তিমিরে ফোটা গোলাপ পর্বঃ ১৫

0
811

তিমিরে ফোটা গোলাপ
পর্বঃ ১৫
Writer Taniya Sheikh

রাত বাড়তে গণিকালয়ের জলসা আরো জমজমাট হয়ে উঠল। সর্বত্র বারবনিতাদের খিলখিল হাসি আর মদের ঝাঁঝাল গন্ধ। নিচে মশালের আলোতে জলসা বসেছে। সেখানে মদ, নগ্নতা আর অশ্লীল নাচ-গানে মেতেছে বারবনিতা আর পুরুষের দল। দোতলার রুমগুলো থেকে এক জোড়া বের হচ্ছে তো আরেক জোড়া প্রবেশ করে। নিকোলাস সন্ধ্যার আগেই নিজের প্রয়োজন শেষ করে বিদায় নিয়েছে। যাওয়ার আগে ফিরেও দেখেনি ইসাবেলার দিকে। যেন একেবারে অচেনা। ইসাবেলা অবাকই হলো নিকোলাসের না চেনার ভান এবং এই নীরব প্রস্থানে। কী আশা করেছিল? ও উদ্ধার করতে এসেছে? সে কি ভুলে গেছে নিকোলাস ওদের মতো সাধারণ মানুষ নয়। নিষ্ঠুর, নির্মম একটা রক্তপিপাসু। ইসাবেলার রক্ত ছাড়া আর কিছুই তার দরকার ছিল না। আজ সেই দরকার বোধহয় ঘুচেছে। তাইতো না চেনার ভান করল। ভালোই হয়েছে তাতে। একটা বিপদ তো গেছে মাথার ওপর থেকে। কিন্তু মন এখনও খচখচ করছে। ইসাবেলা ওকে পুড়ানোর চেষ্টা করল আর ও কিছুই বলল না? এত সহজে ছেড়ে দিলো?

“না ছাড়লে মনে হয় খুশি হতি?” মনের ভেতর থেকে কেউ একজন বিদ্রুপ করে। ইসাবেলা কপট রাগে বলে,

“ওর জন্যই ভালো হয়েছে চুপচাপ ছেড়ে দিয়েছে আমাকে। আবার জোর করুক না, কাঁচের টুকরো এবার ওর বুকে বিঁধিয়ে দেবো। খেয়াল রাখব এবার যেন আর না বাঁচতে পারে। আমাকে চেনে না, হুঁ।”

