তিমিরে_ফোটা_গোলাপ পর্ব-১৮

0
616

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব-১৮
Writer Taniya Sheikh

কদিন ধরে ইসাবেলার মনের মধ্যে উশখুশ করছে ঝরণার ওপরের দিকটা ঘুরে দেখার ইচ্ছায়। পাহাড়ের যে স্থান থেকে ঝরনার পানি নিচে গড়িয়ে পড়ছে সেটা বেশ উঁচুতে। ওই পর্যন্ত যাওয়াও রীতিমতো কষ্টসাধ্য। তবু কৌতূহলের বশে সিদ্ধান্তটা নিয়ে নিলো। সাথে আনা শুকনো কাপড় পাথরের ওপর রেখে গভীর দম নিয়ে পা বাড়ায়। পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠা সহজ ব্যাপার নয়। পা পিছলে পড়ল কয়েকবার। ব্যথাও পেল। কিন্তু হার মানল না। এক মন সতর্ক করে ফিরে যেতে। আরেকমন বেশ জোরের সহিত তাকে উৎসাহ দেয় ওপরে উঠতে। দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে জোরওয়ালা মনকে শুভাকাঙ্ক্ষী ভেবে পুনরায় চেষ্টা করে। না, এভাবে বেয়ে বেয়ে ওঠা সম্ভব নয়৷ আবার বিপদও আছে। উঁচু থেকে পড়লে মেরুদণ্ড ভেঙে যাওয়া কিংবা পটল তোলারও সম্ভবনা প্রবল। ইসাবেলা একটু দূরে পাহাড়ের গায়ে জড়ানো ঝোপঝাড়ের মধ্যে পথ খুঁজতে থাকে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর নিবিড় ঝোপের মধ্যে দিয়ে সহজে ওঠার একটা রাস্তা পেল। এদিকটা তেমন পিচ্ছিল ঢালু নয়।একটু ওপরে কয়েকটা মাঝারি বুনো গাছ। ওদের ধরে ধরে পথ টুকু হাঁফাতে হাঁফাতে উঠে এলো। মাথার ওপর দিগন্ত বিস্তৃত খোলা আকাশ। মুক্ত বাতাসের সাথে মিশে এলো পরিশুদ্ধ মিষ্টি ঘ্রাণ। নিচের মতো অত ঘন বন নয় এখানে। দূরে দূরে কয়েকটা ম্যাপেল আর বীচবৃক্ষ। শরৎ বোধহয় এখনও আসেনি। ম্যাপেল ট্রির পাতাগুলো সবুজ। শরতে এই পাতার সৌন্দর্য স্বর্গীয় রূপ ধারণ করে। সূর্যটা পূর্ণ তেজে জ্বলছে। গাছের ফাঁক গলে পানিতে সেই তেজ পড়তে ঝিলিমিলি করছে পানি। ঝরনার ওপরের জলের উৎসের পাশে এসে দাঁড়ায় ও। স্বচ্ছ জলের পুষ্কনি যেন। সেটাই আস্তে আস্তে ঝিরির রূপ নিয়ে বনের ভেতর ঢুকে গেছে। স্বচ্ছ জলের কোল ঘেঁষে জানা -অজানা রং-বেরঙের ফুল আর ফল গাছের মেলা যেন। একঝাঁক প্রজাপতি উড়ছে ফুল গাছের ওপর। পাখির কূজনে মুখর চারিপাশ। সাথে ঝরনার অবিরাম ঝরে পড়ার শব্দ তো আছেই। ইসাবেলার মন প্রাকৃতিক এই সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে বর্তমান ব্যথা, বেদনা ভুলে গেল। একটু হাঁটলে ঝিরিটা সরু হয়ে বনের ভেতর হারিয়ে গেছে। এদিকটা ছায়াঘেরা সুনিবিড়। বেশ ঠাণ্ডা। ঝিরিপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সামনের মনোরম পরিবেশ উপভোগ করে। ঝিরির ওপাশটা ঘন সবুজ ঘাসে ছাওয়া। ওরই মধ্যে একটা খরগোশ ঘাস মুখে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। ইসাবেলার বেজায় আনন্দ হলো শ্বেতশুভ্র খরগোশটা দেখে। সাবধানে ঝিরি পেরিয়ে খরগোশটার কাছাকাছি যায়। ইসাবেলাকে দেখতে পেয়ে ওটা ঘাসের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। হতাশ মুখে দাঁড়িয়ে পড়ে ইসাবেলা। কিন্তু একটু পরেই ফের মাথা তুলে উঁকি দেয় খরগোশটা। দীর্ঘ হাসি ইসাবেলার ঠোঁটে। ওটাকে ওর চায়। ছুটল খরগোশ ধরবে বলে। মাটি, কাঁদা মাখামাখি করে শেষমেশ ধরতে পারে। ওর হাসির শব্দ ঝরনার ঝরে পড়ার শব্দকেও ক্ষণিকের তরে বুঝি স্তব্ধ করে দেয়। হাঁফাতে হাঁফাতে শুয়ে পড়ল ঘাসের ওপর। খরগোশটাকে দু’হাতে বুকের ওপর ধরে রেখেছে। আতঙ্কিত চোখে চেয়ে আছে ওটা। ইসাবেলা পরম মমতায় ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

