#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৩৬
Writer তানিয়া শেখ
১৩৪৯ সাল,
সুরঙ্গের যত ভেতরে ঢুকছে ততই অবাক হচ্ছে নিকোলাস। প্রাসাদের পূর্বদিকের জঙ্গলঘেরা স্থানে যে এমন একটি ভূতুরে সুরঙ্গ থাকতে পারে এ ওর ভাবনার বাইরে ছিল। এই প্রাসাদে আছে বেশ কয়েক বছর হয়। বাইরে থেকে দেখলে প্রাসাদের রহস্য উদ্ঘাটন সম্ভব নয়। আজ অন্তত তাই ই মনে হলো নিকোলাসের। সুরঙ্গের সামনে ঘন অন্ধকার। মশালের আলোতে এর গায়ে জন্মানো নানান জীব চোখে পড়ে। গা ছমছম করে ওঠে সেসব দেখে। পায়ের নিচটা স্যাঁতসেঁতে। পিচ্ছিল পিচ্ছিল ভাব আছে। সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে আলো ধরে। অবাধে বেড়ে ওঠা বন্য আগাছা -পরগাছা সরিয়ে যেতে হচ্ছে সামনে। পথিমধ্যে দুটো সাপের সাথে দেখা হয়ে গেল। ওর দিকেই যেন শিকারী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জিহ্বাটা বার বার বেরিয়ে আসছিল গা শিউরানো শব্দ করে। সুরঙ্গের গা বেয়ে আগাছার সাথে জড়িয়ে আছে একটা, ঠিক ওর বাম পাশে। কিশোর নিকোলাসের পা দুটো ঠকঠক করে কাঁপছে। আতঙ্কিত দু’জোড়া চোখ। মন বলছে এখানে আসা ওর উচিত হয়নি। কিন্তু এসে তো পড়েছে! ওর বয়সী ছেলেরা হয় সাহসী, দুরন্ত, কিন্তু ও একেবারে উলটো। ভীষণ শান্ত, বয়সের বেমানান ভীতু আর সরল। মায়ের আজ্ঞাকারী ভদ্র ছেলে। এতটা ভদ্র যে লোকে নির্বোধ বলে বেশ মজা নেয়। রিচার্ডের এখানেই আপত্তি। তাঁর সাথে যেন পুত্রের সাদৃশ্যের বড়ো অভাব। এই অভাবেই ক্ষোভ বাড়ে, ক্রোধ জাগে। আপাতত সেটা চেপে গিয়ে হাতের মশাল সমেত ঘুরে দাঁড়িয়ে বলেন,
“আবার কেন থামলে?”
“সা-আ-প।” নিকোলাস আঙুল তুলে দেখায় কয়েক কদম দূরের লতায় জড়ানো ফণা তোলা সাপটাকে। রিচার্ডের ঠোঁটের কোণ বেঁকে গেল। নিজের ভাগ্যের ওপর পরিহাস করল যেন। সৃষ্টিকর্তা তাঁকে এমন ভিতু সন্তান দিলো? গায়ে গতরে তাল গাছ অথচ মেরুদণ্ড দুর্বল! এই ফাঁপা মেরুদণ্ডি পুত্র দিয়ে কী লাভ তাঁর? কোনো লাভ নেই, কেবল লোকের বিদ্রুপ জুটবে এমন পুত্র লাভের কারণে। রিচার্ডের পুরোনো সন্দেহ ফের মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে৷ নিকোলাস কি আদৌ ওর ঔরসজাত? এই একটা সন্দেহ রিচার্ডকে আমূল পরিবর্তন করে দিয়েছে। ওর হৃদয়ে হেমলকের বিষ ঢেলে সমস্তটা করেছে বিষাক্ত। নিকোলাস ওর চেয়ে প্রায় ছয় ইঞ্চি লম্বা। তা সত্ত্বেও ওর বাহু সজোরে চেপে ধরে টেনে সাপটার মুখোমুখি দাঁড় করায়। ভয়ে সরে যেতে চাইলে বাধা দেয় রিচার্ড। নিস্পৃহ গলায় বলে,
“সামান্য একটা সাপকে এত ভয় তোর? নিজেকে আর ওটাকে দেখ। বল শক্তিশালী কে? বল?”