এই সাহসই ইসাবেলার শক্তি জোগায় পুনরায়। হার না মানার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। আঘাত করবে না মা আর ভ্যালেরিয়ার বিশ্বাসে। পাপের এই ক্লেদাক্ত খোঁয়াড়ে কিছুতেই সতিত্ব বিসর্জন দেবে না। এখান থেকে যে করেই হোক বেরিয়ে যাবে। কর্নেলার ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়ে দেখছিল সবকিছু। এই ঘরের একটা জানালা দিয়ে বাইরের রাস্তা দেখা যাচ্ছে। রাস্তার অদূরে মশাল জ্বলছে। সরাইখানা আর এই গণিকালয় ছাড়া সব দোকানপাটই বন্ধ। দিনের বেলার মতো রাস্তায় এখন আর সেই জনসমুদ্র নেই। হঠাৎ হঠাৎ দু’একটা টমটম উলটো দিকে ছুটে গেল। চট করে একটা বুদ্ধি আঁটে ইসাবেলা। রাত আরেকটু গাঢ় হতে গণিকালয় থেকে বেরিয়ে যাবে। ওই ষণ্ডামর্কা দাস বিক্রেতা লোকদুটোও হাল ছেড়ে ফিরে যাবে ততক্ষণে। ইসাবেলা একটু যেন আশার আলো দেখল। শান্ত হয়ে বসল কর্নেলার বিছানার এককোণে। সে বেরোবে এখান থেকে। হার মানবে না। সকল বাধা ঠেলে বাড়ি পৌঁছাবেই। সংকল্প আর সাহসে শরীরে যেন বল ফিরে পায়। সামনে খাবার রেখে গেছেন কর্নেলা। ইসাবেলা সারাদিনে কিছু খায়নি। বাড়ি ফিরতে হলে দেহটাকে সচল রাখতে হবে। কোনো ভাবেই দূর্বল হওয়া যাবে না। প্লেটের সবটুকু খাবার গ্রোগাসে খেয়ে নিলো। একগ্লাস ভদকাও পান করল। সারাদিনের ক্লান্তির পর একটু বিশ্রামের জন্য শরীরটা কাতর হয়ে আসে। মনস্থির করেছে রাত গভীর হলে বের হবে এখান থেকে। তার আগে একটুখানি ঘুমিয়ে নিলে মন্দ হয় না। সেই ভাবনাতেই ইসাবেলা শুয়ে পড়ল বিছানায়। সঙ্গে সঙ্গে ঘুমে ঢলে পড়ে। ঘুম ভাঙল মেয়েলী শীৎকারের আওয়াজে। পূর্ণ যৌবন ইসাবেলার। যৌনতা সম্পর্কে অভিজ্ঞ নয় সে। দৈহিক অনেক ব্যাপার সে জানে না। এই গণিকালয়ের ওই শীৎকার শ্রবণে দেহে নতুন এক অনুভূতি অনুভব করে। ভাঁটার পরে যেমন নদীতে জোয়ার উছলে পড়ে, ওর দেহেও তেমনই অনুভূতি জাগে। গলা শুকিয়ে আসে। দু’পা জড়ো করে, দুহাতে বিছানার চাদর খামচে ধরেছে। শ্বাস ভারী হয়। নিচের ঠোঁট কামড়ে কিছু যেন রুখতে চাইছে। পাশের ঘর থেকে আরো জোরে জোরে আসছে নর-নারীর শীৎকারের শব্দ। ইসাবেলার ডান হাতটা আস্তে আস্তে বুকের ওপর নেমে এলো। ডান বর্তুলকার বক্ষজের ওপর মৃদু চাপ দিতে বিস্ময়ে চোখের পাতা খুলে ফেলল। হুঁশ ফেরে ওর। তড়াক করে উঠে বসে বিছানার ওপর। কী করতে যাচ্ছিল? লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে উঠল। আশেপাশে তাকাল। ভাগ্যিস কেউ দেখেনি এই লজ্জাজনক মুহূর্ত। দু’হাতে কান চেপে ধরে স্তননের শব্দ থেকে নিষ্কৃতি পেতে। দু ফোঁটা চোখের জল ফেলে বসে বসে। এক মুহূর্ত আর এখানে থাকবে না। বেরিয়ে এলো রুমের বাইরে। রাত কত হয়েছে কে জানে? আশপাশের স্তিমিত প্রায় শোরগোলে আন্দাজ করে নিলো বেশ রাত হয়েছে। দোতলাতে দু’একটা ঘর ছাড়া আর সব নীরব। বাইরেও কেউ নেই। ইসাবেলা সাবধানে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। জলসা ঘরে মাতাল, অর্ধ মাতাল হয়ে পড়ে আছে সব। ইসাবেলাকে ওরা খেয়াল করল না। কর্নেলাও কোথাও নেই। এই সুযোগে সদর দরজা থেকে বেরিয়ে এলো। দরজার সামনে দুটো মাতাল পা ছড়িয়ে নেশার ঘোরে কী সব বিড়বিড় করছে। ওই দাস বিক্রেতা দুটোকেও দেখতে পেল না। স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল ওর। মাতাল দুটো টের পাওয়ার আগেই সামনের অন্ধকারে বেরিয়ে এলো। কোথায় যাচ্ছে জানা নেই। কিন্তু পা থামাচ্ছে না। এই আঁধার আর উদ্দেশ্যহীন শূন্য পথে একমাত্র ঈশ্বর ওর ভরসা। সে সতর্কে এগিয়ে যাচ্ছে। শুনশান রাতের এই পথের পদে পদে ভয় আর আতঙ্ক। ইসাবেলা কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি এমন দিন তাকে দেখতে হবে, এত ভয় আর আতঙ্ক আসবে জীবনে। দেশ, পরিবার পরিজন বিচ্ছিন্ন হতে হবে। কিন্তু এটাই বোধহয় জীবন, অপ্রত্যাশিত, অনিশ্চিত আর নিঃসঙ্গতা। হাঁটতে হাঁটতে বাজারের মূল ফটকের দ্বারে এসে থামল। ওই তো লোকালয়। নিঝুম, অন্ধকারের চাদরে মুড়ে আছে টালির ছাদ দেওয়া, কাঠের বাড়িগুলো। হঠাৎ হঠাৎ অদূরে ডেকে উঠছে শেয়াল। ইসাবেলা সামনে আবার চলতে শুরু করে। শূন্য গৃহস্থের আঙিনা পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যায়। কয়েকটা বাড়ি পেরোতেই একটা ঘোড়াশাল দেখতে পেল। ইসাবেলার চোখ আনন্দে চকচক করে ওঠে। ওদের বাড়িতে ঘোড়া আছে। পিটার আর ভ্লাদিমির সাহায্যে ঘোড়ায় সওয়ারী হয়েছে অনেকবার। ঘোড়াশালে দুটো ঘোড়া জাবর কাটছিল। একটা কালো অন্যটা বাদামী রঙের। ইসাবেলা বাদামী রঙের ঘোড়াটাকে বশে আনতে সক্ষম হলো। ওটার গলার রশি খুলবে ঠিক সেই সময় কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে থমকে যায়। ঘোড়ার রশি ছেড়ে কাঁচের টুকরোটা বের করে আনল বুকের কাপড়ের ভেতর থেকে। কাপড়ে মোড়া টুকরোটা উন্মুক্ত করে ভয়ে ভয়ে পেছনে ফিরল। কেউ নেই! তবে কি মনের ভুল ছিল? হয়তো তাই হবে। ইসাবেলা শব্দ করে দম ফেলে ফের ঘোড়ার রশি খুলতে আরম্ভ করে। এবার ঘোড়া সামান্য লাফিয়ে উঠল। ঘোড়ার দৃষ্টি ইসাবেলার পেছনে। সস্তা মদের উৎকট গন্ধ নাকে এসে লাগতে গা শিউরে ওঠে ওর। পেছন থেকে ভারী পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে। ইসাবেলা দ্রুত ঘুরে দাঁড়ায়। ভয়, আতঙ্কে মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। হলদেটে, নোংরা দাঁত বের করে হাসছে ষণ্ডামর্কা সেই দাস বিক্রেতা দুটো। ইসাবেলা হাতের কাঁচের টুকরো তুলে ধরে বলল,