“ভয় পাস না। আমি তোকে মারব না বরং অনেক অনেক আহ্লাদ করব। আজ থেকে তুই আমার সাথে থাকবি। তোকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে।”

খরগোশটাকে বুকের সাথে ধরে নেমে এলো নিচে। ঝরনার কাছে এসে বলল,

“তোকে ছেড়ে দিলে ফের পালাবি। তোকে এভাবে নিয়ে গোসলও তো করতে পারব না। কী করি বলতো?” একটুখানি ভেবে সহাস্যে বলল,

“চল তোকে আগে রুমে রেখে আসি। তুই কিন্তু একটুও ভয় পাস না বুঝলি? আজ থেকে তুই আর আমি বন্ধু। জানিস আমি এখানে বন্দি জীবনযাপন করছি। আমার চারপাশে রক্তচোষার দল। হুট করে ওরা একদিন মেরে ফেলবে আমাকে। মরার আগে মা-বাবা কাওকে দেখতে পারব না। তুই কি আমার কষ্ট বুঝতে পারছিস? আচ্ছা, তোর পরিবার আছে?”

ঘরে এসে বিমর্ষ মুখে বলল,

“তোকেও বুঝি বন্দি করলাম তাই না? এটা ঠিক হলো না। ছেড়ে দেবো তোকে। আমি চাই না আমার মতো তোরও বন্দিজীবন কাটুক। কিন্তু একটুখানি সময় আমার সাথে থাক না, একটুখানি। সন্ধ্যার আগে আমি তোকে রেখে আসব ওখানে। থাকবি?”

খরগোশটা কী বুঝল কে জানে? ওটার চোখের আতঙ্কিত ভাব আর নেই। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে ইসাবেলার মুখের দিকে।

“সত্যি বলছি। আচ্ছা দ্যাখ, এই ওয়াদা করলাম সন্ধ্যার আগে আগে রেখে আসব। ততক্ষণ আমার সাথে থাক। তোকে পেয়ে আমি অনেকদিন পর খুশি হয়েছি। অনেক অনেক খুশি।”

খরগোশটাকে বিছানায় বসিয়ে বলল,

“চুপটি করে বসে থাক। আমি যাব আর আসব। তারপর দুজনে মিলে অনেক মজা করব, হুম।”

দরজা বাইরে দিয়ে বন্ধ করে সানন্দে নাচতে নাচতে সিঁড়ি বেয়ে নামে। নিচের সিঁড়িতে পা দিতে নিকোলাসের মুখোমুখি হয়। ইসাবেলার মুখের এই হাসি আগে দেখেনি নিকোলাস। অপলক চেয়ে রইল। অস্বস্তিতে হাসি নিভে গেল ইসাবেলার ঠোঁটে। পাশ কেটে যেতে নিকোলাস বলে,

“হঠাৎ এত আনন্দের কারণ?”

