজে হাতে দিয়েছে?”
“না, আমার চাকরের হাতে।”
“তাকে ডাকা হোক।”
একটু পর চব্বিশ পঁচিশ বছরের এক পিশাচ যুবক এসে দাঁড়ায় সেখানে। সোনালি চুলের মাথাটা অবনত করে অভিবাদন জানালো।
“নোভা তোর হাতে চিঠি দিয়েছিল?”
“জি, কাউন্ট।”
“কিছু বলেছিল?”
“চিঠিটা হাতে দিয়ে বলেছিলেন, বাবাকে দিয়ো।”
“আর কিছু না?”
“না, কাউন্ট।”
একটু ভাবল নিকোলাস। এই ফাঁকে চাকরটির ভীত রক্তশূন্য দৃষ্টি সাবধানে মনিবের দিকে যায়। রিচার্ড ইশারায় বুঝালেন সন্তুষ্ট হয়েছেন চাকরের অভিনয়ে। পল নোভার চিন্তায় ডুবেছিল। পাশে দাঁড়ানো দুজনের যড়যন্ত্র ওর নজর এড়িয়ে গেল তাই অনায়াসে। নিকোলাস চাকরটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভালো করে ভেবে বল দেখি, সন্দেহজনক কিছু দেখেছিলি কি না।”
চাকরটি ভাবল। সময় নিয়ে বলল,
“তেমন কিছু তো দেখিনি কাউন্ট। তবে তাঁকে খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। ছোটো মনিব যাওয়ার পর থেকে মনমরা থাকতে দেখেছি৷ কিন্তু সেদিন যেন খুব বেশি মনমরা ছিলেন।”
অপরাধবোধের চপেটাঘাত পড়ল যেন নিকোলাসের মুখে৷ চাকরটিকে বিদায় দিয়ে রিচার্ড বললেন,
“খামোখা চিন্তা করছো। জানোই তো আন্দ্রেইর সাথে ওর কত মিল। সৎ ভাইয়ের চোখে দেখেছে কখনো? ওর ভাই বলো বন্ধু বলো ওই একটিই, আন্দ্রেই। সেই ছোটোবেলা থেকে একে অপরের ছায়া হয়ে থেকেছে ওরা। ও যে আন্দ্রেইর টানে যাবে সে আমি আগেই জানতাম৷ এতদিন যখন কাছে ছিল খোঁজও নেওনি বোনের। চলে যেতে এত দরদ জাগছে কেন তোমার? না কি আন্দ্রেইকে হিংসে করছো?”
“সংযত হয়ে কথা বলুন রিচার্ড। আন্দ্রেইকে হিংসে করতে যাব কেন?”
“নোভার হাতের লেখা চিঠি পড়ার পরও তাহলে এত ঝামেলা করছো কেন? কমিউনিটির সকলে শুনলে আমার মতোই ভাববে। হয়তো তারচেয়েও বেশি।”
“থামুন। সুযোগ পেলেই আবোল-তাবোল বকতে থাকেন৷ আপনার প্রয়োজন শেষ এবার আসুন।”
রিচার্ড রাগ রাগ মুখে বেরিয়ে গেলেন দরজার বাইরে। পল এগিয়ে এলো।
“আমার কেন যেন রিচার্ডের কথা বিশ্বাস হচ্ছে না। আপনি একবার নোভার কক্ষে ঘুরে আসুন। ওখানে সব ঠিক নেই। আমি কী করে বুঝাব আপনাকে! আচ্ছা এসব না হয় বাদই দিলাম। বাইরে যুদ্ধ চলছে। এই অবস্থায় ওর কি অতদূর একা যাওয়া ঠিক? পথে যদি কিছু ঘটে?”
“পরিষ্কার করে বল।” ক্ষোভ প্রকাশ পেল নিকোলাসের গলায়। পল বলল,
“আমি ট্রিয়ের সেই জঙ্গলে যেতে চাই যেখানে আন্দ্রেই নির্বাসিত।”
“পল!”
পল এবার আকুতির পর্যায়ে চলে যায়,
“আমাকে যেতে দিন, মনিব। সত্যিটা আমাকে জেনে আসতে দিন৷ আমি জানি, বোনের জন্য আপনারও চিন্তা হচ্ছে। রিচার্ডের কথায় ভরসা করে চুপচাপ বসে থাকা আমাদের ঠিক হবে না। তাছাড়া নোভা একা এতদূর গিয়েছে। পথে বিপদ টিপদও হতে পারে। আপনার শত্রুর অভাব নেই। এর আগেও একবার ও কিডন্যাপ হয়েছিল। আমার মন কু গাইছে। আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিন। আমি ওর খোঁজ নিয়ে আসলে আপনিও নিশ্চিন্ত হবেন।”
নিকোলাস ওকে গভীর দৃষ্টিতে দেখতে লাগল। তারপর হাঁপ ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
“যা।”
পল খুশি হয়ে বলল,
“আজই রওয়ানা হই?”
“হুম।” জার্নালটির দিকে চেয়ে নিকোলাস পুনরায় বলল,
“আজ থাক। কাল সকালে রওয়ানা দিস। আজ রাতে তোর সাথে আমার কিছু কাজ আছে।”
পলের মুখের খুশিটুকু মলিন হলো। তবুও জোরপূর্বক স্মিত হেসে খুব নিচু গলায় বলল,
“ঠিক আছে।”
রিচার্ড দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কান পেতে সব শুনলেন। দাঁত কামড়ে বিড়বিড় করে বললেন,
“বাস্টার্ড পল, খুব নোভা নোভা করছিস। ভেবেছিস বুঝি না কিছু? বাগে পাই একবার তারপর তোর নোভা নোভা জপ ছুটিয়ে দেবো শালা।”
চন্দ্রদেবীর সামনে সূর্যদেবের দূত এসে বন্দনা জানালো।
“কী সংবাদ নিয়ে এসেছো?” বললেন দেবী।
“আগাথার হদিস পাওয়া গেছে।”
দেবী স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন।
“কোথায়?”
“পাতালপুরীর উপরিভাগে।”
দেবী অবাক হলেন।
“পাতালপুরীতে!” তারপর বললেন,
“সূর্যদেব সেখানে কী করে পৌঁছালেন?”
“আপনি তো জানেন সূর্যদেবের স্বভাব। সমস্ত উপরিমণ্ডল খুঁজেও যখন আগাথাকে পেলেন না ভীষণ রেগে গেলেন। ব্যর্থতা তাঁর আত্মগরিমাকে আঘাত করে। পণ করলেন যে করেই হোক আগাথাকে খুঁজে বের করবেন। আমাদের কোথায় না পাঠিয়েছেন! শেষমেশ পাতালপুরীতে রাতের গুপ্তচরদের পাঠানো হলো। কোনো একটা কারণবশত ওদের সর্দার তাদের মিথ্যা বলেছিল। এর শাস্তি অবশ্য পরে সূর্যদেব তাকে দিয়েছেন। সূর্যদেব তবুও থামলেন না। গুপ্তচররা একসময় খবরটা দিলো। এক জাদুর বোতলে বন্দি করা হয়েছে আগাথাকে। অমাবস্যার আঁধারের এক টুকরো কালোতে জড়িয়ে শূন্যে রাখা হয়েছে বোতলটা। স্থানটিকে সকলের চোখের আড়াল করতে জাদুকরি পন্থা অবলম্বন করেছে। সফলও হয়েছিল বলা যায়। কিন্তু ধরা একসময় ঠিক পড়ল। এর জন্য দায়ী আসল ব্যক্তি কে তা এখনও শনাক্ত করা যায়নি।”
দূতের কথা শুনে দেবী কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন,
“আগাথা এখন কোথায়?”
সূর্যদেবের দূত কাউকে ডাকতে একটা বোতল হাতে একজন সেবক এগিয়ে এলো। ভেতরে অস্পষ্ট ধোঁয়াশা। তারমধ্যে আগাথার দুর্বল আত্মাটার এক ঝলক দেখলেন দেবী।
চলবে,,,,
#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব—৮৫(১ম খন্ড)
Writer তানিয়া শেখ
১৩৪৯ সাল,
নিজের অনাগত সন্তানের মায়ের লাশ সামনে নিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছেন ম্যাক্স। রক্তাক্ত দু’হাতে তাকিয়ে আছেন অপলক। বার বার সন্তানতুল্য প্রিয় নিকোলাসের ব্যথিত, আতংকিত মুখটা চোখে ভাসছে। এই দু’হাতে ওকে আঘাত করেছেন তিনি।
“আহ!” সজোরে মেঝেতে কিল দিলেন৷ পরপর কয়েকটা। জমিনটাকে ব্যথা দিতে নয়। নিজের এই দুহাত ওই ইট বিছানো শক্ত জমিনে আঘাত করে থেতলে ফেললেন।
“নিক, আমার নিক বাবা, ক্ষমা কর আমাকে।” উবু হয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। আজ তিনি সব হারিয়েছেন। যার গর্ভে ছিল অনাগত সন্তান সেই মায়াবতী কন্যাকে। অকাঙ্খিত হলেও সন্তানটি তাঁর ঔরসজাত ছিল। আর নিকোলাস! ঔরসজাত না হয়েও সে তো কম ছিল না। আজ এদের কেউ ই তাঁর রইল না। আগাথাকে হারানোর চেয়ে এ ব্যথা আরও বেশি। আগাথা! সে কী ক্ষমা করবে তাঁকে।
“ইস! তোমার জন্য বড্ড দুঃখ হচ্ছে আমার ম্যাক্সওয়েল।” রিচার্ডের পরিহাসের দুঃখ প্রকাশ শুনে চোয়াল শক্ত হয় ম্যাক্সের কিন্তু মুখ তোলেন না। রিচার্ড আরেকটু এগিয়ে আসেন। একটু ঝুঁকে বলেন,
“আমার স্ত্রী-সন্তান কেড়ে নিয়েছিলি তাই না? আহা! কিন্তু ওরা তো সব এখন আমার কাছে, আমার দখলে। তাহলে কেড়ে নেওয়ার খেলায় তুই তো হেরে গেলি। হেরে গেলি! না, কথাটা হবে তোকে আমি হারিয়ে দিয়েছি। আজ তোর চারপাশ শূন্য। না আগাথা আছে আর না নিকোলাস। আবার যার গর্ভে সন্তান ছিল_”
ম্যাক্স লাফিয়ে ওঠেন এবার। তাঁর হাতটা সাঁড়াশির মতো রিচার্ডের গলা চেপে ধরে। গর্জন করে বলেন,
“শয়তান, তোকে আমি শেষ করে ফেলব। তোর মতো অমানুষের জন্য এই পৃথিবী না।”
রিচার্ড তাঁর হাত থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ছটফট করেন। কিন্তু পারেন না। শ্বাসরোধ হয়ে এলো। কী করবেন এখন? দু’আঙুলে বশীভূত একটা বিশাল সর্পকে কাছে ডাকলেন। ম্যাক্স কিছু বুঝে ওঠার আগে ভারী লেজটা দিয়ে সরীসৃপটা তাঁর পায়ে আঘাত করল। টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলেন ম্যাক্স। ছাড়া পেলেন রিচার্ড। গলায় হাত বুলিয়ে খুক খুক করে কেঁশে উঠলেন।
“শালা, তোর তেল ফুরিয়ে গেলেও সলতে জ্বলছে! ওই সলতে কী করে পুড়াতে হয় তা বেশ ভালো করেই জানি। কে আছিস? এই মাদারফাকারটাকে টর্চার সেলে নিয়ে যা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওকে কোড়া মারবি।” দুজন ভৃত্য এসে ম্যাক্সের দুর্বল আহত শরীরটা টেনে তুললো। রিচার্ডের সামনে দিয়ে যেতে শক্তি যুগিয়ে ডান পা’টা তুলে লাথি দিলেন ওকে। চিৎ হয়ে পড়ে গেলেন রিচার্ড। রাগে ও ব্যথায় হিসহিসিয়ে ওঠেন। তেড়ে এসে ওর গলা চেপে ধরলেন,
“বড়ো জোর ওই পায়ে এখনও, হুম?”
ঘুষি দিয়ে নাক ফাটিয়ে ফেললেন ম্যাক্সের। তারপর যে পায়ে লাথি দিয়েছে তাতে লাথি দিতে লাগলেন। হাঁপিয়ে না ওঠা পর্যন্ত থামলেন না। পা’টা ভেঙেই গেল। আর্তনাদ করে উঠলেন ম্যাক্স। রিচার্ড ভৃত্যদুজনকে বললেন,
“আগে ওর ওই পা কাটবি। ভাঙা পা রেখে আর লাভ কী? খামোখা কষ্ট বাড়বে। তারপর মরার আগ পর্যন্ত বুঝিয়ে দিবি আমার পথে এসে কতই না ভুল করেছে। যদি পায়ে ধরে ক্ষমা টমা চায় তো একটু দয়া করিস। ওর প্রাণপ্রদীপ আগেই নিভিয়ে দিস, যা।”
হেসে ওঠেন এবার ম্যাক্স। পাগলের মতো হাসতে হাসতে একসময় কেঁদে দিলেন। রক্তিম সজল চোখে চেয়ে বলেন,
“আমি যে কোন কুক্ষণে তোকে বিশ্বাস করেছিলাম তাই ভেবে সেই সময়কে অভিশাপ দিই। আমার সরলতার, বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ধোঁকা দিয়েছিস তুই। ওই নিষ্পাপ মেয়েটাকে ম্যানুপুলেট করে আমাকে ধোঁকায় ফেলে…..” ম্যাক্সের শ্বাসরুদ্ধ হয়। চোখের সামনে দুঃস্বপ্ন হয়ে ভেসে ওঠে সেই রাতের স্মৃতি। মুখে বলতে আজও বড্ড বাধে। ম্যাক্স সজ্ঞানে আগাথা ছাড়া কোনো মেয়েকে স্পর্শ করার কথা ভাবতেও পারতেন না। ডিভোর্স পেপারে সাইন করার নাম করে বাসায় আমন্ত্রণ করে রিচার্ড। এরপর কৌশলে ভোদকার সাথে মিশিয়ে দেয় মন্ত্র পড়া আফিম। প্রায় এক সপ্তাহ হুঁশ ছিল না বলতে গেলে ম্যাক্সের। যখন মস্তিষ্ক সঠিকভাবে কাজ করে ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। মেয়েটি বড়ো সরল। রিচার্ড ওর দারিদ্রতার সুযোগ নিয়েছে। ম্যাক্স ভীষণ গালমন্দ করেন, রাগ করেন। কী জবাব দেবেন আগাথাকে? মেয়েটি কান্নায় ভেঙে পড়ে। ক্ষমা চায়। ম্যাক্স কী করবেন ভেবে পান না। বিপন্ন, ক্রোধিত মুখে বেরিয়ে যান সেখান থেকে। লজ্জায়, অপরাধবোধে আগাথার সামনে যেতে পারেন না। কিন্তু এভাবে কতদিন? আগাথা, নিকোলাস ও নোভা ওর পথ চেয়ে বসে আছে। মনকে স্থির করেন ম্যাক্স। ফিরতে হবে ওদের জন্য। আগাথাকে সব বলবেন৷ আগাথা নিশ্চয় বুঝবে৷ ক্ষীণ আশা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেন এবার তিনি বাড়ি ফিরবেন। কিন্তু আবার বাধা হয়ে দাঁড়ায় রিচার্ড। বেশ ক্ষমতা তখন ওর। ম্যাক্সের সকল দুর্বলতা নখদর্পনে। বন্দি করে আনল এই গহীন নির্জন স্থানে। সেখানে আগে থেকেই ছিল সেই মেয়েটি, যার সাথে এক সপ্তাহ একই বিছানায় রাত কেটেছে ম্যাক্সের। মেয়েটি তখন অন্তঃসত্ত্বা। তবুও দাবী নেই ম্যাক্সের কাছে ওর। অনুশোচনায় মাথা নুয়ে রইল। এই অবস্থাতেও রিচার্ড ওর ওপর অত্যাচার থামায়নি। অনাহারে, অর্ধাহারে লোহার শিকল পরিয়ে রেখেছে সেখানে। ম্যাক্সকে ছলনায় বাঁধতে না পারার শাস্তি এটা ওর। ওর এই অবস্থা দেখেও মন নরম হয়নি প্রথমে ম্যাক্সের। একই কারাগারে বন্দি থেকেও অনেকদিন কথা বলেনি দুজন। কিন্তু মেয়েটির যন্ত্রণা দেখে শেষমেশ মন গলে। তারপর কথাবার্তা তেমন না হলেও মেয়েটি যন্ত্রণা উপশম করতে হাতটি বাড়ন্ত পেটের ওপর রাখে, কাঁধটা এগিয়ে দেন মাথা রাখতে৷ অনাগত সন্তানের প্রতি টান বাড়ে, মায়া বাড়ে সন্তানের মায়ের প্রতিও। সংকীর্ণ এই গণ্ডিতে কখন যে মেয়েটির কাছে চলে এসেছিল জানেন না। আবারও ভুল হয়েছে। এই ভুলের মাশুল সব খুইয়ে দিতে হলো তাঁকে। আবার সজল চোখে তাকান মেয়েটির লাশের দিকে।
রিচার্ড আজ খুব খুশি। প্রতিশোধ নিতে পেরেছেন। ম্যাক্সের এই অসহায়ত্ব, যন্ত্রণা তাঁকে পৈশাচিক আনন্দ দেয়। কী আনন্দ! আহ! ওর শোক বিহ্বল মুখে চেয়ে ভেতরটা উল্লাসে ফেটে পড়ে। ভৃত্যদুটো টেনে নিয়ে যায় সামনে। ম্যাক্স চিৎকার করে বলেন,
“সত্য কোনোদিন চাপা থাকে না। তোর সত্য নিকোলাস একদিন জানবে। ঈশ্বর সত্যি হলে নিশ্চয় জানবে। ধোঁকা দিয়েছিস তুই আমাকে রিচার্ড। আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন এর উচিত শাস্তি তোকে দেন। আমার সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখতে দিসনি, প্রিয়জনদের কেড়ে নিয়েছিস। ঈশ্বর তোর সবকিছু কেড়ে নেবেন। নরকে যাবি তুই শয়তান।”
ম্যাক্সের শেষ আহাজারি ও অভিশাপ এই কারাগারের দেওয়ালের কোথাও অদৃশ্য হয়ে যায়। রিচার্ড বিজয়ী আজ। তাঁর মুখে সেই আনন্দ যেন ধরে না। ওসব অভিশাপকে থোড়াই কেয়ার করেন তিনি।
“এই মৃত যুবতী ও ওর পেটের শিশু তোর। যা আমোদ কর।”
সরীসৃপটি কী বুঝলো কে জানে। রিচার্ড চলে যেতে মৃত যুবতীর লাশ শরীরের সাথে পেঁচিয়ে নেয়। মুখ হা করে জিহ্বা বের করল। মৃত মৃত গন্ধ! এ কী খাওয়া যায়? হঠাৎ যুবতীর পেটটা নড়ে উঠতে দেখল। হিস হিস শব্দে মুখটা ওর পেটের কাছে নেয়। পেটের উপরিংশের জামাটা সরু দাঁতে ছিঁড়ে ফেললো। তারপর দাঁত বসিয়ে দেয় পেটের ওপর। ভেতরের নড়াচড়া থেমে যায় তারপর। পেট দু’ভাগ করার জন্য যেই না মুখ ফের হা করল কোথা থেকে দমকা হাওয়া এলো। তাপমাত্রা মুহূর্তে শূন্যে নামে। তার সাথে ঘন কুয়াশা নেমে এলো সাপটির চোখের সামনে। এক সময় নিকশ কালো অন্ধকার। অতি ঠাণ্ডায় সরীসৃপের শরীর জমতে লাগল। বেষ্টনী থেকে ছুঁড়ে মারল লাশটি। সেটি পড়ল কারাগারের দুর্গন্ধের নালীতে গিয়ে। দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচল সাপটি।
রাত নামে তারপর সকাল হয়। সকাল গড়িয়ে ফের সন্ধ্যা। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। কারাগারের উঁচু ঢিবির পানি জমা হয়ে সমস্ত ময়লা আবর্জনা নিয়ে এই নালা দিয়েই বেরিয়ে যায় কয়েকফুট নিচের খালে। যুবতীর লাশ আবর্জনার সাথে ভাসতে ভাসতে খালে পড়ে। সেখান থেকে আস্তে আস্তে বনমধ্যে একটা ঝিরির মুখে গিয়ে আঁটকে যায়। আবার সময় নিজ গতিতে এগিয়ে চলে। দিন যায় রাত আসে। এমনি করে তিনদিন। যুবতির সুন্দর দেহটা ফুলে বিভৎস হতে শুরু করেছে। তার পরেও ঝিরির মুখ পিছলে আবার ভাসতে লাগল। অশরীরী কিছু যেন টানছে। পেটটা পানির ওপরে। আরও ফুলে উঠেছে। সারাদিন ঝিরিতে ভাসতে ভাসতে দিন শেষে এক গুহার মুখে এলো। গহীন জঙ্গল। সূর্য ডুবতে চারপাশে ঘন অন্ধকার নামল। নীড়ে ফেরা পাখির কিচিরমিচির বন্ধ হয়। নিস্তব্ধ চারপাশ। সুউচ্চ গাছের ফাঁকে এক ফালি ম্লান চাঁদ উঁকি দেয়। যুবতীর সাদা অর্ধনগ্ন শরীর আবছা দেখা যায়। হঠাৎ আবার তাপমাত্রা শূন্যে নামল। গা কাঁপিয়ে দেওয়া শীতল বাতাস বইছে। এত জোরে যে ওমন পঁচে ফুলে ওঠা মৃতদেহটা টেনে নিয়ে গেল গুহার ভেতরে। যেন বাতাস নয় এক দানবীয় হাত ওটা টেনে নিলো। বাতাসের গতি কমে আসে। পুরোপুরি থামে না। তাপমাত্রার পারদ একটু একটু করে যেন ওপরে উঠছে। ঠিক তখনই এই জঙ্গলের নিশুতি নিস্তব্ধতা ভেঙে কান্না করে ওঠে এক মানব শিশু। সদ্য জন্মানো এক মানব শিশু। যার জন্ম অন্ধকারে, শয়তানের ছায়ায়।
চলবে,,,,