“কাছে এগোবি না। এলে পেট ফুটো করে দেবো।”

একটু থামল ওরা। পরস্পরের দিকে চেয়ে শব্দ করে হেসে পা ফেলে ছুটে এলো ইসাবেলার দিকে। দিশাহারা হয়ে উল্টোদিকে দৌড় দেয় ইসাবেলা। বিধিবাম! সামনে কাঠ দিয়ে ঘেরা। লোক দুজন হাসতে হাসতে কিছু বলছে। ইসাবেলা বুঝল না ঠিক। ইসাবেলার সর্ব শরীর থরথর করে কাঁপছে। এখনই হয়তো অচেতন হয়ে পড়বে আতঙ্কে। হলোও তাই। বাঁচার সকল পথ বন্ধ জেনে লোকদুটোর এগিয়ে আসা দেখে সে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে নিচে।

প্রখর সূর্য রশ্মি চোখে পড়তে চেতনা ফিরল ইসাবেলার। কানে এলো মানুষের কোলাহল আর কর্কশ গলার চিৎকার। পিটপিট করে চোখের পাতা খুলতে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। ভয়ে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। গতকাল যেখানে ওই মেয়েটি দাঁড়িয়ে ছিল। আজ নিজে দাঁড়িয়ে সেখানে। সর্ব শরীর ব্যথায় টনটন করছে। নড়তে গিয়ে বুঝতে পারল একটা খাম্বার সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে তাকে। আশপাশের সেই জনারণ্য। তারই মধ্যে কর্নেলাকে দেখতে পেল। হতাশ, উদ্বিগ্ন। তিনি বোধহয় সত্যিই ইসাবেলার ভালো চেয়েছিলেন। ইসাবেলা কাঁদত লাগল তাকে দেখে। কিন্তু তাঁর চোখের ভাষা বলছে,

“কত সতর্ক করলাম তোমাকে, শুনলে না। এবার বোঝো।”

কর্নেলার কালকের কথা হঠাৎ স্মরণ হয়। শয়তান দুটো ওকে ধর্ষণ করে নি তো? শব্দ করে কাঁদতে লাগল এবার ও। পরনের কাপড় ছেঁড়া, কর্দমাক্ত। শরীরের হাড়ে হাড়ে ব্যথা। গতকালের সেই অসুরের মতো লোকটা এগিয়ে এলো। তার পেছনে শয়তান দুটো। চোখ দুটো চকচক করছে লালসায়। ইসাবেলা চিৎকার করে অভিশাপ, গালাগাল দিতে চাইল। গলা দিয়ে গোঙানির আওয়াজ ছাড়া কিছু বেরোলো না৷ প্রচণ্ড ব্যথা গলায়। অসুরের মতো লোকটা ওর চিবুক রুক্ষ ভাবে তুলে চোখ বুলিয়ে নিলো ইসাবেলার আপাদমস্তক।

“ওর সাথে শুয়েছিস তোরা হারামজাদা? নিষেধ করেছিলাম না তোদের?”

লোকটা ঘুরে দাঁড়িয়ে পেছনের অনুচরদ্বয়কে ঘুষি দিতে ওরা ভীত কণ্ঠে বলল,

“না, মালিক। মায়ের কসম করে বলছি ওর সাথে কিছু করিনি। টেনে হিঁচড়ে আনতে গিয়ে কাপড় ছিঁড়েছে।”

“সত্যি তো?”

“বউ বাচ্চার কসম করে বলছি। আপনার নিষেধ অমান্য করিনি।”

যথার্থই ওরা অচেতন অবস্থা ধর্ষণ করেনি ইসাবেলাকে৷ মালিককে বাঘের মতো পায়। সেই ভয়েই ইচ্ছে সত্বেও মেয়েটাকে ভোগ করা থেকে নিজেদের বিরত রেখেছে।

“এই জন্য আজ মোটা টাকা পাবি। যা এখান থেকে।”
পুরু মোছে তা দিয়ে অনুচর দুটোকে বিদায় করে দাস বিক্রেতা ইসাবেলার পাশে এসে দাঁড়ায়। সামনে দাঁড়ান কর্নেলার হতাশ মুখের দিকে চেয়ে মুচকি হাসল। উপস্থিত জনগণকে উদ্দেশ্য করে ইসাবেলাকে দেখিয়ে যা বলল তা স্থানীয় ভাষায় দাঁড়ায়,

“সতি, যুবতী। সুদূর রাশিয়ান সুন্দরী এই মেয়ে। ঘরের সকল কাজে সিদ্ধহস্ত। এই যুবতি যার হবে সে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান ব্যক্তি। তো জনাব, বলুন, কে চান এই সুন্দরী যুবতীকে।”

অনেকে হাত তুলল। কিন্তু দামে সন্তুষ্ট হয় না দাস বিক্রেতা। সে চাহিদা দেখে দাম আরো হাঁকায়। অবশেষে ভিড়ের মধ্যে একজন বলে ওঠে,
“দুশো মার্ক”

ভুড়িওয়ালা বিশালদেহী ষাটোর্ধ এক লোক হাত তুলে সামনে এগিয়ে এলো। মুদ্রা ভর্তি থলি হাতে পেয়ে দাস বিক্রেতার চোখ ছানাবড়া। সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে অবশেষে নিলাম বন্ধ করে দিলো। ভুড়িওয়ালা লোকটা লোলুপ চোখে চেয়ে আছে ইসাবেলার দিকে। দাস বিক্রেতা ওর হাতের বাঁধন খুলতে সে ক্রন্দনরত গলায় বহু কষ্টে অনুনয় করে,

“প্লিজ, প্লিজ।”

