বকুলতলা ২৬.

0
553

বকুলতলা

২৬.
ওইতো, ড্রেসিংটেবিলের উপরে সযত্নে দুটো ওয়ালেট পরে আছে। দুটোর মাঝে একটা প্রণয়ের বাবা কিনেদিয়েছিল। আরেকটা প্রণয় নিজে কিনেছিল। কিন্তু হিসাব মতে প্রণয়ের তিনটে ওয়ালেট। তৃতীয়টা ওর হাতে। প্রথমটা যখন ছিঁড়ে গিয়েছিল, বাবা তখন এই ওয়ালেটটা কিনে দিয়েছিলেন প্রণয়কে। প্রণয়ের খুব প্রিয় ওয়ালেট ছিল এটা। কালো রঙের। ক্রেডিট কার্ড রাখার জন্য অনেকগুলো খাপ। খাপগুলোর মাঝখানে তরীর ছোট্টকালের ছবি গুঁজে রাখা। শোয়ার সময় ওয়ালেটটা সাথে নিয়ে ঘুমাতো প্রণয়। এক মুহুর্তের জন্য হাত ছাড়া করতো না। কাউকে ধরতে দিতো না। কি যে বাচ্চামো করতো! কিন্তু এখন আর সেই বাচ্চামো নেই। অবহেলায়, অনাদিত ভাবে ড্রেসিংটেবিলে পরে থাকে ওয়ালেট-টা। প্রণয়ের খবর থাকে না। ছুঁয়েও দেখেনা কতদিন! তবে মাঝে মাঝে নিকষ আঁধারে চুপচাপ বসে ওয়ালেটটার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে ভাবে, ওয়ালেট খুলে একবার তরীর ছবিটা দেখবে। কিন্তু হয়ে ওঠে না। দূরত্বটা তরীর বিয়ের দিন থেকেই শুরু হয়েছিল। অনুভূতিগুলোকে চেপে রাখতে শিখেছিল সেখান থেকেই। এরপর আর কিছু ঠিক হয়নি। কোনোদিন হবে কি-না প্রণয়ের জানা নেই।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতের ওয়ালেটটা ড্রেসিংটেবিলে রাখলো প্রণয়। ক্লান্ত লাগছে। বিশ্রী ভাবে ঘেমে আছে শরীর। ভীষণ ভাবে গোসল প্রয়োজন।

তরী যে গ্রাম থেকে চলে এসেছে, প্রণয় জানতো না। নিচে এসে সালেহার সঙ্গে তরীকেও টেবিলে খাবার গোছাতে দেখে খানিকটা থমকালো সে। নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো কিছু সেকেন্ড। গ্রামের নিজস্ব আবহাওয়ায় মেয়েটা একটু ফর্সা হয়েছে কি? হয়েছে বোধহয়। চেহারাটা জ্বলজ্বল করছে। তরীর পাশ ডিঙ্গিয়ে চেয়ারে বসতে বসতে প্রণয় আস্তে করে শুধালো, “কখন এসেছেন?”

তরী প্রণয়ের দিকে তাকালো না। ভাতের বাটিটা হাতের কাছে এগিয়ে দিলো শুধু। প্রণয় আবার বললো, “কিছু জিজ্ঞেস করেছি তরী। উত্তর দিচ্ছেন না কেন?”
—“দুপুরে এসেছি।”
—“বাসে করে?”
—“হ্যাঁ।”
প্লেটে দু’চামচ ভাত বাড়লো প্রণয়। তরকারির বাটি থেকে অল্প সবজি নিলো। খেতে খেতে আচমকা হেসে বললো, “আপনি অনেক বড় হয়ে গেছেন তরী। আগের আর ছোট্ট তরী নন।”
—“আপনিও বদলে গেছেন ভাইয়া। আগে কথায় কথায় অতীত টেনে আনতেন না।”

কথাটা মোটেও সহজ না। খুব কঠিন, তিক্ত, পীড়াদায়ক। প্রণয় শুনলো চুপচাপ। পেটের ক্ষুধাটা মিইয়ে গেল। বুকের ভেতর কোথাও সূক্ষ্ণ ব্যথারা চিনচিন করছে। নিঃশব্দে তপ্ত নিশ্বাস ফেলে সে বললো, “আমি অর্ণবকে ভুলতে পারি না তরী। কেন যেন আপনাকেও ভুলতে দিতে চাইতাম না।”
তরীর ঘৃণা হলো খুব। সেই সাথে কপাল কুঁচকে গেল দৃঢ় প্রশ্নে। জিজ্ঞেস করলো, “অর্ণবের সাথে আপনার কি? ওকে কেন আপনি ভুলতে পারবেন না?”

