বকুলতলা ঈশানুর তাসমিয়া মীরা ২.

0
820

বকুলতলা
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

২.
জ্বর না এলেও মাথার সূক্ষ্ণ যন্ত্রণায় কপালে কতগুলো ভাঁজ পরে গেছে তরীর। চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলেছে। তার ঘরটা অন্যান্য ঘর থেকে ছোট, ছিমছাম। মেঝেতে সাদা চকচকে টাইলস। মাথার ওপর বৈদ্যুতিক পাখার ভটভট, খটখট শব্দ যেন আরও জ্বালাচ্ছে। টেবিলের ওপর রাখা স্যুপটা ঠান্ডা হয়ে গেছে প্রায়। ঘরের বড় বড় দুটো জানালা গলিয়ে সন্ধ্যার কমলাটে আকাশ দেখা যাচ্ছে। তরী ফোন কানে রেখে ওদিকেই তাকিয়ে আছে। ওপাশে থাকা মাহাদ অবিরাম এটা সেটা বলে যাচ্ছে। উলটাপালটা কথা। সে একটারও জবাব দিচ্ছে না। চুপচাপ শুনছে শুধু। তরীর এমন উদাসীনতা দেখে সালেহা চিন্তিত সুরে বললো,
—“কি হইছে আপা? তুমি এমনে ফোন কানে দিয়া বইসা আছো ক্যান? জ্বর আসতাছে?”

আকাশ থেকে নজর সরিয়ে সালেহার দিকে একবার তাকালো তরী। উত্তরে শুধু মুচকি হাসলো। ফোনের ওপাশ থেকে তখন মাহাদ ভাঙ্গা অথচ দৃঢ় গলায় বলছিল, “তরীহ্— আমি মারপিট করি বলেই তুমি আমাকে পছন্দ করো না, তাই না? কথা দিচ্ছি, তুমি আমাকে ভালোবাসলে আমি সব গুন্ডামী ছেড়ে দিবো। একদম ভালো ছেলে হয়ে থাকবো। প্রমিজ!”
তরী ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললো,
—“এমন কথা আপনি কতবার দিয়েছে মাহাদ? আদৌ কখনো কথা রেখেছেন?”
—“তুমিও তো আমাকে কখনো ভালোবাসোনি তরী।”
ছোট্ট একটি বাক্য। অথচ এই বাক্যের ভেতরকার গভীরতা, অভিমান, হাহাকার, সব যেন তরীকে নিমিষেই মিইয়ে দিলো। নিজের কাছেই নিজেকে ছোট মনে হতে লাগলো।
তরী অনুভব করছিল, মাহাদের দ্রুত শ্বাস নেওয়া। হাসফাস করা। মাঝে মাঝে জ্বরের ঘোরে ক্ষীণ গুঙিয়ে ওঠা। লোকটা কি বেশি অসুস্থ? ঔষধ খেয়েছে তো? সে প্রকাশ্যে জিজ্ঞেসও করলো,
—“ওষুধ খেয়েছেন?”
মাহাদের বাচ্চাসুলভ উত্তর, “খাওয়ানোর তো কেউ নেই।”
—“ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। রাখছি।”

ওমনি মাহাদ তাড়াতাড়ি বলে উঠলো, “ফোন কাটবে না তরী। আরেকটু কথা বলবো।”
তরী শুনলো। কল কাটলো না। মাহাদই বলতে রইলো, “আমার ভীষণ একা একা লাগছে তরী। বাসায় কেউ নেই। কথা বলারও কেউ নেই। একটা বউও নেই। রুমও অন্ধকার করে রেখেছি। এখন যদি জ্বীন এসে আমাকে মেরে ফেলে, তখন কি হবে তরী? আমি কি আর তোমার সাথে দেখা করতে পারবো না?”

সালেহা কেমন বেহায়ার মতো তাকিয়ে আছে তরীর দিকে। অবিশ্বাস্য চোখে গিলে খাচ্ছে যেন! তরীর অস্বস্তি লাগছে। সালেহার সামনে কথা বলতে জড়তা কাজ করছে খুব। অস্বস্তি নিয়েই বললো, “ফোন রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করুন মাহাদ। জ্বর আপনাকে পুরো কাবু করে ফেলেছে।”
তরীর কথার ধার ধারলো না মাহাদ। করুণ সুরে বললো, “আমার ক্ষুধা লেগেছে তরী। কিছু খাবো।”
—“বাসায় রান্না করা নেই?”
—“আছে তো! এসে নুডলস বানিয়ে ছিলাম। এখন আর খেতে ইচ্ছে করছে না। তিতা তিতা লাগে।”
—“কাজের আন্টি আসেনি আজকে?”
—“বৃষ্টি হয়েছে না? বৃষ্টি হলে তো খালা আসে না।”

এমতাবস্থায় মাহাদের জন্য খুব মায়া হলো তরীর। মাহাদের মা নেই। বাবা যদিও আছে। কিন্তু তিনি গ্রামে থাকেন। একা একা ঢাকা শহরে পড়তে এসে মাহাদও বখে গেছে। সারাদিন মারপিট, এর সাথে- ওর সাথে লেগেই থাকে। বাবার টাকায় ফুটানি করে। বেহিসাব উড়োউড়ি। তরী মাঝে মাঝে ভাবে, সে এ ছেলেটার সাথে জড়ালো কিভাবে?
বুক চিঁড়ে লম্বা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসতেই নিজেকে ধাতস্ত করলো তরী। হালকা কণ্ঠে বললো, “তিতা লাগলেও খেয়ে নিন মাহাদ। রাখছি। আর কথা বলতে পারবো না।”

সালেহা এতক্ষণ কথা বলার সুযোগ খুঁজছিল। তরী কল কাটতেই উৎফুল্লতায় বেদিশা হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “আপা? তুমি পেরেম করো?”
তৎক্ষণাৎ চোখ বড় বড় করে তাকালো তরী। আলতো ধমক দিতে চাইলো, “কিসব জিজ্ঞেস করছো সালেহা? মাথা ঠিক আছে?”
কিন্তু সালেহা নাছোড়বান্দা। সে জেনেই ছাড়বে! তরীর কাছে এগিয়ে এসে ওর হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো, “কও না আপা। তুমি কি পেরেম করো? ভাইজানের নাম কি? আমারে আগে কও নাই ক্যান?”

তরী নিজের হাত ছাড়িয়ে বললো, “এমন কিছু না সালেহা। বেশি ভাবছো তুমি। আমার ফ্রেন্ড হয়। এমনিতে ফোন করেছে।”
সালেহা একটুও বিশ্বাস করলো না কথাটা। মন খারাপ করে মুখটা একটুখানি করে তাকিয়ে রইলো। যেন সে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে তরীর কথায়। তরী তপ্ত নিশ্বাস ফেললো। সালেহার গাল আদুরে ভাবে টেনে বললো, “রাগ করছো কেন সালেহা? তোমার জন্য আমি আসার সময় কিটক্যাট এনেছিলাম। খাবে না?”

কিটক্যাট চকোলেট পনেরো বছরের কিশোরী সালেহার ভীষণ প্রিয়। কিটক্যাটের কথা শুনতেই সে হেসে ফেললো। লাজুক কণ্ঠে বললো, “তুমি অনেক ভালা আপা।”
তরীও হাসলো। ওর মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে বললো, “আমার ব্যাগটা নিয়ে আসো। কিটক্যাট দিচ্ছি।”

_____

তরীর মামী আয়েশা খাতুন এলেন রাত ন’টার সময়। তরী তখন ঘুমিয়েছিল মাত্র। কিন্তু নিচ থেকে আসা প্রবল চেঁচামেঁচিতে আর ঘুমাতে পারলো না। কিছুক্ষণ বিছানার এপাশ-ওপাশ করে উঠে বসলো। তারপর মাথায় কাপড় জড়িয়ে বেড়িয়ে পরলো রুম হতে।
আয়েশা খাতুন প্রায় সবার জন্য শপিং করে এনেছেন। সোফায় গোল হয়ে বসে আছে উনার আত্মীয়-সজন। তরীর বসার জায়গা নেই। সে ধীরে স্থির পায়ে সালেহার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আয়েশা খাতুন গম্ভীর চিত্তে তরীর দিকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললেন, “এটা তোমার, নাও।”

তরীও বাধ্য মেয়ের মতো নিলো। পাশ থেকে সালেহা ফিসফিসালো, “তোমারে কি দিছে আপা? দেহি? আমারে থ্রী-পিস দিসে দুইটা।”
উত্তরে প্যাকেট-টাই সালেহার হাতে ধরিয়ে দিলো তরী। সালেহা প্যাকেট খুলে ভেতরের কামিজ উল্টেপাল্টে দেখলো। এরপর ভীষণ ভাবে মুখ বিকৃত করে নাক ছিঁটকে বললো, “আমি কাজের মাইয়া দেইখা আমারে সুতির জামা দিসে। তুমি তো মেম সাহেবের ভাগনি লাগো, তোমারে এমন জামা দিসে ক্যান? বাকিগো তো ভালাটাই দিসে। এত হিংসা এই মহিলার ভিতরে! আল্লাহ!”
সঙ্গে সঙ্গে চোখ রাঙ্গালো তরী। নিচু গলায় বললো, “তোমার বড় হয় সালেহা! ভাষা ঠিক করো।”
সালেহার এবার তরীর ওপরও রাগ উঠলো। এই মহিলা এত এত কথা শুনায় তরীকে! অথচ তরী প্রতিবাদও করে না। অসহ্য স্বজন প্রীতি! সে অস্পষ্ট ভাবে বিড়বিড়ালো, “বড়-র ক্যাথাপুড়ি!”

প্রণয় নিঃশব্দে তরীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তরী খেয়াল করেনি প্রথমে। কানের কাছে প্রণয়ের ফিসফিসিয়ে বলা গাঢ় প্রশ্ন শুনে চমকে উঠলো। সে বলছে, “তোমাকে অসুস্থ লাগছে। ঔষধ খাওনি?”
তরী একবার হকচকিয়ে তাকায়। এরপর আবার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। মিনমিনিয়ে বলে, “খেয়েছি।”
—“গুড।”
প্রণয়কে দেখে তার চাচাতো বোন বলে উঠলো, “ভাইয়া, এদিকে এসে বসো। ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

বলতে বলতে একটু সরে গিয়ে বসার জায়গা করে দিলো প্রণয়কে। কিন্তু নিজ জায়গা থেকে সরলো না প্রণয়। ঠায় দাঁড়িয়ে একরোখা উত্তর দিলো,
—“এখানে ঠিক আছি আমি। বসবো না।”

_______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here