দাস বিক্রেতার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। ইসাবেলাকে সে টেনে হিঁচড়ে ক্রেতার দিকে এগিয়ে যায়। ইসাবেলা আর্ত চোখে সাহায্যের জন্য এদিক ওদিক তাকায়। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসে না। হঠাৎ রাস্তার এককোনে দাঁড়ান সেই টমটমে নিকোলাসকে বসে থাকতে দেখল। ওর মুখ দেখা যাচ্ছে না। মাথায় হুডি তুলে আয়েশ করে টমটমে মাথা এলিয়ে বসে আছে। টমটমের সামনে বসা সেই ভৃত্যটি। ইসাবেলা সর্ব শক্তি ব্যয়ে চিৎকার করে তার কাছে সাহায্য চায়,

“সাহায্য করুন আমাকে। ঈশ্বরের দোহাই লাগে সাহায্য করুন।”

লোকটা শুনেও সে কথা শোনে না। একচুল নড়ল না। ভাবলেশহীন মুখে চেয়ে রইল ইসাবেলার দিকে। নিকোলাসও ফিরে তাকাল না ওর দিকে। দাস বিক্রেতা ভুড়িওয়ালার হাতে তুলে দিতে ইসাবেলা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। ও জানে সামনে দাঁড়ান এই লোলুপ কুকুরটা এখন কী করবে। রাগে ক্ষোভে চিৎকার করে নিকোলাসকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“আজ ভরা মজলিশে আমার ইজ্জত হরণ করবে এই কুকুরটা। এই তো চেয়েছিলে তুমি। আমাকে লাঞ্ছিত, অপদস্ত হতে দেখে আনন্দ হচ্ছে তোমার, তাই না? জানোয়ার, অমানুষ, তোকে আমি কোনোদিন ক্ষমা করব না। ঘৃণা করি তোকে আমি, ঘৃণা করি। আমার জীবনের এই পরিণতি আজ তোর জন্য। তুই আমার পবিত্র জীবনটাতে কলঙ্কের কালি মেখে দিলি। তোকে ঈশ্বর কোনোদিন ক্ষমা করবে না। আমার মায়ের হায় লাগবে তোর ওপর__” ইসাবেলার কথা থেমে যায় ভুড়িওয়ালার হাত বুকের ওপর থামতে। অন্যহাতে লোকটা ওর ঘাড় ধরে চুমু খাওয়ার জন্য মুখ নামিয়ে আনে। ইসাবেলা লোকটার মুখের ওপর একদলা থু থু দিয়ে সরে যায়। উপস্থিত জনতা হো হো করে হেসে ওঠে তাই দেখে। অপমানে গজগজ করতে করতে সজোরে চপেটাঘাত করল ইসাবেলার গালে। নিচে পড়ে গেল ইসাবেলা। লোকটা ওর চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলে দাঁত খিচিয়ে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল দিলো। লোকটার অন্য হাত সাপের মতো ওর বুকের জামার ওপর এসে থামে। এরপর কী হবে ইসাবেলা জানে। কিছুক্ষণের জন্য যেন শ্বাস নিতে ভুলে গেল ও। লোকটার ঠোঁটের কোণে পৈশাচিক হাসি। ইসাবেলার গলার কাছের জামার কিছু অংশ ছিঁড়ে ফেলল এক টানে৷ লজ্জায় দুচোখ বন্ধ করে ইসাবেলা। নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে। লোকটা ওর বুকের কাপড় সম্পূর্ণ ছিঁড়তে যাবে তখনই পেছন থেকে সেই পরিচিত, কাঙ্ক্ষিত গলার স্বর শুনতে পেল ইসাবেলা। নিজের কানকে যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।

“ওকে ছেড়ে দাও।”

ইসাবেলা তখনও চোখ মেলেনি। দুচোখ দিয়ে জল পড়ছে। লোকটার হাত সরে গেছে ওর বুকের ওপর থেকে। যেন হাত নয় মস্ত এক অজগর ছিল। ইসাবেলা সরে দাঁড়ায়। রুক্ষ, বিরক্ত হয়ে লোকটা নিকোলাসের দিকে ঘুরে বলল,

