বকুলতলা
৩১.
বকুলফুলের নিজস্ব ঘ্রাণটা মিষ্টি হলেও বড্ড কড়া ধাঁচের। আশপাশে তরতর করে ছড়িয়ে পরে। গাছের ঝাঁকে ঝাঁকে ফোঁটা ফুলগুলো মোহগ্রস্ত করে তুলে মন, প্রাণ। আনন্দের জোয়ার যেন এদিক ওদিক ছোটাছোটি করে সর্বত্র ছড়িয়ে যায়। এই যানজটে বদ্ধ গাড়ির জানালা খুলতেই অতদূর থেকেও বকুলের সুস্পষ্ট ঘ্রাণ পেল প্রণয়। মন মাতানো ঘ্রাণ। সেবার এমনই বকুলের মৌসুম ছিল। ছোট্ট ভাইটা তার এমন দিনেই মা’রা গিয়েছিল। ছেলের মৃ’ত্যুতে দিশেহারা হয়ে আয়েশা খাতুন দোষারোপ করলেন তরীকে। তরীও তখন ছোট। ছাদে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে ঘটনাটা ঘটে গিয়েছিল অপ্রত্যাশিত ভাবে। কেউই দোষী ছিল না। কিন্তু আয়েশা খাতুন সেটা বুঝতেই চাইলেন না। বরং তরীদের সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন। গ্রামে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন।
প্রণয় ছোটবেলা থেকেই প্রচন্ড বুঝদার। বয়সের তুলনায় বেশি বুঝে। হাসে কম, মানুষের সাথে মিশে কম। নিজের মাঝে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। এমন না যে কারো অবহেলায় সে এমন হয়ে গেছে। সবাই তাকে প্রচন্ড স্নেহ করে। আসলে প্রণয়টাই এমন। তার স্বভাবটাই অন্যরকম।
প্রণয়ের যতটুকু মনে পরে, গ্রামে গেলে সে ওই ছোট্ট আলো বাতাসে ঘেরা ঘরটাতেই পরে থাকতো। তরীর সাথে দেখা হয়েছে পাঁচ কি ছয়বার। আর দেখা হলেও প্রত্যেকবার মেয়েটাকে অজ্ঞাত কারণে খুব করে বকেছে প্রণয়। তরীর হয়তো সেটাও মনে সেই। আবদুলের সাথে হয়তো প্রণয়কে ঘুলিয়ে ফেলেছিল বোকা মেয়েটা। আবদুল তো তরীদের ওখানে কখনো যেত না। ও থাকতো নানূ বাড়িতে।
তরীর প্রতি প্রণয় ছোটবেলা থেকেই দূর্বল ছিল। জানালা দিয়ে যখন ছোট্ট মেয়েটাকে বকুলগাছের ডালে বসে পা দুলাতে দেখতো, প্রণয়ের ভালো লাগতো খুব। মেয়েটা প্রতিদিন কোত্থেকে কোত্থেকে যেন পেয়ারা, আম, জাম নিয়ে উঠে বসতো গাছের ডালে। মনের সুখে তার বেসুরো গলায় এমন এমন গান গাইত! ওটা আসলে গানেরই জাতই না। তবে সত্যি বলতে, তরীর প্রতি ওই ভালো লাগাটা ঠুনকো ভালো লাগাই ছিল। তার বয়সই বা তখন কত? ভালোবাসার সে কি বুঝে?
রফিক সাহেব আয়েশা খাতুনের অগোচরেই বোনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। শত হোক একমাত্র বোন তার। বললেই কি সম্পর্ক ছিন্ন করা যায়? তার ফোনেই প্রথম কিশোরী তরীর ছবি দেখেছিল প্রণয়। গ্রাম্য নারীদের মতো ঢালা শাড়ি পরে কোন বিয়েতে যেন গিয়েছে মেয়েটা। মুক্তর মতো চোখ ধাঁধানো হাসি, সাজ। আবেগে বয়সটায় প্রণয় বিশ্রী ভ্রমে পরে গিয়েছিল। জীবনে প্রথমবার বাবার ফোনটা চুরি করে গ্যালারি থেকে তরীর সব ছবি নিয়ে নিয়েছিল নিজের ফোনে। রাতের বেলা একমনে তরীর ছবিগুলো বারবার জুম করে দেখতো। আস্তে আস্তে ভয়া’বহ প্রেমে নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিল না চাইতেও। ভালোবেসে ফেলেছিল ছোটবেলার ওই ছিঁচকাদুনে মেয়েটাকে। যাকে শুধু হাফপ্যান্ট পরা অবস্থায় এককালে মাঠে দৌঁড়াতে দেখেছিল সে!
আয়েশা খাতুন কিভাবে যেন ব্যাপারটা আঁচ করতে পারলেন। ওয়ালেটে তরীর ছবি দেখেই হয়তো। তবে একদম না জানার ভান করে রইলেন। ভেতরে ভেতরে রফিককে দিয়ে প্রণয়কে স্কলারশিপের জন্য পিড়াপিড়ি করতে লাগলেন। স্কলারশিপও হয়ে গেল এর মাঝে। প্রণয় পড়াশোনায় ভালো। না হয়ে যাবে কোথায়?
