#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব-২১
Writer Taniya Sheikh
“আমি ম্যাক্সের শোকে কাতর হয়ে বিছানায় শুয়েছিলাম। ঘুম কিছুতেই এলো না চোখে। সারাদিনের ক্লান্তি আর অনাহারে শরীর দূর্বল। পরিত্যক্ত আমার সেই পুরোনো বাড়িতে খাবার বলতে কিছুই ছিল না। নোভা খিদে সহ্য করতে না পেরে কাঁদতে কাঁদতে আমার বুকেই ঘুমিয়ে গেল। অনেকক্ষণ নিকোলাসের সাড়াশব্দ না পেয়ে মৃদু গলায় ডাকলাম বার কয়েক। কিন্তু কোনো জবাব পেলাম না। যা ম্যাক্স ভক্ত ছেলে! রাতের অন্ধকারে ম্যাক্সকে খুঁজতে বেরোলো কি না ভেবে তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে নেমে এলাম। নোভা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। চাদরে গলা অব্দি ঢেকে দিলাম মেয়েকে। শিওরের জ্বলন্ত বাতিদানটা হাতে তুলে নিলাম। পুরো বাড়ির ভেতর খুঁজেও নিকোলাসকে পেলাম না। অজানা শঙ্কায় পাগলপ্রায় হয়ে ছুটলাম গৃহদ্বারের বাইরে।
“নিকোলাস, নিকোলাস!”
অশ্রুরুদ্ধ গলায় ডাকলাম ছেলেকে। কিন্তু ছেলে আমার কোথাও নেই। সেই পরিত্যক্ত গ্রামে রাতদুপুরে ছেলেকে কোথায় খুঁজব ভেবে দিশাহারা হয়ে পড়ি। মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবনা চিন্তা করার মতো অবস্থা ছিল না আমার। সদর দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে বেরিয়ে পড়লাম সেই ভূতুরে জনমানব শূন্য গ্রামে ছেলেকে খুঁজতে। আকাশে সেদিন কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠেছিল। ঘুটঘুটে আঁধারের চাদরে মুড়েছে সমস্ত গাঁও। তেলের বাতির ওই স্বল্প আলোতে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম। ভয় যে করছিল না তা নয়। প্রতি পদে পদে মৃত্যু ভয় তাড়া করে ফিরছিল। কিন্তু নিকোলাসের চিন্তা সবকিছুর উর্ধ্বে। বেশ কিছুদূর এগিয়ে গিয়েছিলাম। এমন সময় আমার সকল ভয়, চিন্তা দূর করে নিকোলাস ডেকে উঠল,
“মা!”
প্রাণ ফিরে পেলাম যেন। দৌড়ে ওকে বুকে জড়িয়ে চুমুতে চুমুতে ওর মুখটা ভরিয়ে দিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম,
“কোথায় গিয়েছিলি একা? ভয় পেয়েছিলাম তো।”
“মা, ও-দিকে!”
ভীত মুখে তোতলাতে লাগল নিকোলাস। রীতিমতো কাঁপছে ওর শরীর। আঙুল দিয়ে সামনে ইশারা করে কিছু বলতে চাইছে। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। কিছুটা শান্ত হয়ে বলল,
“মা, ওদিকে মানুষের লাশ পড়ে আছে। একটা না অনেকগুলো। পঁচে গলে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে ওদের মৃতদেহ থেকে।”
ভয় পেলাম আমি। এই গ্রাম পরিত্যক্ত হওয়ার কারণ আগে কেন ভাবিনি? নিকোলাসের হাত ধরে দ্রুত চলে এলাম বাড়ির ভেতর। নোভা তখনও ঘুমিয়ে। কোলে তুলে নিকোলাসের হাত ধরে সেই রাতেই গাঁ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
“আমরা কোথায় যাচ্ছি মা?”