” তুই কে রে শালা? রাজা বাদশাহ? ভালোই ভালোই বলছি সটকে পড় এখান থেকে। নচেৎ মেরে বাপের নাম ভুলিয়ে দেবো। টাকা দেখাচ্ছে আমায়।”

নিকোলাস গম্ভীর গলায় আবার বলল,

“তুমি যা দিয়েছ তার তিনগুন দিচ্ছি। ছেড়ে দাও ওকে।”

ইসাবেলা চোখ খুলে তাকাল এবার নিকোলাসের দিকে। নিকোলাস কী বলতে চাইছে বুঝতে চেষ্টা করল। নিকোলাসের আলখেল্লার হুডি নাক পর্যন্ত ঢাকা। ঠোঁট দুটো শক্ত হয়ে আছে। ভুড়িওয়ালার পায়ের কাছে মুদ্রা ভর্তি একটা থলে ছুঁড়ে দিলো সে। লোকটা মুদ্রা ভর্তি থলি দেখে হাসল।

“আরে যা ব্যাটা, এই ছেমরি আমার। ঢের টাকা আছে আমার, কিন্তু এমন সুন্দরী নেই। এই ছেরির ভরা যৌবনের গাঙে আজকে সাঁতার কাটমু আমি।”

উপস্থিত জনতার কয়েকজন হো হো করে হেসে ওঠে। লোকটা স্থানীয় ধনী। মুদ্রা নয় ইসাবেলাকে প্রয়োজন তার। এই মেয়ে এত মানুষের সামনে তার মুখে থু থু দিয়েছে। কেনা দাসীর এত স্পর্ধা! জনসমক্ষে মেয়েটাকে শিক্ষা না দিলে তার শান্তি হবে না। সুতরাং নিকোলাসের কথা আমলেও নিলো না। উলটো তার লাঠিয়াল বাহিনীকে ইশারা করে নিকোলাসকে বন্দি করার জন্য। ইসাবেলার দিকে আবার ফিরল সে। হাত বাড়াল ওর বুকের অর্ধ ছেঁড়া জামার দিকে। ইসাবেলা সাহায্যের আশায় নিকোলাসের দিকে তাকায়। নিকোলাস তেমনই নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার লালসার হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে ইসাবেলা। কিন্তু লোকটা ওর গলা চেপে ধরেছে এক হাতে। মুখটা নামিয়ে এনেছে চুমু খাবে বলে। লোকটার অন্য হাত বুকে রাখবে তখনই ইসাবেলার চোখের সামনে ঘটে গেল নৃশংস এক ঘটনা। কোথা থেকে একটা শ্বেতকায় নেকড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল ভুড়িওয়ালা লোকটার ওপর। মুহূর্তে তার শরীর খণ্ড বিখন্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ইসাবেলা চারিদিকে। ভয়ে চিৎকার করে ওঠে ইসাবেলা। লোকটার রক্তের কয়েক ফোটা ছিটকে পড়ে ওর গায়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় উপস্থিত জনতা স্তম্ভিত। ইসাবেলার সামনে দাঁড়িয়ে সদর্পে গর্জন করছে নেকড়েটা। ওর জ্বলজ্বলে রক্ত লাল দৃষ্টি আর রক্ত মাখা শ্বদন্ত দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠল সব। ছুটোছুটি করতে লাগল এদিক ওদিক। কেবল কর্নিলাকে বিচলিত হতে দেখা গেল না। দাস বিক্রেতার দিকে বিদ্রুপাত্মক হেসে ধীরে ধীরে গণিকালয়ের দিকে চলে গেলেন। দাস বিক্রেতার রেগে যায়। তার আদেশে অনুচর দুটো মারতে ছুটে এলো নেকড়েটাকে। ও দুটোরও ভুড়িওয়ালার মতো একই পরিণতি হয়। এই দৃশ্য দেখে ভয়ে পালায় দাস বিক্রেতা। ইসাবেলা কিন্তু তেমনই জড়বৎ দাঁড়িয়ে আছে ভীত বিহ্বল হয়ে। রক্তে ভেজা ওর সারা শরীর। নেকড়ে ওর দিকে তাকাতেই ইসাবেলা ওই চোখে চেয়ে সম্মোহিত হয়ে যায়। ঘুরে দাঁড়ায় নেকড়ে। হেঁটে যায় টমটমের দিকে। ইসাবেলা কলের পুতুলের মতো সেটাকে অনুসরণ করে। কোচওয়ান আগে থেকে সিটে তৈরি হয়ে ছিল। নেকড়ে লাফ দিয়ে উঠে পড়ল টমটমের ভেতরে। তারপর ইসাবেলা আস্তে আস্তে উঠে বসল সেটার পাশে। মুহূর্তে ঘোড়ার পিঠে চাবুক কষতে টমটম নিয়ে ছুটল ঘোড়া। ইসাবেলার সংবিৎ ফিরতে ঘুরে তাকাল পাশে। অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে রইল। পাশে সম্পূর্ণ নগ্ন শরীরে নিকোলাস বসে আছে। চোখ বন্ধ করে সিটের সাথে মিশে গেছে ওর দেহ। ইসাবেলা চোখ সরিয়ে নেয় লজ্জায়।