ইসাবেলা থামল তবে জবাব দিলো না। এক মাস হতে চলল নোভার দাসী হিসেবে আছে। নিকোলাসের সাথে এরমাঝে দেখা হলেও এড়িয়ে গেছে। কী দরকার সেধে বিপদ ডেকে আনার। ও বেশ বুঝেছে নিকোলাস ওর জন্য সঠিক কেউ না। বিপদের নামান্তর। সুতরাং যতটা পারা যায় এড়িয়ে গেলেই বাঁচে। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা নিকোলাস আমলে নেয়নি। কিন্তু ইদানীং ইসাবেলার এই উপেক্ষা, এড়িয়ে যাওয়া মোটে পছন্দ হচ্ছে না। আজও যখন ঠিক একই কাজ করল রাগে ওর বাহু চেপে ধরে।

“কানে খাটো? কথা বলেছি শোনোনি? আমাকে অসম্মান করার শাস্তি কতটা ভয়ানক হয় জানো তো?”

ইসাবেলা মাথা নিচু করে জোরপূর্বক বাহু ছাড়িয়ে নিলো। তারপর মুখ তুলে একপলক নিকোলাসের রাগত মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করে। এই লোকটার সমস্যা কী? ইসাবেলা তাকে এড়িয়ে যায় সে বোঝে না? ইচ্ছে করে ইসাবেলাকে বিপদে ফেলতে চাইছে বোধহয়। নির্লিপ্ত মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে পা চালিয়ে বেরিয়ে গেল সদর দরজা দিয়ে। নিকোলাসের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। কত বড়ো স্পর্ধা এই মেয়ের! নিকোলাসের কথাকে উপেক্ষা করে!

“এক্ষুনি গলা টিপে ধর। ওর দেহের রক্ত চুষে মেরে ফেল। শিক্ষা দে এই অসম্মানের।” নিকোলাসের ভেতরের শয়তানটা রাগে গজগজ করে। নিকোলাস চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়ায়,

“না, নির্বোধ এই মেয়ে। মাফ করে দিলাম এবারকার মতো।”

দ্রুত গোসল সেরে ইসাবেলা ফিরে আসে প্রাসাদে। একপ্রকার দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলো। দরজার কাছাকাছি আসতে থ মেরে দাঁড়িয়ে যায়। ওর স্পষ্ট মনে আছে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে গিয়েছিল। তাহলে খোলা কেন? রুমের ভেতর ঢুকতে চিৎকার করে ওঠে,

“নোভা, এ কি করলে?”

রক্তমাখা মুখে ভ্রু কুঁচকে তাকায় নোভা। হাতে এখনো খরগোশটার অর্ধ খাওয়া রক্তাক্ত দেহটা। ইসাবেলা কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ল দরজার গোঁড়ায়।

“কী হয়েছে ইসাবেল?”

“কী হয়েছে? পিশাচিনী, ডাইনি কোথাকার। কেন খেলি খরগোশটাকে? কেন?”

ক্রন্দনরত গলায় চেঁচিয়ে ওঠে ইসাবেলা। নোভা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল। তারপর অপরাধী মুখে বলল,

“আমি ভেবেছি তুমি আমার জন্য এনেছ।”

ইসাবেলা সেকথা শুনেও শুনলো না। কপাল চাপড়ে বলল,

“সব দোষ আমার। কেন নিয়ে এলাম ওকে এখানে আমি? কেন আনলাম? আমার জন্য নিষ্পাপ প্রাণীটা মারা পড়ল। আমি ওকে ওয়াদা করেছিলাম রেখে আসব। ওয়াদা ভঙ্গ হলো তোমার কারণে। মেরে ফেললে তুমি ওকে। এমন কেন করলে? তোমাকে আমি ক্ষমা করব না নোভা। কক্ষনো না।”

ইসাবেলা দৌড়ে বেরিয়ে যায় প্রাসাদের বাইরে। ঝরনার পাশে হাঁটু মুড়ে বসে সশব্দে কাঁদতে লাগল। নিকোলাস পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। ইসাবেলাকে কাঁদতে দেখে থেমে যায়। মনে মনে কৌতূহল জাগলেও সেটা দমন করে নিজের কাজে চলে গেল। সন্ধ্যার পর ওই পথেই ফিরছিল। ঝরনার ওদিকটাতে চোখ যেতে একইভাবে বসে থাকতে দেখল ইসাবেলাকে। ক্রন্দনে কেঁপে কেঁপে উঠছে ওর দেহ। নিকোলাস পাশে এসে দাঁড়ায়।

“পিটার মরেছে।”

লাফ দিয়ে ওঠে ইসাবেলা। আর্ত চোখে তাকায় নিকোলাসের মুখপানে। নিকোলাস এবার বিরক্তি চেপে সঠিকভাবে বলল,

“এভাবে ভর সন্ধ্যাবেলা এই নির্জনে বসে কাঁদছ কেন? তোমার পিটার মরেছে?”

ইসাবেলা কোনো কথায় বলল না। রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠল। সাধ্যি থাকলে এই মুহূর্তে নিকোলাসকে খুন করে ফেলত ও। সাধ্য নেই বলেই দাঁতে দাঁত কামড়ে চুপ করে রইল। নিকোলাস জবাব না পেয়ে ধমকে ওঠে,

“বাচ্চাদের মতো কাঁদছ কেন?”

ভয় পেল ইসাবেলা। কিন্তু রাগও কম হলো না। আগের স্থানে মুখ ঘুরিয়ে বসল। চোখ, নাক মুছে মনে মনে বলল,

“এই তো সেদিন ফাঁসির ঘোষনা দিয়েছিলি। এর আগে নেকড়ের সামনে ছেড়ে দিয়েছিলি। আজ হঠাৎ আমার কান্না শুনে দরদ উতলে পড়ল কেন? হারামজাদা, আমি তোর এই আলগা দরদ বুঝি না ভেবেছিস? আমাকে বেঁচে থাকতে দেখে সহ্য হচ্ছে না। ইচ্ছে করে রাগাচ্ছে যেন উলটো পালটা বলি। আর উনি নিয়ে গিয়ে নেকড়ের সামনে ছেড়ে দিক। ইতর, বদমাশ। সে ইচ্ছে তোর কোনোদিন পূরণ হবে না।”

নিকোলাস নিশ্চিত জানে ইসাবেলা মনে মনে বকছে। ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে ঝুঁকে বলল,

“যদি সাহস থাকে মুখ ফুটে বলো।”

না, এখানে আর বসে থাকা যাবে না। ইসাবেলা রেগে তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়ে নিকোলাসের নাকে লাগে ওর মাথা। ব্যথা না লাগলেও ইসাবেলার এহেন আচরণে বিরক্ত হয় নিকোলাস,

“নির্বোধ, দেখেশুনে উঠতে পারো না?”

ইসাবেলা ঠোঁট শক্ত করে গলা দিয়ে বেরিয়ে আসা প্রতিবাদকে রুখে নিলো। এদের সাথে কথা বলার চেয়ে বোবা হয়ে থাকায় উত্তম। কারো সাথেই আর কথা বলবে না। খরগোশটার কথা মনে পড়তে ফের চোখ ভরে এলো অশ্রুতে। কাঁদতে কাঁদতে ঘুরে দাঁড়িয়ে হনহন করে অন্যদিকে চলে গেল। নিকোলাসের ভেতরের শয়তানটা ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,

“দেখলি আবার অসম্মান করল। এবারও ছেড়ে দিবি?”

“এবার আর ছাড়াছাড়ি নেই। চরম শিক্ষা দেবো।”

শয়তানটা খুশি হয়। কিছুক্ষণ পরেই নিকোলাস বলে,

“নির্বোধ মেয়েমানুষকে মেরে বীরত্ব বা মজা নেই। বরঞ্চ সময়ের অপচয়।”

চলবে,,,

কদিন ধরে খুব ব্যস্ত সময় পার করছি। আজকের পর্ব একটু ছোটো হয়ে গেল। নেক্সট পর্বটা বড়ো করার চেষ্টা করব।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here