বকুলতলা
২৫.
ব্যাগগুলো বেঞ্চের একপাশে সাবধানে রাখা। বেঞ্চটা ছোট। তবুও যথাসম্ভব মাহাদ থেকে দূরত্ব রেখে বসেছে তরী। বারবার কোণা চোখে লোকটাকে দেখছে। মাহাদ খেয়াল করেছে ব্যাপারটা৷ কিন্তু কিছু বলেনি। শুরু থেকেই মুখটা কেমন গম্ভীর করে রেখেছে। কপালে শত শত বলিরেখার ভাঁজ। কথাও বলছে না। তরীর মন খারাপ হলো ভীষণ। নাহ্, মাহাদের অভিমান দেখে নয়। কিংবা তার মাহাদকে না বলে যাওয়ার জন্যও নয়। সে মনে মনে অপ্রাণ চাইছিল, লোকটা যেন এবার একটু শুধরাক। ক্ষণিকের বিচ্ছেদের বেদনা কাটিয়ে মরিচিকার পিছু ছেড়ে দিক। কিন্তু কই? লোকটাকে যেমন দেখেছিল, তেমনই আছে। বরং আরেকটু বেপরোয়া হয়ে গেছে বোধহয়। তরীর প্রতি নীরব অধিকারবোধটা আরেকটু বাড়িয়ে দিয়েছে।
তরী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সুদীর্ঘ, চরম যন্ত্রণাময় লম্বা নিশ্বাস! ধীর গলায় শুধালো, “আপনি আমাকে ছেড়ে দিচ্ছেন না কেন মাহাদ?”
—“তোমাকে ছেড়ে দেওয়া যায়?”
মাহাদ বলতে বলতে তাকালো। গম্ভীর দৃষ্টি, গম্ভীর কণ্ঠ। চাহনিটাও ঠিকঠাক নেই। কোমলতার ছিঁটেফোঁটাও নেই। আবার বললো, “তুমি নিষ্ঠুর তরী। পাথর। সেই পাথরটা ঠিক কতবার আমাকে আঘাত করেছে জানো?”
—“আপনার উচিত আমাকে ছেড়ে দেওয়া। শুধু শুধু সময় নষ্ট করছেন। অধৈর্য লাগে না?”
তরীর নির্লিপ্ত প্রশ্ন। মাহাদ সুদূর মাঠের মধ্যিখানে তাকিয়ে রইলো। জবাব দিতে সময় লাগালো খুব। দুটো হাফ প্যান্ট পরা ছেলে একটা ছাগলের ছানা নিয়ে খেলছে। ছেলে দুটোর মধ্যে ছোট ছেলেটা ছাগলটাকে ভয় পাচ্ছে। কাছে আসলেই ছিঁটকে সরে যাচ্ছে বারবার। যা দেখে বড় ছেলেটা মজা পেয়ে ইচ্ছে করে ছাগল ছানাকে ওর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মাহাদ পুরো বিষয়টা দেখলো নিঃশব্দে। আবিষ্কার করলো, আমরা যেটা থেকে নিজের পিছু ছাড়াতে চাই, ঠিক সেটাই আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতোপ্রোতো ভাবে মিশে যায়। ব্যাপারটা হাস্যকর। অল্পখানি হাসলোও মাহাদ। আনমনা হয়ে উত্তর দিলো, “আমি তোমার প্রতি বিরক্ত হতে চাই তরী। অধৈর্য হতে চাই। কিন্তু তোমাকে পাওয়ার আশাও ছাড়তে পারছি না। এই আশা আমাকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। তুমি বরং বলতে পারো, তোমাকে পেয়ে আমি অশান্ত।”
তরী চুপচাপ শুনলো। ভাঙ্গাচোরা রাস্তার গর্তগুলোতে কি যেন খুঁজলো। পেল না। হতাশ হলো। মায়ের মুখটা একবার মনে করার চেষ্টা করে বললো, “আপনি যদি কখনো জানতে পারেন, আমি ধ’র্ষি’তা। তবে কি আমার সাথে আর কথা বলবেন?”
বলেই মাহাদের দিকে তাকালো তরী। লোকটার অভিব্যক্তি দেখতে। ভেবেছিল সে চমকাবে, ভড়কে যাবে। এরপর ঘৃণ্য দৃষ্টি ফেলে চলে যাবে তরীকে ছেড়ে। অথচ তেমন কিছুই হলো না। মাহাদকে একদম স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। দৃষ্টি আগের মতোই ছেলেগুলোর ওপর। খানিক্ষণ বাদে বললো, “আমি ধারণা করেছিলাম এমন কিছু।”
—“বুঝিনি। কি ধারণা করেছিলেন?”