“ও বিষাক্ত। ওর নিঃশ্বাসে পর্যন্ত বিষ আছে। ওটাই ওর হাতিয়ার, ওটাই ওর শক্তি। কিন্তু আমি তো নিরস্ত্র, সাধারণ মানুষ। দেহের দীর্ঘতাকে শক্তি ভেবে কাছে গেলেই ও ছোবল দেবে। মরে যাব আমি।”
নিকোলাস সরল কিন্তু বোকা নয়। ওর আর্ত মুখে চেয়ে কথাগুলো ভেবে একটু ভাবুক হলো রিচার্ড৷ তারপর সাপের কাছ থেকে সরিয়ে এনে বলল,
“চল।”
প্রাণে পানি পেল যেন নিকোলাস। ত্রস্ত পায়ে পিতার একটু আগে আগে চলতে লাগল এবার। সাপটা ওর দৃষ্টি সীমার বাইরে যেতে হাঁপ ছাড়ে। রিচার্ডের মুখে তখনো ভাবনার ছাপ। কী যে ভাবছেন তিনিই জানেন। নিকোলাস বারেক ফিরে পিতাকে দেখল। রিচার্ডের গম্ভীর মুখ ওর ভীতি আরো বাড়িয়ে দেয়। মায়ের নিষেধ অমান্য করে, না জানিয়ে রিচার্ডের সাথে এসেছে। ওর মা আগাথা জানতে পারলে রাগ করবেন। কী এক কারণে মা ওকে রিচার্ডের থেকে দূরে দূরে রাখে। নিকোলাসের নিজেরও ভালো লাগে না রিচার্ডের সান্নিধ্য। কৈশোরে পা রেখেছে। অনেক কিছুই বুঝতে পারে এখন। আর সবার বাবা-মায়ের মতো সম্পর্ক নয় ওর বাবা-মায়ের। তাতে অবশ্য একটুও খারাপ লাগা নেই। রিচার্ডকে ও পিতা হিসেবে আগাগোড়াই অপছন্দ করে। যে পিতা প্রহার, ধমক আর তিরস্কার ছাড়া কখনো কথা বলেনি তাঁকে পছন্দ করার তো কথা নয়। তবুও হয়তো পিতাকে ও শ্রদ্ধা করত। হাজার হোক জন্মদাতা, কিন্তু মায়ের ওপর পিতার অকথ্য নির্যাতন নিকোলাসকে করেছে রুষ্ট। মা’কে ও সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। মা’ই ওর দুনিয়া। সেই মা’কে প্রতি মুহূর্তে অপমানিত হতে দেখে কোনো সন্তান ঠিক থাকতে পারে না। নিজের ওপর করা সকল নির্যাতন নিকোলাস মুখ বুঁজে সহ্য করেছে। টু শব্দটি করেনি পিতার বিরুদ্ধে, ঘৃণাও না। কেবল মা’কে ও নির্যাতিত হতে দেখতে পারে না। শৈশব থেকে রিচার্ড ওর কাছে ভীতির নামান্তর ছিল। এখন অপছন্দও এসে মিশেছে। অন্যদিকে ম্যাক্স ওর পছন্দের মানুষ। তাঁকে ও বাবা বলেও স্বীকার করবে অকপটে। পিতৃস্নেহের অভাব তিনি পূরণ করেছেন। মায়ের পরে নিকোলাসকে যদি কেউ ভালোবেসেছে তবে তিনি ম্যাক্স। নিকোলাস ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না ম্যাক্স ওর হৃদয়ের কতখানি জুড়ে আছে। সেই শৈশব থেকেই দুজনের সম্পর্ক নিবিড়। ম্যাক্স বরাবরই ওকে বলেছেন,
“তোর সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক নেই নিক। তবে জেনে রাখিস আমার আত্মার পরম আত্মীয় তুই৷” বালক নিকোলাসের বুকের বা’পাশে হাত রেখে বলেছিলেন,
“এই যে হৃদয়, এখানে আমি আজীবন থাকব। এই রূপে না হোক অন্যরূপে, তবুও থাকব দেখিস। তোর আর আমার নিয়তি একই সূত্রে গাঁথা। চন্দ্রদেবী আমাকে কথা দিয়েছেন রক্তের এই বৈষম্য তিনি ঘুচাবেন। তোর আর আমার হৃদয় যেমন এক হয়েছে, তেমনই দুজনের রক্তও একই মোহনায় গিয়ে মিশবে। আমি সেই দিনটির প্রহর গুনছি।”
নিকোলাসও প্রহর গুনেছে সেই দিনের। যখন জেনেছিল ওর মা আর ম্যাক্স বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, খুব খুশি হয়েছিল। ভেবেছিলাম ম্যাক্সের কথা বুঝি এবার সত্যি হবে। কিন্তু ভাগ্য এবারো বিরূপ হলো। ম্যাক্স নিখোঁজ হলেন। রিচার্ডের কাছে ফিরতে হলো ওর মাকে। নিকোলাস জানে ওর মা আগাথা কতটা ভালোবাসে ম্যাক্সকে। মাকে সুখী দেখতে চায়। সুখী একটা পরিবার চায়। ঠিক যেমনটা ওরা ম্যাক্সের সাথে ছিল বছর খানেক আগে। তাই তো ম্যাক্সকে ওর মন বার বার খুঁজে ফেরে। আজ যখন রিচার্ড বলল সে ম্যাক্সের কাছে নিয়ে যাবে, নিকোলাস কোনোকিছু না ভেবেই চলে এসেছে। কতদিন পর ম্যাক্সের সাথে দেখা হবে। ও ঠিক করেছে দেখা হওয়ামাত্রই তাঁর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে খুব কাঁদবে। অনুযোগে অনুযোগে ম্যাক্সকে নাজেহাল করে ছাড়বে। কথাগুলো ভেবে আনমনেই হাসল। ওর হাসি উবে যায় কাঁধে ভারী হাতটা পড়তে। পেছন ফিরে তাকাতে রিচার্ডের রাশভারি মুখ দেখতে পায়। সামনে দৃষ্টি রেখে ইশারায় করছেন। পিতার দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে ফেরে। সুরঙ্গের শেষ মাথায় গুহার মতো ছোট্ট গোলাকার জায়গা। এখান থেকে বেশ খানিকটা ঢালু হওয়ায় গাছের গুঁড়ি কেটে সিঁড়ি মতো করা হয়েছে। রিচার্ডকে অনুসরণ করে নামল নিকোলাস। সুরঙ্গের মতোই অন্ধকার এখানেও। মনটা কেমন যেন করছে নিকোলাসের। এমন অন্ধকার, অনিরাপদ স্থানে ম্যাক্স রয়েছে? কিন্তু কেন? নিচে নামতে উৎকট গন্ধ এসে লাগে নাকে। ভেজা মাটিতে পা প্রায় দেবে যায়। তারপরেই থমকে গেল। সাপের বিষাক্ত শ্বাস প্রশ্বাসে পুরো গুহার ভেতরটা কাঁপছে যেন। নিকোলাস সতর্ক হয়ে শুনল- একটা নয় অসংখ্য সাপের বিচরণ। রিচার্ডের হাতের মশালের আলোতে ক্রমশ সাপগুলো ওর চোখে পড়ল। শান্ত অথচ শিকারী দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওরা। মাথা সামান্য তুলে এঁকেবেঁকে চলছে সদর্পে। সাপের প্রকারভেদ সম্পর্কে খুব একটা জ্ঞান নেই নিকোলাসের, তবে এই সরীসৃপগুলোকে দেখে ওর মনে হলো পৃথিবীর সকল সাপের জাতই এখানে উপস্থিত। একটা ব্যাপার ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সাপগুলোর সামনে গোরু থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রাণীর অর্ধগলিত মরদেহ পড়ে আছে। গা গুলিয়ে এলো। রিচার্ড নির্ভয়ে মশাল হাতে সামনে এগোচ্ছে। ওর সামনে থাকা সাপগুলো কুর্নিশের ভঙ্গিতে স্থান ছেড়ে সরে যায়। বেশ অবাক করে নিকোলাসকে এসব। হঠাৎ খেয়াল করল রিচার্ডের বা’হাতের তর্জনীর দিকে। কোমরের নিচে ঝুলে থাকা তর্জনী ছাড়া সব কটা আঙুল ভাঁজ। ওই একটা আঙুল চক্রাকারে ঘুর্নায়মান। নিকোলাস সাপগুলোর দিকে ফের তাকাল। এবার যেন আরো চমকে উঠল। প্রতিটি সরীসৃপের দৃষ্টি স্থির ওই আঙুল দিকে। ভয়ে থেমে গেল আবার নিকোলাস। আর সাথে সাথে গর্জনের ভঙ্গিতে ফোঁস করে উঠল কালোর রঙের ব্লাক মাম্বাটা। ঠিক নিকোলাসের বা’পাশের মরা গাছের ডালে জড়িয়ে ছিল সেটা। ফণা তুলে মাথা এগিয়ে আনতে রিচার্ড তর্জনী তাক করেন। পিছিয়ে যায় ওটা আগের স্থানে। নিকোলাসের হাঁটু কাঁপছে রীতিমতো।
“থেমো না। চলতে থাকো।” বড়ো অদ্ভুত আর অচেনা লাগল রিচার্ডের গলা। আর নিকোলাস চুপ করে থাকতে পারল না। ভীত কণ্ঠে বলে উঠল,
“এখানে ম্যাক্স থাকে! আপনি আমাকে মিথ্যা বলছেন, তাই না?”
“একটু পরেই সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবে নিকো।”
“এই বলেই এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন। কিন্তু কোথায় ম্যাক্স? আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না এমন একটা জায়গায় ম্যাক্স কেন থাকবে? এখানে কি কোনো মানুষ থাকতে পারে?”
রিচার্ড হঠাৎ খ্যাঁক করে হেসে উঠলেন। বিড়বিড় করে বললেন,
“মানুষ!”
নিকোলাস ঠিক বুঝল না। কিন্তু পিতার মুখের ভাব ওর পছন্দ হলো না। ম্যাক্সকে নিয়ে কোনো কটুক্তি ও সহ্য করবে না। তাতে এই বয়সে যদি পিতার হাতে মার খায় খাবে। রিচার্ড অবশ্য এরপরে চুপ রইল। ওরা আরো খানিক হাটতে সামান্য আলোর দেখা পেল। গুহার এই মোড়ে শুয়ে আছে বিশালাকার পাইথন। রিচার্ডকে দেখে সেটার ভারী শরীর সরে যায়।
“সাপগুলো আপনার বশীভূত?”
নিকোলাসের প্রশ্নে হাসলেন আবার রিচার্ড। ঘাড়ের ওপর দিয়ে চেয়ে বলেন,
“তুমি চাও?”
“হু?”
“এদের বশীভূত করতে চাও?”
সজোরে মাথা ঝাকায় নিকোলাস। সাপকে ওর ভীষণ ভয়। ভয়ের জীবকে বশীভূত করে করবে কী? তাছাড়া কাওকে বশীভূত করে তার জীবনের ছন্দ নষ্ট করা এক ধরনের অপরাধ। নিকোলাস নির্ঝঞ্ঝাট জীবন বেশি পছন্দ করে। রিচার্ড ছেলের মুখে কিছুক্ষণ চেয়ে গম্ভীর হয়ে যান। চলতে চলতে বলেন,
“এসো।”
গুহার মোড় ঘুরতে লোহার বন্দিশালা। রিচার্ডের পা থামে। সেই সাথে থামে নিকোলাস। সামনে আঙুল তুলে রিচার্ড বলেন,
“ওই যে তোমার ম্যাক্স বাবা?”
আনন্দে জ্বলে ওঠে নিকোলাসের চোখজোড়া। কিন্তু কোথায় ম্যাক্স? এখানে দাঁড়িয়ে কাওকেই দেখল না। রিচার্ড ইশারা করল সামনে এগিয়ে যেতে। নিকোলাস সানন্দে এগিয়ে গেল। বন্দিশালার এককোণের আবছা আঁধারে দু’টো মানুষকে দেখতে পেল। নিকোলাসের আনন্দ ম্লান হয়ে যায় সামনের দৃশ্য দেখে। এক যুবতীর কোলে শুয়ে আছে ম্যাক্স। পরনে পুরোনো ময়লা কাপড়। দুজন দুজনের দৃষ্টিতে এতটাই হারিয়ে গেছে যে সামনে নিকোলাসের উপস্থিতি টের পাননি। যুবতীর মুখটা এক সময় ঝুঁকে এলো কোলে থাকার ম্যাক্সের মুখের দিকে। ম্যাক্সও এক হাতে যুবতীর মাথার পেছনে হাত রেখে মুখ তুললেন। দুজনের ঠোঁট নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়। নিকোলাসের মনে হলো কেউ যেন ওর বুক বরাবর শরবিদ্ধ করেছে। অসহ্য যন্ত্রণায় নিঃশ্বাস আঁটকে আসার উপক্রম। সেই মুহূর্তে কেবল একটা অনুভূতিই ওর সমস্ত কিছুর ওপর আধিপত্য করে বসল, আর তা হলো প্রতারিত হওয়ার বিষম জ্বালা। পেছনে দাঁড়ানো রিচার্ড তখন মহাখুশি। যা দেখাতে চেয়েছিল তাই তিনি দেখাতে পেরেছেন। ছেলের অন্তরের জ্বালাকে বিষে পরিণত করতে এগিয়ে এলেন।
“দেখো তোমার ম্যাক্স বাবাকে, প্রেমিকা নিয়ে বেশ মজেই আছে সে। তোমাকে এবং তোমার মাকে বেমালুম ভুলে গেছে আজ।”
রিচার্ডের উঁচু গলায় চমকে তাকান ম্যাক্স এবং যুবতীটি। নিকোলাসের ব্যথাতুর মুখটা দেখে ম্যাক্স ভূত দেখার মতো চেয়ে রইলেন। রিচার্ড নিকোলাসের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“ও একটা ধোঁকাবাজ, মিথ্যাবাদী। তোমার মা আর আমার সংসার ভাঙতে এতদিন মিথ্যা ভালোবাসার নাটক করেছিল তোমাদের সাথে। কার্যসিদ্ধির পর তোমাদের ছেড়ে নতুন প্রেমিকা জুটিয়ে সংসার পেতেছিল। ধরে এনে এখানে বন্দি করে রেখেছি দুটোকে। এবার প্রতিশোধ নাও নিকো।”
“ও মিথ্যা বলছে নিক, ওর কথা তুই বিশ্বাস করিস না বাবা।”
ম্যাক্স উঠে এসে দাঁড়ালেন নিকোলাসের সামনে। নিকোলাসের অনিমেষনেত্রের কার্ণিশে জল টলমল করে। ঠোঁট দুটো কেঁপে ওঠে। অস্ফুটে বলে,
“এমন কেন করলে তুমি ম্যাক্স বাবা? আমার মাকে কেন ধোঁকা দিলে? আমাদের সুখী সংসারের স্বপ্ন তুমি কেন ভেঙে দিলে? এখন আমি মাকে গিয়ে কী বলব? মা যে তোমার ফেরার আশায় পথ চেয়ে আছে।”
“নিক, বাবা আমার।” ম্যাক্স হাত বাড়িয়ে ওকে ছুঁতে গেলে সরে দাঁড়ায় নিকোলাস। আহত চোখে তাকালেন ম্যাক্স। যুবতী অপরাধী মুখ করে পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ম্যাক্স রিচার্ডের দিকে জ্বলন্ত চোখে চেয়ে বলেন,
“সব এই রিচার্ডের কারসাজি বিশ্বাস কর নিক। ও আমাকে __”
ম্যাক্সের কথা শেষ করতে দেন না রিচার্ড। বলেন,
“তুই আমার ছেলে আর আগাথাকে ধোঁকা দিয়ে ভেবেছিস বেঁচে যাবি? তোকে আর তোর প্রেমিকাকে ভয়ংকর মৃত্যু দেবো আমি।”
রিচার্ডের ডাকে পাইথন হেলতে দুলতে এগিয়ে যায় ম্যাক্সের খাঁচার দিকে। যুবতী আঁতকে ওঠে। পাইথনকে এগিয়ে আসতে দেখে যুবতী আতঙ্কে চিৎকার করে,
“ম্যাক্স, ম্যাক্স।”
ম্যাক্স ফিরতে নিকোলাস ওর হাত চেপে ধরে।
“আমি সব ভুলে যাব। তুমি ওকে ফেলে চলো আমার সাথে। মা আর নোভা অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। চলো ম্যাক্স বাবা।”
যুবতীর আতঙ্কিত মুখ দেখে খারাপ লাগছে নিকোলাসের। কিন্তু মায়ের খুশির জন্য সে এই মুহূর্তে খারাপ লাগাটাকে ঠেলে সরিয়ে দিলো, স্বার্থপর হলো। পাইথন একেবারে কাছাকাছি চলে গেছে। যুবতী কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“ম্যাক্স, ম্যাক্স আমাদের বাচ্চাকে ও মেরে ফেলবে।”
নিকোলাসের হাতের মুঠ খুলে ম্যাক্সের হাতটা মুক্ত হয়। যুবতীর বড়ো পেটটাতে দৃষ্টি স্থির হলো ওর। ঈর্ষার অনল একটু একটু করে শান্ত মস্তিষ্ক, পবিত্র হৃদয়কে পুড়াতে লাগল। ম্যাক্স কিছু বলবে তার পূর্বে যুবতি পুনরায় আর্তনাদ করে ওঠে। সেদিকে ছুটে যান ম্যাক্স। মনুষ্য রূপে পাইথনটার সাথে পেরে উঠবে না জেনে নিজের নেকড়ে রূপ ধারণ করেন। চোখের পলকে পাইথনটার দেহ টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে বন্দিশালার এদিকে ওদিকে। যুবতী অচেতন হয়ে পড়ল সেখানে। ম্যাক্স মানুষ রূপে ফিরে যুবতীর মাথাটা কোলে নিয়ে জাগানোর চেষ্টা করেন। হঠাৎ পেছন ফিরে তাকাতে নিকোলাসের বিবর্ণ মুখ, বিস্ফোরিত চোখ দেখতে পায়। কোল থেকে যুবতীর মাথা নামিয়ে আবার এগিয়ে এলো নিকোলাসের কাছে। সবটা ব্যাখ্যা করতে গেলে ভয়ে সরে যায় নিকোলাস। রিচার্ড ওকে বুকে জড়িয়ে বলেন,
“নিকো, দেখলে তো চোখের সামনে এই বহুরূপীর আসল চেহারা। ও তোমাদের ক্ষতি ছাড়া কোনোদিন ভালো কামনা করেনি, করবে না। কে জানে তোমার ওপরও হয়তো জাদুটোনা করে রেখেছে।”
শিউরে ওঠে নিকোলাস। পিতার মুখের দিকে তাকায় তারপর ম্যাক্সের পানে। একরাশ ঘৃণা আর ভয় দেখতে পায় নিকোলাসের চোখে ম্যাক্স। বিমর্ষ হলো তাঁর মুখ।
“ওকে মেরে ফেলো নিকো, নয়তো ও আমাদের সবার পরিণতি করবে ওই পাইথনের মতো। মেরে ফেলো ওই প্রতারক, মিথ্যাবাদী আর বহুরূপীটাকে।”
নিকোলাসের হাতে ধারালো তলোয়ার তুলে বন্দিশালার দরজা খুলে দেয় রিচার্ড। নিকোলাস নড়ে না। ম্যাক্সকে ও কিছুতেই মারতে পারবে না। পিতাকে মাথা নাড়িয়ে, করুণ মুখে অসম্মতি জানায়। রিচার্ড তাতে অসন্তুষ্ট হলেন। বললেন,
“তবে ওর প্রেমিকাকে মেরে আয়। ওই মেয়ের জন্য ম্যাক্স তোর মাকে ছেড়েছে। ওকে মেরে শিক্ষা দে ম্যাক্সকে। মার, মার, মার।”
কানের কাছে অদ্ভুত আওয়াজে চেঁচাতে লাগল রিচার্ড। বদলে যায় নিকোলাসের শান্ত মুখ। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তলোয়ার তুলে যুবতীর অচেতন দেহের দিকে এগিয়ে যায়। যেন চাবি দেওয়া কলের পুতুল। বিড়বিড় করে বলে,
“এ আমার ম্যাক্স বাবাকে কেড়ে নিয়েছে, এ আমার মায়ের ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছে, আমাদের সুখী সংসারের স্বপ্ন ভেঙেছে ওর কারণে। মৃত্যু হোক আজ ওর, মৃত্যু হোক।”
নিকোলাস তলোয়ার শূন্যে তুলতে ম্যাক্সের যেন ঘোর কাটে। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। যুবতীর বুকে ঢুকিয়ে দেয় তলোয়ারের সূঁচালো অংশ নিকোলাস। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে। গর্জন করে ওঠে ম্যাক্স। নেকড়ে রূপে নিকোলাসকে আক্রমণ করে বশে। ওর বুকে ঢুকিয়ে দেয় ধারালো নখ। কামড়ে ধরে নিকোলাসের গলা। সংবিৎ ফেরে নিকোলাসের। ব্যথায় নীলচে হয় ওর মুখ। মাকে চিৎকার করে ডাকে,
“মা, মা, বাঁচাও।”
রিচার্ড ছুটে এসে জাদু বলে ম্যাক্সকে নিকোলাসের দেহের ওপর থেকে সরিয়ে দেয়। নিকোলাসের রক্তাক্ত আহত শরীর দেখে হুঁশ ফিরল ম্যাক্সের। নিজের সন্তানের প্রতি প্রতিটি জীবই আবেগি এবং তাদের সুরক্ষায় হয় ঢাল। ম্যাক্সের ক্ষেত্রেও তেমনই হয়েছে। ঔরসজাত সন্তানের বিপদ দেখে তিনি নিকোলাসকে আক্রমণ করে বসেছেন। কিন্তু এখন যখন নিকোলাসের রক্তাক্ত আহত শরীর দেখলেন, অনুশোচনা আর আক্ষেপে পাগলপ্রায় হয়ে উঠলেন।
“নিক, আমার বাবা, আমাকে মাফ করে দে। এ আমি কী করেছি?” দুহাতে চুল মুঠ করে পাগলের মতো কাঁদতে লাগলেন ম্যাক্স। রিচার্ডের ঠোঁটে পৈশাচিক হাসি। তিনি আজ সফল। নিকোলাস এবার সম্পূর্ণ তাঁর, পুরোটাই তাঁর। নিকোলাসের চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে এলো। ম্যাক্স কাঁদছেন অথচ, এখন আর নিকোলাসের খারাপ লাগছে না সেই কান্না শুনে। এই এত ব্যথার মধ্যেও হাসল। অদূরে যুবতীর রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে। নিকোলাসের দৃষ্টি পাথর হয়ে গেল। ভেতর থেকে কেউ একজন বলল,
“তুই খুনী, তুই পাপী। প্রতিহিংসার বশে দুটো প্রাণ শেষ করেছিস। নরকে যাবি তুই, বিধাতা তোকে ঘৃণা করে। পৃথিবীর সকল জীব তোকে ঘৃণা করবে, তোর মা তোকে ঘৃণা করবে।”
ভীতসন্ত্রস্ত নিকোলাস কাঁদতে লাগল চিৎকার করে। রিচার্ডের কোলে জবুথবু হয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলে,
“আমি ওকে মারতে চাইনি। ওকে বাঁচাও কেউ। ওকে বাঁচাও।”
“তুমি আজ প্রমাণ করেছ তুমি আমার ছেলে নিকো।”
রিচার্ড ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। নিকোলাস সিক্ত চোখে তাকায় পিতার দিকে। নিষ্ঠুর আর নির্মমতায় ভরা ওই মুখ। মা কি এ থেকেই দূরে রাখতে চেয়েছিল ওকে? আজ মায়ের সব চেষ্টা বিফল হলো। পিতার যোগ্য ছেলে বলে প্রমাণিত হলো নিকোলাস। কিন্তু এমনটা হতে তো চায়নি ও। দুর্ভাগ্য আজ ওকে অন্ধকারে ঠেলে দিলো।
পাপের বোঝা বুকে নিয়ে একটু একটু করে অন্ধকারে তলিয়ে যায় নিকোলাস। ওর সামনে এখন কেবলই অন্ধকার। যেখান থেকে ও আর আলোতে ফিরতে পারবে না। আজ যেন ওই যুবতীকে মারেনি, নিকোলাস নিজে মরেছে। এখন মনেপ্রাণে চাইছে সত্যি সত্যি মৃত্যু হোক ওর। হত্যাকারী হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়।
রিচার্ড ডাকছেন। নিকোলাসের শক্তি নেই জবাব দেওয়ার। হঠাৎ ওর মনে হলো শীতল কিছু ওর পা বেয়ে আস্তে আস্তে উঠে আসছে ওপরে। কাঁপুনি দিয়ে উঠল সর্ব শরীর। ম্যাক্সের ক্রন্দনরত অসহায় মুখ ক্রমশ পরিবর্তন হতে লাগল। ১৩৪৯ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এসে থামল। নিকোলাসের সর্ব শরীর অস্বাভাবিক রকমের শান্ত। ম্যাক্সের মুখের আদল বদলে ইসাবেলার মুখে রূপ নিয়েছে। ইসাবেলা! বিস্ময়াহত হয়ে চোখ মেলল নিকোলাস। ওর হৃৎস্পন্দনের গতি তীব্র গতিতে বাড়ছে। সেই শীতল স্পর্শটা বুকের বা’পাশে উঠে আসতে খপ করে ধরে ফেলে। ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিতে খিলখিল হাসির শব্দে পুরো কক্ষ ভারী হয়ে ওঠে। এ যেন হাসি নয় সেই বিষাক্ত সাপের নিঃশ্বাস। গলা চেপে ধরে সামনে দাঁড়ানো সুশ্রী তরুণীর। কোনোরকম ভয়ের চিহ্ন নেই তরুণীর চেহারায়। সম্মোহনী হাসি হেসে আরো ঢলে পড়তে চায় নিকোলাসের গায়ের ওপর। ওর উষ্ণ জিহ্বা নিকোলাসের গ্রীবা, চোয়াল বেয়ে ঠোঁটের কোণে আসতে থেমে যায়। নিকোলাস ওর শরীর আছড়ে ফেলে অদূরের দেয়ালে। মুহূর্তে সোজা হয়ে দাঁড়ায় তরুণী। কামুক চাহনীতে দেহটাকে আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে হেলে দুলে পুনরায় নিকোলাসের পেছনে এসে দাঁড়ায়। চাপা গলায় বলে,
“চলো না প্রিয়, একটু মজা করি দুজনে মিলে। রাতের নেশায় তোমাকে নিয়ে ডুবে যাই।”