বিদেশে গিয়ে প্রণয়ের ভালোই দিন কাটতে লাগলো। নতুন শহর, নতুন বন্ধুবান্ধব, নতুন কিছু শিখার উদ্যোগ আর রাতের বেলা তরীর ছবি দেখা। দিনগুলো মন্দ কাটছিল না। প্রণয় মনে মনে আশায় ছিল, দেশে ফিরে বাবা মাকে তরীর কথা জানিয়ে দেবে। মাস ঘুরতেই তরীকে চটজলদি বিয়ে করে ফেলবে। তার আর এই অপেক্ষা কিছুতেই সইছে না।
তারপর একদিন রফিক থেকে জানতে পারলো, তরীর নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে। আগামী সপ্তাহেই বিয়ে। শুনে প্রয়ণ এক মুহুর্তও দেড়ি করেনি। বলে দিয়েছিল তরীকে তার ভালোবাসার কথা। সে তরীকে বিয়ে করতে চায়। রফিকও আশ্বস্ত করলেন, তিনি বিষয়টা দেখবেন। বিদেশে থাকার পুরো সময়টাতে মিথ্যে বলে গেলেন মা, বাবা দুজনেই। দেশে আসার পর তরীর সাথে নাকি তারই বিয়ে দিবেন। একরাশ উত্তেজনা নিয়ে প্রণয়ও পড়ালেখা শেষে দেশে ফিরলো। তরীকে নিজের করে পাবে বলে হাজারটা স্বপ্ন বুনে যত্ন করে আগলে রাখলো। সেই যত্ন করে আগলে রাখা স্বপ্নগুলো তারা কেউই বাস্তব হতে দিলেন না। ভেঙ্গে চূড়মাড় করে দিলেন। জানালেন, তরীর আরও একবছর আগে বিয়ে হয়ে গেছে। তারা নাকি চেষ্টা করেছিলেন। তরী, তরীর মা-বাবাই রাজী হননি।
প্রণয়ের বুকের ব্যথাটা এখনো সেই আগের মতোই তাজা হয়ে উঠে। যখন ভাবে, তার জন্মদাত্রী মা-ই দিনের পর দিন তাকে মিথ্যে বলে গেছে। ধ’র্ষিতা বলে তিনিই কোনো ধরণের চেষ্টা করেননি বিয়ের বিষয়ে। কে চায় একটা ধ’র্ষিতাকে বাড়ির বউ করতে?
জ্যাম ছেড়েছে বহু আগে। বকুলগাছটা পেরিয়ে বহুদূরে ছুঁটে গেছে তাদের গাড়িটা। সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রণয় গাড়ির কাঁচটা আবার উঠিয়ে দিলো। সীটে নিজের মাথা এলিয়ে আস্তে আস্তে বিড়বিড় করলো, “ও আমাকে হয়তো কোনোদিনই বুঝবে না।”
–
হাসপাতালের পরিবেশ একটু খারাপ। ঘু’ষখোর কোম্পানি তাকে ভালো কোনো হাসপাতালে ভর্তি করায় নি। এ নিয়ে একটু বিরক্তই মাহাদ। একটু বেশিই। আপেলে কামড় দিতে দিতে তরীর দিকে আড়চোখে একটু তাকালোও সে। মেয়েটা চোখ মুখ গম্ভীর করে বসে আছে। তার হাঁটুর কাছে। আজকে সকালে রিপোর্ট করতে একটা বস্তিতে যেতে হয়েছিল তাকে। সেখানেই কিভাবে যেন নড়বড়ে একটা ঘর হুট করেই গায়ের ওপর পরে গিয়েছিল। ব্যথা অবশ্য তেমন একটা পেত না সে, যদিনা ঘরের টিনে গাঁথা কাচ, পেরাক, আর টিনের সূক্ষ্ণ কোণা অংশগুলো পায়ে বিঁধে যেত! তার চেয়ে বেশি গুরুতর অবস্থা হয়েছে ক্যামেরা ম্যানের। বেচারার পেটে আস্ত একটা কাচ ঢুকে গেছে। আপাতত ওটিতে আছে সে। হাসপাতালে নেওয়ার পর অফিসের স্যারকে জানানোর পাশাপাশি পরিবারের এক দুজন সদস্যকেও জানানো হয়েছিল। মাহাদের মুখে তো সবসময় তরীই লেগে থাকে। নম্বরের কথা জিজ্ঞেস করতেই তরীর নম্বরটাই সর্বপ্রথম বলে দিয়েছিল সে। তাছাড়া এখানে তো ওর আপন কেউ থাকে না। বজ্জাদ হাসপাতালের কর্মচারীরা বাড়ির লোক না আনা অব্দি নিস্তারও দিচ্ছিল না।
তরী যে কল পাওয়ার পর তক্ষুণি ছুটে এসেছে হাসপাতালে, মাহাদ তা জানে। তরীকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তাড়াহুড়ো করে উলটো জামা পরে এসেছে মেয়েটা। চুল আঁচড়ায় নি। এলোমেলো ভাবে উড়ছে ওগুলো। ফোন পাওয়ার পর কেঁদেছিল হয়তো। চেহারা ভীষণ মলিন হয়ে লাল হয়ে আছে। একটু পর পর নাক টানছে। মাহাদ নিঃশব্দে হাসলো। মেয়েটা তাকে এত গভীর ভাবে ভালোবাসে, অথচ স্বীকার করতে চায় না।
মাহাদ আবারও হাসলো। তা দেখে তরী ভ্রু কুঁচকে শুধালো, “কি হয়েছে? হাসছেন কেন?”