মাহাদ সেকথার উত্তর দিলো না। পালটা প্রশ্ন ছুঁড়লো, “তোমার গলার দাগ তাহলে কিসের? অর্ণবের দেওয়া? নাকি ওই জানো’য়ারের?”
তরী এতটা আশা করেনি। একদম করেনি। বিমূঢ়তায় বাকহারা হয়ে গেছে। চোখের বড়োসড়ো দৃষ্টি মাহাদের ওপরই স্থির। কিছু বলতে নেওয়ার আগেই মাহাদই আবার অনুমতি চাইলো, “সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে তরী। আমার কাছে নেই। তুমি এখানে বসো। আমি সামনের দোকান থেকে নিয়ে আসছি।”
তরী একদমই যেতে দিলো না। শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো, “আপনি এত কিছু জানেন কিভাবে? আমি তো কাউকে বলিনি।”
—“তুমি জানতে চেয়েছিলে না? বকুলফুল কুড়াতে আমি তোমাকে কোথায় দেখেছি? তোমার বাড়িতেই। আমি তোমাদের পাশের গ্রামে থাকি।”
কথাগুলো বড্ড কঠিন লাগছে। যে মাহাদ থেকে সে এতদিন তার অতীত লুকাচ্ছিল, সেই কিনা আগে থেকে সবটা জানে। ব্যাপারগুলো হজম করতে বেগ পেতে হলো তার। রুদ্ধশ্বাসে বললো, “আমাকে কবে থেকে চেনেন আপনি?”
—“বেশি না। তিন বছর হবে।”
—“আপনি জানতেন আমার আগে বিয়ে হয়েছিল? আমাকে ধ’র্ষ’ণ করা হয়েছিল?”
—“হ্যাঁ।”
—“তাহলে না চেনার অভিনয় করেছেন কেন এতদিন?”
—“আমি কোনো অভিনয় করিনি তরী। প্রথম দিন তোমাকে চিনি বলেই আগ বাড়িয়ে কথা বলেছিলাম। কিন্তু তখন শুধু তোমাকে ভালো লাগতো। তোমাকে জানার আগ্রহ ছিল না। তাছাড়া আমি তোমার ব্যাপারে যা শুনেছি, সব ভাসা ভাসা। সিওর ছিলাম না। তুমি কষ্ট পাবে বলে কখনো জিজ্ঞেসও করিনি।”
নিচের ঠোঁটটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরলো তরী। অজানা কারণে খুব কান্না পাচ্ছে। একমুহুর্তের জন্য ছিঁচকাঁদুনে হয়ে চোখের জলে ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে সব। কিন্তু সে ব্যর্থ। এমনটা করার সাধ্য নেই।
—“এখন তো জেনে গেছেন আমি ধ’র্ষি’তা, ডিভোর্সি। ছেড়ে দিচ্ছেন না কেন? আমার অসহ্য লাগছে আপনাকে। সবাইকে অসহ্য লাগছে আমার। আমি– আমি মরছি না কেন?”
মাহাদ চুপচাপ তরীর উত্তেজনা দেখলো। ঠান্ডা গলায় আস্তে আস্তে শুধালো, “আমাকে বিয়ে করবে তরী?”
তরীর আগের মতোই জবাব, “না।”
—“চলো, পালিয়ে বিয়ে করি।”
তরী কটমট চোখে তাকালো,
—“বলেছি তো করবো না! বারবার একই কথা বলছেন কেন?”
—“তুমি আমাকে ভালো না বাসলেও তোমার মনে আমার জন্য একটু হলেও ভালো লাগা আছে। কথাটা কি অস্বীকার করতে পারবে?”
—“আমার আপনাকে কোনো ভালো টালো লাগে না। কল্পনার জগত থেকে বেরিয়ে আসুন।”
মাহাদ বেহায়ার মতো আরেকদফা হাসলো, “তুমি এত মিথ্যুক তরী!”