“সামনের মোটা কম্বলে ঢেকে দাও ওর শরীর। দ্রুত করো।”

কোচওয়ানের রুক্ষ গলার স্বরে বোকার মতো চেয়ে রইল ইসাবেলা। এই লোক কথা বলতে পারে? রাশিয়ান ভাষাও জানে? কোচওয়ান আবার একই কথা বলল উদ্বিগ্ন গলায়। ইসাবেলা তার কথা মতো সামনে সিটের তলা থেকে মোটা কম্বল বের করে কাঁপা হাতে নিকোলাসের শরীর ঢাকতে লাগল।
ভীত চোখে নিকোলাসের মুখটা দেখছে। কী দেখল একটু আগে? নিকোলাস! রক্তচোষা! নেকড়ে! বড়সড় একটা ঢোক গিললো। হঠাৎ দৃষ্টি থামল নিকোলাসের বুকের বা’পাশের উল্কা চিত্রর ওপর। একটা গোলাপ, পাশে চাঁদের মতো সিম্বোলিক আকৃতির চিত্র। চিত্রটা আরো ভালো করে বুঝার জন্য ঝুঁকে যেতে নিকোলাস চোখ মেলে তাকায়। এই দৃষ্টি ইসাবেলা চেনে। প্রথম যেদিন মাদাম আর ও নিকোলাসকে ঝিলের পাড়ে পেয়েছিল, ঠিক এমন দূর্বল আর অসুস্থ দেখাচ্ছিল ওকে। শ্বাস ধীরে ধীরে পড়ছিল। জ্বরের রোগীর মতো কাঁপছিল নিকোলাস। আজও হুবুহু তাই হচ্ছে। ইসাবেলা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। নিকোলাস কম্পিত হাতে ওর হাত থেকে কম্বল কেড়ে নিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে নিলো। বিড়বিড় করে বলল,

“সরে যাও আমার কাছ থেকে, সরে যাও।”

ইসাবেলা ভয়ে ভয়ে সরে বসল। নিকোলাস শব্দ করে অসুস্থ মানুষের মতো শ্বাস ছাড়ছে। নিকোলাস যেন একটা ভুলভুলাইয়া। যত দেখছে ততই মাথা আউলে যাচ্ছে। অপ্রত্যাশিত নতুন নতুন রূপ প্রকাশ পাচ্ছে ওর। ইসাবেলা হতবুদ্ধি হয়। হঠাৎ নিজের দিকে চোখ পড়ে। সারা শরীরে রক্ত দেখে গা শিউরে ওঠে। কী নৃশংস ঘটনাই না প্রত্যক্ষ করল আজ! নিকোলাসের এই নৃশংস রূপ আরো বেশি ভীতসন্ত্রস্ত করে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। কত পুরুষই না স্পর্শ করল আজ। গা ঘিন ঘিন করছে। হাত দিয়ে শরীরের এখানে ওখানে মুছতে লাগল। কিছুক্ষণ পর টমটম এসে থামে একটা অচেনা পরিত্যক্ত বাড়ির সামনে। ইসাবেলা বাড়িটার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পাশে তাকাতে অবাক। নিকোলাস পাশে নেই!

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here