তিমিরে_ফোটা_গোলাপ পর্ব–৭২

0
616

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৭২
Writer তানিয়া শেখ

চাঁদে গ্রহণ লেগেছে। এই সময়টা বেশ অস্থিরতায় কাটে চন্দ্রদেবীর। কত কী ঘটে পৃথিবীতে অথচ, তখন কিছুই তিনি দেখতে পান না। সাহায্য করতে পারেন না পছন্দের মানুষগুলোকে। এইটুকু সময়ে অনেক কিছু ঘটে যায়, কিন্তু তাঁর সামনে রুদ্ধ আঁধারের দুয়ার। যা ভেদ করা অসম্ভব।

আগাথাকে এতবার বোঝানোর পরেও ওঁ পৃথিবীতে গিয়েছে আজ। বেশ কয়েকমাস ধরেই অনুনয় করছিল। চন্দ্রদেবীকে কিছু নিয়মের মধ্যে চলতে, বলতে ও কাজ করতে হয়। চাঁদের শাসনকর্ত্রী হলেও তিনি পুরোপুরি চলেন সপ্ত আসমানে আসীন স্রষ্টার নির্দেশে। আগাথাকে সে কথা বলেই এতটাদিন পৃথিবীতে যাওয়া থেকে বিরত রেখেছিলেন। ইদানীং আবার আগের মতো গোঁ ধরেছে পৃথিবীতে যাবে। চন্দ্রদেবীর সামনে তাঁর মনের কথা গোপন থাকে না। সন্তানের বিপদ মায়েরা আগে থেকেই অনুধাবন করতে পারে। আগাথাও পেরেছে। নোভার সামনে ঘোর বিপদ। বহুদিন সন্তানদের সামনে যাননি। আজ না গেলেই নয়। আগাথাকে বিশেষ স্নেহ করেন চন্দ্রদেবী। তাঁর বারংবার করা অনুনয় উপেক্ষা করতে পারেননি। না চাইতেও অনুমতি দিতে হয়েছে। এখন সেই জন্য অনুতাপ হচ্ছে। কেন যে অনুমতি দিলেন ওকে! আজ গ্রহণ সরতে আধঘণ্টা লেগে যেতে পারে। এরমধ্যে যদি কিছু হয়! চন্দ্রদেবী তামার গোলকের সামনের এসে দাঁড়ালেন। দু-হাত ওর ওপর রেখে বললেন,

“গোলক গোলক, দেখা,
আগাথার আত্মার রশ্মিরেখা।”

গোলকে ধোঁয়াশা ক্রমশ বাড়ে। চন্দ্রদেবী অধীর হয়ে অপেক্ষা করেন আগাথার আত্মার আলো দেখার জন্য। কিন্তু অনেকক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পরও কিছু দেখতে না পেয়ে ভীষণ চিন্তায় পড়েন। পুনরায় বলেন,

“গোলক গোলক, দেখা,
আগাথার আত্মার রশ্মিরেখা।”

গোলকে এবারও ধোঁয়াশা ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। চন্দ্রদেবীর জোর বাড়তে থাকে গোলকের ওপর। এক পর্যায়ে রেগে যান শান্ত দেবী। পাছে দেবীর রোষানলে পড়তে হয় এই ভয়ে মুখ খোলে গোলক।

“অভিবাদন ও দেবী,
আজ গ্রহণে ম্লান আমার দ্যুতি।
নাই থাকে যদি আলো,
কেমনে দেখাই কোথায় কী হলো?”

দেবী শান্ত হলেন। সত্যি তো! তিনি দেবী হয়েই যখন নিরুপায় তখন গোলক আর কী করবে।
কিন্তু মনটা বড়ো বিচলিত দেবীর। সিংহাসনে বসে সামনে অন্ধকারে চেয়ে রইলেন। অপেক্ষা করতে লাগলেন এই কালো ছায়া সরে যাওয়ার। বিড়বিড় করে বললে,

“আগাথা, বাছা আমার! সাবধানে থেকো, সাবধানে থেকো।”

আগাথা পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট শুনতে পেলেন দেবীর কথা। বড়ো দেরি হয়ে গেছে এই সতর্কবার্তা পেতে।

“বহু চেষ্টার পর আজ সফল হয়েছি। এখন থেকে তুই আমার গোলাম। গোলাম।” অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে পুরুষালি কর্কশ কণ্ঠটি। আগাথা লোকটাকে দেখতে পাচ্ছে না। তাঁর সামনে ঘোর অন্ধকার। চতুর্দিকে ঘূর্ণায়মান অদৃশ্য এক রজ্জু। এই রজ্জুর বাঁধন তাঁকে বন্দী করে ফেলেছে। খারাপ কোনো জাদুকরের খপ্পরে পড়ে গেছেন আগাথা। এখন উপায়? দেবীকে স্মরণ করলেন। সাহায্য কামনা করলেন ঈশ্বরের। তাই শুনে আরও জোরে হাসল লোকটি।
“কেউ আসবে না তোমায় বাঁচাতে আগাথা। কেউ না।”

“তুমি আমার নাম জানো?”
জাদুকরেরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আত্মাদের বন্দী করে। আগাথা এতক্ষণ ভেবেছিলেন ভুলক্রমে তিনিও এদের ফাঁদে পড়ে গেছেন। তখনই লোকটার পূর্বের কথাটা স্মরণ হয়। উদ্বিগ্নতার কারণে কথাগুলো খেয়াল করেননি। প্লান করেই বন্দী করা হয়েছে তাঁকে। কিন্তু কেন? এখন ভয় তিরতির করে বেড়ে গেল। জাদুকর নিচু গলায় বলল,

“নাম? শুধু নাম নয় আগাথা। তোমার নাড়িনক্ষত্রের সব আমার জানা।”

“কে তুমি?”

“আমি? এখনই জানতে চাও? নাহ! এখন বললে তো মজা নেই। আরেকটু সবুর করো। শুভক্ষণে দৃষ্টিবিনিময়ে হবে আমাদের।”

সিংহাসনে গম্ভীর হয়ে বসে আছে নিকোলাস। রাশিয়া ও জার্মানির যুদ্ধ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। হিটলার আশাবাদী ছিল জয়ের। রাশিয়ার অনেক শহর এখন জার্মানির দখলে। হিটলারের বিপুল সংখ্যক সৈন্য এবং সাঁজোয়া অস্ত্রের সামনে দিশাহারা হয়ে পড়েছিল রাশিয়া। সবই জার্মানির পক্ষে ছিল। বিপত্তি বাঁধিয়েছে রাশিয়ার বৈরী আবহাওয়া। শীত, ভারী বর্ষণ জার্মান সৈন্যদের নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে। ক্যাম্পে দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। অস্ত্রের সরবরাহ নেই। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিচ্ছে নতুন নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব। এই সুযোগটা কাজে লাগালেন জোসেফ স্ট্যালিন। রেড আর্মিদের সৈন্য সংখ্যা বাড়তে লাগল। রাশিয়া নতুন উদ্যমে জার্মান সৈন্যদের মোকাবেলা করতে প্রস্তুত। হিটলার বেকায়দায় পড়েছে। কিন্তু হার মানতে নারাজ সে। তার এক কথা ‘জার্মানি হবে পৃথিবীর সর্বশক্তিমান নয়তো কিছুই নয়।’ প্রথম চারটি শব্দ প্রতিষ্ঠিত করতে সব করবে সে। অতিরিক্ত কোনোকিছুই ভালো নয়। হিটলারের কিছু মিত্র পক্ষের মতে হিটলার এখন যা করছে তা অতিরিক্ত। এই কারণে বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে তাদের। পরাজয় এখন সময়ে ব্যাপার। কিন্তু হিটলারকে বুঝাবে সাধ্য কার! না চাইতেও তার ভয়ে মিত্রপক্ষের সেসব নেতারা চুপ আছেন। নিকোলাস ওদের মতো ভীতু নয়। হিটলারকে কোনোকালেই ও ভয় করেনি। সে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে হিটলারকে আর সমর্থন করবে না। রাশিয়া আক্রমণের পর থেকে হিটলারের সাথে ওর মনোমালিন্য শুরু হয়। সেটা এখন বিরোধে রূপ নিয়েছে।

সামনের সভাসদদের আসন থেকে রিচার্ড উঠে দাঁড়ালেন। নাখোশ মুখে বললেন,

“হিটলারের সাথে শত্রুতা তোমার উচিত হবে না। ওকে আমাদের প্রয়োজন।”

“ও এখন আমাদের কোনো কাজের না।” বলল নিকোলাস। রিচার্ড বললেন,

“ভবিষ্যৎ দেখোনি তুমি নিকোলাস। কী করে বুঝলে ওকে আমাদের প্রয়োজন পড়বে না।”

“হিটলারের ভবিষ্যৎ এখন ওর ললাটে দিনের আলোর ন্যায় জ্বলজ্বল করছে। পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে ও। তোমার মস্তিষ্ক বুড়িয়ে গেছে। সুতরাং দূরদর্শিতা তোমার মধ্যে থাকার কথা না। এসব গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তায় তোমার মতামত দেওয়া উচিত বলে মনে করি না। মানবে না জানি, তবুও বলছি, এই সিংহাসনের উপযুক্ত কোনোদিন তুমি ছিলে না। রাজা হতে কূটবুদ্ধি আর ম্যানুপুলেটিভ স্বভাব ছাড়াও আরও কিছু থাকা লাগে। যা তোমার নেই।”

শান্ত গলায় বলল নিকোলাস। যেচে এসে বারবার মতামত দেওয়া রিচার্ডের বদঅভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে। খুব বিরক্ত হয় তাঁর ওপর নিকোলাস। প্রচণ্ড অপমানিতবোধ করলেন রিচার্ড। দাঁতে দাঁত পিষে আসনে বসলেন। সোফিয়া পাশে বসে কটমট করে বললেন,

“আর কত অপমানিত হবে? কত নিষেধ করি চুপ করো। না, উনি আমার কথা শুনবেন না। একজন অপদার্থ, দুর্বলকে ভালোবেসেছি আমি। কেবল অপমানিত হওয়া ছাড়া যার কিছুই করার নেই তার।” হঠাৎ সন্তানের মুখটা মনে যায় সোফিয়ার। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে ওর ক্ষতির আশংকা করে। ঠিক আছে কী আন্দ্রেই? আন্দ্রেইকে খুব মনে পড়ে এখন তার। নিকোলাসের দিকে তীব্র ঘৃণার দৃষ্টিতে চেয়ে চাপা গলায় স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

“তোমাকে আমি উজাড় করে ভালোবেসেছি রিচার্ড। বিনিময়ে কিছু দেওনি। এবারও আমার নিজের জন্য কিছু চাইবো না। তুমি ওই সিংহাসন ফিরিয়ে নেও রিচার্ড। আমি তোমায় ওই শয়তানটার জায়গায় দেখতে চাই।”

রিচার্ড একদৃষ্টে সিংহাসনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সভাসদদের সাথে আলাপে মশগুল নিকোলাস। এদিক ফিরলে দেখতে ওরই কাছের দুজনের চোখে প্রতিহিংসার ও প্রতিশোধের অনল দাউ দাউ করে জ্বলছে। কী ভয়ংকর তার তীব্রতা!

সভার ইতি টানলো আজকের মতো নিকোলাস।
একে একে সকলে ওকে অভিবাদন জানিয়ে বিদায় নিলো। সিংহাসনে গা এলিয়ে দেয় নিকোলাস। ইসাবেলার সান্নিধ্যের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। চোখ বন্ধ করে প্রিয়তমার মুখটা স্মরণ করল। আনমনেই মুচকি হাসল। ওর সকল খুশির উৎস যেন ইসাবেলা। ওকে ছাড়া সব কিছু বিষাদ, বিষণ্নতায় মোড়া, শূন্যতায় ভরা। ওর জীবন্মৃত দেহটা জীবন্ত হয় ইসাবেলার সান্নিধ্যে এলে। বহুকালপূর্বের অনুভূতি টের পায় তখন। কী চমৎকার, সজীব সেই অনুভূতি! এই অনুভূতি দীর্ঘস্থায়ী হোক। ইসাবেলা ওর হোক, সবভাবেই, সব অবস্থায়। যেটুকু দুরত্ব তাও আর না থাক। মিলেমিশে একাকার হতে চায় ওর ভেতর নিকোলাস।

“পল!”

মনিবের এক ডাকে বিনীতভাবে সামনে এসে দাঁড়ায় পল। নিকোলাস সিংহাসন ছেড়ে উঠে বলল,

“তৈরি হ। আজ রাতেই মস্কোর উদ্দেশ্য রওয়ানা হব।”

“বেয়াদবি না নিলে একটা কথা বলব, মালিক?”

মাথা নাড়ায় নিকোলাস,

“হুম।”

“দুই দেশের মধ্যেকার এমন খারাপ অবস্থার মধ্যে না গেলেই কী নয়? তাছাড়া কমিউনিটিতে আপনার শত্রু বাড়ছে। আজও আপনার সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অনেকে ছিল। বিশেষ করে_”

“রিচার্ড। তাই তো?” পলকে থামিয়ে দিয়ে বলল নিকোলাস।

“জি।” পল জবাব দিলো। নিকোলাস উপেক্ষিত হাসি হেসে বলল,

“এ আর নতুন কী। রিচার্ড কবে আমার পক্ষে ছিল? যারা বুদ্ধিমান তারা আমার সাথে শত্রুতা করার ভুল করবে না। কমিউনিটির সকলের জানা নিকোলাসের সাথে শত্রুতার ফল কত ভয়াবহ হয়। এ নিয়ে তুই ভাবিস না। ওরা আমার কিছু করতে পারবে না। এত সাহস বা ক্ষমতা ওদের নেই। যা গিয়ে তৈরি হয়ে নে।”

পল প্রস্থান করবে তখনই নিকোলাস থামালো ওকে,

“দাঁড়া।”

প্রশ্নাত্মক চোখে ঘুরে দাঁড়াল পল। একটু ভাবুক হলো নিকোলাস তারপর বলল,

“তুই বিয়ে পড়াতে পারবি?

“বিয়ে? কার?” বিস্ময়ে প্রশ্ন করে পল। নিকোলাস মৃদু ধমকে বলল,

“প্রশ্নের জবাবে প্রশ্ন করবি না৷ পারবি কি না বল।”

“আমি ফাদার নই। চার্চে যাওয়া আসা হয়ই না তেমন। কী করে পারব?”

গম্ভীর হয়ে পায়চারি করতে করতে ভাবল কিছুক্ষণ নিকোলাস। তারপর বলল,
“তুই বিয়ে পড়ানোর নিয়মটা জানিস তো?”

“তা জানি।”

“ব্যস! ওতেই হবে। যা এখন।”

আর কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ পায় না পল। দরজার দিকে যেতে যেতে একটা প্রশ্নই ভাবল,
“কিন্তু বিয়েটা কার? বিয়েটা কার?”

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here