প্রণয় চোখ তুলে তাকালো। তৃষ্ণার্ত চোখজোড়া প্রখর ভাবে ঘুরতে লাগলো তরীর মুখের আশেপাশে। মেয়েটা চোয়াল শক্ত করে আছে। দৃষ্টি কি দারুণ কঠিন! শুধু প্রণয়ের বেলাতেই এই কাঠিন্যতা। ঠোঁট হালকা কাঁপছে। তরী কি রেগে গেছে খুব? প্রণয়কে বকছে? মনে মনে গালিটালি কিছু দিচ্ছে নাকি? দিতেও তো পারে। সে তো প্রণয়কে দেখতেই পারে না। মারাত্বক হতাশ হয়ে প্রণয় কেমন অন্যমনস্ক হলো, “তরী? আমি আপনাকে ভালোবাসি। সেই ছোট থেকে।”

সাথে সাথে একটা ছোট্ট আওয়াজ হলো। সালেহা ‘আপা’ বলে ডাকলো যেন। খুব ক্ষীণ শব্দে। সে যে এতক্ষণ তাদের সামনে দাঁড়িয়ে চুপচাপ কথা গিলছিল, কেউ খেয়াল করেনি। তরী নজর তুলে তাকালো একবার। মেয়েটার ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে থাকা অস্বস্তিতে ফেলছে। প্রণয়ের একটু আগের কথাটাও ভেতরটাকে চমকে দিচ্ছে। এমন মজা করার মানে কি?

—“মাথা ঠিক আছে আপনার? কি আবলতাবল বকছেন?”
প্রণয় আরেকদফা হতাশ হলো। নির্বিকার মন বিরক্ত হলো। মেয়েটা আজও বুঝলো না তাকে। গুরুত্ব দিলো না তার কথাকে। চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললো, “ঠিক আছি আমি। আবলতাবলও বকছি না। শুধু–”
তরী বলতে দিলো না,
—“চুপ করুন ভাইয়া। এতটা– এতটা বাজে কেন আপনি? আপনাদের বাসায় থাকি বলে সস্তা পেয়ে বসেছেন?”
—“সস্তা পেয়ে বসিনি তরী। শুধু আপনাকে বোন হিসেবে দেখছি না।”

তরীকে স্তব্ধ করে প্রণয় চলে যেতেই সালেহা কিছু বলতে চাইলো। কিন্তু তরী তার আগেই ধমকালো, “একটা কথাও না সালেহা! চুপচাপ কাজ করো।”
বাধ্য হয়ে সালেহাও আর কিছু বললো না। কিন্তু তার ভেতরকার কৌতূহল তখনো দমেনি।

লাইব্রেরী ঘরের জানালাটা সশব্দে খুলতেই বাতাস সুরসুর করে ঢুকলো যেন। পর্দার বাঁধা মানলো না। তবুও সাদা পর্দাটা একপাশে গুটিয়ে রাখলো প্রণয়। পাঁচ নম্বর তাক থেকে সেই বইটা নিলো। আজ আর ৮১ নম্বর পাতায় কিছু লিখলো না। চলে গেল একদম শেষ পাতাটায়। পাতাটা ফাঁকা পুরো। উপরের দিকে যদিও একদুটো লাইন আছে। লাইনগুলো একবার বিড়বিড় করে পড়ে এর দু’আঙুল নিচ থেকে কলম চালালো প্রণয়,

‘আমি একটু আগে ওকে আমার মনের কথা বলে দিয়েছি একাকীত্ব। কিন্তু ও আমাকে এখনও বুঝেনি। আমাকে ও ভালোবাসে না। পছন্দও করে না। তীব্র কষ্টে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি একাকীত্ব! মনে হয়, মনে হয় যেন শ্বান নিতে পারছি না। আমার এ কি রোগ হলো একাকীত্ব? আমি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি দিন দিন। কেন যে ওকে মনের কথা আগে বললাম না! ওর বিয়ের আগেও বলতে পারিনি। এখনো না।
জানো? ওকে প্রতিদিন একটা ছেলের সাথে দেখি আমি। মাহাদ নাম ছেলেটার। ওদের দুজনকে একসাথে দেখলে আমার ভেতরটা জ্বলে যায়। সহ্য করতে পারি না। স্বার্থপরের মতো বারবার অতীত টেনে এনে বুঝাই, ছেলেরা ভালো না। ইশারা ইঙ্গিতে বোঝাতে চাই, মাহাদ ছেলেটাও ভালো না। আমি জানি, আমি সত্যিই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। হয়তো হয়েও গেছি। আমি এই বইয়ের মতো পরিণতি চাই না একাকীত্ব। প্রিতমের মতো ভালোবাসা হারাতে চাই না। আমার সত্যি কষ্ট হচ্ছে। এত কষ্ট কেন আমিই পাচ্ছি? আমি ভালো থাকতে চাই। একটু ভালোবাসা চাই। অথচ! অথচ আমার আশেপাশে কেউ নেই। সব শূণ্য, ফাঁকা, খালি।

২১ আগষ্ট, ২০২১’

_____________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here