নিকোলাসের কাঁধে শ্বদন্ত ছুঁয়ে লম্বা আঙুল চোয়াল বেয়ে বুকে নেমে যায়। নিকোলাস ঘুরে ওর চুলে মুঠি চেপে ধরে বলে,
“গ্যাব্রিয়েলা, এই শেষ বার বলছি, আমার চোখের সামনে থেকে চলে যাও।”
“এমন আনরোমান্টিক কেন তুমি বলো তো? আমি তোমার সহচরী এখন, তবে একটু আদর সোহাগ করো না কেন? একটুখানি ভালোবাসো না, প্রিয়।”
গ্যাব্রিয়েলা ওর গলায় দু’বাহু জড়িয়ে গলায় চুমু দিতে লাগল। নিকোলাস চুলের মুঠি চেপে দূরে সরিয়ে বলে,
“সহচরী? তুমি আমার সহচরী নও গ্যাব্রিয়েলা। তুমি আর সবার মতোই আমার দাসী। দাসীদের ঔদ্ধত্য আমি মোটেও বরদাস্ত করি না। শাস্তি পাবে তোমার এই আচরণের জন্য।”
গ্যাব্রিয়েলা ভড়কে গেল নিকোলাসের কথায়। ওর ঘাবড়ে যাওয়া মুখ দেখে বিদ্রুপ করে হাসে নিকোলাস,
“ভয় পেলে? আদর সোহাগ নেবে না? আজ তোমাকে আমার আদর সোহাগের নতুন রূপ দেখাব। বিশ্বাস করো বেজায় পছন্দ হবে সেটা তোমার।”
ওর চুলের মুঠি ধরে হাওয়ায় উড়ে নিয়ে নিলো প্রাসাদের নিচের কবরস্থানে। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল পল। ওর হাতে ছোট্ট একটা ক্রুশ আর শুকনো গোলাপ। গ্যাব্রিয়েলার মুখ সাদা হয়ে গেল।
“আমার ভুল হয়েছে প্রভু, আমি আর ওমন আচরণ করব না। ক্ষমা করুণ আমাকে।”
“পল!” মালিকের ডাকে নত মাথায় এগিয়ে এলো পল। নিকোলাস গ্যাব্রিয়েলাকে কফিনে ছুঁড়ে ফেলতে পল ওর গায়ের ওপর ক্রুশটা ছুঁড়ে দেয়। চিৎকার করে ওঠে গ্যাব্রিয়েলা। কফিনের মুখ টেনে ওর ওপর শুকনো গোলাপ রেখে দূরে গিয়ে দাঁড়ায় পল।
“প্রভু, আমাকে ক্ষমা করুন। ভুল হয়েছে। এমনটা আর হবে না। মুক্ত করুন এখান থেকে।”
গ্যাব্রিয়েলার আর্তনাদ উপেক্ষা করে রুমে ফিরে আসে নিকোলাস। চেয়ারে দুচোখ বন্ধ করে আগের মতো বসে। শান্ত গলায় পলকে বলে,
“আগামীকাল সকাল পর্যন্ত নির্ধারিত গ্যাব্রিয়েলার শাস্তি। তারপর সরিয়ে ফেলিস ক্রুশ আর গোলাপ।”
“জি, মালিক।”
“নতুন কোনো খবর আছে?”
“জি, বাল্টিক সাগরের পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামে আগামীকাল আপনাকে যেতে হবে। সেখানকার অনুসারীরা খুব করে আশা করছে আপনাকে।”
মাথা নাড়াতে পল বিদায় হয়। নিকোলাসের কপাল কুঁচকে যায় হঠাৎ। বিড়বিড় করে বলে,
“বাল্টিক! লিথুনিয়া!”
মুহূর্তে ইসাবেলার মুখটা ভেসে ওঠে। ইসাবেলা কী এখনো লিথুনিয়া আছে? ও কী ঠিক আছে? হয়তো এতদিনে কোনোভাবে পৌঁছে গেছে রাশিয়াতে। তাই হবে। চারমাস গত হয়েছে কিন্তু ইসাবেলাকে স্মৃতি থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেনি নিকোলাস। ও যেন কাছে না থেকেও আরো কাছে থিতু হয়েছে। মনে মনে ক্ষিপ্ত হয় নিজের ওপর। কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায় শিকারের খোঁজে। ইসাবেলাকে নিয়ে ভাবার সময় কিংবা অবসর নিজেকে দেবে না।
চলবে,,,,
ভীষণ অসুস্থ থাকার কারণে এতদিন কোনো পর্ব দিতে পারিনি। আজ আলহামদুলিল্লাহ কিছুটা ভালো। ইন শা আল্লাহ এখন থেকে আগের মতো নিয়মিত দেওয়ার চেষ্টা করব।