#তনয়া
#পর্ব -১৪
তনুর পাশের সিটে বসে খুব করে দাঁতে দাঁত চেপে রেখে হাসছে মিশকাত।একদম মিচকে শয়তানী হাসি।এই মুহূর্তে খুব জোরে হাসতে ইচ্ছে করলেও সেটাকে কষ্ট করে দমিয়ে রাখতে হচ্ছে।তনুর মুখখানা দেখার মতো হয়েছে।বেচারী না পারছে সহ্য করতে না পারছে কিছু বলতে।মিশকাত যে ওদের সাথে যাবে তা তনুকে মোটেও বুঝতে দেয়া হয়নি।রাফাত শান্তা মারুফের সবটা জানা থাকায় ওরা টিকিট সেভাবেই কেটেছে।শান্তার সাথে মারুফ বসে পরেছে।তনু হাজার বলেও মারুফকে শান্তার পাশ থেকে সরাতে পারেনি।এমনিতেই বাসে উঠে মিশকাতকে দেখে একটা ঝটকা খেয়েছে তার ওপর মিশকাতের পাশের সিটে ওকে বসতে হয়েছে।সব মিলিয়ে করুণ দশা।অন্যদিকে মিশকাত বিজয়ী ভঙ্গিতে বসে আছে। আয়রা ছাড়া সবাই মিটিমিটি হাসছে যা তনু বুঝতে পারলেও আয়রা বুঝতে পারল না।রাফাতের কাছে জানতে চাইলে রাফাত চুপ করিয়ে দিয়েছে। বলেছে সিলেট পৌঁছে সবটা বলবে।তানভীর এসেছিলেন সবাইকে বিদায় দিতে।মিশকাতকে দেখে মোটেও অবাক হন নি।বরং বড় মেয়ে জামাইকে একটু ইশারায় ওদের দিকে খেয়াল রাখতে বলেছেন।সবাই খুব মজার মুডে থাকলেও তনুর সব অসহ্য লাগছে।পাশে বসা মিশকাত নিজের মতোন বসে আছে।তনুর দিকে তাকাচ্ছে না।দুহাত বুকের মাঝে নিয়ে সিটে শরীর এলিয়ে দিয়ে আরামে আছে।তনু চুপ থাকতে না পেরে বলল,
“তোমার না পরিক্ষা?”
“হুম, তো?”
“তুমি তাহলে যাচ্ছো কেন?”
“কেন, পরিক্ষা থাকলে সিলেট যাওয়া যাবে না এটা কোথাও লেখা আছে?”
“নাহ্ লেখা নেই।তবে কেউ যদি যায় তখন ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু হয়!” তনু একটু ঝাঁজের সাথে বলল।
“তোর সমস্যা হচ্ছে নাকি আমায় দেখতে উল্টো লাগছে।মাথার দিকে পা আর পায়ের দিকে মাথা আছে মনে হচ্ছে যে দৃষ্টিকটু লাগবে?”
তনু চুপ করে রইলো।সে কার সাথে কথা বলতেছে তা ভুলেই গেছিলো।এটা তো ছেলে মানুষ নয় যেন আস্ত খাটাসমার্কা ঝগড়ুটে!
গ্রীন লাইন পরিবহনে বসে তনু রাগে লাল নীল সবুজ রং ধরন করছে।ইচ্ছে করছে মিশকাতের মাথার সব চুল গুলে ছিড়তে।প্রায় ছয় সাত ঘন্টা এই অসহ্য মিশকাত ফিসকাত কে সহ্য করতে হবে!এখন বুঝতে পারছে সবাই যেন তার বিরুদ্ধে এক যোগে ষড়যন্ত্র করেছে!মিশকাত চোখ বন্ধ করেও তনুর রাগটা উপভোগ করছে।
তনু রাগটা সামলানোর জন্য জানালার বাইরে মন দিলো।কিছুক্ষণ পর তনু অনুভব করলো মিশকাতের মাথাটা তার ঘাড়ের দিকে ঝুঁকে এসেছে।চট করে ঘুরে তাকাতেই দেখলো মিশকাত ঘুমিয়ে পরেছে।বাসের ঝাঁকুনিতে তনুর দিকে ঝুঁকে এসেছে। তনু একটু ঠেলে দিলো মিশকাতকে কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো মিশকাতকে নড়ানো গেল না।ঠিক আগের মতন ঝুঁকে আছে।তনুর হাসফাস লাগলো।এতকাছে মিশকাতের এর আগে কখনো আসা হয়নি।মিশকাতের নিশ্বাসের শব্দ গুনতে পারছে যেন।তনু কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো মিশকাতের পানে।ঝাঁকড়া চুলের গোল গাল ফর্সা ছেলেরটার মাঝে কি এমন আছে?যে তনুকে ভুলে থাকতে দেয় না, দূরে থাকতে দেয় না।এই ছেলেটাই বা তার মাঝে কি এমন দেখেছে যার জন্য এতসব পাগলামি!
