তিমিরে_ফোটা_গোলাপ পর্ব-২০

0
664

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব-২০
Writer Taniya Sheikh

ট্রেনটা ছাড়বে ছাড়বে করেও এখনও দাঁড়িয়ে আছে প্লাটফর্মে। যাত্রীদের মধ্যে এই নিয়ে চাপা অসন্তোষ। ইসাবেলা ঘাড় গুঁজে বসে আছে। মুখশ্রীতে গভীর ভাবনার ছাপ। আগাথা মুচকি হেসে ওরই দিকে দৃষ্টি অনড় রেখেছেন। এই মুহূর্তে তিনি চুপ। হয়তো অপেক্ষা করছেন ইসাবেলার কাছ থেকে কিছু শোনার প্রত্যাশায়। ভাবনার জগৎ ছেড়ে বেরিয়ে এলো ইসাবেলা।

“নিকোলাসও নেকড়ে?” ওর মনে পড়ে সেই বাজারের ঘটনাটা। নিশ্চিত হতে আগাথাকে প্রশ্ন করল। আগাথা স্বাভাবিকমুখেই জবাব দিলেন,

“হ্যাঁ, কিন্তু_”

“আবার কিন্তু? ও ঈশ্বর! কী হচ্ছে আমার সাথে এসব? কেন হচ্ছে? আপনি জানেন গত কয়েক মাসে কীসব উদ্ভট পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি? আমার হঠাৎ হঠাৎ মনে হয়েছে আমি যেন একটা দুঃস্বপ্নের মধ্যে আছি। রক্তচোষা, নেকড়ে! জীবনটা আমার বন জঙ্গল হয়ে গেছে।”

ওর অভিযোগ শুনে আগাথা হাসলেন।

“তুমি ভারি মিষ্টি মেয়ে।”

“জি?”

“বলেছি তুমি ভারি মিষ্টি একটা মেয়ে।”

লাজুক মুখে হাসল ইসাবেলা। আগাথার দিকে চেয়ে লজ্জা লুকিয়ে বলল,

“আমি আমার দুঃখের কথা বলছি আর আপনি বলছেন অন্য কথা। আচ্ছা, এসব কথা বাদ। আপনি তখন বলছিলেন প্রায় রাতে পাওয়া সেই গন্ধটা আপনার বাবার ছিল। তিনি আপনাকে চিনলেন কীভাবে? আর আপনার মায়ের সাথেই তার সম্পর্ক কীভাবে হয়?”

আগাথা একটু চুপ করে বলতে শুরু করেন,

“বাবা মানুষরূপে থাকাকালীন পরিচয় মায়ের সাথে। দুজনই দুজনকে দেখে আকৃষ্ট হন। হঠাৎ করেই কাছে আসা। নিজের সত্যিটা মনে পড়তে বাবা চলে যান। মা সেই মিলনকে কৈশোরের ভুল মনে করে ভুলে গেলেন বাবাকে। কে জানত তাদের ক্ষনিকের ভুলে আমার জন্ম হবে। বাবার সাথে যোগাযোগ না থাকায় আমার কথাটা তাঁকে বলতে পারেননি মা। আঠারোতম জন্মদিনে বাবা আমার কথা জানতে পারেন। কে তাকে বলেছিল জানো?”

“কে?”

“আমার জোড়া, ম্যাক্স।”

“আপনার জোড়া!”

