#তনয়া
#পর্ব -৬
“মিশকাত ভাই তোমার কি মনে আছে, কয়েকবছর আগে আমি যখন তোমায় একটা চিরকুট লিখেছিলাম তুমি তখন কি রাগটাই নাকি করেছিলে!আজও তোমায় লিখতে বসেছি তবে চিরকুট নয় চিঠিও নয়।আমার জমানো কথা গুলো,যা কখনো তোমার সামনে দাঁড়িয়ে বলার সাহস হবে না আমার।তুমি হয়ত খুব রাগবে।বলবে,তুই এতকথা লিখেছিস কেন তনু?তোর কি মুখ নেই নাকি তোর কথার এত দাম যে মুখ দিয়ে একটা কথা বেরোলেই সেটা সোনায় পরিনত হয়ে যাবে!
বিশ্বাস করো আমি কথা গুলো কখনো বলতে চাই নি।তাইতো নীরবে সরে এসেছি। যে সম্পর্কের শুরুই আমাদের হয়নি সেটার শেষ টেনে দিয়েছি।এইজন্য বোধহয় তুমি তনুকে ঘৃণাও করতে পারো না,ভালোবাসাটাও প্রকাশ করতে পারো না।আমাদের হয়ত সম্পর্কের শুরু হয়নি কিন্তু ভালোবাসা,সে তো অনেক আগে হয়ে গেছে।সেটা এখনো আছে সেটা বলতে পারবো না।কিছু কথা বলতে নেই।মিশকাত ভাই তুমি শুধু শুধু পুরোনো কিছু বিষয় মাথায় গেঁথে রেখেছ।কেন রেখেছ বলোতো?লায়লা আপার বিয়েতে যে অনুভূতি গুলো দুজনের মনে জমাট বেঁধেছিল তা এতদিনে মলিন ধুলো হয়ে উড়ে গেছে।তুমি আমায়” ভালোবাসো “এই কথাটা আমায় বলার জন্যই সেদিন রাতে ডেকেছিলে।কিন্তু আমি আসিনি।এই প্রশ্ন নিশ্চয় তোমায় তাড়া করে বেড়ায়?ভালোলাগা থেকে ভালোবাসার সূত্রপাত ঘটেছিল নিজেদের অজান্তে তা দুজনেই খুব করে বুঝেছিলাম।অসম প্রেমের শুধুটা খুব বড় ঝড় নিয়ে এসেছিল আমার জীবনে।তবে জানোতো প্রেম,ভালোবাসা এ দুটো বিষয় আমার কাছে আলাদা অর্থ বহন করে।আমাদের প্রেমটা হয়নি, এটাই আমার কাছে শান্তির বিষয়।তুমি হয়ত কিছুই বুঝতে পারছো না।সবটাই বলবো তোমায়।তার আগে এতদিনের জমানো কথা গুলো একটু বলে নেই।
ছোট বেলা থেকেই তোমার প্রতি আলাদা একটা ভালোলাগা তৈরী হয়েছিল।সেটা কি ধরনের সেটা বোঝার মতো জ্ঞান তখনো হয়নি।এরপর ধীরে ধীরে সেটা আরও গভীর হয়, যখন আমি বুঝতে পারি তোমার চোখেও আমার জন্য অন্যরকম ভালোলাগা তৈরী হয়েছে।আমি তখন স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে পা দিয়েছি।লায়লা আপার বিয়েতে সবাই মিলে হৈ-হুল্লোড়র করার ফাঁকে আমরা দুজনে কাছাকাছি এসেছিলাম।দুজনে খুব করে অনুভব করেছিলাম দুজন দুজনকে ভালোবাসি।আমি তোমায় চিরকুট লিখে ছিলাম,”
“প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস,
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।”
তুমি সবটা বুঝেও চোখ পাকিয়ে বলেছিলে,তনু আমি তোর কি সর্বনাশ করেছি রে?সেটা আবার তুই ঢং করে আমায় লিখে পাঠাস!সাহস করে মুখে বলতে পারিস না?তাছাড়া এটা কবিগুরুর কবিতার লাইন। মুলত প্রেমের উপাখ্যান।কবি প্রেয়সীর চোখের ভাষা বুঝতে চেয়েছেন।তুই কি চাস বলতো তনু?
আমি তোমার কথায় জোরে হেসে উঠেছিলাম।তুমি কেমন রেগে হনহনিয়ে চলে যেতে গিয়ে দরজায় দাড়াম করে একটা বারি খেয়েছিলে মনে আছে?
লায়লা আপুর হলুদ সন্ধ্যায় তুমি কোথা থেকে যেন, কিছু লাল রঙের কাঁচের চুড়ি এনে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেছ।আমার মন তখন তোমার জন্য উচাটন করা শুরু করে দিয়েছিলে।বিয়ের দিন কানের কাছে ফিসফিসিয়ে এসে বলেছিলে,তনু রাতে একবার ছাঁদে আসবি প্লিজ,তোর সাথে আমার খুব দরকারী কথা আছে।আমি জানতাম মিশকাত ভাই তুমি তোমার অনুভূতি গুলো চেপে রাখতে পারনি।বলতে চেয়েছিলে আমায়।তার একটা বড় কারন,তুমি আমার চোখে তোমার প্রতি সেই একি অনুভূতির সন্ধান পেয়েছিলে!
