বকুলতলা ২১.

0
733

বকুলতলা

২১.
আলমারিটা সেগুন কাঠের তৈরি। দু’দারে ভীষণ সুন্দর নকশা করা। তরী একদম শেষের তাক থেকে বড়সড় একটা ব্যাগ বের করলো। কালো রঙের। চেন খুলে একবার ঝেড়ে নিলো ভেতরটা। হালকা ময়লা বের হলো। পরক্ষণেই ব্যাগটা বিছানায় রেখে এক এক করে পরনের জামা বের করতে লাগলো সে। হাতে বেশি সময় নেই। এইতো, ঘড়ির কাটা ন’টায় এসেছে। দশটার আগেই যে বাস ধরতে হবে!
সালেহা বিছানায় চুপচাপ বসেছিল। দেখছিল, তরীর কাজ করা। পা দুলিয়ে দুলিয়ে এবার বললো, “আমারে কিছু কইরতে দাও আপা। খালি খালি বইয়া থাইকতে ভাল্লাগতেছে না।”

তরী বেশ বেছে বেছে জামা নিচ্ছে। কালো আর লাল রঙের তার দুটো একই রকমের থ্রি-পিস আছে। সুতীর। কিছুক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দ করে সে কালোটাই নিলো। মুচকি হেসে বললো, “বিছানার জামাগুলো তাহলে ভাঁজ করে ব্যাগে রাখো। আমার কাজটাও তবে আগাবে।”
সালেহা সেটাই করতে লাগলো। ওর সাহায্যে কাজ অনেকটাই তাড়াতাড়ি হয়েছে। একফাঁকে তরীও ছটপট তৈরি হয়ে নিলো।
রফিক সাহেব বসার ঘরে বসে চা খাচ্ছিলেন। তার আবার সকালে একটু চা না খেলে হয় না। মশলা চা। অফিসে যাওয়ার আগে সর্বদা দশ-বিশ মিনিট সময় ব্যয় করে চা পান করেন তিনি। চায়ের কাপে দু’বার চুমুক দিয়ে খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছিলেন। নত মস্তিষ্কে তরী এসে সামনে দাঁড়াতেই গম্ভীর স্বরে বললেন, “কিছু বলবে?”
—“জি মামা। আসলে.. আব্বা ফোন করেছিলেন সকালে। তিতির অসুস্থ খুব। আমাকে দেখতে চাচ্ছিল। তাই গ্রামে যাবো ভাবছিলাম।”
—“কখন যাবে?”
—“আজকেই। সকাল দশটার বাস ধরবো।”
রফিক চায়ে আবারো চুমুক দিলেন, “টিকেট কেটেছ?”
—“না মামা। ওখানে গিয়েই টিকেট কাটবো।”
—“আচ্ছা। আমি প্রণয়কে বলছি। তোমাকে দিয়ে আসবে।”

তরী যেন চমকালো। ওই লোকটার সাথে যেতে হবে? জোড় গলায় দিরুক্তি করলো, “তার প্রয়োজন নেই মামা। আমি একাই যেতে পারবো।”
রফিক তাকালেন। তীক্ষ্ণ চোখে। ভীষণ গাম্ভীর্য নিয়ে। থমথমে গলায় আদেশ করলেন, “প্রণয়ই নিয়ে যাবে তোমাকে।”
তরী প্রতিবাদ করার সময় পেল না। রফিক চা শেষ করে তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালেন। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে হাঁক ছাড়লেন, “প্রণয়? এদিকে আসো।”

ঢাকা শহরে গরম পরেছে খুব। আবহাওয়াও আজ বড্ড বাজে। মেয়েটা চলে যাবে দেখেই কি এত বাজে লাগছে? এসির ঠান্ডা স্পর্শেও অতটা স্বস্তি পাওয়া যাচ্ছে না। বরং এক অসহ্য দহনে ভেতরটা পুরছে। ড্রাইভিং করতে করতে প্রণয় আড়চোখে একবার পাশের মেয়েটার দিকে তাকালো। সে একমনে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। হালকা বাতাসের দমকে মাথার ঘোমটা ক্ষীণ উড়োউড়ি করছে। কি বিষণ্ণ মুখটা!
প্রণয় বেশক্ষণ চুপ থাকলো। পাশের রাস্তায় গাড়ি ঘুরিয়ে আস্তে করে শুধালো, “চলে যাচ্ছেন কেন তরী?”
তরী তাকালো না। চমকালো না। নির্জীব ভাবে বসেই রইলো। ভীষণ নির্লিপ্ত স্বরে উত্তর দিলো, “এমনি।”
—“আসবেন কখন?”
—“জানি না।”