“হ্যাঁ, প্রতিটি নেকড়ের একজন জোড়া থাকে। একটা নির্দিষ্ট সময় পরে এরা একে অপরের গায়ের গন্ধে পরস্পরকে চিনে নেয়। ম্যাক্স আমার বিয়ের পরই চিনতে পারে। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমি ওর জোড়া হয়েও আর নই। অন্যের স্ত্রীকে তো আর জোড়া বলে জাহির করতে পারবে না। দূর থেকে কেবল আমাকে দেখে যেত। ওই যে গন্ধ পেতাম। তারমধ্যে প্রথম যে গন্ধ পেয়েছিলাম সেটা ছিল ম্যাক্সের। আমাকে বিমুগ্ধ করত সেই মিষ্টি গন্ধ।” এইটুকু বলে থামলেন। একটু যেন ভাবুক দেখা গেল। তারপর আবার বলতে আরম্ভ করলেন,

“ম্যাক্সের কথা শুনে বাবা আমাকে দেখতে আসেন লুকিয়ে। প্রথমবার দেখেই সবটা বুঝে গিয়েছিলেন তিনি। এতবড়ো কথাটি মা লুকিয়েছেন জেনে রেগে মাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে রওনা হন। কিন্তু পথিমধ্যে শান্ত মস্তিষ্কে ভাবেন, ভুল তো তাঁর। তিনিই খোঁজ নেননি। পেছন ফিরে তাকাননি। সেই সংকোচে দূর থেকেই দেখতেন আমাকে। কাছে আসার জন্য সময় নিচ্ছিলেন। এর মাঝে আমিই তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ওই যে তোমাকে যা বলেছি আগে।”

ইসাবেলা মাথা নাড়ায়। হঠাৎ বলে বসে,

“একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

“অবশ্যই।”

“এসব আমাকে কেন বলছেন আপনি?”

“কারণ আছে।”

“কী?”

“মূল কারণ শুনতে চাও না পুরো গল্প?”

“কার গল্প? আপনার?”

“শুধু আমার না। নিকোলাসে, ন_”

“ওর ব্যাপারে শুনে আমার কী লাভ? আজকের পর ওকে আমি তো দেখব না। দেখতে চাইও না। আমার জীবনের দুঃসময় নিকোলাস।” মুখটা কঠিন হলো ইসাবেলার। আগাথা হাসলেন। বললেন,

“তবে মূল কথায় আসব?”

“হুম।”

আগাথা মূল কথায় এখনই আসতে নারাজ। তিনি সবটা বিস্তারিতভাবে আগে বলতে চান এই মেয়েকে। সব শোনার পরই মেয়েটাকে নিজের আসল উদ্দেশ্য জানাবেন। এর আগে বললে উদ্দেশ্য সফল হবে না। বড়ো আশা নিয়ে এসেছেন মেয়েটির সামনে।

“আমার সম্পর্কেও জানতে কৌতূহল জাগছে না। এই যে এতকিছু বললাম। সবটা তো শেষ হয়নি। পরেরটুকু শোনার আগ্রহ জাগছে না?”

প্রবল আগ্রহ জাগছে ইসাবেলার। কিন্তু ভয়ে প্রকাশ করছে না। কৌতূহলের কারণে আজ ওর এই দশা। ফের কৌতূহল দেখালে আবার কি না কী হয়! কিন্তু মনের মধ্যে কৌতূহলের পোকা কুটকুট করতে লাগল। ট্রেন ছাড়তে কতক্ষণ লাগবে কে জানে? ততক্ষণে আগাথার গল্প শুনলে মন্দ হয় না। কিছু সময় উশখুশ করে বলেই ফেলল,

“আপনার বাবা কী বলেছিলাম একা নিয়ে গিয়ে? আপনি নেকড়ে বলেই কি নিকোলাস জন্মসূত্রে নেকড়ে? নোভাও কি তাই? মৃত হওয়ার পরও আমার সামনে জীবিতরূপে কীভাবে এলেন? এবং কেন?”

একদমে বলে থামল ইসাবেলা। সলজ্জে মুখটা অন্যদিকে ঘুরাল। আগাথা মৃদু হাসলেন। বললেন,

“মাত্র এই কটা প্রশ্ন?”