মিশকাত তনুর কাঁধে মাথা এলিয়ে ঘুমোচ্ছে অন্যদিকে তনু ভাবনায় ডুবে আছে।ছেলেরাও যে বাসে এভাবে হাবার মতন ঘুমোয় তা আগে জানা ছিল না তনুর।বুকের ভেতর কি হচ্ছে সেটা ইচ্ছে করেই বুঝতে চাইছে না সে।কি হবে বুঝে?বুঝতে গেলেই তো সব তালগোল পাকিয়ে যায়।যা হচ্ছে হোক না?এই মুহূর্ত গুলো কখনও হয়ত জীবনে আর ফিরে আসবে না।কৈশোরের ভালোলাগা থেকে ধীরে ধীরে ভালোবাসা তৈরী হওয়া,সম্পর্ক শুরুর আগেই ভেঙে যাওয়া,দূরে দূরে থাকা এসব অনেক হয়েছে।কিন্তু আজকের এই আকস্মিক ভাবে এত কাছাকাছি দুজনের থাকাটাও তো অন্যরকম একটা ব্যাপার!সে তো এসব কল্পনাও করেনি।তনু এতদিন ভেবেছিল সে তার মনকে বাঁধতে পেরেছে কিন্ত না সে কখনোই পারেনি!তা না হলে মিশকাতকে দূরে সরিয়ে দিতে পারছে না কেন?সে কথা ভাবতেই বুকের ভেতর জ্বলছে কেন?
“তুমি অনেক আগে থেকেই ওদের ব্যপারটা জানতে তাই না?”
শান্তার প্রশ্নে মারুফ ফোনের স্ক্রীন থেকে দৃষ্টি সরালো।
“হুম সেই শুরু থেকেই।”
“তবে ওদের মাঝে এত ঝামেলা কেন?”
“সব সম্পর্কের ধরণ এক হয় না রে পাগলি!ভালোবাসি মুখে বলেই সব সম্পর্কের সূচনা হয় না।”
“তাহলে ওদের ভবিষ্যৎ কি?”
“সেটা তো সৃষ্টিকর্তা ভালো জানে।মিশকাত প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছে। দেখবি একদিন তনু চাওয়ার থেকেও অনেক বেশি কিছু পাবে।সেদিন ও আর মিশকাতকে ফেরাতে পারবে না!”
“আমার কিন্তু বড় মামিকে নিয়ে ভয় হয়।”
“এখন আর সেই ভয় নেই।মিশকাত সবটা জানে।ও সবটা সামলে নেবে সে বিষয়ে নিশ্চিত থাক।”
“কিভাবে জানে?”
“সে অনেক কথা।আয়রা আপার বিয়ের সময়ই জেনেছিল।”
“ওমা তাই নাকি?তাহলে মিশকাত ভাই যে ওমন হুট করে চলে গিয়েছিল?”
“কি জানিস তো?কখনও কখনও চলে যেতে হয় ফিরে আসার জন্যই।মিশকাতের চলে যাওয়াটা দরকার ছিলো।ও সেদিন চলে গিয়েছে জন্য দেখ সবটা কিন্তু ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে!”
শান্তা একবার পেছন ফিরে তাকালো।তনুর কাঁধে মাথা রেখে মিশকাতকে ঘুমাতে দেখে হেসে ফেলল। মারুফকে ফিসফিসিয়ে বলল,
“মিশকাত ভাই কি সত্যি সত্যি ঘুমোচ্ছে?”
মারুফ হেসে উঠল।বলল,
“তুই বুঝে নে।”
পৌঁছানোর ঠিক বিশ মিনিট আগে মিশকাত উঠল।তনুর কাঁধ শক্ত হয়ে গেছে।প্রচন্ড ব্যাথা হচ্ছে।মিশকাত আড়মোড়া ভেঙে বলল,
“তোর খিদে পেয়েছে খুব? মুখটা ওমন করে রেখেছিস কেন?শোন,তুই সিলেটে এসেছিস এখানে সবকিছুতেই সজীবতা মাঝখান থেকে তুই এমন মরা মরা হয়ে থাকবি না বলে দিলাম!”
তনু হাসবে না কাঁদবে না রাগবে কিছু বুঝে উঠল না তার।গন্তব্য আসায় নেমে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো। রাফাতও ইশারায় ওদের নামতে বলল।তনু ঘাড় ঠিকমতো সোজা করতে পারছে না।মিশকাতকে বসে থাকতে দেখে বলল,
“নামবে না? ”
মিশকাত অলস ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো। তনুর খুব কাছে মুখটা এনে বলল,
“তোর শরীরে বিয়ে বিয়ে গন্ধ! এটার কারণ কিরে?”
