তনয়া #পর্ব -৯

0
406

#তনয়া
#পর্ব -৯

ঘুম ভেঙে মায়ের মুখটা চোখে পরলো তনুর।শায়লা বেগম বসে আছেন তনুর মাথার পাশে।কপালে জলপট্টি দেয়া।তনুকে চোখ মেলে তাকাতে দেখে শায়লা বেগম বললেন,

“কিভাবে এমন জ্বর বাঁধালি?রাতে আমার কাছে আসলি না কেন?”

“খুব সমস্যা হয়নি তো।হঠাৎ জ্বর এসে যাবে বুঝতে পারিনি।আপা ফোন করেছে,মা?”

“হুম করেছে।তোর জ্বরের কথা শুনে অস্থির হয়ে উঠেছে।তুই যেতে পারবি না বুঝতে পেরে বোধহয় খুব মন খারাপ করেছে।”

“কেন যেতে পারবো না?তুমি শুধু শুধু আপার মন খারাপ করিয়ে দিলে।এমনিতেই তো নতুন পরিবেশে গিয়ে আপা খুব নার্ভাস হয়ে আছে!”

“পাগল নাকি তুই,এই শরীর নিয়ে কিভাবে যাবি?বেশি অসুস্থ হলে তখন কে দেখবে?আমি তোকে কিছুতেই যেতে দেব না।আয়রাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলব।”

‘ফুফুরা তো সবাই থাকবে।এখন তো আমার জ্বর কমে গেছে।”

“বেশি বুঝিস না তনু?তোর শরীরে এখনো জ্বর আছে।দূর্বল হয়ে গেছিস।তোর বাবাও বলে দিয়েছে তোর যাওয়া হবে না।”

“আপা খুব কাঁদবে আমায় দেখতে না পেয়ে।যখন দেখবে সবাই আছে কিন্ত তুমিও নেই,আমিও নেই তখন দেখবে সত্যি সত্যি খুব মন খারাপ করবে।তুমি তো জানো আপা কেমন?”

“সেটা জানি জন্যই তোর বাবাকে পাঠাচ্ছি।তোর বাবা গেলে অনেকটা সামলে নিতে পারবে।”

“বাবা যাবে!”

“হুম,তুই যেতে পারবি না জন্যই তোর বাবাকে যেতে বলেছি।তা না হলে তো যেত না।মেয়ের শ্বশুর শ্বাশুড়ি কেউ এখনো আমাদের বাড়িতে আসলো না তার আগে আমরা কিভাবে যাই?তবু আয়রার জন্যই যাওয়া।আমাদের কাউকে দেখতে না পেয়ে মেয়েটা সত্যি সত্যি পাগলামি করবে।তাও তন্ময়কে সাথে দেয়াতে একটু ভরসা ছিল।ওর সময় লাগবে অনেকটা আমাদের ছেড়ে থাকার অভ্যাস গড়ে তুলতে।”

তনু মায়ের কোলে মাথা রাখলো।মায়ের কষ্টটা খুব করে অনুভব করতে পারছে সে।মেয়েরাই বোধহয় মায়ের কষ্ট গুলো বুঝতে পারে!সে নিজে তো মা হতে পারবে না তাই সন্তানের জন্য মায়ের কেমন কষ্ট হয় তা খুব করে বোঝার চেষ্টা করছে।

আয়রাকে সাজানো হচ্ছে।অথচ আয়রা ছটফট করছে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মাকে ফোন করেছিল।তখনই তনুর জ্বরের খবর পেল।সেই থেকে মনটা খারাপ হয়ে আছে ।তনু নিশ্চয়ই আসবে না আজ!এটা ভেবেই অস্থির হয়ে আছে।

রাফাত ঘরে ঢুকে আয়রাকে দেখে হাসলো।সে বেশ বুঝতে পারলো আয়রার কি চাই?

রাফাত তনুকে ফোন করলো।তনুর ফোনটা শান্তার কাছে ছিল।শান্তা ফোন এনে তনুকে দিলো।

“আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া,কেমন আছেন?”