অথচ সেই রাতে আমার জীবনের মোড় পাল্টে গিয়েছিল।কি হয়েছিল সেটা লিখতে এখনো আমার হাত কাঁপছে মিশকাত ভাই।সেই আঘাত আমি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি।আমি প্রতিনিয়ত জ্বলছি,পুড়ছি সাথে তোমাকেও পোড়াচ্ছি।আমি বুঝতে পারিনি তুমি সেই চারবছর আগের সময়টাতে আঁটকে থাকবে?তাহলে হয়ত কথা গুলো আরও আগে তোমায় জানাতাম।”
“কিরে প্রেমপত্র লিখছিস বুঝি!”
তনু চমকে উঠে খাতা বন্ধ করলো।তাকিয়ে দেখলো,শান্তা ঝুঁকে আছে ওর ওপর।বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“কি আজে বাজে বকছিস?”
“আমি মোটেও আজেবাজে বকছি না।তুই তো কি সুন্দর লিখছিলি। বোধহয় সবকিছু ভুলে চিঠিতেই ডুবেছিলি।তা নাহলে আমার এত ডাক তোর কানে ঢুকলো না কেন? সত্যি করে বলতো আয়রা আপার কোনো দেবর তোর মনে ধরেনি তো?”
“আশ্চর্য তো!আয়রা আপার দেবর আমার অনেক ছোট।আর আমি কোনো চিঠি লিখছিলাম না।”
“গতকাল দুলাভাইয়ের সাথে তো আয়রা আপার দেবর এসেছিল।উনি তো তোর থেকে অনেক বড়।চাকরি করে শুনলাম।কিরে,তোদের দুজনের মাঝে কিছু চলছে নাতো?” শান্তা বাঁকা হেসে বলল।
“আরাফ ভাই তো আপার খালা শ্বাশুড়ির ছেলে।”
“একি কথা দেবর তো।”
“হ্যাঁ,কিন্তু তুই যেমন ভাবছিস সেসব কিছু নয়।”
“ঠিক আছে তোর কথা বিশ্বাস করে নিলাম।তাহলে আমাকে দেখা খাতায় এতক্ষণ ধরে কি লিখছিলি?”
শান্তার কথায় আঁতকে উঠে তনু।সবর্নাশ!এই মেয়ে বলে কি?জীবন থাকতে এই খাতা কাউকে দেখানো যাবে না।এমনিতেই পুরোটা লিখতে পারলো না তার ওপর আবার দেখতে চাইছে?উফ কি করবে এখন সে?
“আমার লেখা তোকে দেখতে হবে না।যা গিয়ে সাজুগুজু শুরু কর।”
“উহু,একদম না।এখন তো দেখতেই হবে।তুই দেখাতে চাইছিস না মানে নিশ্চয়ই প্রেমপত্র! ”
তনুর কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা হলো।সে আরও জোরে খাতাটা আঁকড়ে ধরলো। কেন যে এই ঘরে বসে লিখতে গেল?
“সত্যি বলছি,কোনো প্রেমপত্র নয়।”
“ভালোয় ভালোয় দেখা নইলে সবাই ডেকে আনবো কিন্তু?”
“ওই তুই আমারে হুমকি দেস নাকি?”
“হ, তাই দেই।এখন কথা কম বলে তাড়াতাড়ি দেখা।”
****
তনু বুঝে গেল শান্তা খাতাটা না দেখে পর্যন্ত থামবে না।অথচ সে কিছুতেই লেখাগুলো দেখাবে না।শান্তাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দৌড়ে বের হলো ঘর থেকে।
পার্লারের মেয়ে দুটো বিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবে মাত্র বেজ মেকআপ করেছে কনের মুখে এরই মাঝেই কান্নাকাটি করে অবস্থা খারাপ করে ফেলেছে।এভাবে সময় নষ্ট করলে সাজাবে কখন।এরকম কনে এট আগে দেখেনি তাড়া।সব মেয়েই এইদিনটার জন্য কতশত কল্পনা সাজিয়ে অপেক্ষা করে।বউ সাজার স্বপ্ন প্রতিটি মেয়ের থাকে।অথচ এই মেয়েটার সাজ নিয়ে কোনো ফ্যান্টাসি নেই।শায়লা বেগম ঘরে আসতেই আয়রা কেঁদে ফেলেছে।মেয়ের কান্না দেখে শায়লা বেগম নিজেকে সামলাতে পারেন নি।আয়রাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। সবাই এদের মা মেয়ের কান্ড গালে হাত দিয়ে বসে দেখছে।তনুর ফুফু চাচীরা ধমক দিয়েও থামাতে পারছে না।
একজন তো বলে বসেছে,”এতো যদি কষ্ট হয় তাহলে মেয়ের বিয়ে কেন দিচ্ছো?নিজের কাছে রেখে দিলেই তো পারো।”
তনু বড় মামাকে ডেকে নিয়ে এসেছে।বড় মামাই তার বোনকে সামলাতে পারবে।তনুর ভাবনাই ঠিক হলো। একটু পর শায়লা মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বের হয়ে গেল।সবাই হাফ ছেড়ে বাচলো।
তনু আয়রাকে বলল,
“তুমি কি বলোতো আপা?মাকে এভাবে কাঁদাচ্ছো কেন?মেয়ের বিয়েতে মা একটু মজা করবে,আনন্দ করবে তা না শুধু কাঁদছে, এভাবে কি হয়?”