প্রণয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে এসিটা বন্ধ করে দিলো। গায়ে কাঁটার মতো বিঁধছে এই শীতল পরশ। মেয়েটা যাওয়ার বেলায়ও ওর সাথে ভালো করে কথা বললো না। একটুখানি ভালো করে তাকালো না। বুকটা বুঝি এজন্যই ভারী লাগছে? তরীকে তো সে অনেকদিন দেখতে পাবে না।
আস্তে আস্তে গাড়ির গতি কমে গেল। পথটা প্রচন্ড ছোট মনে হচ্ছে। অথচ প্রণয় চাইছে দীর্ঘ করতে। অনেক, অনেক, অনেক দীর্ঘ। কোনো এক নির্জন স্থানে গাড়ি থামিয়ে তরীর সুশ্রী মুখপানে তাকিয়ে থাকতে। বলতে, “তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না, তরী।”

সময়টা দীর্ঘ হলো না। আস্তে আস্তে গাড়ি চালালেও দশমিনিটের ভেতর বাস স্টেশনে পৌঁছে গেল ওরা। বাস স্টেশন খালি নেই। ভীষণ ভীড় আর কোলাহলেপূর্ণ। সেদিকে একবার কপাল কুঁচকে তাকিয়ে প্রণয় বললো, “আপনি এখানে দাঁড়ান তরী। আমি টিকেট কেটে আনছি।”
—“দরকার নেই। আমি পারবো। আপনি চলে যান।”
—“আপনি অনেক বেশি অবাধ্য তরী।” বিরক্তমাখা গলায় কথাটা ছুঁড়ে দিয়েই প্রণয় এগোলো টিকেট কাউন্টারের দিকে। ভিড় ঠেলে টিকেট কেটে আনলো। তরীকে বাসে উঠালো। যাওয়ার মুহুর্তে দোকান থেকে চিপস, সফট্ ড্রিংকসও আনলো কতগুলো। তরী নিতে না চাইলেও জোড় করে ধরিয়ে দিলো। প্রণয়কে দেখে মনে হচ্ছে, আকাশের মানুষ হুট করেই মাটিতে মুখ থুবড়ে পরেছে। এসি ছাড়া যে ছেলেটা চলতে পারে না, সে এখন রোদে পুড়ে হলেও দাঁড়িয়ে আছে। কপাল বেয়ে টপটপ করে ঘাম ঝরছে। শার্টের হাতায় কপালটা মুছলো সে। ঘষে ঘষে, যত্নহীন ভাবে। ঠান্ডায় বসে যাওয়া স্বরে বললো, “বাস ছেড়ে দিবে এক্ষুণি তরী। আর কিছু কি লাগবে? নিয়ে আসবো?”

জানালা দিয়ে মুখ বের করে প্রণয়কে উঁকি দিয়ে দেখলো তরী। জবাব দিলো, “আপনি চলে যান। লাগবে না কিছু।”
—“বাসটা ছাড়ুক। তারপর যাবো।”
এরপর সামান্য থেমে বললো, “গ্রামে গিয়ে কল করবেন তরী। আমাকে না করলেও বাবাকে করবেন। ঠিকাছে?”

তরী হ্যাঁ, না কিছুই বললো না। বাস ছেড়ে দিলো একটু পরই। প্রণয় যেন উদ্বীগ্ন হয়ে উঠলো মুহুর্তেই। মনে মনে বলতেই রইলো, “তরী থাকুক। না যাক।”
কিন্তু তা তো হবার নয়। সে তো চলে গেছে।

ফ্যানের বাতাস গায়ে লাগছে না। বাহিরের সতেজ বাতাসটাও জানালা গলিয়ে ঘরে ঢুকতে পারছে না। মাহাদ জানালা খুললো। ফোনের ডায়াল লিস্টে গিয়ে আবারও কল লাগালো তরীকে। মেয়েটা আজকে ভার্সিটি যায়নি। মেলার চাকরিটাও তো কালকে শেষ হয়ে গেছে। সে সকাল থেকে ভার্সিটির গেটে তরীর জন্য অপেক্ষা করেছে। তরী আসেনি। এখন কল দিচ্ছে, সেটাও ধরছে না। ভেতরটা ভীষণ রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো মাহাদের। কোথাও আবার সুপ্ত অভিমানে মিইয়ে গেল মন। কলটা বাজতে বাজতে কেটে গেলে মাহাদ আবার কল লাগালো। একবার, দুইবার, তিনবার। চিন্তায় অস্থির হয়ে পায়চারি করলো ঘরে। মন মানলো না। শান্ত সে হঠাৎই অশান্ত হয়ে গেল। সিগারেট ধরালো। ধোঁয়া উঁড়ালো। পকেট থেকে ফোন বের করে আবারও কল লাগালো তরীকে। আকাশ যেন তখনো তাচ্ছিল্য করছে। খুব বিশ্রীভাবে। বিশাল গগনটা শূণ্যে ঠেলে মাহাদ তখন নিঃশব্দে অভিযোগ জানালো, “তুমি আমাকে কখনোই গুরুত্ব দিলে না নৌকা।”

________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
পর্বটা ভালো হয়নি হয়তো। দুঃখীত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here