লজ্জিত মুখটা এবার স্বাভাবিক করে ইসাবেলা বলল,
“আপাতত।”

একটু সময় নিয়ে আগাথা বলতে শুরু করলেন আবার,
“আমার বাবার প্রথম কথা ছিল, রিচার্ডের সাথে সম্পর্ক ছেদ করো। তাঁর ধারণা রিচার্ড আমার জন্য ভালো নয়। কিন্তু আমার মনের অবস্থা তখন ভিন্ন। রিচার্ডকে ছাড়ার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না। সুতরাং বাবার সাথে একদফা কথা-কাটাকাটি করে চলে এলাম। বাবা কয়েকবার বুঝাতে এলেন। এতে করে আমাদের বাবা -মেয়ের সম্পর্ক তৈরি হওয়ার আগেই তিক্তরূপ ধারণ করে। তাঁকে অমান্য করায় রেগে ত্যাগ করলেন। আমিও যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম না। এদিকে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দ্রুতই পেট বড়ো হতে লাগল। ভয়টাও বাড়ল আমার। অনাগত সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত, চিন্তিত কাটত দিনরাত। এতে করে আমার শারীরিক অবস্থা খারাপের দিকে যেতে লাগল। রিচার্ডের চিন্তা বাড়ল। ওকে একসময় সবটা খুলে বললাম। প্রথম তো বিশ্বাসই করেনি। যখন নেকড়ে রূপে ওর সামনে দাঁড়ালাম মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায় ওর। আমি ভাবলাম এবার বুঝি ও আমাকে ছেড়ে যাবে। কিন্তু না, সে আমার ভরসা, বিশ্বাস হয়ে রইল। সব জেনেও আমার প্রতি ভালোবাসার কমতি রাখেনি। গর্ভাবস্থার ছয় মাসে আমার পেট নয়মাসের ন্যায় বড়ো হয়ে ওঠে। লোকের নজর এড়িয়ে গৃহবন্দী হয়ে রইলাম। কিন্তু বাচ্চা জন্মদানের সময় তো আড়ালে থাকতে পারব না। রিচার্ড এক রাতে আমাকে নিয়ে রওনা হলো দূরের একটি গ্রামে। পথিমধ্যে আমার প্রসব বেদনা ওঠে। ঘোড়া গাড়ি থামানো হয় এক বনের পাশে। ভাগ্যের কী লীলা! ওই জঙ্গলের নেকড়ে লিডার ছিল আমার জোড়া ম্যাক্স। আমার গন্ধ পেয়ে সে সেখানে উপস্থিত হয়। রিচার্ড তখনও আমাদের ব্যাপারটা জানত না। ম্যাক্স আর আমার সরাসরি আলাপ হয়নি পূর্বে। দুজনে বিব্রতবোধ করছিলাম। এদিকে প্রচণ্ড ব্যথায় বেহাল দশা আমার। রিচার্ডের কাছে সবটা জানার পর আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো ম্যাক্সের আস্তানায়। সেখানেই জন্ম হয় আমার প্রথম সন্তান, আমার নিকোলাসের। জ্ঞান ফেরার পর প্রথম দেখে মনে হয়েছিল, যেন মানুষ নয়, স্বর্গের শিশু। সন্তানকে আশা করেছিলাম রিচার্ডের কোলে। কিন্তু না, নিকোলাসকে কোলে নিয়ে এগিয়ে এলো সোনালী কোঁকড়া চুলের, পিঙ্গলবর্ণের দীর্ঘদেহী যুবক ম্যাক্স। খুবই অস্বস্তি হচ্ছিল ওকে চোখের সামনে দেখে। অদ্ভুত এক অনুভূতি কাজ করছিল ভেতরে। আমার কোলে ছেলেকে তুলে দিয়ে আমাদের কপালে চুমু খেয়ে ম্যাক্স বলেছিল,

“চন্দ্র দেবী আমার সাথে নিষ্ঠুর এক পরিহাস করল। তা হোক, আমি মনপ্রাণে এখন চাই তুমি সুখে থাকো। কিন্তু একটা কথা বলতে চাই তোমাকে।” গম্ভীর হয়ে ওঠে ওর মুখ। আমি অধীর হয়ে অপেক্ষা করছি। যা বলল তারজন্য প্রস্তুত ছিলাম না। ও বলল,

“তোমার সন্তান কোনো সাধারণ মানব নয়। তুমি হয়তো ভাববে সাধারণ নয় বলতে তোমার মতোই বুঝাতে চাইছি। কিন্তু না, সাধারণ না বলতে বুঝাতে চাইছি ও ভবিষ্যত নেকড়ে লিডার। শুধু তাই নয়, ওর মধ্যে বিশেষ কিছু লক্ষণ রয়েছে।”

“বিশেষ লক্ষণ?”

“হ্যাঁ, তোমার ছেলে অর্ধ অমরত্বের লক্ষণ নিয়ে জন্ম নিয়েছে। যা কেবল হাজার বছরে একজন নেকড়ে লিডারের ভাগ্যে থাকে। আর এই কারণে ওর ওপর বিপদের মাত্রা প্রবল।”

ম্যাক্স আমার ভীত মুখে চেয়ে বলল,

“ভয় পেয়ো না আগাথা। ওর কিছু হবে না। আমি হতে দেবো না।” নিকোলাসের মাথায় হাত রেখে বলল,

“আজ থেকে ওকে দেখে রাখার দায়িত্ব আমার।”

কেন যেন ম্যাক্সের কথায় আমি ভরসা পেলাম। ওর হাতটা ধরে কৃতজ্ঞতা জানাব তখনই ও বলল,

“আরেকটা কথা আগাথা, ওর বয়স বিশ হওয়ার পূর্বে এ কথা আমি এবং তুমি ছাড়া তৃতীয় কেউ যেন জানতে না পারে।”

আমি বললাম,

“এতবড় কথা কিছুতেই লুকাতে পারব না রিচার্ডের কাছ থেকে।”

“পারতে হবে। তোমার সন্তানের জন্য পারতে হবে।”

সেদিন সন্তানের মুখ চেয়ে ম্যাক্সের কথা না চাইতেও মেনে নিয়েছিলাম। মনে মনে অপরাধবোধ জন্মে রিচার্ডের কাছ থেকে এতবড়ো ব্যাপার লুকিয়েছি বলে। জানতাম না এই অপরাধবোধই আমার সন্তানের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে একদিন। ম্যাক্স উঠে দাঁড়ায়। যাবে বলে ঘুরে ফের আমার দিকে তাকায়। বলে,

“একটা অনুরোধ রাখবে আগাথা?”

“কী?”

“তোমার ছেলের নামটা আমাকে রাখতে দেবে?”

যে অধিকার রিচার্ডের তা আমি ম্যাক্সকে কী করে দিই? কিন্তু ওর আশান্বিত মুখ চেয়ে না করতে পারিনি।

“ঠিক আছে।”

এগিয়ে এসে নিকোলাসকে কোলে তুলে কপালে চুমু খেয়ে বলল,

“নিকোলাস উইলিয়াম। আজ থেকে ওর নাম নিকোলাস উইলিয়াম।”

একটা সময় পর্যন্ত রিচার্ডের ধারণা ছিল নামটা আমিই রেখেছি। এবং বলেছিলাম, নিকোলাস আমার মতো নয়। সে রিচার্ডের মতোই মানুষ। কে জানত রিচার্ডের সন্দেহের শুরু সেখান থেকেই। আমার মিথ্যা বলা মুখ ও খুব সহজে চিনে নিতো। সেদিনও হয়ত নিয়েছিল। কিন্তু চুপচাপ থেকেছে। এদিকে নিকোলাস যত বড়ো হতে লাগল আমার ভয়টাও বাড়তে থাকে। নিকোলাসের প্রতি আমার এই অতি সাবধানতা রিচার্ডের সন্দেহ আরো বাড়িয়ে দেয়। আশ্চর্যগত ভাবেই ম্যাক্সের সাথে নিকোলাসের অসম বন্ধুত্ব তৈরি হয়। বাবার চেয়ে ওর কাছে প্রিয় ছিল ম্যাক্স। প্রায় সব সময়ই ওরা একসাথে সময় কাটাত। রিচার্ডের চোখের কাঁটা হতে লাগল ম্যাক্স। আমাকে আর ম্যাক্সকে নিয়ে সন্দেহের বীজ বুনতে শুরু করে মনে মনে। কেমন যেন বদলাতে শুরু করল। ম্যাক্সের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেতে উঠল। নিকোলাসকে নিয়ে ম্যাক্সকে একদিন খুব করে অপমান করে। নিকোলাসের বয়স তখন ছয় কী সাত। ম্যাক্সের সাথে ঘুরতে যাওয়ায় খুব ধমকাতে লাগল ছেলেকে রিচার্ড। বাবার রাগত মুখ দেখে ভয়ে ম্যাক্সকে জড়িয়ে ধরেছিল। টেনে ওর বুক থেকে ছেলেকে ছাড়িয়ে রুম বন্দি করল। ম্যাক্স প্রতিবাদ করতে রিচার্ড তেতে ওঠে। দুজনের মধ্যে বাকবিতন্ডা চরমে রূপ নিলো। রাগের বশে মনের সকল ক্ষোভ সেদিন প্রকাশ করল রিচার্ড। আমাকে আর ম্যাক্সকে নিয়ে ওর মনের মধ্যে যে নোংরামি ছিল সব বেরিয়ে এলো। লজ্জায়, ঘৃণায় মনে হলো মরে যাই। ম্যাক্স আর আমি সত্যিটা বুঝাতে লাগলাম। কিন্তু ব্যর্থ হই আমরা। সত্যিটা জেনে আরো ক্ষেপে যায়। ম্যাক্সকে ঘুষি মারে। জামার কলার ধরে বের করে দেয় বাড়ির বাইরে। সেদিন আমার মুখ চেয়ে চুপচাপ মাথা নত করে চলে যায় ও। সেই যে গেল এরপর বছর কয়েক ওকে আমি আর দেখিনি। নিকোলাস পথ চেয়ে থাকত ওর আশায়। আবদার করত ম্যাক্সকে দেখার, ওর কাছে যাওয়ার। একদিন রিচার্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ছেলেকে ঘরে ঢুকিয়ে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে বেদম প্রহার করে। আমার চিৎকার আশেপাশের লোক জড়ো হয়। রিচার্ড বাধ্য হয় বেরিয়ে আসতে। কেবল সেদিনের জন্য ওর ওই নিষ্ঠুরতা থেমেছিল। আস্তে আস্তে তা আরো বাড়ে। কারণে – অকারণে চলে নিকোলাস আর আমার ওপর ওর নিষ্ঠুরতা। আমাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা বন্ধ করল। ভাবলাম এবার বুঝি সব ঠিক হবে। হলো উলটো। আমাকে ব্যথা দেওয়ার আরেক রাস্তা সে খুঁজে পেয়েছে। আমারই চোখের সামনে নিকোলাসকে নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করতে লাগল। খুশি হতো যখন দেখত আমি ছেলের কষ্ট দেখে কাঁদছি। রিচার্ড যেন আর সেই স্বাভাবিক রিচার্ড নেই। সন্দেহের বিষ আকণ্ঠ পান করে মদ্যপ, বিকারগস্তে পরিণত হয়। ওই রিচার্ডকে আমি ভয় পেতাম। বাবার ওমন রূপ বালক নিকোলাসকে বাকরুদ্ধ করে দেয়। চঞ্চল, হাসি-খুশি ছেলেটা আমার একসময় চুপচাপ হয়ে গেল। পিতার নির্যাতনেও মুখ ফুটে আর্তনাদ বেরোতে না। এসব কারণে রিচার্ডের সাথে সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হলো। সব অপমান হজম করে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম স্বাভাবিক হতে। বৈবাহিক সম্পর্ক কতকটা দ্বিচক্রযানের ন্যায়। একটা চাকা নষ্ট হলে আরেকটা এমনিতেই অকেজো হয়ে পড়ে। রিচার্ড ঠিক মতো বাড়ি ফিরত না, কথা বলত না। দু’জন কাছাকাছি আসতাম কেবল ওর দৈহিক প্রয়োজন পড়লে। একসময় সেটাও কমতে লাগল। ভয় বাসা বাঁধল মনে। কে জানত এই ভয়টাও একদিন সত্যি হবে। সোফিয়া ছিল ওর সহকর্মীর শ্যালিকা। মেয়েটা কয়েকবার এসেছিল আলাপ জমাত। আমার ওকে ভালো লাগেনি। হাসিটাও কেমন মেকি। ওই মেকি হাসির আড়ালে যে আমার সংসার গ্রাস করার লোভ ছিল তা সেদিন ঘূর্ণাক্ষরেও টের পাইনি। সত্যিটা জানাজানি হয় সোফিয়া সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়লে। বাচ্চাটা ছিল রিচার্ডের। সুতরাং ওর পরিবার থেকে রিচার্ডকে তাড়া দেওয়া হলো। বাধ্য হয়েই একপ্রকার গোপনে বিয়ে করল রিচার্ড ওকে। এদিকে আমি বোকার মতো আশা বেঁধেছিলাম রিচার্ড ওকে ছেড়ে আমার কাছে ফিরে আসবে। কিন্তু সে আর কোনোদিন মন থেকে আমার কাছে ফেরেনি। সবার অগোচরে সোফিয়া আর ওর সন্তানকে নিয়ে আলাদা সংসার শুরু করে। সোফিয়া সবসময়ই ভাবত আমাকে সে হারিয়ে দিয়েছে রিচার্ডকে কেড়ে নিয়ে। অন্ধ ভালোবাসা, অন্ধ বিশ্বাস মানুষকে বোকা বানায়। আমি বোকা ছিলাম, সোফিয়াও তেমনই। ওই বোকা মেয়ের মনটা আমারই মতো ভাঙল যেদিন আমি ফের আরেকবার সন্তানসম্ভবা হলাম। হয়তো আমিই ওকে শিক্ষা দিতে রিচার্ডের সাথে সম্পর্ক চলমান রেখেছিলাম। নিজের ব্যথাটা বুঝাতে চেয়েছিলাম। যখন দেখলাম উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। সুখ কিন্তু মোটেও পেলাম না। বড্ড খারাপ লাগল সোফিয়ার পর্যায়ে নেমে যাওয়াতে। ঘৃণা হলো নিজের প্রতি। নোভা গর্ভে আসার পর রিচার্ডকে কাছে ঘেঁষতে দিইনি। সিদ্ধান্ত নিলাম রিচার্ডের ঘর ছেড়ে আলাদা থাকব। রিচার্ড খুশি ছিল না। তবুও মুখ ফুটে প্রতিবাদ করেনি। আমি সেদিনও বোকার মতো চেয়েছিলাম ও ফিরে আসুক আমার কাছে। ক্ষমা চেয়ে জোর করে বুকে টেনে নিক। কিন্তু বাস্তবতা নিষ্ঠুর। ভালোবাসার চাইতে ঘৃণার ক্ষমতা প্রবল। এই যে এতকিছু ঘটে গেল। এর প্রভাব কেবল আমাদের তিনজনের ওপরই পড়েনি। আরেকজন ছিল যে নীরবে এসবে প্রভাবিত হয়েছে। আমার মানিক, আমার কলিজার টুকরো নিকোলাস। কোমলপ্রাণ ছেলেটা বাবার আদর আহ্লাদের বদলে নিপীড়িত হয়েছে। মায়ের নিত্যদিনের চোখের জল দেখতে দেখতে ভেতরে ভেতরে বদলাতে লাগল। বৈবাহিক সেই সম্পর্কের বিষাক্ততায় একা আমিই যন্ত্রণা পাইনি, পেয়েছে আমার ছেলেটাও। ছেলের জন্য ম্যাক্সের খোঁজ করলাম। ওকে খুঁজে সবটা বলতে বেচারা নিজেকে দোষাতে লাগল। নিকোলাসের সব দায়িত্ব নিতে চাইল। আমার আপত্তি ছিল না। আপত্তি জানায় রিচার্ড। আমাদের জড়িয়ে স্থানীয় রাজার কাছে বিচার দেওয়ার হুমকি দিলো। ওদিকে আমাদের নামে কুৎসা রটনা শুরু করে দেয় সোফিয়া। লোকের তিরস্কারে সেখানে টিকে থাকা দায় হয়ে পড়ে আমার। ম্যাক্স পরামর্শ দেয় পালিয়ে যাওয়ার। আমার সামনে তখন ওই একটা পথই খোলা। তিনজনে পালিয়ে এলাম অন্য শহরে। সেখানে নোভার জন্ম হলো। ও হলো রিচার্ডের মতোই সাধারণ মানুষ। কিন্তু নেকড়ে মায়ের কিছু প্রভাব ওর মধ্যে থাকবে বলে জানাল ম্যাক্স। ধীরে ধীরে নিকোলাসও স্বাভাবিক হয়ে উঠল ম্যাক্সের সান্নিধ্যে। ম্যাক্স নিজের আপনজন ছেড়ে আমাদের সাথে থাকতে লাগল। ওর কেয়ার, ভালোবাসা মুগ্ধ করল আমাকে। মুগ্ধতা প্রেমের সম্পর্কে গড়াতে সময় নিলো না। জোড়া হিসেবে ও আমাকে মার্ক করে। তারপরেই মনে হলো জন্মজন্মান্তরে সম্পর্ক ছিল আমাদের। যেন এক আত্মা দুই দেহ আমরা। আমাদের সেই সম্পর্ক মনুষ্য ধর্মের আর সমাজের চোখে ছিল নিষিদ্ধ। কিন্তু অচেনা ওই শহরে সেই খবর কারো জানার কথা না। সুখেই কাটছিল দিন। নিকোলাস কৈশোরে পা রাখল। নোভার মুখে তখন আধো আধো বুলি। প্রথমবার বাবা বলে ডাকতে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে ম্যাক্স। একদিন আমাকে বলে,

“আমি যদি সত্যি ওদের বাবা হতে পারতাম আগাথা!”

চোখদুটো ছলছল করছিল ওর। ভয় কেবল একা ম্যাক্সের ছিল না। আমারও ছিল। রিচার্ডের অধিকার সমাজ স্বীকৃত। অথচ, বাবা হিসেবে কোনো দায়িত্বই সে পালন করেনি। অন্যদিকে ম্যাক্স জন্মদাতা না হয়েও বাবা হয়ে উঠেছিল। আমি জানতাম মানুষের সমাজে এ পাপ। কিন্তু স্বেচ্ছায় পাপটাকে গ্রহণ করি আমরা দুজন। অর্ধেক মানবীয় সত্তার কারণে সেই পাপবোধে থেকে মুক্তি পেতে অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা বিয়ে করব। নিকোলাস সত্যিটা জানত। আমার আর ম্যাক্সের প্রণয়ের সূত্রটা ছিল ও। আমাদের খুশি দেখতে চেয়েছিল নিকোলাস। সুতরাং ও আমাদের বিয়ের সিদ্ধান্তে খুশিই হলো। ম্যাক্সের মনে চলছিল অন্য ব্যাপার। আমার ভেতরের মানবীয় পাপবোধ ও বুঝতে পারত। আর তাই তো কাওকে না জানিয়ে সে রিচার্ডের সাথে দেখা করে। তৎকালে ডিভোর্স অতটা সহজ ব্যাপার ছিল না। ম্যাক্স রিচার্ডের সাথে দেখা করে আপোষে ডিভোর্সের ঝামেলা শেষ করতে চেয়েছিল। ভুলটা বোধহয় সেখানেই হয়। ডিভোর্স দেবে বলে আশ্বস্ত করে রিচার্ড। আমিও কী বোকা ছিলাম। বিশ্বাস করলাম ম্যাক্সের মতো। সকল কাগজপত্র তৈরি করে ম্যাক্স গেল রিচার্ডের কাছে। তিনদিনের স্থানে পুরো একসপ্তাহ পার হলেও ম্যাক্স ফিরল না। চিন্তা হতে লাগল এবার। নিকোলাস একাই যেতে চাইল ম্যাক্সের খোঁজে। আমি জোর করলাম সাথে নেওয়ার। ছেলে মেয়েকে নিয়ে রওনা হলাম পুরোনো আবাসস্থলে। সেখানে পৌঁছে প্রথম ধাক্কাটা খেলাম। মানুষের সেই বসতি কবরস্থানের মতো ভূতুরে আর নিস্তব্ধতায় মোড়া। ঘর-বাড়ি সব পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। অনেক ঘুরেও একটা মানুষের দেখা পেলাম না। শেষে নিরুপায় হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম রিচার্ড এবং সোফিয়ার বাড়িতে যাওয়ার। নিকোলাস আমাকে শক্ত করে ধরেছিল। ছোট্ট নোভার মাথা আমার বুকে। ম্যাক্সের খারাপ কিছু ঘটেছে ভেবে কাঁদতে লাগলাম নীরবে। নিকোলাস সান্ত্বনা দিলো। বলল, ওর ম্যাক্স বাবা যাওয়ার আগে ওয়াদা করেছে ফিরে আসার। সে ফিরবে। আমার মন সেই সান্ত্বনা কিছুতেই মানছিল না। খারাপ কিছুর আভাস পাচ্ছিলাম আমি। তিনজনে এলাম রিচার্ডের আর সোফিয়ার বাড়িতে। অন্য সব বাড়ির মতো এ বাড়িও জনমানব শূন্য। ঘরের ধুলো ময়লা আর ঝুল দেখে মনে হলো, এই বাড়িতে অনেকদিন কেউ থাকে না। হতাশ হয়ে ভেঙে পড়লাম। নিকোলাস আমাকে শক্ত করে ধরে গাড়িতে তুলল। আমাকে কাঁদতে দেখে নোভা কান্না শুরু করে। নিকোলাসের মনের অবস্থাও ভালো না। ওর প্রিয় ম্যাক্স। তাঁর খোঁজ না পেয়ে নিকোলাস অস্থির হয়ে ওঠে। পাশ্ববর্তী একটা বাড়িতে আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ম্যাক্সের খোঁজে বেরিয়ে গেল। আমাদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য ও ছিল। কিন্তু ওর জন্য কেউ ছিল না। ওই মৃত্যুপুরীতে একলা খুঁজে ফিরেছে প্রিয় ম্যাক্স বাবাকে। শেষমেশ খুঁজে না পেয়ে বিধ্বস্ত হতাশ চেহারায় ফিরে এলো। হাঁটু মুড়ে নত মুখে বসল আমার সামনে। শিশুর মতো ফুপিয়ে কেঁদেছিল। বুঝলাম ম্যাক্সকে চিরতরে হারিয়েছি। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদলাম। দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যা নামে চারিদিকে। সাথে আসা ঘোড়ার গাড়িটিকে খুঁজে পেলাম না। নিরুপায় হয়ে সেদিন আমাদের পুরোনো বাড়িতে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। স্বপ্নেও ভাবিনি সেই রাত আমাদের জন্য কাল হয়ে আসবে।

চলবে,,,

আগাথার কাহিনি একটু লম্বা হয়ে গেল। আশা করি আগামী পর্বে অতীত স্মৃতিচারণ শেষ হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here