অথচ তরীর মুখ শক্ত। হ্যাঁ সে মাহাদকে পছন্দ করে। অর্ণবকেও তো তার ভালো লাগতো। পছন্দ করতো একসময়। সেই পছন্দ কই? নেই। ঘৃণা ছাড়া পছন্দের জায়গা কোথাও নেই। তরী মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, মাহাদ অর্ণবের মতো হবে না। কিন্তু পুরোপুরি বিশ্বাসটা আসে না। আসবেও না হয়তো কখনো।
–
গায়ের সাদা এপ্রোনটায় কিভাবে যেন কফির দাগ লেগে গেছে। বিশ্রী ভাবে দাগটা জ্বলজ্বল করছে সাদা কাপড়ে। শরীর থেকে এপ্রোনটা খুলে ফেললো প্রণয়। এলোমেলো ভাবে ভাঁজ করে চেয়ারে রেখে দিলো। বিরক্ত লাগছে খুব। মাথা প্রচন্ড ব্যথা করছে। কপালের বাম পাশটা টনটন করতে করতে অবশ হয়ে গেছে। যা গরম আজকে! তার আবার মাইগ্রেন আছে তো! গরম একেবারেই সহ্য হয় না।
রিমোট নিয়ে এসির পাওয়ারটা কমালো প্রণয়। বেশি ব্যথা থাকায় একটা ঔষধও খেয়ে নিলো। ডিউটি এখনো শেষ হয়নি তার। সবে দুপুর বাজলো। রাতের আগে তো ছুটিও মিলবে না। শার্টের প্রথম কয়েকটা বোতাম খুলে প্রণয় তপ্ত নিশ্বাস ফেললো। চোখ বুজলো ধীরে ধীরে। কিচ্ছু করতে ইচ্ছে করছে না এখন। একটু ঘুম প্রয়োজন। কিছুক্ষণের জন্য। কিন্তু তা কি ওর নসিবে আছে? মিনিট গড়াতে না গড়াতেই ওটির জন্য ডাকতে চলে এলো একজন পুরুষ নার্স।
তখন রাত দশটা বেজে গেছে। হাসপাতাল থেকে মাত্র বেরিয়েছে প্রণয়। আজকে আর গাড়ি করে যাবে না। ড্রাইভ করতে ইচ্ছে করছে না। হাসপাতালের সামনে দাঁড়ানো একটা রিকশা ডাকলো সে। রিকশাচালক প্যান্ডেল ঘুরিয়ে তৎক্ষণাৎ সামনে হাজির হলো। জিজ্ঞেস করলো, “কই যাইবেন?”
উত্তর দিতে গিয়ে ভ্যাবাচেকা খেল প্রণয়। আশ্চর্য ব্যাপার! নিজের বাড়ির ঠিকানা মনে আসছে না ওর। অবশ্য না আসাটাই স্বাভাবিক। অনেক বছর হয়ে গেছে। সেই কলেজ জীবনে রিকশায় ঘুরাঘুরি হতো। এরপর তো বিদেশে পড়তে গেল। ওখানে রিকশা নেই। দেশে এসে বাবা গাড়ি কিনে দিলেন চলাফেরার জন্য। তবে একদম যে মনে নেই, তা কিন্তু নয়। মাথায় ক্ষীণ জোড় প্রয়োগ করতেই ঠোঁটে চলে এলো ঠিকানাটা। দরদার ছাড়াই রিকশায় উঠে বসলো প্রণয়।
রিকশা চলছে। রিকশার গতির তালে তালে বাতাসের ঝাপটা ছুঁয়ে দিচ্ছে প্রণয়কে। এ যেন এসির থেকেও ঠান্ডা, শীতল পরশ। শান্তি লাগছে খুব। ঘুম চলে আসছে। প্রণয় কিন্তু নির্জনতা খুব একটা পছন্দ করে না। সারাজীবন একা একা থেকেছে বলেই হয়তো। কিন্তু এই নির্জন রাস্তাটা খুব করে টানছে তাকে। যেন বলছে, “এসো হে, এখানে শান্তি বেঁচা হয়। তুমি কি কিনবে একটু করে?”
রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটাতে গিয়ে প্রণয় আবারও থমকালো। ভুলেভালে পুরোনো ওয়ালেট-টা নিয়ে এসেছে সে। খুলতেই বামপাশের কিছু অব্যবহৃত কার্ডের মাঝখানে তরীর একটা পুরোনো ছবি দৃষ্টিগোচর হয়ে গেছে প্রথমেই। তরীর ছোটবেলার ছবি। তখন বোধহয় মেয়েটা আট বছরের একটা পিচ্চি। প্রণয়ের বয়সও খুব কম। সবে কিশোরে পা দিয়েছে। আলী নামের একটা ছেলে ছিল ওই গ্রামে। মারাত্বক ছবি তুলতে পারে। সেদিন প্রণয় তরীকে কি জন্য যেন বকেছিল। কাঁদতে কাঁদতে মুখটা পানি পানি করে ফেলেছিল মেয়েটা। আলী তখন চুপিচুপি ছবিটা তুলেছিল। প্রণয় জানতো না। পরবর্তীতে পূর্ণযুবক বয়সে পারিবারিক এলবামে এই ছবিটা খুঁজে পেতেই কেটেকুটে ওয়ালেটে ঢুকিয়ে রেখেছিল সেই অনেক আগে। এখন আর ওয়ালেট-টা ব্যবহার করা হয়না।
প্রণয় দারোয়ানকে ডেকে বললো, “তোমার কাছে পঞ্চান্ন টাকা হবে চাচা? আমি পরে এসে দিয়ে যাবো।”
________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা