তিমিরে ফোটা গোলাপ
পর্ব- ০২
Writer Taniya Sheikh
প্রত্যাখ্যান আর মিথ্যার কণ্টকাঘাতের ব্যথা সর্বাঙ্গে বিষের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। মনটা ভেঙে দিয়েছে পিটার ওর। এই বাড়ির মুরুব্বিরাও ইসাবেলাকে কিছু বলেনি। তাঁরা সকলে ঘটনার আগে জেনেছে পিটারের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের কথা৷ কেন আড়ালে রেখেছে ওঁরা? কেন পিটার বলল না তাকে? ওর ওই নীরব পলায়ন ইসাবেলাকে যে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। ভেবেছিল দু’ একদিন গেলে হয়ত পিটার ফিরবে কিংবা ওর কোনো পত্র আসবে। কিন্তু সে আশাহত হয়েছে এবারও। বাইরের জগতের প্যাঁচ বোঝে না ইসাবেলা। মানুষের জীবনের ক্ষুদ্র বৃহৎ জটিলতা সম্পর্কে একেবারেই জ্ঞান নেই। মা ওকে যা দেখিয়েছেন তাই দেখেছে। মা দেখিয়েছেন এই ঘর, এই ঘরের হেঁশেলে সীমাবদ্ধ থাকাতেই নারী জীবনের সার্থকতা। বিপ্লব কী? বিপ্লবী কেন হয় মানুষ? এসব ওর জানা নেই। জানা নেই বলেই ভেবে নিয়েছে পিটারের বিপ্লবী হওয়ার কথাটা নিছক সান্ত্বনার বাণী। আদপে সে ইসাবেলাকে চায় না বলেই এভাবে চলে যেতে পেরেছে। আজ দুদিন হতে চলল পিটার ফেরারি। মহল্লায় এ নিয়ে কথা চালাচালি হচ্ছে। সকলে বলছে পিটার আর ফিরবে না। দানিল ছেলের উপর ক্ষুব্ধ। পুলিশ তাকে জেরায় জেরায় নাজেহাল করেছে। ছেলের কোনোরকম খোঁজ-খবর নিতে সে নারাজ। ওলেগ গম্ভীর হয়ে আছেন। একটা থমথমে ভাব পুরো বাড়িময়। বিয়ে উপলক্ষ্যে আগত অতিথিরা সান্ত্বনার বাণী আওড়ে ফিরে গেছে গতকালই। ভ্লাদিমির সেই কথা শুনে ইসাবেল সেদিন মূর্ছা যায়। তাকে ধরে বিছানায় শুয়ে দেওয়া হয়েছিল। আজ দু’দিন হয় বিছানা ছেড়ে নামছে না। জানালায় বসে পথ চেয়ে থাকে, এই বুঝি ও পথে পিটার হেঁটে এলো। কিন্তু না, সে আর আসে না। পিটারকে অধিকার করবে বলে মুখিয়ে থাকা যুবতীদেরদল সকৌতুকে রাস্তা দাঁড়িয়ে গলা তুলে বলছে,
“পালিয়েছে তোমার রাজপুত্তুর। আহা! এবার বুঝলে তো কেউ তোমার মতো সতীসাধ্বীকে চায় না। অমন দাদি-নানি সেজে থাকলে কপালে আর প্রেমিক জুটবে না, স্বামী তো দূর কী বাত।”
তাতিয়ানার ধমকে মেয়েগুলো মুখ ভেংচে চলে যায়। কিন্তু ওদের ওই কথা, ও তো ইসাবেলার হৃদয় বিদীর্ণ করে দিলো। লজ্জায়, অপমানে মাটির সাথে মিশে যাওয়ার সাধ জাগে। তাতিয়ানা, ভ্লাদিমি ছুটে এসে বোনকে জড়িয়ে ধরল। কারো সাথে কোনো কথায় সে বলছে না। আর না শুনতে ইচ্ছুক কারো কথা। মা আন্না মেরিও মেয়ের এই দুরাবস্থা চোখে দেখতে পারছেন না। তার নিষ্কলুষ মেয়েটি বিনাদোষে শাস্তি পাচ্ছে। গত দু’দিন হয় সে পানি ছাড়া কিছুই মুখে তোলেনি। সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে কাঁদছে। এমনকি ওর প্রিয় আন্টি ভ্যালেরিয়ার সাথেও তেমন কথা বলেনি। ভ্যালেরিয়া ওর মায়ের সৎ বোন। সৎ হলেও দু’বোনের সম্পর্ক খুব ভালো। আন্না মেরিওর অর্ধেক বয়স ভ্যালেরিয়ার। বলা যায় তাতিয়ানার বয়সী। মায়ের অকাল মৃত্যুর পর এ বাড়িতে বছর দশেক ছিল সে। ইসাবেলার সাথে গড়ে ওঠে অসম বন্ধুত্ব। নিজের মনের কথা অকপটে যদি কাওকে ইসাবেলা বলেছে তবে সে ভ্যালেরিয়া। সেই ভ্যালেরিয়া আসার পর থেকে ইসাবেলাকে বুকে আগলে বসে আছে। ওর বুকে মাথা রেখে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছে ইসাবেলা।
“তোমাকে একটা কথা বলব ভ্যালেরি?”
ঘুমন্ত ইসাবেলার মুখের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বোনের দিকে তাকায়,
“হুম”
“এবার সাথে করে বেলাকে নিয়ে যাও তুমি। কিছুদিন তোমার সাথে চার্চের মতো পবিত্র স্থানে থাকলে ওর মনটা শান্ত হবে। ঈশ্বরের সান্নিধ্যে মা আমার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে।”
ভ্যালেরিয়া ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে ওকথা শুনে। শুকনো ঢোক গিলে বলে,
“এ অসম্ভব আপা, আপনি জানেন, বিভিন্ন দায়িত্বপালনে চার্চের বাইরে থাকতে হয় আমাকে বেশিরভাগ সময়। তাছাড়া চার্চে ওকে রাখা যাবে না। আচ্ছা, আপনি কী ওকে সিস্টার বানাতে চাইছেন?” শেষটায় কপাল কুঁচকে যায় ভ্যালেরিয়ার। আন্না মেরিও আর্ত কণ্ঠে বলেন,
“না না, আমি শুধু চাইছি এই বাড়ির বাইরে গিয়ে কিছুদিন ঘুরে আসুক বেলা। সেটা তোমার সাথে হলে আমি নিশ্চিন্ত হই।”
ভ্যালেরিয়া বোনকে মনের কথা কী করে বোঝাবে? কী করে বোঝাবে তাঁরা সকলে যা ভাবে সে তা নয়। সে নিজের জীবনটাই উৎসর্গ করেছে ঈশ্বরের উদ্দেশ্য, ঈশ্বরের সৃষ্টি এই মানুষদের কল্যাণের নিমিত্তে। কিন্তু সকলের ভাবনার মতো ওত সহজ নয় তাঁর এই ‘সিস্টার’ জীবন। আর দশটা সাধারণ সিস্টারের মতোও নয় তার কাজ। বছর তিনেক হলো সে সিস্টারের শপথ নিয়েছে। তারপর থেকে বাড়িতে আসা হয়নি তেমন। ইসাবেলার অনুরোধ রক্ষার্থে তিন বছরে এই প্রথম এলো। ফাদার জালোনভের কাছ থেকে যখন তখন চিঠি এসে পৌঁছাবে দুয়ারে। চিঠি এলে তাঁকে ফিরতে হবে আবার। আর কোনোদিন এখানে ফেরা হবে কি না জানে না সে। তাকে আনমনা হতে দেখে আন্না মেরিও ফের শুধান,
“নেবে বেলাকে, ভ্যালেরি?”
“আপনি বুঝতে পারছেন না আপা। বেলা এখানেই ভালো থাকবে। রোজ সাথে করে শনি, রবিবারে চার্চে নিয়ে যাবেন। এখানকার চার্চের সিস্টারদের সাথে কথা বলব আমি। অনুরোধ করব ওকে একটু সময় দেওয়ার।”
আন্না মেরিওর মুখ কালো হয়ে যায়। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলেন,
“তোমাকে ছাড়া আর কারো সান্নিধ্যে ওকে দিয়ে ভরসা পাইনা আমি। একটু ভেবে দেখো আমার কথাটা।”
এখানের ভাবার কিছু নেই। ভ্যালেরিয়া পারবেই না ওই বিপদসংকুল জীবনে ইসাবেলাকে জড়াতে। ইসাবেলাকে সে বড্ড ভালোবাসে। মেয়েটার খারাপ কিছু হোক কিছুতেই চায় না। এই বাড়ির বাইরে প্রতি পদে পদে বিপদ ভ্যালেরিয়ার। তাইতো সে পিছুটান ভুলে থাকে। নিজের দুর্বলতাগুলো কাওকে দেখাতে চায় না।
“ভ্যালেরি!”
ইসাবেলার ডাকে সংবিৎ ফেরে। মুচকি হেসে বলে,
“ক্রাসিভায়া( বিউটিফুল) ঘুম ভেঙেছে তোমার? কিছু খাইয়ে দিই?”
“না, খিদে নেই। তুমি আরো কাছে সরে এসো। তোমাকে জড়িয়ে ধরি।”
ভ্যালেরিয়া ওকে জড়িয়ে ধরে। ইসাবেলা আদুরে বেড়ালের মতো ওর বুকে মাথা রেখে অনেকক্ষণ কোনো কথা বলে না। ভ্যালেরিয়া ওর হালকা বাদামি চুলে বিলি কেটে বলে,
“ক্রাসিভায়া, এমন করে তো জীবন চলে না। তোমাকে ধৈর্য শক্তি বাড়াতে হবে। শক্ত হতে হবে।”
“ওরা সকলে আমায় মিথ্যার মধ্যে রেখেছিল ভ্যালেরি। আমি কী করে শক্ত হব? তুমি আমাকে বলছ ভেঙে পড়তে না, ও ভ্যালেরি, আমি যে ইতোমধ্যে ভেঙেচুরে শেষ হয়ে গেছি। পিটার আমার মনটাকে এভাবে কেন ভাঙল?”
ভ্যালেরিয়া নিরুত্তর। ইসাবেলা ফুঁপিয়ে ওঠে।
“আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে হয় না ভ্যালেরি। এখানে দমবন্ধ হয়ে আসছে আমার। আর কিছুদিন থাকলে মরেই যাব বুঝি। তোমার সাথে করে নিয়ে যাও না আমায়, নেবে তো?”
“ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। ও কথা বলো না আর। নিজেকে এভাবে দুর্বল করে তুলো না ইসাবেল। এখানে থেকেই তোমাকে বাঁচতে শিখতে হবে। যিশুর জীবনী পড়েছ না? তিনি কত দুঃখ ভুগেছেন। শূলে বিদ্ধ হয়েছেন তবুও আশাহত হননি। কাওকে দোষারোপ করেননি। ভালোবাসেন তিনি আমাদের। ঈশ্বর তোমায় ভালোবাসে। এই দুর্যোগের কাল থেকে বেরিয়ে ঈশ্বরের দেখানো পথে চলতে হবে তোমায়। জীবন থেকে বিশ্বাস হারিয়ো না। ঈশ্বর তোমায় ধৈর্যশীল করুন। মঙ্গল হোক তোমার।”
ইসাবেল ওর গলা জড়িয়ে ধরে,
“আমি কিছু শুনতে চাই না। আমায় তুমি এবার সাথে করে না নিলে মরা মুখ দেখবে। আমি সত্যি মরে যাব ভ্যালেরি। পিটারের স্মৃতি আমায় মেরে ফেলবে। তোমার সাথে না রাখ, কিন্তু এই রিগা শহর থেকে আমায় নিয়ে চলো।”
ভ্যালেরিয়া চিন্তায় পড়ে। ইসাবেলা কাঁদতে কাঁদতে ওর বুকের উপর ঘুমিয়ে যায়। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের ঘন কালোয় চারপাশ ঢেকে গেছে। ভ্যালেরিয়া ঘণ্টাখানেকের জন্য পার্শ্ববর্তী চার্চে গিয়েছিল। বাড়িতে ঢোকার মুখে উত্তর দিকের রাস্তা থেকে ভেসে এলো ঘোড়ার খুঁড়ের আওয়াজ। থেমে দাঁড়ায় সে। মেরুন রঙের ফিটন এসে থামল ওর সামনে। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন চল্লিশোর্ধ্ব এক লোক। পরনে তাঁর কালো আলখেল্লা। মাথায় কালো পাগরি। মুখভর্তি দাড়িগোঁফ। গলায় ঝুলছে ক্রুশ। অভ্যর্থনা জানায় ভ্যালেরিয়া। লোকটাকে কয়েকবার দেখেছে ফাদার জালোনভের সাথে। চিনতে কষ্ট হলো না তাই। তবে নামটা ঠিক মনে করতে পারল না। লোকটা মাথা মৃদু নুয়ে প্রত্যুত্তর করে পকেট থেকে একটা খাম বের করলেন। শুকনো গোলাপের ছবির স্ট্যাম্পসম্বলিত খামটা দেখে গলা শুকিয়ে এলো ভ্যালেরিয়ার। হাত বাড়িয়ে খামটা নিলো। খামটা হাতে দিয়েই ফিটনে উঠে পড়ল লোকটা। উঠার আগে আরেকবার আশপাশটা সতর্কে দেখে নিলো। কোথাও কেউ নেই। লোকটাকে নিয়ে উত্তর দিকের রাস্তায় ফের হারিয়ে গেল ফিটনটি। ভ্যালেরিয়া গলার ক্রুশটা শক্ত মুঠে ধরে আস্তে আস্তে উঠে এলো দোতলায় ইসাবেলার কক্ষে। ইসাবেলা ঘুমিয়ে আছে। আজ অনেক বলে কয়েক চামচ স্যুপ খাওয়াতে সক্ষম হয়েছে। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ইসাবেলার তখনকার কথা। নতুন ভাবনা যোগ হলো আগত চিঠির ভেতরের অদেখা নির্দেশ। চিঠিটা অসতর্কে সামনের ছোট্ট টেবিলে রেখে ওয়াশরুমে ঢুকল।
হঠাৎ দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙে ইসাবেলার। পাশে ভ্যালেরিয়া নেই। বোধহয় পাশের ঘরে নৈশ প্রার্থনায় মগ্ন। ভ্যালেরিয়ার এই পরিবর্তন ভীষণ ভালো লাগে ইসাবেলার। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয় সেও সিস্টার হবে। না, সিস্টার নয়, সে হবে নান। কিন্তু মা রাজি হবেন না। বয়সও তো কম। সবে সতেরো পড়ল। নান হওয়ার ইচ্ছেটা এই ক্ষণে প্রবল হলো। এই মোহ, মায়া ত্যাগ করতে পারলেই বুঝি কষ্ট লাঘব হবে। আচ্ছা, মনুষ্য জীবনে এত কষ্ট কেন? গলাটা শুকিয়ে এসেছে। শিওরের পাশে পানির জগটা পেল না। ওই তো ছোট্ট টেবিলের উপর ওটা। অনাহারে দূর্বল শরীরটাকে ঠেলে তুলে দাঁড় করিয়ে চলল সেদিকে। পানি পান করে গ্লাসটা রাখতে যাবে তখনই চোখ পড়ে টেবিলে পড়ে থাকা চিঠির খামটার দিকে। হাতে তুলে নিলো। ভাবলো চিঠিটা পিটারের নয়ত? আনন্দটুকু তার নিমেষে মুছে গেল লেখাগুলো দেখে। পিটারের নয়। প্রেরকের নাম ধাম পড়তে পারল না। বড়ো অদ্ভুত লেখা। কোন দেশের ভাষা কে জানে? কিন্তু চিঠিটা কার? ভ্যালেরিয়ার! হঠাৎ চোখ পড়ল স্ট্যাম্পের শুকনো গোলাপের ছবিটার উপর। সাধারণ শুকনো গোলাপের মতো নয় ওটি। বেশ অন্যরকম। যেন শুকিয়েও জীবন্ত। আচমকা মনে হলো এই রকম একটা চিত্র ও আগেও কোথাও দেখেছিল! কিন্তু কোথায়?
চলবে,,,,
“তিমিরে ফোটা গোলাপ” এর পরবর্তী পর্বগুলো ১/২ দিন অন্তর অন্তর পাবেন।