“জানি না। শুধু জানি এই মুহূর্তে এই গাঁ ছাড়তে হবে।”
ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেলে- মেয়েকে নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে উদ্দেশ্যহীনভাবে এগোতে লাগলাম। পথে যেতে চোখে পড়ল কয়েকটা মৃত দেহ। আজই হয়তো মরেছে। পঁচে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে ওদের মৃতদেহ থেকে। দ্রুত পা চালালাম। মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকছি। একজন অসহায় মা রাতের আঁধারে সন্তানদের বাঁচাতে আকুল আবেদন জানায় স্রষ্টার কাছে। স্রষ্টা আমার আবেদন রক্ষা ঠিকই করলেন, কিন্তু যার দ্বারা করলেন তাঁকে আমি আশা করিনি। রিচার্ড কীভাবে খবর পেয়েছিল জানি না। ঘোড়াগাড়ি করে এদিকেই আসছিল সে। আমাদের দেখে নেমে সামনে এলো। বলল,
“তাড়াতাড়ি গাড়িতে ওঠো।”
নিকোলাস আমাকে জড়িয়ে ধরে। রিচার্ড ওর ভয় বুঝতে পেরে বিমর্ষ মুখে আমাকে বলে,
“পুরো গাঁ প্লেগের প্রকোপে শেষ হয়ে গেছে। শুরুর দিকে যারা গাঁ ছেড়েছিল তারই রক্ষা পায়। এক মুহূর্ত আর এখানে নয়। তাড়াতাড়ি গাড়িতে ওঠো।”
সন্তানদের নিরাপত্তার কথা ভেবে আমি আর প্রতিবাদ করতে পারলাম না। ওদের নিয়ে উঠে পড়লাম গাড়ির ভেতর। নিকোলাস ঘাড় গুঁজে বসেছিল পাশে। রিচার্ড ওর মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। আমি গলা ঝাড়তে অপ্রস্তুত দেখাল ওকে। চোখে চোখ রাখছিল না। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল আমার। তবুও বললাম,
“আমাদের কথা কীভাবে জানলে?”
“এক পেয়াদা বলল। সে না কি কার কাছে শুনেছে তোমরা গাঁয়ে এসেছ।”
রিচার্ডের দৃষ্টি এবার আমার বুকে মাথা রাখা নোভার দিকে স্থির। হাত বাড়িয়ে ওর মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করল,
“কী নাম রেখেছ ওর?”
“নোভালি আগাথা।” বললাম আমি।
“আমার লাস্ট নাম দেওনি?” মনঃক্ষুণ্ন হলো। রাগে দাঁত কামড়ে বললাম,
“কেন দেবো? কী হও তুমি ওর?”
“বাবা হই।”
বিদ্রুপ করে হাসলাম। রিচার্ডের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। একটু ভয় পেলাম। রিচার্ড সেটা বুঝতে পেরে মুখ নামিয়ে নরম সুরে বলল,
“আমি তোমাদের সাথে অনেক অন্যায় করেছি আগাথা। ক্ষমা চাওয়ার মুখ নেই। তবুও যদি_”
“তবু যদি কী হ্যাঁ?” চেঁচিয়ে প্রশ্ন করলাম। নোভা চমকে উঠল ঘুমের ঘোরে। ওর মাথায় আলতো করে হাত বুলাতে আবার ঘুমিয়ে গেল। রিচার্ড আর কোনো কথা বলল না। গাড়ি এগোচ্ছে সামনে। কোথায় যাচ্ছি তখনও জানতাম না। জিজ্ঞেস করলাম,
“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
“আমি যেখানে আছি সেখানে। নিরাপদেই থাকবে তোমরা।”
“না, তোমার ওখানে যাব না। কোচওয়ানকে বলো, আমাদের শহরের বাইরে নামিয়ে দিতে। নিজেদের ব্যবস্থা আমরা বেশ করে নিতে পারব।”
“পাগলামির সময় না এখন আগাথা। প্লেগ মহামারির রূপ নিয়েছে। আশপাশের সব স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে ভয়ংকর ভাবে। আমার সন্তান_”
“খবরদার যদি ওদের সন্তান বলেছ। তুমি ওদের কেউ না।”
“তবে কে ওদের সব, ম্যাক্স?”
জবাব দিতে পারলাম না আমি। রিচার্ড রাগত মুখে বলল,
“আমি সব ভুলে যাব। তুমিও তাই করবে। আজকের পর ম্যাক্স নয় আমিই তোমাদের সব।”
“কিছুতেই না।”
রিচার্ড হাসল। গুরুত্বই দিলো না আমার প্রতিবাদ। নিকোলাস চুপচাপ শুনছিল। রিচার্ড ওর নত মুখপানে চেয়ে বলল,
“বাবাকে মনে পড়ে না নিক?”
নিকোলাস আমাকে শক্ত করে ধরে আছে। রিচার্ড খপ করে ওর হাত ধরে বলল,
“এখনও এত ভয় আমাকে তোর? কেন ভয় পাস, বল? আপন পিতাকে কেন এত ভয় পাবি তুই?”
“তুমি আমার পিতা নও।”
নিকোলাস প্রতিবাদ করে ওঠে। রিচার্ডের চোখ জ্বলছিল রাগে। হঠাৎই শান্ত হয়ে মৃদু হেসে আমাকে লক্ষ্য করে বলল,
“আগাথা, আগাথা, দেখো আমার ছেলে আমাকে পিতা বলতে অস্বীকার করছে। এর দায় কার?”
“তুমি ভালো করেই_” রিচার্ড আমার চোয়াল চেপে ধরে।
“তুমি আমার আগাথা। এত তো ভালোবেসেছিলাম। কেন ধোঁকা দিয়েছিলে? কেন?”
“কতবার বলব আমি তোমাকে ধোঁকা দিইনি।”
“তবে কেন ম্যাক্সকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছ তুমি?”
“তুমি সোফিয়াকে কেন বিয়ে করেছিলে?” পালটা প্রশ্ন ছুঁড়লাম। ম্যাক্স আর আমার সম্পর্ক ওদের মতো নয়। রিচার্ডকে আক্রমণ করতে প্রশ্নটা করেছিলাম। বেশ লেগেছিল ওর। নিকোলাস রিচার্ডের হাত আমার চোয়াল থেকে সরানোর চেষ্টা করছে। রিচার্ড হাত সরিয়ে আগের মতো বসে রইল গুম হয়ে। নিকোলাস ভীরু গলায় আমাকে ফিসফিস করে বলল,
“মা, আমরা সামনে নেমে যাব।”
“কোথাও নামবে না তোমরা। আজকের পর থেকে তোমাদের ভাগ্য আমি লিখব। আমি।”
সত্যি সেদিনের কথা রেখেছিল রিচার্ড। আমাদের ভাগ্য বদলে দিয়েছিল ও। জোরপূর্বক ওর ওখানে নিয়ে যায়। একপ্রকার বন্দি দশায় কাটতে লাগল আমাদের জীবন। সন্তানদের সামনে নেকড়ে রূপে আসতে পারিনি। ম্যাক্সের নিষেধ ছিল নিকোলাসের বিশ বছর হওয়ার আগে এসব কিছুতেই জানানো যাবে না। রিচার্ড আমার অসহায়ত্ব বুঝে বিদ্রুপ করত। ম্যাক্সের গায়েব হওয়ার পেছনেও ওরই হাত ছিল। কিন্তু কোনোদিন সেটা স্বীকার করেনি। সোফিয়া আমাদের মানতে পারেনি। কিন্তু রিচার্ডের ভয়ে চুপচাপ সহ্য করে আমাকে এবং আমার সন্তানদের। রিচার্ডের পাগলামি দেখেছি আমি। আমাকে নিজের করে রাখার জন্য সব করেছে সে। জাহির করেছে আমাকে সে ভালোবাসে। ভালোবাসা কাকে বলে ও জানেই না। ও কেবল বল প্রয়োগে অধিকার করতে জানে আর জানে ধূর্ততা। একজন সামান্য রাজকর্মচারী থেকে কূটবুদ্ধিতার জোরে রাজার খাস লোক বনে যায়। কিন্তু তাতেও ওর লোভ কমে না। পুরো রাজ্য নিজের দখলে চায় ওর। প্লেগ মহামারির প্রকোপে সমস্ত রাজ্যে দুর্ভিক্ষ নেমে এলো। না খেয়ে, রোগে আক্রান্ত হয়ে হাজার হাজার লোক মরল। রাজাকেও কৌশলে মেরে ফেলে রিচার্ড। সিংহাসন দখল করে বসে। বিশ্বস্ত সঙ্গী হিসেবে কাওকে ওর দরকার। সোফিয়ার ছেলে তখনও ছোটো। সুতরাং নিকোলাসের দিকে হাত বাড়ায় সে। শত চেষ্টার পরেও ছেলেকে ওর কালো ছায়া থেকে আড়াল করে রাখতে পারিনি। জানি না কী বলেছিল নিকোলাসকে ও। ছেলেটা আমার অনুরোধ, অনুনয় উপেক্ষা করে রিচার্ডের কথা শুনতে লাগল৷ অন্ধের মতো অনুসরণ করল ওকে। যাকে একদিন পিতা বলতে অস্বীকার করেছিল একসময় তাকেই নিকোলাস বাবা বলে ডাকল। ম্যাক্সের নামও শুনতে পারত না। আমাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। এদিকে নোভাও বড়ো হচ্ছিল। রিচার্ড তাকেও আমার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার পাঁয়তারা শুরু করে। বছরের পর বছর পেরিয়ে যায়। আমার জীবনের পরিবর্তন হয় না। কিন্তু আমার নিকোলাস আমূল পাল্টে যায়। ওর বিশ বছর হতে মাত্র কয়েক মাসের বাকি। অধীর আগ্রহে দিনটার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। নিজেকে চিনবে ওইদিন ও। তখন আমি সব বলব ওকে। হয়তো সেদিন ফিরে আসবে সঠিক পথে। অন্যদিকে রিচার্ডের ক্ষমতা দিন দিন বাড়তে লাগল। প্রজাদের চোখে আমি ছিলাম রিচার্ডের স্ত্রী, রাজ্যের রাণী। সোফিয়া হয়ে রইল মিস্ট্রেস। মোটেও সন্তুষ্ট ছিল না ও। কিন্তু কিছু বলার সাহসও নেই রিচার্ডের সামনে। আমাকে আপন করে পেতে কত কী ই না করেছে রিচার্ড। আমি ওকে আর কোনোদিন গ্রহন করেনি। এই ক্ষোভ আর রাগ আরো ভয়ংকর করে তোলে ওকে। আমাকে শাস্তি দিতে নিকোলাসকে খারাপ পথে নামিয়েছে। মানুষ খুন থেকে শুরু করে সব রকম খারাপ কাজে নিকোলাসকে সামিল করেছে। আমার আবেগী, সহজ সরল ছেলেটা একসময় ভাবলেশহীন, নিষ্ঠুর পাথরের মূর্তিতে পরিণত হয়। আশপাশের দশ রাজ্যের লোক কাঁপত ওর নাম শুনে। রিচার্ডের প্রধান সেনাপতি সে৷ সুতরাং কোনো শাসকের সাহস ছিল না এই রাজ্য আক্রমণ করার। ইচ্ছে মতো যেকোনো রাজ্য নিজের দখলে নিয়ে নিতো রিচার্ড। তার জন্য যতটা নিচে নামার সে নিঃসংকোচে নেমে যেত। একসময় নিজেকে সর্বক্ষমতার অধিকারী মনে করতে লাগল। ঈশ্বরকে ভুলে গেল। নিজেকে সেই স্থানে তুলতে চাইল। অমরত্ব চায় এবার ওর। এরমধ্যে অজানা এক রোগের প্রাদুর্ভাব হয় পাশের রাজ্যে। এক নতুন প্রজাতির বাদুড়ের কামড়ে রক্তশূন্য হয়ে মরতে লাগল মানুষ। মৃত্যুর পর ওরাই আবার হিংস্র পিশাচে পরিণত হয়ে নিশিরাতে মানুষের রক্তপিপাসু হয়ে ওঠে। জনমনে ত্রাসের সৃষ্টি হয়। স্থানীয় পাদ্রীদের পরামর্শে মৃতদেহগুলোকে পুড়িয়ে ভস্মীভূত করে ফেলা হলো। নিস্তার পাওয়া গেল পিশাচদের হাত থেকে। মৃত্যুর মিছিল কিন্তু থামল না। ঈশ্বরের গজব নেমেছে বলে প্রচার হলো। গির্জায় গির্জায় প্রার্থনা শুরু হয়। সাধারণ মানুষ যখন ঈশ্বরের সন্তুষ্টি কামনায় দিনরাত গির্জার দুয়ারে মাথা কুটছে, তখন কিছু শয়তানের পূজারি পৈশাচিক অভিসন্ধি আঁটে। রিচার্ডও ছিল সেই দলে। জীবন্মৃত হওয়ার অর্থ মৃত্যুকে হারিয়ে দেওয়া। এমন সুযোগ হাত ছাড়া কী করে সে? স্বেচ্ছায় হলো অভিশপ্ত পিশাচ। আমার নিকোলাসকে ভুলিয়ে ভালিয়ে পিশাচে পরিণত করল। নিকোলাসকে আমি কিছুতেই থামাতে পারলাম না। আমারই চোখের সামনে আমার দুটো সন্তান পিশাচে পরিণত হলো। আমি অনুনয় করলাম নিকোলাসকে। হয়তো মা বলেই সেদিন সেই অনুনয় রেখেছিল ও। মরতে দিয়েছিল আমাকে। কবর দিয়েছিল মানুষের মতো। কিন্তু আমার আত্মা আজও শান্তি পায়নি। আজও চিৎকার করে কাঁদে সন্তানদের জন্য। তুমি প্রশ্ন করেছিলে না মৃত হওয়ার পরও কী করে এলাম তোমার সামনে? এক মা তাঁর অভিশপ্ত সন্তানদের শাপমোচনের জন্য মৃত্যু পুরীর শৃঙ্খল ভেঙে এসেছে। মৃত্যু পুরীর ওপারের ওই স্বর্গীয় সুখও এই মাকে আঁটকে রাখতে পারেনি। সে এই ধরা তলে এসেছে কেবল তাঁর সন্তানদের ওই পিশাচের জীবন থেকে মুক্ত করতে। যা সে জীবিতকালে পারেনি, মৃত্যুর পর পারতে চায়। আর তাইতো তোমার সামনে এসেছে। তোমার সাহায্য কামনায়।”
“আমার সাহায্য?” বিস্মিত হয় ইসাবেলা। আগাথার সব কথা শুনে আবেগি হয়ে পড়েছিল। কিন্তু শেষ কথাটা ওকে বিচলিত করে। আগাথা ওর হাত দুটো ধরে ছলছল চোখে বলল,
“তোমাকে আবার ফিরতে হবে ওদের কাছে। ওদের সবাইকে শেষ করে পৃথিবীটাকে পিশাচমুক্ত করবে তুমি। তার আগে একটা কাজ করতে হবে তোমাকে। আমার সন্তানদুটোকে দিয়ে ঈশ্বরের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করাবে। কীভাবে করবে সব আমি শিখিয়ে_” আগাথার কথা শেষ হওয়ার পূর্বে হাত ছাড়িয়ে নেয় ইসাবেলা। আর্ত কণ্ঠে বলল,
“আমি পারব না। ক্ষমা করুন আমাকে।” বহুকষ্টে ওই পিশাচদের কবল থেকে মুক্ত হয়েছে সে। জেনেশুনে ওদের কাছে যাওয়া আত্মহত্যার সামীল। ইসাবেলা কখনও তা করবে না। আশাহত হয় ক্ষণিকের জন্য আগাথা। কিন্তু হাল ছাড়ে না।
“নিজের জীবনের ভয় করছ? অথচ, তোমাকে বাঁচাতে ভ্যালেরিয়ার প্রাণ গেছে। স্বার্থপর মেয়েমানুষ, এই ভালোবাসো ভ্যালেরিয়াকে? ভীরুর মতো ফিরে গিয়ে শান্তি পাবে জীবনভর? ওরা ভ্যালেরিয়া, ফাদার জালোনভের মতো আরো কতশত মানুষ মারবে তার ইয়ত্তা নেই। আমার সন্তানদের মতো আরো কত জনকে যে পিশাচে পরিণত করবে! তুমি তো মা নও তাই আমার ব্যথা তুমি বুঝবে না। চাচা আপন জীবন বাঁচা। নিজেকে বাঁচিয়ে ফিরে যাও। অর্নথক প্রাণ গেল বেচারি ভ্যালেরিয়ার।”
আগাথা রুষ্ট, আশাহত মুখে উঠে দাঁড়ায়। ভ্যালেরিয়ার কথা মনে পড়তে বুকটা হু হু করে ওঠে ইসাবেলার। সেই কালো রাত মনে করে। ভ্যালেরিয়ার মৃত্যু চোখে সামনে ভেসে ওঠে। সিট থেকে দাঁড়িয়ে যায়। খুঁজতে লাগল আগাথাকে। ওই তো ট্রেনের বাইরে দেখা যাচ্ছে।
“এই মেয়েটা অনেকক্ষণ ধরে একা একা কথা বলছিল। মাথা টাথা খারাপ আছে বোধহয়?”
ইসাবেলা কেবিন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে নিজের সম্পর্কে সহযাত্রীদের ফিসফিসানি গলা শুনে থমকে দাঁড়ায়। তবে কি এরা আগাথাকে দেখেনি?
চলবে,,,