তিমিরে_ফোটা_গোলাপ পর্ব–৫৮ Writer তানিয়া শেখ

0
650

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৫৮
Writer তানিয়া শেখ

গতরাতে বাড়ি ফেরেনি ভিক্টোরিজা। এই ঘটনা নতুন নয়। এমন অনেক রাতেই আগে ও বাড়ি ফিরত না৷ বার, ক্লাবে মেতে থাকত। কিন্তু তখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল। এখন চারিদিকে যুদ্ধের দামামা বেজেছে। বাইরে কারফিউ। এর মাঝে রাতভর মেয়ের বাইরে কাটানো দুশ্চিন্তার ব্যাপার বটে জাস্টিনা বেনাস নীলসনের জন্য। বেনাস মেয়ের আচার আচরণে খুব বেশি সন্তুষ্ট থাকেন না। কিন্তু মেয়ের রূপকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক অনেক রাঘববোয়ালদের তিনি বশে এনেছেন। এই কারণে ভিক্টোরিজার অনেক ঔদ্ধত্যকে তিনি ছাড় দেন। আজ ভিক্টোরিজা যেন সকল ঔদ্ধত্য ছাড়িয়ে গেছে কারফিউর মাঝে বাড়ির বাইরে পা রেখে। স্ত্রী কাছে সব শুনে তৎক্ষনাৎ লোক পাঠালেন মেয়েকে খুঁজতে। বহু খোজাখুঁজির পরও কোথাও মেয়েকে পেলেন না। স্বামী স্ত্রী দুজনই চিন্তায় পড়লেন। বেনাস ওপর মহলের সাহায্য নিলেন মেয়েকে খুঁজতে। মেয়ের চিন্তায় জাস্টিনার মেজাজ সপ্ত আসমানে চড়ে আছে। রেগেমেগে জুজানিকে চড় কিল দিলেন। দোষটা যেন সব জুজানির। বেচারি জুজানি নিজেও মিসের নিখোঁজে চিন্তায় ছিল। গৃহকর্ত্রীর প্রহারে কাঁদতে কাঁদতে এসে বসে রইল নিজ রুমে। খাবার টেবিলে এই প্রথম রান্না ভালো হয়নি বলে খুব কটু কথা শোনালেন মাদাম আদলৌনাকে জাস্টিনা। মাদাম নীরবে শুনে গেলেন। ইসাবেলা আজ আর জাস্টিনার সামনে আসেনি। মাদাম ওকে মাতভেইর কাছে থাকতে বলেছিল। সন্ধ্যার প্রারম্ভে মাদাম কবিরাজের সাথে দেখা করবেন বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। তাঁর বেরিয়ে যাওয়ার ঘণ্টাখানেক পরে জুজানি এসে জানালো ভিক্টোরিজা বাড়ি ফিরেছে। ইসাবেলা স্বস্তি পেল। ভিক্টোরিজা নিখোঁজ শুনে ওরও চিন্তা হচ্ছিল। জুজানি আরো বলল, গৃহকর্ত্রী রাতের খাবার গরম করে টেবিলে পরিবেশন করতে বলেছেন। ইসাবেলা রান্নাঘরে এলো। মাদাম আদলৌনা রাতের খাবার তৈরি করে গেছেন। ইসাবেলা সেগুলোকে গরম করে টেবিলে পরিবেশন করে। তারপর আবার রান্নাঘরে এসে দাঁড়ায়। ডাইনিং-এ বেনাস ও জাস্টিনার গলা শুনতে পাচ্ছে। তাঁদের গলার স্বর চিন্তিত। ভিক্টোরিজা এসেই শুয়ে পড়েছে। মুখটা ক্লান্ত, ফ্যাকাশে। জাস্টিনার অসংখ্য প্রশ্নের জবাবে নিরুত্তর থাকার পর একসময় ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেছে ভিক্টোরিজা। মেয়ে বাড়ি ফিরেছে তাতেই বেনাস, জাস্টিনা খুশি।দুজনে চুপচাপ খেতে লাগলেন। বেনাসের মনে নানান প্রশ্নের উদয় হলো। এই শহর তন্নতন্ন করে খুঁজেছিলেন মেয়েকে। কোথাও পাননি। পুরো একটা রাত এবং দিন ভিক্টোরিজা ছিল কোথায়?
বেনাসের মনে কীসের যেন শঙ্কা কাজ করছে। প্রথমে ভিক্টোরিজার লাপাত্তা হয়ে যাওয়া তারপর হুট করে বাড়ি ফেরা তাঁর মনে কেন যেন সন্দেহ সৃষ্টি করছে? মেয়ের মুখটা তিনি দেখেছেন। মেয়েকে ওভাবে আগে কখনো দেখেননি। সন্দেহের কারণ ঠিক ওটাই। খাবার শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন। জাস্টিনা জুজানিকে আদেশ করেছে, রাতে ভিক্টোরিজার ঘুম ভাঙলে কিছু খাইয়ে দেওয়ার জন্য। স্বামীর পিছু পিছু সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলেন। তাঁদের থাকার রুম ডান দিকে। কিন্তু বেনাস বা’দিকে পা বাড়ায়। ওদিকটাতে ভিক্টোরিজার রুম। জাস্টিনা বললেন,

“এখন ও ঘরে না গেলেই কি না? সকালে যেয়ো।”

“আমি ওকে জাগাব না। তুমি রুমে যাও আমি আসছি।”

জাস্টিনাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হেঁটে চলে এলো মেয়ের দরজার সামনে। দরজাটা ভেজানো ছিল। নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকলেন বেনাস। মনের সন্দেহটা কাটানো দরকার। ভিক্টোরিজার রুমের হ্যারিকেনটার সলতে একেবারে কমিয়ে রাখা। ম্লান আলোয় মেয়ের বিছানার দিকে এগোলেন। চিৎ হয়ে শুয়ে আছে ভিক্টোরিজা। হাত দুটো বুকের ওপর ভাঁজ। নিস্প্রভ আলোয় ওর মুখটা ভীষণ সাদা লাগছে। জানালার বাইরের তুষারের স্তুপের ন্যায়। মানুষকে এত সাদা বড্ড বেমানান লাগে। বেনাস মেয়ের শিওরের পাশে এসে দাঁড়ালেন। কেন যেন মৃত মানুষের মতো মনে হচ্ছে ভিক্টোরিজাকে। সত্যি ভয়টার তাঁর পেয়ে বসল এবার। গত পরশুদিনের আগে এমনটা ঘটলে হয়তো সন্দেহ জাগত না, ভয়ও পেতেন না।

তাঁর এক কাছের বন্ধু গত পরশুদিন কল করেছিল। বেশ ভীত মনে হয়েছিল ওঁর গলা। কী হয়েছে জানতে চাইলে বললেন,

“বেনাস, আমি বুঝি আর বাঁচব না। ওরা আমাকে মেরে ফেলব বন্ধু।”

“কারা?”

“ভ্যাম্পায়াররা।”

“কী যা তা বলছ? ওসব বাস্তবে আছে না কি?”

“আছে আছে। আমি নিজ চোখে দেখেছি। ঠিক এই কারণে ওরা আমাকে বাঁচতে দেবে না। আমি তোমাকে সাবধান করতে কলটা করেছি।”

“আমাকে সাবধান করতে?”

“হ্যাঁ, সবচেয়ে ভয়ের কথা কি জানো বেনাস? ওরা অবিকল আমাদের মতো দেখতে। আমাদের মাঝে মিশে গেছে। সাধারণ চোখে ওদের আলাদা করা যায় না। তুমি বোধহয় জানো না, সেদিন তোমার বাড়ির ক্রিসমাসের অনুষ্ঠানে ওদের কয়েকজন ছিল।”

বেনাস চমকে ওঠে। কম্পিত কণ্ঠে বলেন,

“তুমি ওদের নাম জানো?”