“কান্না আটকাতে পারছিনা তো” আয়রা ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো।
“আটকাতে না পারলে গিলে ফেলো।”
“কি সব বলিস?কান্না আবার গিলে ফেলে কেমন করে?”
“এটা একটা কৌশল।তোমার পরে শেখাব।এখন চুপচাপ ভালো মেয়ের মতো সাজতে বসো।আজ তোমায় রাজকন্যা সাজানো হবে। দেখবে আয়নায় নিজেকে দেখে সব কান্না ভুলে যাবে।”
“তুই খালি উল্টা পাল্টা কথা বলিস।”
“কোনো কথা নয় আপা।আর একবারও যদি কাঁদো তাহলে আমি রাফাত ভাইকে ফোন করবো।তাকে বলব ভিডিও কল করে বউয়ের কান্না দেখতে।”
“কিহ!”
“হ্যাঁ।”
আয়রা বোকা মেয়ের মতো চুপচাপ সাজতে বসলো।তনু হাসলো,তার আপাটা কতো সরল!
সবকিছু কি সহজে মেনে নেয়।রাফাত ভাইয়ের সাথে সম্পর্কটাও যেন সরলতায় ভরে থাকে।
মিশকাত ব্যস্ত হয়ে পরেছে।মেহমান আসতে শুরু করেছে।সব ছেলেদের আজ অনেক খাটাখাটুনি। মিশকাতের ইচ্ছে করছে তনুর মুখটা একবার দেখতে।গতরাতের পর দেখা হয়নি তনুর সাথে।মনটা কেমন উচাটন করছে।কাজ গুলো ফেলে যেতেও পারছে না।তার নিজের দায়িত্বে থাকা কাজ গুলো দ্রুত সারতে চাইছে।কারণ,বরযাত্রী আসার সময় যেন তনুর আশেপাশে থাকতে পারে!আরাফ ছেলেটাকে আজ শায়েস্তা করার উপায় ভেবে রেখেছে সে।বেশি বাড়াবাড়ি করলে কি ডোজ দিতে হবে তাও ভেবে রেখেছে।
“মিশকাত বাবা একটু শুনে যা।”
মিশকাত মায়ের ডাকে এগিয়ে এলো।বলল,
“ডাকছো কেন?”
“আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। আজ বিয়ে বিদায়ের পর পরই আমরা মা ছেলে বাড়ি যাবো।”
“কি বলছো?শরীর খারাপ কেন? ”
“জানি না।এমনি শরীর টা ভালো লাগছে না।”
মিশকাত এগিয়ে এসে মায়ের কপালে হাত রাখলো। জ্বরও তো আসে নি তাহলে মা হঠাৎ বাড়ি যেতে চাইছে কেন?
“কি হয়েছে সেটা বলবে তো?বেশি খারাপ লাগলে বলো ঔষধ এনে দেই।”
“বাসায় সব ঔষধ আছে।তুই আমায় নিয়ে যাবি বলে রাখলাম।আমার ভালো লাগছে না।তোর বাবাকে বললে তো যাবে না।তাই তোকেই বললাম।”
“কিন্তু মা, বিয়ে বিদায় হতে তো রাত হয়ে যাবে।”
“তা হোক।বেশি রাত হলে বিদায়ের আগেই চলে যাব।তুই না হয় আমায় রেখে পরের দিন আসিস আবার।” কথাটা বলে মিশকাতের দিকে একবার আঁড়চোখে তাকালেন রেহেনা বেগম।ছেলের মনের ভাব বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না।তাই চলে যাওয়াটাই বেশি প্রয়োজন।
“আমি তোর ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছি।”
মিশকাত শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।মাকে আজ অচেনা লাগছে।ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।মা হঠাৎ বিয়ের অনুষ্ঠান ছেড়ে চলে যেতে চাইছে কেন?মিশকাতের বুকের ভেতর যেন কিছু কামড়ে ধরলো।খুব কষ্ট হচ্ছে। সে বুঝতে পারছে প্রকৃতি তাকে আবার তনুর কাছ থেকে আলাদা করছে।
চলবে..