“রাফাত সালামের জবাব দিয়ে বলল,ভালো আছি।কিন্তু তোমার আপা বোধহয় ভালো নেই?তোমাকেও নিয়ে আসা উচিত ছিল।”

তনু হাসলো।গলার স্বর বসে গেছে তাই হাসিটা রাফাত শুনতে পেল না।সে বলল,

“ভাইয়া আপনি ভিডিও কলে আসেন।”

রাফাত বিনাবাক্য ব্যয়ে তনুকে ভিডিও কল করলো।তনু ইশারায় আয়রাকে ফোনটা দিতে বলল।রাফাত আয়রার সামনে ফোনটা রেখে বলল,

“তোমার সাজ বোনকে দেখাও।তা না হলে দেখা যাবে মেকআপ কালো হয়ে গেছে খুব তাড়াতাড়ি।”

আয়রা লজ্জা পেল।রাফাতের দিকে ছলছলে চোখে তাকালো। রাফাত বিনিময়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে চলে গেল নিজের কাজে।আয়রাকে হাসিখুশি রাখার জন্য সে সবসময় চেষ্টা করে যাবে।সে জানে আয়রা নামের মেয়েটা সবাইকে ভালোবাসতে জানে,ভালোবাসায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখতে পারে।রাফাতের তো শুধু ভালোবাসা চাই!মায়ায় ভরপুর মেয়েটার মায়ার সাগরে ডুবে থাকা চাই!

“আপা এত নার্ভাস কেন হচ্ছো?তোমায় বলেছিলাম না তোমার মতোই আরেকজন ভালোমানুষ রাফাত ভাইয়া!তুমি খুব ভাগ্যবতী আপা!তোমার কোমলতা কখনো কঠোরতায় পরিনত হতে দেবে না! ”

“ধুর,কি বলছিস?”

“সত্যি বলছি, তুমি ভেবে দেখতো,ভাইয়া কিভাবে বুঝলো তুমি আমাকে দেখার জন্য ছটফট করছিলে?”

আয়রার ভেতরটা প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল।রাফাত যে অন্যরকম একটা মানুষ তা সে গতরাতেই বুঝতে পেরেছে।একজন নারী তো তখনই পরিপূর্ন যখন সে একজন ভালো জীবনসঙ্গী পায়।সেই জীবনসঙ্গী ধীরে ধীরে আত্মার সঙ্গী হয়ে ওঠে।আয়রার এই প্রথম বাবা,ভাই ছাড়া কোনো পুরুষকে ভালোবাসার হাতেখড়ি হলো রাফাতের মাধ্যমে।জীবন নামক বইয়ে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে।

***

মিশকাত সকাল সকাল বেরিয়ে এসেছে তনুদের বাড়ি থেকে।সে এখন বাসে বসে আছে।সোজা ভার্সিটিতেই যাবে।তনুর কথা সে রেখেছে।অনেক দূরে চলে এসেছে সে তনুর থেকে,অনেকটা দূরে!
বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে।তনুর সাথে কৈশোরের কাটানো সুন্দর স্মৃতি গুলো মানসপটে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। তনুর ঝর্ণার মতো প্রানবন্ত চমৎকার হাসির ফোয়ারা যে খুব অল্পসময়ের মধ্যেই তার মন চুরি করে নিয়েছিল!কি সুন্দর ছিল মুগ্ধ হওয়ার দিন গুলো,প্রেমে পড়ার দিন গুলো!মিশকাতের সামনের সিটে দুটো ছেলে মেয়ে বসেছে।মেয়েটা ছেলেটার ঘাড়ে মাথা রেখেছে।দুজনে হাতে হাত রেখে বসে আছে।মিশকাতের বুকটা চিনচিন করে উঠলো। তারও তো এরকম কতশত স্বপ্ন ছিল তনুকে ঘিরে।

“বাদল দিনে তনুর হাত ধরে সারা শহর হাঁটবে।মেঘের গুড়গুড় শব্দ ভালোবাসাময় শব্দ হয়ে উঠবে।তনুর কাজলদিঘী চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে থাকবে অপলক,খুঁজতে চাইবে ভালোবাসা।হুট করেই তনুকে নিয়ে পাড়ি জমাবে মেঘেদের দেশে।তনুর কাঁধে মাথা রেখে সূর্যদয় দেখবে,পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে তাদের ভালোবাসার চিহ্ন আঁকবে, গল্প রচনা করবে!কখনো বা তনুর প্রতি অভিমানের পাহাড় জমাবে একটু ভালোবাসা কম পরলেই।ঘুমিয়ে থাকা তনুর পা দুটো কোলে নিয়ে আলতায় রাঙিয়ে দেবে।ঘুম ভাঙার পর তনুর যখন আনন্দে চোখে জল আসবে তখন সে খুব যত্ন নিয়ে তা মুছে দেবে।গভীর রাতে হুটহাট ঘুম থেকে জাগিয়ে তনুর কাছে আবদার জুড়ে দেবে বিরিয়ানি খাবার জন্য!তনু যখন ঘুম চোখে তাকে বকবে আর রান্না করবে তখন সে মিটিমিটি হাসবে!শীতের রাতে বারান্দায় বসে গায়ে চাদর জড়িয়ে দুজনে কুয়াশার আড়ালে লুকিয়ে থাকা চাঁদকে খুঁজবে।অবসরে তনুর কোলে মাথা রেখে কল্পনার রাজ্যে ডুবে যাবে।বুড়ো হলে দুজনকে কেমন লাগবে দেখতে সেই ভাবনায় ব্যকুল হবে।তনুর লম্বা ঘন রেশমি চুলগুলো সাদা হবে,মসৃণ ত্বক কুঁচকে যাবে তখন তনুকে কেমন লাগবে সেই কল্পনায় বিভোর হবে।কল্পনা শেষে চমকে উঠে বলবে,বুড়ি তনুকে তো দেখতে অসাধারণ লাগবে!তনু তখন তার বুকে মৃদু কিল বসিয়ে দেবে লজ্জা পেয়ে।”

মিশকাতের চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো অজান্তেই। ছেলেরা কাঁদে না কে বলল?প্রতিটা ছেলেকেই ভালোবাসার কাছে পরাজিত হতে হয়,প্রিয়তমার অবহেলার কাছে অসহায় হতে হয়।ভালোবেসে গুমরে গুমরে মরতে হয়!আচ্ছা, সে কি চেয়েছিল এমন যন্ত্রণাময় ভালোবাসা?

ফোনের শব্দে মিশকাত নিজেকে স্বাভাবিক করলো। ফোনের স্ক্রীনে বাবার নম্বর দেখে রিসিভ করলো।

“তুই পৌঁছে গেছিস, বাবা?”

“নাহ্,একটু পরেই পৌঁছাব। তুমি চিন্তা করো না।আমি হলে পৌঁছে তোমায় ফোন করবো।”

“তোর মা কিন্তু খুব রেগে গেছে। পরে কথা বলিস একটু।এভাবে হুট করে চলে গেলি,পরিক্ষা না থাকলে তোকে মানা করতাম যেতে।”

“কিছু করার নেই বাবা।মাকে বুঝিয়ে বলো।” মিশকাতের গলাটা ধরে এলো।

“তোর গলাটা এমন শোনাচ্ছে কেন রে?”

“কেমন আবার শোনাবে?বাসে আছি তো তাই হয়ত নেটওয়ার্কের সমস্যা হচ্ছে।”

“কোনো সমস্যা হলে আমায় জানাস।” টাকা লাগলে সেটাও বলিস?”

“বাবা, তোমার কাছে যদি কখনো খুব বেশি কিছু চেয়ে বসি যেটা হয়ত তোমার সাধ্যের মধ্যে নেই তাহলে কি সেট জিনিসটা আমায় দেবে?”

মিশকাতের বাবা একটু চুপ করে থেকে বললেন,

“আমার ছেলেকে আমি জানি।সে আমার সাধ্যের বাইরে কিছুই চাইবে না।যদি কখনো চাস তাহলে বুঝে নিবো খুব প্রয়োজনীয় কিছু যা তোর জীবনের সাথে জড়িত!আমি বাবা হয়ে সেই জিনিসটা তোকে দেয়ার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করবো।”

মিশকাত নিজেকে আর স্বাভাবিক রাখতে পারলো না।কোনোরকমে বলল,

“থ্যাংক ইউ বাবা,রাখছি।”

এত কষ্টের মাঝেও মিশকাতের হাসি পেল।মানবমন কত বিচিত্র। সবাই নিজের মতো করে সম্পর্ক গুলোকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়।অথচ সবাই ভুলে যায় প্রতিটি সম্পর্কেরই নিজস্বতা আছে!

সবাই আয়রার বউভাতে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছে। তনু বালিশে ঠেস দিয়ে বসে দেখছে।সকাল থেকেই সে মিশকাতের কথা ভাবছে।গতরাতে কি হয়েছিল ছাঁদে কিছুই মনে নেই।ছাঁদ থেকে একা কি করে ঘরে এসেছে সেটাও জানে না।ঘর ছেড়ে বের হতে ইচ্ছে করছে না।উঠলেও মায়ের বকুনির খেতে হবে।অথচ মনটা ছটফট করছে মিশকাত ভাইকে দেখার জন্য। হঠাৎ খাতাটার কথা মনে হলো তার।বিছানায় ভালোভাবে দেখলো কিন্তু পেল না।তার স্পষ্ট মনে আছে সে গতরাতে তার শোয়ার বালিশের নিয়ে রেখেছিল।তাহলে নেই কেন? শান্তাকে ডেকে বলল,

“আমার খাতাটা তুই নিয়েছিস?”

“নাহ,তোর খাতা তো আমি সকালবেলা টেবিলে দেখেছিলাম।”

তনু দ্রুত বিছানা ছেড়ে টেবিলের কাছে আসলো।হুড়মুড়িয়ে পরতে ধরলে চেয়ারের হাতল ধরে নিজেকে আঁটকালো।শান্তা তাই দেখে রাগী চোখে তাকালো।তনু হেসে বলল,

“মাকে বলিস না প্লিজ!আর উঠবো না বিছানা ছেড়ে।”

“তুই এই খাতাটায় কি পেয়েছিস বলতো?মনে হচ্ছে তোর প্রান ভ্রমরা এই খাতাটা!”

তনু কিছু না বলে শুধু হাসলো।

“তাহলে বোধহয় আমার ধারনাই ঠিক তুই প্রেমপত্র লিখছিস? ”

“ধুর,এসব কথা বলা ছাড়া তুই থাকতেই পারিস না।আচ্ছা শোন,তোরা তো সবাই এক গাড়িতেই যাবি, তাহলে মিশকাত ভাইকে বলিস তো ফিরে এসে যেন আমার সাথে দেখা করে।”

“মিশকাত ভাই তো সকালে চলে গেছে, জানিস না?”

তনুর বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো।নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

“কেন হঠাৎ চলে গেল?”

“শুনলাম পরিক্ষার ডেট দিয়েছে নাকি । তাড়াতাড়ি হলে ফিরতে হবে।তাই তো সকালেই বেরিয়ে গেছে।”

“ওহহ।বড়মামা মামি আছে? ”

“হ্যাঁ আছে।মামি নাকি আয়রা আপার শ্বশুর বাড়ি থেকে সোজা চলে যাবে।এখানে আর আসবে না।ওনার নাকি শরীরটা খারাপ।”

তনুর কেমন যেন খটকা লাগলো।মিশকাত ভাই চলে গেল মামিও থাকতে চাইছে না!নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে।সে এবারও মিশকাত ভাইকে কথা গুলো জানাতে পারলো না!দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো তনু।মিশকাত ভাই কাছে এসে আবার চলে গেল অথচ কিছু বলা হয়ে উঠলো না।এই বিষয়টা গলার কাঁটার মতো বিঁধে থাকবে মনে।নিমিষেই মনটা খারাপ হয়ে গেল।কান্না গুলো গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে! এত কেন কষ্ট হচ্ছে তার?

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here