#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৭৩
Writer তানিয়া শেখ
রবিবার ম্যাক্সওয়েল পরিবারের সকলে এসেছে স্থানীয় চার্চে। ডান দিকের সারির প্রথমে প্রবীণ ম্যাক্সওয়েল বসেছেন। মাথায় পাতলা সাদা চুল, নাকটা ইগল পাখির ঠোঁটের ন্যায়, বয়সের ভারে ঝুলে যাওয়া ভুরুর কারণে চোখজোড়া ছোটো দেখাচ্ছে। তার মাঝের মণি নীল। ওতে নমনীয়তা নেই। তীব্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। আজ তিনি কালো রঙের শার্ট আর টাউজার পরেছেন। অন্যদিনের চাইতে আজ তাঁকে কম গম্ভীর লাগে। পাশে ছেলেরা বসেছে। পেছনে পুত্রবধূ ও দৌহিত্ররা।
দুই সিটের সারি পরে ইসাবেলা বসেছে৷ পাশে রেইনি, ওর কোলে তাশা। মস্কো এসে তাশার স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে। বেশ কিছুদিন হলো ঘুমটাও ভালো হচ্ছে ওর। আগে মাঝরাতে ভয়ে চিৎকার করে উঠত। সমস্যাটা ইদানীং দেখা যাচ্ছে না। একা দুদন্ড ছাড়া যেত না ওকে। অবশ্য এখনও ছাড়া হয় না। রেইনি সবসময়ই ছায়ার মতো পাশে থাকে।
পাশের সারিতে মাতভেই তাতিয়ানা আর ভ্লাদিমি বসেছে। একটু পর কী একটা কারণে ভ্লাদিমি উঠে চার্চের বাইরে গেল। মাতভেই সেখানে বসে রেইনির কোল থেকে তাশাকে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। এলোই না মেয়েটা ওর কাছে! এই অল্পদিনে পুরোপুরি রেইনিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ওকে ছাড়া এক মুহূর্ত তাশার চলে না। অতটুকু বাচ্চা মেয়ে রোজ নিয়ম করে তাশাকে ঘুম পাড়াবে, ঘুম থেকে উঠাবে, খাওয়াবে, গোসল করাবে আবার খেলে ওর মন ভুলাবে। বেশ চাপ পড়ছে রেইনির ওপর। শুকিয়ে গেছে শরীর। মাতভেইর মনে বেজায় মায়া। কারো কষ্ট ও দেখতে পারে না। রেইনি তো কত ছোটো! ওর কোল থেকে মেয়েকে নিতে চাচ্ছিল। রেইনি হয়তো বুঝতে পারে মাতভেইকে। ম্লান হেসে ইশারায় আশ্বস্ত করে, ওর কষ্ট হচ্ছে না। মাতভেই আশ্বস্ত হয় না। তাতিয়ানা এতক্ষণ দেখছিল সব। চাপা গলায় বলল,
“তুমি যতই চেষ্টা করো কাজ হবে না। এটাই এ বংশের নিয়ম। ওইটুকু মেয়ে বেশ ভালোভাবেই বুঝে গেছে।”
“নিয়ম?”
নিভৃতে হাঁপ ছাড়ে তাতিয়ানা।
“নিয়ম! সভ্য ভাষায় সেটাই বলা চলে। এ বংশের কিছু নিয়ম আছে মাতভেই। আধুনিক যুগে এসেও যার কতকটা বর্বরোচিত।”
“কী বলছো বুঝতে পারছি না।” বলল মাতভেই।
“সব এখন বলতে পারব না। শুধু জেনে রাখো, রেইনির ওপর মায়া দেখিয়ে ওর কষ্ট কমাতে পারবে না তুমি। যে কষ্ট সিলমোহর হিসেবে কপালে লেগে গেছে তা কমানো যায় না।”
মাতভেই এই হেঁয়ালি কথাগুলোও বুঝলো না। ওর মুখ দেখে তাতিয়ানা বলতে বাধ্য হলো।
“রেইনি ম্যাক্সওয়েলদের দাসী মাতভেই। ওর জীবনটা উৎসর্গ করেছে ম্যাক্সওয়েলদের নামে। আমৃত্যু মনিবের সেবা করা ওর ধর্ম। এই ধর্ম থেকে কেউ বিচ্যুত করতে পারবে না, তুমিও না।”
মাতভেই স্তম্ভিত। এইটুকু মেয়ে জীবন উৎসর্গের কী বোঝে? কে বুঝিয়েছে এসব ওকে? মাতভেইর দৃষ্টি থামে মার্কোভিকের পাশে বসা তিখনের দিকে। পাথরের মূর্তির মতো লাগছে আজ তাকে। আপন নাতনির জীবনকে কেউ এমন করে নষ্ট করতে পারে? তিখনের প্রতি শ্রদ্ধাটুকু আর রইল না।
তাতিয়ানা পাশ ফিরে তাকায়। তাশা হাত পা ছুঁড়ে খেলছে রেইনির কোলে বসে। ইসাবেলা মাথা ঝুলিয়ে ফিসফিস করে শিশুসুলভ ভাষায় গল্প করছে। খিলখিল করে হাসছে তাশা। রেইনি একদৃষ্টে ওকে হাসতে দেখছে। হাসি সংক্রমক। যে দেখে সেও হাসে। রেইনির হাসি তাশার মতো প্রানবন্ত নয়, নিষ্প্রাণ।
প্রার্থনা শেষে মার্কোভিক ফাদারের কুশলাদি জানতে গেলেন। বেশ সময় নিয়ে চার্চের ব্যাকইয়ার্ডে কথা বললেন দুজন। বাকিরা লনে অপেক্ষা করছে। রেইনির কোল ছেড়ে নেমে লনের সবুজ ঘাসে দৌড়ে বেড়াচ্ছে তাশা। চার্চে আগত শিশুদের কয়েকজন ওর সাথে খেলতে আগ্রহ দেখায়। তাশা একেবারে উপেক্ষা করছে ওদের। রেইনি ছাড়া আর কারো সাথে খেলবে না ও। ইসাবেলা দূরে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখে মুচকি হাসে। তাশা আর রেইনির অসম বন্ধুত্ব ভ্যালেরিয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়। হাসি নিভে যায়। সামনের শূন্য গগনে চেয়ে থাকে। পাশে আন্না মেরিও ভাবিদের সাথে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। ছেলেরা একটু তফাতে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। মাতভেইর গম্ভীর মুখটা সরস করতে অপ্রয়োজনীয় কথা বলছে তাতিয়ানা। মাতভেইকে মন খারাপ করতে দেখলে কেন যেন মোটেও ভালো লাগে না। রেইনির ব্যাপারটা নিয়ে এত মাথা ঘামাবে জানলে বলতোই না।
একটু পর ফাদারকে সাথে করে মার্কোভিক সেখানে এলেন। মধ্য বয়সী ফাদারের পরনে সাদা ক্যাসক, মাথায় টাক। সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা। একে একে পরিবারের সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে ইসাবেলাকে দেখিয়ে বললেন,
“এ হচ্ছে আমার ছোটো নাতনি, ইসাবেলা অ্যালেক্সিভ। ইসাবেলা, ইনি ফাদার কাজিমির।”
“হ্যালো ফাদার।”
“হ্যালো চাইল্ড। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। তোমার সম্পর্কে সব শুনেছি আমি। প্রভু তোমার সাথে ছিলেন বলেই এতবড়ো বিপদের হাত থেকে ফিরে এসেছ। ভ্যালেরিয়ার পরিণতির জন্য আমি মর্মাহত। ওর আত্মার শান্তি কামনা করছি।” বুকে ক্রস আঁকলেন ফাদার। ইসাবেলা আনতমুখে দাঁড়িয়ে রইল। মার্কোভিক বললেন,
“ওর জন্য ভালো পাত্রের সন্ধানে আছি আমরা ফাদার। আশির্বাদ করুন যেন শীঘ্রই সুযোগ্য পাত্র পেয়ে যাই।”
ইসাবেলার বুকের ভেতর ধ্বক করে ওঠে। চকিতে তাকায় নানার দিকে। মার্কোভিক আমলেও নিলো না সে চাহনি। ফাদার মুচকি হেসে মাথা আগে পিছে নাড়িয়ে হাত আশীর্বাদের ভঙ্গিতে তুলে বললেন,
“আশীর্বাদ করি।”
আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে মার্কোভিক ফাদারের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। চললেন বাড়ির পথে। ফাদারকে পাশ কাটিয়ে যেতে ইসাবেলাকে তিনি থামালেন।
“চাইল্ড, একটু দাঁড়াও।”
“জি, ফাদার?”
ফাদার একটু উশখুশ করে বললেন,
“সিস্টার ভ্যালেরিয়ার কাছে একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ছিল। ওর মৃতদেহ খুঁজে সেটা আমরা পাইনি। পরে শুনেছি ওর যাবতীয় জিনিসপত্র তোমাদের ঠিকানায় পাঠানো হয়েছে। তুমি কি জিনিসপত্র দেখেছিলে চাইল্ড?”
ইসাবেলার গলা শুকিয়ে এলো। চট করে মিথ্যা বলতে গিয়ে কথা জড়িয়ে যায়।
“না, না। আমি তো এ ব্যাপারে কিছু জানিই না।”
ফাদার ওর ফ্যাকাশে মুখ চেয়ে গম্ভীর হয়ে বললেন,
“ওহ! আচ্ছা এসো তবে।”
হাওয়ার বেগে এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারলে খুশি হয় ইসাবেলা। ফাদার একদৃষ্টে ওর পথপানে চেয়ে রইলেন। বিড়বিড় করে বললেন,
“প্রভু তোমার মঙ্গল করুন। আমিন।” শেষবার বুকে ক্রস এঁকে চার্চে প্রবেশ করেন।
সারাপথ বুক ঢিপঢিপ করেছে ইসাবেলার। বিয়ের প্রসঙ্গ পর্যন্ত ভুলে গেছে ভয়ে। রুমে এসে দরজায় খিল দেয়। বিছানায় বসে পাশ রাখা গ্লাস থেকে ঢকঢক করে পানি পান করে। এখনও ফাদারের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি স্মরণ করে শিউরে উঠছে। ওর কথাগুলো কী বিশ্বাসযোগ্য ছিল? সন্দেহ করেনি তো ফাদার? সন্দেহ করলেই বা কী। চিরকুটটা এখন আর ওর কাছে নেই। বিপদমুক্ত নিকোলাস। আস্তে আস্তে বিছানায় শুয়ে পড়ল ইসাবেলা। নিকোলাসকে নিয়ে ওর ভীষণ ভাবনা হয়। এত শত্রু ওর! মাঝেমাঝে ইসাবেলার মনে হয় নিকোলাস যদি সাধারণ মানুষের মতো হতো! এই ভয়টা তখন থাকত না। দুজনে মিলে ছোট্ট একটা সংসার গড়ে তুলতো পাহাড়ের ওপর। বিত্তবৈভব কখনোই চাইনি ইসাবেলা। কেবল প্রিয়জন সাথে থাকলে চলবে৷ তার হাত ধরে বহুপথ হাঁটবে। দেখবে সূর্যাস্ত, সূর্যোদয়। কাঁধে মাথা রেখে জোছনা বিলাস করবে। নীল আকাশের নিচে বালুকাবেলার প্রবল বাতাসে দাঁড়িয়ে গাঢ় চুম্বনে সিক্ত করবে পরস্পরের ওষ্ঠদ্বয়। আরও কত ইচ্ছে জাগ্রত হয় ইসাবেলার মনে। কিন্তু সব ধূসর মলিনতায় ছেয়ে যায় অচিরেই। নিকোলাসের সূর্যাস্ত সহ্য হয় না। ও পুড়ে শেষ হয়ে যাবে সকালের সূর্যরশ্মিতে। এমন সূর্যোদয় ইসাবেলা দেখবে? কখনোই না। ইসাবেলার চোখজোড়া ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে এলো। নিকোলাসের সুদর্শন প্রেমময় অবয়ব স্মরণ করে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। পাষাণ বাস্তবতাকে কল্পনার মাধুরিতে ভুলে থাকাতেও সুখ। ইসাবেলার সেই সুখও বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। বাতাসে জানালার পাল্লার ঠুকাঠুকিতে ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ঘুম চোখে দেওয়াল ঘড়িতে চেয়ে দেখে রাত পৌনে বারোটা। এত রাত হলো কেউ ওকে ডেকে তুললো না! বিছানা ছেড়ে উঠে খোলা জানালার বাইরে তাকায়। অজস্র তারার মেলা বসেছে। মাঝের চাঁদটা আজ বড়ো উজ্জ্বল। ঘরময় সেই আলো লুটোপুটি খাচ্ছে। বাইরে বাতাস বইছে খুব। জানালার পাল্লা বার বার বাড়ি খাচ্ছে। ইসাবেলা উঠতে যাবে তখনই খেয়ালে এলো গায়ের কম্বলটা। বিকেলে ঘুমানোর সময় কম্বলটা পায়ের কাছে ছিল। দরজাও ভেতর থেকে দেওয়া। চোখজোড়া দপ করে জ্বলে ওঠে। হাসি ঝিলিক দেখা যায় ঠোঁটে।
“নিকোলাস।” তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে নামল। দাঁড়ায় জানালার পাশে। না, ও নেই। হতাশ মুখে ঘুরল। হতাশা মুহূর্তে আনন্দে রূপ নেয় সাইড টেবিলের ওপরে রাখা প্যাকেট দেখতে। কাছে গিয়ে প্রথমে প্যাকেটকা শুকলো। সমস্ত হৃদয় বিমোহিত হয়, দেহে কাঁপন ধরে এই সোঁদা মাটির গন্ধে। প্যাকেটটা খুলতে টকটকে লাল রঙের একটা অফ সোল্ডার, সিভলেস ফ্রক বেরিয়ে এলো। ম্যাচিং লাল রুবি পাথরের ইয়ারিং আর জুতোও ছিল। নিকোলাসের চয়েস মুগ্ধ করে ইসাবেলাকে৷ প্রিয়জনের দেওয়া প্রথম উপহার। এত আনন্দ হচ্ছে ইসাবেলার! ফ্রকের ভাঁজ থেকে বেরিয়ে এলো চিঠি,
“প্রিয়তমা,
আমার হৃদয় নিঙড়ানো ভালোবাসা জানাই। বিশেষ কারণে আজ তোমাকে জাগালাম না। কষ্ট নিয়ো না লক্ষীটি, কথা দিচ্ছি কাল সব পুষিয়ে দেবো। দেখা হবে আগামীকাল রাতে। আরেকটি কথা, মা আর নোভা ছাড়া কারো জন্য কিছু কিনিনি আমি৷ এতকাল পরে তোমার জন্য কিছু কিনলাম। তুমি ঠিক বুঝবে না কতটা আনন্দ হচ্ছিল আমার। হয়তো বুঝবে৷ একমাত্র তুমিই তো বোঝো আমায়। তুমি আমার খুব আপন, বেলা। তোমাকে পৃথিবীর সমস্ত খুশি দিতে চাই। এটা তেমনই একটা ক্ষুদ্র চেষ্টা। ড্রেসটা দেখে মনে হয়েছে এটি কেবল তোমার জন্যই তৈরি। আমি একটিবার হলেও এই ড্রেসে তোমায় দেখতে চাই। সাথে তোমার খুশি। উপহার গ্রহণ করে ধন্য করো এই গরিবকে। গরিব? উঁহু! যার তুমি আছো সে গরিব হয় কী করে? তোমাকে পেয়ে নিকোলাস বিত্তেশ হয়েছে। যাইহোক আর কথা বাড়াচ্ছি না। বলে রাখি, যাওয়ার আগে তোমার ঠোঁট চুম্বন করেছি। ওটা আমার হক, হুম? ভালোবাসি বেলা।
ইতি
তোমার নিকোলাস”
চিঠিটাতে চুমু দিয়ে ইসাবেলা বলল,
“ভালোবাসি নিকোলাস।”
ফ্রকটা বুকে জড়িয়ে বিছানায় আবার শুয়ে পড়ে। আগামীকাল রাত আসতে এত দেরি কেন? এই রাত কেন ফুরায় না? কবে ঘুচবে সময়ের এই অপেক্ষা? আর যে বিচ্ছেদ সহ্য হয় না ইসাবেলার।
চলবে,,,