টেলিফোনের লাইনের ওপর পাশে বন্ধুর চিৎকার শুনতে পেলেন। তারপর কঠিন নিস্তব্ধতা নামে। বেনাস বারকয়েক বলেন,

“হ্যালো, হ্যালো?” কোনো জবাব নেই। পরদিন সকালে খবর এলো সেই বন্ধুটির লাশ পাওয়া গেছে বাড়িতে। লাশটা বড়ো বিভৎস অবস্থায় ছিল। পুলিশের ধারণা জংলী কোনো পশুর আক্রমণে মারা গেছেন তিনি৷ বাড়ির চাকরবাকরেরা রাতে জংলী প্রাণীর গর্জন শুনেছিল। সুতরাং এ নিয়ে আর তেমন কথা ওঠেনি। কিন্তু বেনাসের ভয়টা বেড়ে যায়। কাওকে এ ব্যাপারে বলেননি তিনি। আজ যখন নিজের নিখোঁজ মেয়ে ফিরে এলো এবং ওর ফ্যাকাশে, অবসন্ন মুখটা দেখলেন, ভয়টা হু হু করে জেগে উঠল মনের মধ্যে। একটু আগেও মনে হয়েছিল অকারণেই ভয় পাচ্ছেন। ভিক্টোরিজা হয়তো কোনো প্রেমিকের বাড়িতে ছিল। মনের ভয় দূর করতে মেয়ের রুমে এসেছেন তিনি। ভ্যাম্পায়ার নিয়ে গত পরশু থেকে বেশ জেনে নিয়েছেন। মেয়েকে একটু পরীক্ষা করলে দোষ কোথায়? তিনি তর্জনী ভিক্টোরিজার নাকের সামনে ধরলেন। অনেকক্ষণ পরও হাতে কোনো উঞ্চতা পেলেন না। শুকনো ঢোক গিললেন বেনাস। তাঁর শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। কাঁপা হাতে মেয়ের কপাল ছুঁতে আঁতকে দুগজ দূরে সরে গেলেন। ভিক্টোরিজার কপাল বরফের ন্যায় ঠাণ্ডা। এমনটা কেবল মৃত মানুষের বেলাতেই সম্ভব। আচমকা ভিক্টোরিজার জানালার কবাট খুলে যায়। উন্মাদ বাতাসে রুমের সবকিছু উড়তে লাগল। বাতাসে হেলেদুলে নিভে গেল হ্যারিকেনের আলো। বেনাস ধড়ফড়িয়ে উঠে দরজার কাছে যেতে দরজাটা সশব্দে বন্ধ হলো। বেনাস পেছনে কারো উপস্থিতি টের পাচ্ছেন। ভয়ে তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে। ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরাতে একটা অশরীরী তাঁকে আক্রমণ করে বসল। মৃত্যুর পূর্বে সেই অশরীরী মানবীয় রূপ তিনি দেখতে পেলেন। তাঁর সুশ্রী মেয়েটি ভয়ংকর ডাইনিতে পরিণত হয়েছে।

স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন জাস্টিনা। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙল। পাশে ফিরে দেখলেন বেনাস এখনও ফেরেননি। বিছানা ছেড়ে নেমে রুমের বাইরে বেরিয়ে এলেন। স্টাডি রুমে গিয়ে দেখলেন সেখানেও নেই বেনাস। মনে পড়ল, শেষবার মেয়ের রুমে গিয়েছিলেন। ভিক্টোরিজার রুমের দিকে যাবেন হঠাৎ জুজানির কান্না শুনে থমকে দাঁড়ালেন সিঁড়ির মুখে। কড়িডোরের ল্যাম্পটা হাতে নিয়ে হলঘরে নেমে এলেন। কান্নার শব্দটা আসছে হলঘরের দক্ষিণ দিক থেকে। ওদিকটা গেস্ট রুম। জুজানি গেস্ট রুমে কী করছে?

“জুজানি?”

জাস্টিনা ডাকলেন। ক্ষীণ কান্নার শব্দটা মিইয়ে গেল একটুখানি। তারপর আবার আগের মতো কাঁদতে লাগল। রাতদুপুরে এভাবে কেউ কাঁদে? জাস্টিনা বিরক্ত হয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন ফিরে যাবার জন্য। কাজের লোক কাঁদছে তাতে তাঁর কী? কাঁদুক হতচ্ছাড়িটা। সকালে হলে এই কারণে ওকে আচ্ছা মতো বকবেন তিনি। দু কদম এগোতেই কান্নার গলা বদলে গেল। এখন গলাটা তাঁর মেয়ে ভিক্টোরিজার মনে হচ্ছে। আশ্চর্য! একটু আগে স্পষ্ট জুজানির কান্নার গলা শুনেছিলেন। মুহূর্তে গলাটা বদলে গেল কী করে? তাঁর কি হ্যালুসিনেশন হচ্ছে? জাস্টিনা মন দিয়ে শুনলেন। না! মোটেও হ্যালুসিনেশন নয়। ভিক্টোরিজাই কাঁদছে। শুধু ভিক্টোরিজা একা নয়, জুজানিও। মাঝ রাতে দুজনে এমন মরাকান্না কাঁদছে কেন? জাস্টিনা এগিয়ে গেলেন গেস্ট রুমের দিকে। যত এগোচ্ছেন ততই মনে হচ্ছে কান্নার সুরটা টানছে তাঁকে। এখন চাইলেও আর ফিরতে পারবেন না। ভয় পেয়ে বসল জাস্টিনাকে। সম্মোহিতের মতো গেস্টরুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন। এই রুমটা অস্বাভাবিকরকমের ঠাণ্ডা। সামনের ফ্রেঞ্চ জানালার কবাট খোলা। বেপরোয়া ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকে সবকিছু উড়িয়ে নিচ্ছে। এত ঠান্ডায় জাস্টিনার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। কুসংস্কারমুক্ত আধুনিকা রমণী জাস্টিনা। অশরীরী কোনো কিছুতেই তাঁর বিশ্বাস নেই। ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসও লোক দেখানো। তবুও ভয়টা কিছুতেই কাটানো গেল না। ভীত গলায় মেয়েকে ডাকলেন,

“রিজা?” প্রত্যুত্তরে কান্নার গুনগুনানি ছাড়া কিছু এলো না। জাস্টিনার হাতের ল্যাম্পের আলো বাতাসে নিভু নিভু করছে। রুমে একনজর বুলাতে সামনের খাটের এককোণে মেয়েকে দেখতে পেলেন। পিঠ এদিক করা, পিঠময় ওর সোনালি চুল উড়ছে। শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে কান্নার তোড়ে। জাস্টিনা এদিক ওদিক ল্যাম্পটার আলো নিয়ে জুজানিকে খুঁজলেন। কোথাও নেই ও। জাস্টিনা মেয়ের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন।

“কাঁদছ কেন সুইটহার্ট?”

ভিক্টোরিজার কাঁধে হাত রেখে প্রশ্ন করলেন তিনি। গুনগুনিয়ে কান্নার শব্দ থেমে গেল, কিন্তু ঘুরে তাকাল না সহসা ও। জাস্টিনা ল্যাম্প ঝুঁকে ধরতে যা দেখলেন তাতে তাঁর গলা দিয়ে আর্তচিৎকার বেরিয়ে এলো। ভিক্টোরিজা পৈশাচিক হাসি হেসে মায়ের দিকে তাকাল ঘাড় ঘুরিয়ে। ওর মুখময় তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। এক লাফে দূরে সরে গেলেন জাস্টিনা। জুজানির রক্তশূন্য মৃতদেহ পড়ে আছে ভিক্টোরিজার সামনে। মেয়ের এহেন ভয়ংকর রূপ দেখে কিছুক্ষণ থ মেরে রইলেন। এই দৃশ্য বিশ্বাস করতে সময় লাগল তাঁর। রাতে তাঁর স্বামীর রুমে না ফেরার কারণ এতক্ষণে বুঝলেন। বেনাস বেঁচে নেই, একমাত্র মেয়ের এই দশা। জাস্টিনার বুক ফেটে কান্না এলো। ভিক্টোরিজা উঠে দাঁড়ায়। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁটের পাশে লেগে থাকা রক্ত চেটে দাঁত বের করে হাসে। গা শিউরে ওঠা সেই হাসি। জাস্টিনার সর্ব শরীর থরথর করে কাঁপছে। হাত থেকে ল্যাম্পটা লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে। কোনোরকমে রুম থেকে ছুটে বেরিয়ে এলেন। হলঘর এসে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন কিছুতে বেঁধে। ক্ষীণ আলোয় দেখতে পেলেন এ বাড়ির ভৃত্যদের লাশ পড়ে আছে নিচে। একটু আগে এসব খেয়াল করেননি। জাস্টিনা ভয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠলেন। ছুটলেন ইসাবেলাদের রুমের দিকে। ওই ঘরে এখনও বাতি জ্বলছে। রুমের কাছাকাছি যেতে বাড়ির পেছনে ঘোড়ার খুরের শব্দ কানে এলো তাঁর। থামলেন জাস্টিনা। সেদিকে এগিয়ে যাবেন তখনই অদৃশ্য কিছু এসে তাঁকে হল ঘরের দিকে টেনে নিয়ে গেল। চাপা একটা আর্তনাদ মুহূর্তে বিলীন হয়ে যায় সেই স্থানে।

নিকোলাস বিশেষ কাজে জার্মানি গেছে। ফিরবে পরশুদিন। সুতরাং ইসাবেলা আজ বাড়িতেই ছিল। ঘুম আসছিল না ওর। মাতভেইও মায়ের না ফেরাতে চিন্তিত। দু’জনই রুমের বাইরের চাপা আর্তনাদ শুনতে পায়। মাতভেই চকিতে সোজা হয়ে বসল খাটের ওপর। ইসাবেলা কান পেতে শুনল হিংস্র গর্জন। এই গর্জন ওর চেনা। বুকটা কেঁপে ওঠে আতঙ্কে। দ্রুত থলিটা খুঁজে রোজারিও বের করে। আজ আর ওটা নিজে পড়ল না। পরিয়ে দিলো মাতভেইর গলায়। নিজের কোমরে গুঁজে নেয় কাঠের চৌকা মাথার টুকরো। বাকি জিনিসগুলো হাতের কাছে রেখে ত্রস্ত পায়ে দরজার দিকে যায়। বেশ কিছুক্ষণ পরে পরিচিত গলার ডাক শুনে দ্রুত দরজা খুলে দিলো। সামনে রক্তাক্ত শরীরে মাদাম বসে আছেন। ইসাবেলা কেঁদে ওঠে,

“মাদাম, এই অবস্থা কী করে হলো আপনার?”

গতপর্বের পর থেকে………

ইসাবেলা উর্ধ্বমুখে তাকিয়ে ছিল ছিন্ন পাপড়িগুলোর দিকে। ওদের থেকে বেরোনো দ্যুতি ক্রমশ আরো ম্লান হচ্ছে। ফুলের পুষ্পবৃন্ত, পরাগদন্ড, গর্ভদন্ড একত্রে আছে বিচ্ছিন্ন পাপড়িগুলোর মাঝে। পুষ্পবৃন্তের সাথের পরাগদন্ড আর গর্ভদন্ড নেতিয়ে যেতে লাগল। ওগুলো যত নেতিয়ে যায় পাপড়িগুলোর দ্যুতি ততই ম্লান হয়। হঠাৎ আবহাওয়া পরিবর্তন হলো। বিদ্যুৎস্ফুরণ আছরে পড়ল এই রুমের জানালায়। দেখতে দেখতে ঝড় উঠল বাইরে। প্রচন্ড জোরে জানালার কাচে আঘাত করছে বাতাস। সাথে হিংস্র নেকড়ের গর্জন শোনা যাচ্ছে। মাতভেই মায়ের লাশ কোলে নিয়ে সজল চোখে তাকাল ইসাবেলার দিকে। ইসাবেলা বলল,

“খুব খারাপ কিছু ঘটতে চলছে মাতভেই। সাবধান হতে হবে আমাদের।”

ইসাবেলা দরজার দিকে তাকায়। দরজা খোলা। তাড়াতাড়ি উঠে দরজা বন্ধ করতে গেলে প্রবলবেগে ধেয়ে আসা বাতাস ওকে উড়িয়ে ফেলে দেয় জানালার দিকে। ওটা বাতাস নয়, অন্য শক্তি। জানালার বাড়ি খেয়ে মেঝে পড়ে ব্যথায় গোঙাতে লাগল ইসাবেলা। ওর দেহের আঘাতে জানালার কাচে ফাটল ধরে। বাতাসের দাপটে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় জানালার কাচ। ছুটে এসে ওর শরীরের ওপর পড়ল।

“ইসাবেলা!”

মাতভেই বহুদিন পর দুপায়ের ওপর দাঁড়িয়েছে। আনন্দ আর নেই এখন ওর। ইসাবেলাকে টেনে বসাল। উদ্বিগ্ন গলায় বলল,

“ঠিক আছো তুমি?”

“ঠিক আছি আমি। মাতভেই আমাদের এখান থেকে পালাতে হবে। চলো এক্ষুনি।”

ইসাবেলা দাঁড়াতে গিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা জানালার কাচের টুকরো ঢুকে গেল পায়ের তলায়। ব্যথায় ককিয়ে উঠল। মাতভেই দেখল ইসাবেলার দেহের অনেক জায়গায় কাছের টুকরোর আচর লেগেছে। ওকে কোলে তুলে বিছানায় বসাল। এই ফাঁকে রসুনের মালাটা অজান্তেই ছিঁড়ে পড়ে গেল নিচে। বিছানায় বসিয়ে পায়ের তলার কাচের টুকরো বের করে আনে মাতভেই। দাঁতে দাঁত কামড়ে ব্যথা গোপন করার চেষ্টা করে ইসাবেলা। কিছুটা ব্যর্থ হয়। মাতভেই ফার্স্ট এইডের বক্স খুঁজতে লাগল। ইসাবেলা দেখল জানালা দিয়ে কালো ধোঁয়ার কুন্ডলি ঢুকছে। নাকে এসে লাগল অপরিচিত একটা গন্ধ। অপরিচিত! ঠিক অপরিচিতও নয়। তবে পরিচিত প্রিয় সেই সোঁদা মাটির গন্ধ এটি নয়। আর্ত কণ্ঠে মাতভেইকে বলল,

“মাতভেই চলো এখান থেকে, তাড়াতাড়ি চলো।”

“তোমার পা ব্যান্ডেজ করতে হবে আগে। এই অবস্থায় এক পা হাঁটতে পারবে না তুমি।”

ফার্স্ট এইডের বক্স খুঁজতে খুঁজতে বলল মাতভেই। ওর মাথার বেশ ওপরে এখনো একইভাবে চক্রাকারে ঘুর্নায়মান বিচ্ছিন্ন ম্লান আলোর ফুলটা। ইসাবেলা উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে পায়ে। সামনে চেয়ে আর্ত হয়ে ওঠে। ধোঁয়ার কুন্ডলি একটা অবয়বের রূপ নিচ্ছে। সম্পূর্ণ মানবীয় রূপে আসতে ইসাবেলা ভীত গলায় বলল,

“আন্দ্রেই!”

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here