তনু স্তব্ধ হয়ে রইলো।মিশকাত হাসতে হাসতে নেমে গেল। সে একটুও ঘুমোয় নি।জেগে থাকলে তনু সহজ হতে পারতো না এমনি কি এই সুন্দর সময়টাও ওদের ঝুলিতে জমা হতো না।তাই ঘুমের ভান ধরেছিল।ইচ্ছে করেই তনুর কাঁধ থেকে মাথা সরায় নি।এত বছরের দূরত্ব সে পইপই করে সবটার হিসেব তুলবে,হু।হোক না কষ্ট তাতে কি? তনু এতদিন ধরে কি তাকে কম কষ্ট দিয়ে এসেছে?
সবাই “রেইনবো গেস্ট হাউজে”উঠেছে।রাফাত দুদিন আগেই তিনটে রুম বুক করে রেখেছে।
সবাই রুমে গিয়েই ধুপধাপ করে শুয়ে পরল।আয়রা সারাটা পথ ঘুমিয়ে এসেছে তাই এখন তার ক্লান্ত লাগছে না।ওয়াশরুমে।ঢুকলো ফ্রেশ হতে।মারুফ আর মিশকাত একরুমে। শান্তা তনু এক রুমে।বিকেলে ওরা বের হবে সিলেট সদরে যে কয়টা চা বাগান আছে তার যেকোনো একটা দেখতে।তনু সবথেকে বেশি উত্তেজিত চা বাগান দেখার জন্য। এর আগে কখনও সিলেট আসা হয়নি।
তনু ব্যাগ থেকে জামাকাপড় বের করছে।শান্তা ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে তনুকে দেখে হেসে বলল,
“তোর কাঁধটা একটু টিপে দেব? ”
তনু শিউরে উঠল।লজ্জায় কথা বলতে পারলো না।দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।ঘন্টাখানেক আরাম করে খেয়ে ওরা বের হলো!” মালনীছড়া চা-বাগানের” উদ্দেশ্যে।গাড়িতে বসে তনু একবারও মিশকাতের দিকে তাকায়নি এমনকি খাবার সময় সবাই গল্পগুজব করলেও সে চুপচাপ ছিল।
চারপাশে উঁচু নিচু টিলা সাথে সবুজের সমারোহ! কারো মুখে কোনো কথা নেই।সবাই প্রকৃতির মাঝে বিভোর। রাফাত মিশকাত মারুফ আগেও সিলেট এসেছিল অথচ মনে হচ্ছে নতুন করে সব দেখছে।সৃষ্টিকর্তার কি অপরূপ সৃষ্টি! মালনীছড়া চা বাগানের প্রবেশ গেট অনেক গুলো।ওরা অনুমতি নিয়ে ভেতরে ঢুকলো।আনন্দে তনুর চোখে পানি চলে এসেছে।এত সবুজের সমারোহ এই প্রথম কাছ থেকে দেখছে!বাকি সবার অবস্থাও একি।এই জন্যই বোধহয় সিলেটকে” দুটি পাতা একটি কুঁড়ির” দেশ বলা হয়!বাংলাদেশের নব্বই শতাংশ চা বাগান এই সিলেটেই অবস্থিত।তনু এতটাই বিভোর ছিল যে মিশকাত কখন এসে তার পাশে দাঁড়িয়েছে।মিশকাত তনুর অনেকটা কাছে এসে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
“আমায় ছাড়া তোর এই প্রকৃতির বুকে হারিয়ে যাওয়া কি উচিত?”
তনু চমকে উঠে পেছন ফিরতে মিশকাতকে দেখল। কিছু বলল না সে তো বলার মতো ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।তবে মিশকাতের চোখের ভাষা খুব করে বুঝলো।সে এতক্ষণ যে মুগ্ধতা নিয়ে সবকিছু দেখছিল ঠিক তেমনই মুগ্ধতা নিয়ে মিশকাত অপলক তাকিয়ে আছে তার দিকে!
আয়রা খুশিতে লাফাচ্ছে প্রায়।রাফাতের শার্ট ধরে ঝুলছে বারবার।রাফাতের বুকের কাছটা কুঁচকে গেছে তবু হাসি মুখে আয়রার পাগলামি গুলো দেখছে।আয়রার যেন খুশি ধরে না।ইচ্ছে করছে রাফাত কে নিয়ে এখানেই সংসার করতে।দুজনে মিলে এই চা বাগানে কাজ করবে!রাফাত বোধহয় সেই ভাব বুঝতে পারলো।হেসে বলল,
“আয়রা এখানেই থেকে যাবে?”
“হ্যাঁ, আমার খুব ইচ্ছে করছে।”
“তাহলে আমার কি হবে?”
“আপনিও তো আমার সাথেই থাকবেন।”
“আমাদের বাবু কোথায় থাকবে?”
আয়রা সবকিছু দেখতে দেখতে উত্তর দিলো
“আমাদের সাথে।”
রাফাত জোরে হেসে উঠল।আয়রা একটু পর বুঝতে পেরে লজ্জায় কুঁকড়ে গেল।মুখ লুকোনোর জায়গা হিসেবে রাফাতের বুকটাই পেল।
চলবে..