—“তুমি উলটো জামা পরে এসেছো তরী।”
তরী লজ্জা পেয়ে মাথা নুয়ালো। এখানে আসার পরপরই বোকার মতো কাজটা খেয়াল করেছিল সে। মাহাদ ঠোঁটের হাসিটা স্থির রেখেই মোলায়েম স্বরে বললো, “তরী, আমি তো তোমার কাছে আসতে পারবো না। কোমড়ে ব্যথা। তুমিও আমার কাছে আসবে না। একটু কষ্ট করে মুখটা ওড়না দিয়ে মুছো তো। কান্নার দাগ বসে গেছে.. এত কাঁদতে হয়? আমি কি ম’রে গেছি?”
তরীর আবার কান্না পেয়ে গেল। তবে সে কাঁদলো না। একদমই না। ঠিক ঠিক মাহাদের কথা মতোই ওড়না দিয়ে গালটা ঘঁষে মুছলো। আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো, “কিভাবে হয়েছে এসব?”
মাহাদ মিথ্যে বললো, “মা’রামারি করতে গিয়ে হয়েছে।”
—“মিথ্যে বলছেন কেন? মা’রামারি করতে গিয়ে কি ক্যামেরা ম্যানকেও নিয়ে গিয়েছিলেন সাথে?”
—“হ্যাঁ। ক্যামেরাম্যানটাকে নিজের এসিসট্যান্ট হিসেবে রেখেছিলাম। আমার সাথে একটু হাতে হাতে মা’রামা’রি করবে। কিন্তু ব্যাটা কাজের না। নিজে তো ম’রলোই, সাথে আমাকেও মা’রলো।”
তরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ে আছে। চুপচাপ, নিঃশব্দে দেখছে মাহাদকে। লোকটা মিথ্যা বলতে কি পটু! কিভাবে অকপটে একের পর এক মিথ্যা বলে যাচ্ছে। ভেবে আরেক দফা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। ফোনের পাওয়ার বাটনে চাপ দিয়ে সময় দেখে নিলো। দুপুর তিনটা। সে এসেছিল দুটোর দিকে।
—“পায়ে কি বেশি ব্যথা পেয়েছেন? ডাক্তার কি বললো?”
—“ডাক্তারের কথা দিয়ে তুমি কি করবে? আমার কথা শুনো। আমার কোমড় থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত জ্বলে যাচ্ছে। আই নিড প্রপার রেস্ট! আর রেস্টের জন্য সবচেয়ে বড় উপাদান একটা বউ। তাই আমার এখন একটা বউ লাগবে।”
তরী হতাশ কণ্ঠে বললো, “তো বিয়ে করে ফেলুন।”
—“তুমি তো রাজী হচ্ছো না। ভুজুংভাজুং করে যাচ্ছ। শোনো মেয়ে, আমি কিন্তু বুঝে গেছি তুমি আমায় ভালোবাসো। এখন আর নাকচ করে লাভ নেই।”
তরী জবাব দিলো না এবার। বাসা থেকে বলে আসেনি। তার ভয় লাগছে। আয়েশা খাতুন আবার কি না কি শুনিয়ে দেন। আবার অস্বস্তিও হচ্ছে। উলটো জামা পরে হাসপাতালের এই লম্বা কেবিনটায় এভাবে বসে থাকা যায় নাকি? অনেকেই কোণা চোখে তাকে দেখে হাসছে।
মাহাদ আচমকা হাত বাড়িয়ে দিলো। বললো, “আমার হাতটা একটু ধরো তো তরী।”
তরী ধরলো। উচ্চবাক্য করলো না। মাহাদ ঠান্ডা সুরে বললো, “তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
তরী শুধু চোখ তুলে তাকালো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টে। মাহাদই প্রশ্ন করলো, “তুমি কি সত্যিই আমাকে একটুও পছন্দ করো না তরী?”
তরীর কেন যেন আজ আর মিথ্যা বলতে ইচ্ছে করলো না। প্রশ্রয় দিলো নিজেকে। মাহাদের আকুলতায় সিক্ত হলো। পুরুষালী হাতের ভাঁজে নিজের হাতটার দিকে বেশক্ষণ তাকিয়ে ক্ষীণ স্বরে জবাব দিলো, “করি।”
_______________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা